আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জামাতকে সশস্ত্রকরণে গোলাম আযম : আর্মি কানেকশান... : অমি রহমান পিয়াল



আইরিন সুলতানার "১৯৭১ : বীরাঙ্গনা অধ্যায়" পোষ্টটা স্টিকি করার আহবান জানিয়েছিলাম। কিন্তু কর্তৃপক্ষ সাড়া দেননি। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, প্রতিবেলায় যে কারও একটি দলিল ভিত্তিক পোষ্ট আমি কপি-পেস্ট করে পোষ্ট করবো। হয়তো ব্লগ কর্তৃপক্ষ আমাকে এর শাস্তি দিবেন। যদি কেউ আমার সিদ্ধান্তটিকে মেনে না নেন তাহলে বলবেন; আমি তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেবো।

অনুমতি না নেয়ার জন্য লেখকের কাছে ক্ষমা প্রার্থী। ---------------------------------------------------------------------------------- 1.পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী তার জবানবন্দীতে ফজলুল কাদের চৌধুরীর (সাকা চৌধুরীর বাবা) সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ, মৌলবী ফরিদ আহমদের সাহায্য প্রদানের কুণ্ঠাহীন প্রয়াস এবং খান এ সবুর খানের 'পাকিস্তানী আনুগত্যের অঙ্গীকারের কথা' অত্যন্ত প্রশংসনীয়ভাবে উল্লেখ করেছেন। খাজা খয়েরুদ্দিনের সঙ্গে মাত্র একবার এবং অধ্যাপক গোলাম আযমের সঙ্গে সাক্ষাৎকার না ঘটলেও তাদের সম্পর্কে জেনারেল নিয়াজীর স্পষ্ট সার্টিফিকেট : 'এসব নেতৃবৃন্দ অত্যন্ত ভালো পাকিস্তানী। পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখার জন্য এরা নিজেদের সর্বস্ব উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিলেন। ' 2.নিয়াজীর সঙ্গে অধ্যাপক গোলাম আযমের হৃদ্যতা গড়ে ওঠেনি।

উঠেছিল মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সঙ্গে। ফরমান আলী লিখেছেন, 'নির্বাচনে আওয়ামী লিগ দুটো আসন ছাড়া সবগুলোতেই জয়লাভ করেছে। এই নিরঙ্কুশ বিজয়কে নস্যাত করার জন্য আমি জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করেছিলাম। ' তিনি অন্যত্র বলেছেন, 'এসময় দেশপ্রেমিক ও পাকিস্তানী আদর্শে বিশ্বাসী দলগুলোর জন্য কিছু করার ফিকির করছিলাম। আর না হোক, এসব লোক যাতে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌছে সমভাবে প্রচারণা চালাতে পারে সে সুযোগ থাকা উচিত।

এ ব্যাপারে আমি লেঃ জেনারেল পীরজাদার সঙ্গে আলাপ করেছিলাম। তিনি আমার কথাগুলো অনুধাবন করে বললেন, 'হঁ্যা, এদের কিছু না কিছু সাহায্য সহযোগিতা করা উচিত। ...আমি এ ব্যাপারে সচেষ্ট থেকে বিভিন্ন জনকে অনুপ্রাণিত করার চেষ্টা করলাম। পরে এমন এক পর্যায় এল, মেজর জেনারেল ওমর ইনটেলিজেন্সের ডাইরেক্টর জেনারেল এনএ রিজভী বিভিন্ন শিল্পপতিদের ওপর 20-22 লক্ষ টাকা জোগাড় করে 5-6টি দলের মধ্যে ভাগ করে দেন। এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্টেরও (ইয়াহিয়া) বাড়তি উৎসাহ ছিল।

3.পাকিস্তানের গোয়েন্দাবাহিনী কতর্ৃক সংগৃহীত এই টাকা কাদের পেছনে ব্যয় করা হয়েছিল? এ প্রসঙ্গে পাকিস্তান সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর মেজর সিদ্দিক সালিক লিখেছেন, 'কাউন্সিল মুসলিম লিগের খাজা খয়েরুদ্দিন, কনভেনশন মুসলিম লিগের ফজলুল কাদের চৌধুরি, কাইয়ুম মুসলিম লিগের খান এ সবুর, জামায়াতে ইসলামীর গোলাম আযম ও নেজামে ইসলামীর মৌলবী ফরিদ আহমেদ- এদের সাহায্য করা হয়েছিল। এবং আদর্শগত দিক থেকে এরাই ছিলেন পাকিস্তান দর্শনে বিশ্বাসী এবং শেখ মুজিবের বিরোধী। 4.এসব নেতা পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর স্থানীয় পর্যায়ের এজেন্ট হিসেবে নির্বাচনের আগে থেকেই কাজ করছিলেন। আর্থিক দিকটা যতটা না খাজা খয়ের, সবুর খান, ফকা চৌধুরি হাতড়ে নেবার সুযোগ গ্রহন করেছেন, তার চেয়েও নানাদিক থেকে বেশি আনুকুল্য নিতে সক্ষম হয়েছিলেন গোআযম। কেননা তার গায়ে বেশি করে লেপ্টানো ছিল কথিত ধর্মীয় আলখেল্লা ও পাকিস্তানী জাতীয়তাবাদের প্রলেপ।

তাছাড়া তৎকালীন সময়ে স্বাধীনতাবিরোধীদের মধ্যে জামাতই ছিল কমবেশি সংগঠিত। সেজন্য একথায় বিস্মিত হবার কারণ নেই যে, 25 মার্চের সেই ভয়াবহ রাতের নির্মম নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ছড়িয়ে দেয়া স্তুপিকৃত লাশের এবং অগি্নদগ্ধ বাড়িগুলোর সামনে দিয়ে লাটভবনে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে উৎসাহের সঙ্গে উপস্থিত হতে এদের এক সপ্তাহের বেশি বিলম্ব হয়নি। '71 সালের 4 এপ্রিল যখন সমগ্র বাংলাদেশের সশস্ত্র প্রতিরোধ-যুদ্ধ তীব্রতর, বিভিন্ন শহর ও জনপদে বাঙালি জাতি মরণপন যুদ্ধে লিপ্ত, অশ্রু ও রক্তের প্রাণবহ্নিতে প্রাণ উৎসর্গের প্রতিযোগিতারত; সেই মুহূর্তে এইসব দেশীয় বিশ্বাসঘাতক ও পাকিস্তানের দালাল লাটভবনে টিক্কা খানের রক্তাক্ত হাতের উঞ্চ অভ্যর্থনায় বিগলিত হতে বিবেকের তাড়না বোধ করেননি। ঐ মুহূর্তে নুরুল আমিনের নেতৃত্বে গোআযম, ফরিদ আহমদ, খাজা খায়ের প্রমুখ সামরিক গভর্নর টিক্কা খানকে এ আশ্বাস দিতেও কুণ্ঠাহীন ছিলেন না যে সামরিক অভিযান 'যথার্থ' ও ' প্রশংসনীয়' এবং এ ক্ষেত্রে তাদের থাকবে কার্যকর সহযোগিতা। টিক্কা খান সহযোগিতার এই প্রস্তাবকে ধন্যবাদ জানিয়ে দুষকৃতিকারী ও সমাজবিরোধীদের (মুক্তিবাহিনী) আশ্রয় না দেওয়া এবং সামরিক কতর্ৃপক্ষের কাছে এদের সম্পর্কে তথ্য পৌছে দেবার জন্য' উপদেশ দেন।

শুধু বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে দেশের অখন্ডতা রক্ষায় ফলপ্রসু কাজ করতে নির্দেশ দেন। 5. ফলপ্রসু কাজের জন্য তাৎক্ষণিক ব্যবহার কাঠামোগত বিন্যাস শান্তি কমিটি গঠনের প্রাক্কালে জামাতের নেতৃত্ব মানতে অস্বীকৃতি জানালে ভিন্ন দলীয় নেতাদের সঙ্গে পারস্পরিক সমঝোতার দায়িত্ব পালনে আবিভর্ূত হলেন এককালের পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধূরি (পাকিস্তান অবজারভারের মালিক ও সম্পাদক, দালাল তালিকাভুক্ত), যিনি পাক সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে পাকিস্তান রক্ষার জন্য প্রচারণা চালাতে অর্থ নিতেন। তার নেতৃত্বে 6 এপ্রিল গোআযমসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে নাগরিক শান্তি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহন পাকাপাকি করতে সমর্থ হন। শান্তি কমিটি গঠনের পর 13 এপ্রিল জোহরের নামাজের পর বায়তুল মোকাররম থেকে পরিচালিত একটি মিছিলে গোআযমের 'পাকিস্তানের সংহতি' ও 'বুনিয়াদ অটুট থাকুক' এবং 'ভারতের ঘূন্য হামলার (মুক্তিবাহিনীর) বিরুদ্ধে পাকিস্তান যেন উপযুক্ত জবাব দিতে পারে' সেজন্য আল্লাহর কাছে মোনাজাতের পরপরই জঙ্গী জামাতের ইসলামীর কর্মীরা আজিমপুর কলোনীসহ বিভিন্ন স্থানে অগি্নসংযোগ, বেপরোয়া ধর্ষন ও বাঙালীদের হত্যা করে রাস্তার পাশে ফেলে রাখে। সোল্লাসে শ্লোগান দেয় : পাকিস্তানের উৎস কি/ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, পাকিস্তানী ফৌজ জিন্দাবাদ, টিক্কা খান জিন্দাবাদ, ইয়াহিয়া খান জিন্দাবাদ ইত্যাদি।

গোআযম অত্যন্ত কৌশলে শান্তি কমিটির মধ্যে জামাতের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় ও জেলা এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে সাংগঠনিক কাঠামো ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। 17 মে জামাত নেতা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ওমরাও খানের সভাপতিত্বে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির একটি সভা বিএনপি ও জাতীয় পার্টির মন্ত্রীসভার সদস্য মাঈদুল ইসলামের পিতা মালেক মন্ত্রীসভার সদস্য আবুল কাশেমের আসাদ গেটের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়। সভার প্রস্তাবে 'নিষিদ্ধ আওয়ামী লিগ পরিচালিত রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের ফলে সৃষ্ট মারাত্মক সংকট থেকে দেশকে রক্ষার উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনীর সময়োচিত (25 মার্চের নৃশংস হত্যাকাণ্ড) ব্যবস্থা গ্রহনের উচ্ছসিত প্রশংসা ও পাকিস্তানের বিশ্বাসঘাতকদের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য কঠোরতম ব্যবস্থা গ্রহনের (হত্যাকাণ্ড) জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সশস্ত্র বাহিনীকে তাদের মহান কাজে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ইসলামী শক্তিসমূহের মধ্যে গভীর ও অচ্ছেদ্য মতৈক্য প্রতিষ্ঠা উচিত বলে মত প্রকাশ করা হয়। ' দুষকৃতিকারীদের (মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতাকামী জনগন) তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করার ওপর জোর দেওয়া হয়। 6.পাকিস্তান সামরিক চক্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে জামাত নেতা জেনারেল ওমরাও খানের সঙ্গে গোআযমের পূর্ণাঙ্গ আলোচনার ভিত্তিতে জামাতের ছাত্র-যুবকদের সশস্ত্রকরণের দ্বিতীয় ধাপে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

এই লক্ষ্যে জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে গোআযম প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ-পরবর্তী এক বিবৃতিতে বলেন, 'জনগন পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পূর্ণ সাহায্য ও সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত। কিন্তু জীবননাশের জন্য দুস্কৃতিকারীরা (মুক্তিযোদ্ধারা) হুমকি দেওয়ায় তারা এ ব্যাপারে পূর্ণ সাহায্য দান করতে পারছে না। ' সেজন্য 20 জুন লাহোরে এক সংবাদ সম্মেলনে গোআযমের দাবি ছিল, 'দুস্কৃতিকারীদের (মুক্তিবাহিনীর) তৎপরতার মুখে জনগনকে (জামাত কর্মীদের) অস্ত্র দেওয়া উচিত। ' এরপরপরই সামরিক গভর্নর জেনারেল টিক্কা খান জুন মাসেই পূর্ব পাকিস্তান রাজাকার অর্ডিন্যান্স জারি করেন। জামাত কর্মীদের সশস্ত্র করার লক্ষ্যে গঠিত হয় রাজাকার ও আলবদর বাহিনী।

জামাতের তৎকালীন মজলিশে শুরা সদস্য মওলানা একেএম ইউসুফ রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা যিনি কিছুদিন পূর্বেও ছিলেন জামাতের সেক্রেটারি জেনারেল। আর বর্তমান সেক্রেটারি জেনারেল মতিউর রহমান নিজামী পাকিস্তানী জেনারেল রাও ফরমান আলীর তত্বাবধানে আলবদর বাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। গোআযম রাজনৈতিক নেতৃত্বের মূখ্য ভূমিকায় থেকে রাজাকার ও আলবদর বাহিনীকে পরিচালনা করেন। দেশপ্রেমিক ব্যক্তি, ছাত্র-যুবক এবং শ্রেনীপেশার বিভিন্ন স্তরের মানুষ যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন তাদের হত্যার জন্য এসব জাতিদ্রোহী বাহিনী ও তাদের সীমাহীন অপরাধ ইতিহাসে নজিরবিহীন। (স্বাধীনতার 25 বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত এক সংকলনে প্রবন্ধটি লিখেছেন আবু সাইয়িদ) ছবি : 1971সালের যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযম ও তার সাঙপাঙ্গরা


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।