আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফাহমিদুলের আত্মপরিচয় অনুসন্ধান: পুনর্পাঠ

পর্যটক

ফাহমিদুল হক গত কয়েকদিন ধরে একটা বড় ব্লগ লিখছিলেন পর্বে ভাগ করে। এরপর সবমিলিয়ে অখণ্ডে তা আবার পোষ্টে দেন। Click This Link ওটা এমনিতেই বড় পোষ্ট বলে আমার মন্তব্য এখানে আলাদা পোষ্ট আকারে দিচ্ছি। আশা করি ফাহমিদুল রাগ করবেন না বা আগ্রহের কমতি হবে না। ফাহমিদুল যথেষ্ট খাটা খাটনি করেছেন বোঝা যায়।

যথেষ্ট সাহসও দেখিয়েছেন। ফাহমিদুলের শ্রম ও অধ্যাবসায়ের প্রশংসা করে শুরু করছি। আমি এখানে কিছু পয়েন্ট আকারে আমার কথা তুলব। ১. আপনি লেখাটা শুরুর আগে "অসাম্প্রদায়িক" (অসাম্প্রদায়িক বলতে আপনি যা বুঝেন বা বুঝিয়েছেন তাই) উপাদান আপনাকে খুঁজে দেখতে হবে ও হাইলাইট করতে হবে - এরকম একটা ভাব আগাম অনুমান করে নিয়ে লেখা শুরু করেছেন যা আপনার লেখার প্রবাহকে সবসময় শাসন করে গেছে - সাধারণভাবে বললে এটাই আপনার লেখার একটা বড় দূর্বলতা। ২. লোকধর্ম বলে আমাদের এক নতুন একটা বৈশিষ্ট চিহ্নিত করে বাঙালি ও মুসলমানের পাশে জায়গা করে দিয়েছেন - ভালো।

প্রস্তাব রেখেছেন, "আমার বিবেচনায় লোকধর্মকে আমাদের মূল আইডেন্টিটি হিসেবে শনাক্ত করা প্রয়োজন, অন্তঃত বিবাদমান বাঙালিত্ব ও মুসলমানিত্বের প্রকাশ্য দ্বন্দ্বের কারণে"। এই আলোচনাটা ব্লগে বলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের মুরুব্বিরা (বাংলাদেশীটা গোনায় ধরলাম না) বোধহয় টের পায়নি,- আপনি এমন একটা কথা বলেছেন। দেখা যাক, বাঙালি জাতিয়তাবাদীরা আপনাকে কেমন আদর আপ্যায়ন করে, দেখার অপেক্ষায় রইলাম। ৩। তারচেয়েও সম্ভবত আরও একটা কারণে আপনার লেখাটা আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, কারণ তাজ্জব ব্যাপার হলো আপনার বাঙালির ইতিহাস ১৯৫২ সাল বা বড় জোড় ১৯৪৮ সালের উর্দুকে না বলা থেকে শুরু হয়নি।

৪. আপনি বলেছেন, "যদিও ১৯৭১ সালে কোনো কমিউনিস্ট বিপ্লব হয়নি...... তবে কমিউনিজম প্রভাবিত সেকুলারিজম এবং আধুনিকতা এক পর্যায়ে আল্ট্রা সেকুলারিজমে রূপ পেয়েছে, এবং ইসলামবিরোধিতা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে বাঙালিত্বে অনুপ্রবেশ করেছে। মুক্তিযুদ্ধে ইসলামপন্থী দলগুলোর বিরোধিতা এই বিষয়টিকে সুনিশ্চিত করেছে। এই আল্ট্রা সেকুলারিজম ও মডার্নিজম বাঙালিত্বের দিক থেকে লোকধর্মকে উপেক্ষা করতে উৎসাহিত করেছে -- কারণ তা গ্রাম্য, কারণ তা অনাধুনিক। বাউল গান আধুনিক শিক্ষিতের কাছে অডিও ইন্ডাস্ট্রিবাহিত পল্লীগীতিমাত্র। লুঙিপরিহিত জটাধারী বাউল তার দৃষ্টিতে নিম্নবর্গের প্রতিনিধিমাত্র।

মাজার হলো তার কাছে ভণ্ডগুরু ও গাঁজাখোর শিষ্যের আবাসমাত্র। অথচ দেখা যাবে নিম্নবর্গের বাউলের বা মাজারকেন্দ্রিক মুর্শিদের তত্ত্বকথা বোঝার বুদ্ধি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত বাঙালির ঘটে নেই বললেই চলে"। - একথা যদি মানেন তাহলে আপনার সাথে বাঙালি জাতীয়তাবাদের, চোখে পড়ার মত পার্থক্য হলো, আপনি সেকুলারিষ্টই থাকতে চান "আল্ট্রা সেকুলারিজম ও মডার্নিজম বাঙালিত্বের দিক" যেতে চান না। আর এটাকেই আপনি সমস্যা বা বিপদ হিসাবে দেখছেন। আপনাকে ঠিক বুঝলাম কী না জানি না।

ভুল হলে বলবেন। আসলে এদুটোর পার্থক্য কী? বুঝি নাই। আপনি সম্ভবত আরও কিছু বলতেন। আবার একটু বলবেন? আপনার আর একটা অবজারভেশন বেশ আগ্রহ উদ্দীপক। বলেছেন, "ইসলামবিরোধিতা অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে বাঙালিত্বে অনুপ্রবেশ করেছে"।

সম্ভবত আপনি একটু ভিন্নভাবে দেখার চেষ্টা করছেন। দেখা যাক এতে আমরা কোথায় গিয়ে দাঁড়াই। ৫. তবু প্রথম প্যার‌্যাতেই বলছেন, লোকধর্ম হলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর চর্চিত গৌণধর্মসমূহ"। একেবারে গৌণ বানিয়ে দিলেন। মুখ্য গৌণের নির্ধারক কে? কী দিয়ে নির্ধারণ করব মুখ্য গৌণ? আমরা কী শহুরে ক্ষমতা কর্তৃত্ত্বের দাবড়ানি দেখিয়ে কথা বলছি না? ৬. "বাঙালিত্বে বিশ্বাসী যে সে তার মুসলমানিত্ব খারিজ করতে পারলে যেন বাঁচে" - এটা বোধহয় কম করে বললেন।

এটা এখন, ইসলাম বা মুসলমান পরিচয় ত্যাগ করার উদাত্ত আহ্বান জানানোতে গিয়ে ঠেকেছে । এই সা. ই. ব্লগে এর কত ছড়াছড়ি। কোন মানুষকে সে যে ধর্মেরই হোক তাকে ধর্ম ত্যাগ করতে বলা কী ধরণের নিষ্ঠুর, অমানবিক বর্ণবাদী তো বটেই -সেই হুশ বিবেচনাও হারিয়ে বসে আছে এই দায়িত্ত্বজ্ঞানহীন 'মানুষেরা'। আমরা কারও চিন্তাভাবনাকে সমালোচনা তুলোধোনা করতে পারি, ধর্মের ভালোমন্দ নিয়ে তর্ক করতে পারি, এমনকি কূটতর্কও করতে পারি - কিন্তু একটা মানুষের ধর্মটাই খারাপ, ওর অন্য কোন ধর্মগ্রহণ করা উচিত - এই সীমাছাড়ানি কথাটার ভয়াবহতা যার উপলব্দিতেও আসছে না এমনই অমানবিক এক সমাজ তৈরি করছি আমরা! কারণ আমাদের মাথায় ধর্মহীন এক কাল্পনিক সমাজ বিরাজ করে। বাংলাদেশ তো দূরে থাক, দুনিয়ার কোথাও কোন সমাজে এটা বিরাজ না করলেও ওটাই আমাদের চাই, অসম্ভব হলেও ওটাই আমাদের আবদার।

কারণ ধর্ম কী - এটাই তাদের জানা নাই। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও আধুনিকতার আড়ালে বসে এরা নিজেদের জন্য যথেচ্ছাচারের বন্দোবস্ত চায় আর এক ধর্মহীন সমাজের কল্পনায় বিভোর থাকে, এই অসম্ভব কল্পনাই সমাজকে এক নৈরাজ্য দাঙ্গার দিকে ঠেলে দিচ্ছে ক্রমশ। এমনিতেই বাঙালি জাতীয়তাবাদী আধুনিক মুসলমান তাঁর মুসলমানিত্ত্ব নিয়ে একটা হীনমন্যতায় ভুগে। এরা যতই ধর্মহীন এক কল্পনার সমাজে ভাসতে থাকে, কাউকেই তাঁর সঙ্কটের কথা বুঝাতে পারে না কিন্তু কষ্ট পায় - আর এতে ওদিকে ততই মোল্লা মৌলবি ধর্মের উপর একচেটিয়া লাভ করে। আমরা সব ওদের হাতে ছেড়ে বসে আছি।

সেও বুশের সাথে ক্রসেড লড়ছে ভেবে মনের কষ্ট মিটায়, ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা তড়তড়িয়ে জায়গা করে নেয়। এক অদ্ভুত চক্রের মধ্যে আমরা সবাই আটকা পরে আছি। ৭. আপনি দাবি করছেন, "বাউল তত্ত্বে আত্মা ও পরমাত্মা একই, আত্মা পরমাত্মারই অংশ; তাই আত্মাকে জানাই হলো পরমাত্মাকে জানা। দেহের মাধ্যমেই আত্মাকে জানা বাউলদের আধ্যাত্মিক সাধনার অংশ। 'খাঁচা'র ভেতর 'অচিন পাখি'র আসা যাওয়ার অনুসন্ধানের কারণ হলো এই"।

অথবা, "সুফিবাদ প্রভাবিত বাউলতত্ত্ব", "মারফতের অবস্থান থেকে তার প্রশ্ন শরীয়তপন্থা নিয়ে" - একথাগুলো আসলে তথ্যসূত্রে যাদের নাম দেখছি তাদের বয়ান। "আত্মা ও পরমাত্মা" সুফিদের এই ধারণার সাথে লালনের "অপর" "অধরা" "পড়শি" "অচিন পাখী" ইত্যাদি ধারণার কোন সম্পর্ক নাই। আর সবচেয়ে বড় কথা সুফিবাদ কখনই ধর্মতাত্ত্বিক চৌহদ্দি পেরিয়ে নিজেকে ব্যাখ্যা করে নাই বা দাঁড় করায় নাই। বিপরীতে লালন সবসময়ই ধর্মতাত্ত্বিকতার বাইরে, ধর্মের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত সমস্ত চিন্তার পর্যালোচনা বা ক্রিটিক করে তার আগানো। বাংলায় প্রথম ধর্মের পর্যালোচক।

লোকধর্মে সিনক্রেটিক (syncretic) বা সমন্বয়বাদীতা থাকতে পারে। কিন্তু লালন ধর্মের syncretic বা সমন্বয় দূরে থাক, সব চিন্তা বা ধর্মের পর্যালোচনাই তাঁর পথ। আপনি ঠিকই ধরেছেন বাংলার সমাজগুলো তান্ত্রিকতা, সুফিবাদ ও বৈষ্ণববাদ ইত্যাদি অনেক কিছু পার হয়েছে। লালনের সাধক ধারার মধ্যে বৌদ্ধ তন্ত্র (শাক্ত ধারা নয়), ভক্তি ধারা বা নদীয়ার ধারার (বৃন্দাবনের বৈষ্ণববাদ নয়) প্রভাব থাকলেও আবার, এদের সবার তিনি ক্রিটিক। লালনের ষ্টাইলটা হলো, ধর্মের বা চিন্তাধারাগুলোর যে গল্প বা চরিত্র বা ঘটনাকে বর্ণনা করে আশ্রিত বা দাঁড়িয়ে ছিল লালন সেই গল্প, চরিত্র বা ঘটনাকেই তার কথা পারার উপায় হিসাবে নিয়েছেন ঠিকই।

এরপর হয় পুরান ব্যাখ্যা বা বয়ানের মধ্যে এমন এক প্রশ্ন করে বসছেন যেটা নিজেই এর উত্তর, নয়ত নিজে সরাসরি নতুন ব্যাখ্যায় একে তাঁর গানে হাজির করেছেন। নদীয়ার বৈষ্ণবদের একই গোষ্ঠগান লালন সাধকদের ভোরবেলার গান; কিন্তু প্রশ্ন উত্থাপন ও ব্যাখ্যার কারণে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। লালনের নবীতত্ত্বের গান ইসলামের বেষ্ট ক্রিটিক। আমাদের শহর, এর উপনিবেশিক বিকাশ ইত্যাদি নানান কারণে ঐ ট্রাডিশন থেকে শহরের আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে আমাদের লোকজ চিন্তা চর্চার ধারা থেকে উৎপাটিত হয়ে গেছি। ফলে এখন শহরের লোক অনেক পড়ালেখা করেছে অতএব সে বেশি জানে, লোকজ চিন্তাগুলোকে তাঁর দুনিয়ার চৌহদ্দিতে দেখা সীমাবদ্ধ ধারণা দিয়ে যা সে ব্যাখ্যা দিবে, যে মান অবস্হান নির্দেশ করে দিবে, লেখায় লিখিত অক্ষরে তাই ওটাই এর মানে বলে মানা হবে।

ছোটলোকদের একটা নিচু চিন্তার লোকগীতির বেশি ওর মর্যাদা লাভ ঘটবে না, ঘটেনি। আপনি কী খেয়াল করেছেন লালনের সম্পর্কে বলতে গেলেই কেন আমরা লালন সম্পর্কে আমাদের বিদ্যজনেরা কে কী বলেছেন তার উদ্ধৃতি দেই, ওখানেই লালনকে খুজতে যাই? আপনার তথ্যসূত্র তালিকা দেখুন, কলকাতার বাবুরা, ঐ সময়ের পত্রিকা, রবীন্দ্রনাথ, ডঃ আহমদ শরীফ বা সর্বশেষ আবুল হাসান চৌধুরি পর্যন্ত সবাই ওখানে আছে। লালন সম্পর্কে জানতে বা জানাতে গেলে সরাসরি লালনকে অর্থাৎ তাঁর গান থেকে উদ্ধৃতি টানা ও ঐ গানকে ব্যাখ্যা করে দেখানই কী অথেনটিক পথ নয়? লালন পড়ে কে কী বুঝেছেন - এটা তো সেকেন্ডারি সোর্স ও তাঁর ব্যাখ্যা। কেন আমরা সেকেন্ডারি সোর্সে সহজ, স্বস্তিবোধ করি? ভেবে দেখবেন। ৮. বলেছেন, "আজ যে মুসলমান একসময় বৌদ্ধ ছিল, পরে সে হিন্দু হয়েছে এবং আরও পরে মুসলমান হয়েছে" - তাই কী? আগে বৌদ্ধ পরে হিন্দু হয়েছে - আপনি কী তাই বলতে চেয়েছেন? আরও অনেক কিছু বলার ছিল।

পরে চেষ্টা করব হয়ত। কিন্তু আপাতত এখন শেষ করতে হচ্ছে। আমি আন্তরিকভাবে আপনার উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। ভালো থাকবেন।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.