সকল মার্কিন নেতা স্নায়ুযুদ্ধের সময় শুধুমাত্র সাম্যবাদের আন্তর্জাতিকতার বিপদ দেখতে পেতেন। একজন ব্যতিক্রম ব্যক্তি ছিলেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জন এফ. কেনেডি। যিনি সাবধান করেছিলেন অপ্রয়োজনীয় গোপনীয়তা এবং গোপন সংগঠনগুলো যেমনঃ স্কালস এ্যান্ড বোনস,দ্য কাউন্সিল ফর ফরেন রিলেশন্স এবং দ্য বিল্ডারবার্গ গ্রুপ সম্পর্কে। ১৯৬১ সালে আমেরিকান নিউজপেপার পাবলিশার্স এ্যাসোসিয়েশনের অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণে বলেছিলেন,“‘গোপনীয়তা’ শব্দটি মুক্ত ও অবাধ সমাজের পরিপ্রেক্ষিতে অত্যন্ত বিরক্তিকর;এবং মানুষ হিসেবে আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে এবং ঐতিহাসিকভাবে গোপন সংগঠনগুলোর,গোপন শপথের এবং গোপন কার্যক্রমের বিরোধিতা করে এসেছি। ”
কেনেডি ছিলেন বিংশ শতকে জন্মগ্রহণকারী প্রথম মার্কিন রাষ্ট্রপতি।
যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসের অন্যতম সুশিক্ষিত এই রাষ্ট্রপতি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘কাম লডে’ অর্থাৎ সম্মানসহ উত্তীর্ণ হন। তাঁর যে বইটি তাঁকে আলোচনার তুঙ্গে নিয়ে আসে তা হলো ‘হোয়াই ইংল্যান্ড স্লেপ্ট?’ বা ‘ইংল্যান্ড কেন ঘুমিয়ে ছিল?’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব ইংল্যান্ড ও জার্মানির মধ্যে চলমান কূটনৈতিকতা ছিল বইটির উপজীব্য। এই বইটি প্রমাণ করেছিল যে কেনেডি শুধুমাত্র ভৌগলিক-রাজনীতিতেই সমঝদার ছিলেন না,ছিলেন পর্দার আড়ালে থাকা চক্রান্ত করে যাওয়া বিশ্বায়নবাদীদের সম্পর্কেও সম্যক অবহিত।
চমকপ্রদ ব্যাপার হলো,তাঁর রাজনৈতিক জীবন হয়ত শুরু হয়েছিল একজন সন্দেহভাজন নাৎসি গুপ্তচরের সাথে তাঁর সম্পর্কের জন্য।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই সন্দেহ করছিল যে ইনগা আর্ভাদ নামক সেই সাবেক মিস ডেনমার্ক একজন নাৎসি। কারণ সে হিটলারের ঘনিষ্ঠ হারম্যান গোরিংয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিল এবং সেখানে তার সঙ্গে হিটলারের সাক্ষাৎ হয়। তার পেছনে একটানা লেগে থাকার পরে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হন যে তার অন্যতম সাক্ষাৎপ্রার্থী ছিলেন নৌবাহিনীর নিম্নপদস্থ অফিসার জন এফ. কেনেডি। ওই সময় কেনেডি মার্কিন নৌবাহিনীর গোয়েন্দা শাখার হয়ে ওয়াশিংটনে কর্মরত ছিলেন। তাঁর পিতা এবং নৌকর্তৃপক্ষকে সতর্ক করার পরে কেনেডিকে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে বদলি করা হয়।
সেখানে তিনি সঙ্গীদেরকে বাঁচিয়ে যুদ্ধবীর বনে যান এবং পরবর্তী সময়ে এই খ্যাতি তাঁকে রাষ্ট্রপতি হতে সাহায্য করে। সকল প্রশংসা এফবিআইয়ের প্রথম পরিচালক এডগার হুভারের জন্য!
১৯৬০ সালে রিচার্ড নিক্সনকেই পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হিসেবে ধরা হচ্ছিল। কিন্তু কর্পোরেট যুক্তরাষ্ট্রের সকল আশা গুঁড়িয়ে ওই সময়ের নিকটতম ব্যবধানে জন কেনেডি জিতে যান। কর্পোরেট প্রধানরা এবং তাদের নাৎসি পৃষ্ঠপোষকেরা এ ভেবে শান্ত ছিল যে জনকে তাঁর পিতা জোসেফ কেনেডি নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হবেন। জোসেফ ছিলেন নাৎসিদের প্রতি সহানুভূতিশীল।
কিন্তু ১৯৬১ সালে তিনি স্ট্রোক করলে জন কেনেডি লাগামছাড়া হয়ে যান। ১৯৬৩ সালের মধ্য পর্যায়েই কেনেডি অনেক শক্তিশালী সংগঠনগুলোর মাথাব্যথার কারণ হয়ে গিয়েছিলেন। সিআইএ-কে ভেঙ্গে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছিলেন তিনি। আরো রয়েছে দক্ষিণ ভিয়েতনাম থেকে মার্কিন সেনাবাহিনী প্রত্যাহার,মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর করমুক্ত বিদেশী সম্পদগুলোর উপরে নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো(যেসব কোম্পানির অনেকগুলোরই নাৎসি নেতা বোরম্যানের সাথে সম্পর্ক ছিল),ওয়াল স্ট্রিট এবং ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের ক্ষমতা খর্বকরণ। সিআইএ-কে কেনেডি হত্যায় অভিযুক্ত করা হয়,যে সিআইএ নাৎসি গেহলেন সংস্থাকে প্রচুর ডলার সহায়তা দিয়েছিল।
ভবিষ্যতে ওয়াটারগেট কেলেংকারীতে জড়িত থাকা হাওয়ার্ড হান্ট,ফ্রাংক স্টার্জিস এবং ক্যাস্ট্রোবিরোধী কিউবান কার্লোস ব্রিঙ্গুইয়ার তাঁর হত্যাকাণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কেনেডির প্রকাশ্য হত্যাকারী লি হার্ভে ওসওয়াল্ডের বন্ধু ছিল জর্জ ডি মোহরেনশিল্ট,যে একজন নাৎসি গুপ্তচর হিসেবে গোয়েন্দা জীবন শুরু করে।
কেনেডি হত্যায় নাৎসি মানসিকতার ব্যক্তি এবং নাৎসিদের জড়িত থাকা নিয়ে যে বহুল বিতর্কিত প্রমাণ পাওয়া যায় যে বইটিতে তা হলো ‘টর্বিট ডক্যুমেন্ট’। এই বইটির মূল লেখক ছিলেন টেক্সাসের আইনজীবী ডেভিড কোপল্যান্ড,যিনি ছদ্মনামে লিখতে বাধ্য হন। তাঁর মতে,কেনেডি হত্যা ছিল কমিউনিস্টবিরোধী সংস্থাগুলোরই কাজ।
যদিও কেনেডি কমিউনিস্টদের দমন করার জন্য যথেষ্ট পদক্ষেপ নিয়েছিলেন,কিন্তু তার আপন ছোট ভাই ছিল কমিউনিস্টদের প্রতি সহানুভূতিশীল। এবং সিআইএ সন্দেহ করতে থাকে যে কেনেডি অন্তর্ঘাতমূলক কাজ করেছেন। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-কিউবা যুদ্ধের সময় মার্কিনিরা কিউবার 'বে অফ পিগস' আক্রমণ করে। কিন্তু পর্যাপ্ত জঙ্গি বিমানসহায়তা না পাওয়ায় মার্কিনবাহিনীর পরাজয় ত্বরাণ্বিত হয়। কেনেডি বিমান পাঠানোর প্রস্তাব নাকচ করে দেন।
মার্কিনবাহিনী পরাজিত হয় সুপ্রশিক্ষিত ফিদেল ক্যাস্ট্রোবাহিনীর রণকৌশল এবং বীরত্বে কাছে।
গুরুত্বপূর্ণ কোনো হত্যাকাণ্ড-গবেষকই মনে করেন না যে শুধুমাত্র নাৎসিরাই কেনেডিকে মেরেছিল। তবে বিশ্বযুদ্ধের আগে ও পরে নাৎসিবাদের সাথে সম্পৃক্ত থাকা ব্যক্তিরা বিভিন্ন গোপন সংগঠনে(সিক্রেট সোসাইটি) ঢুকে গিয়েছিল এবং কেনেডির নীতিগুলোর বিরোধিতা করে বেড়াচ্ছিল। কেনেডির হত্যাকাণ্ড তদন্তে গঠিত হয়েছিল ‘ওয়ারেন কমিশন’। এটা মোটেই কাকতালীয় ব্যাপার না যে তদন্তে জড়িত ছিল জন ম্যাকক্লয়(বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট) এবং এ্যালান ডালস্।
তাদের ছিল নাৎসিদের সাথে যোগাযোগ,যেমন ছিল জেরাল্ড ফোর্ডের;যিনি এডগার হুভারের হয়ে কমিশনের উপরে নজরদারি করছিলেন। এই সকল হর্তা-কর্তারা কাজ করছিলেন একটি নয়া বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য— যেখানে 'বিশ্বব্যাপী সমাজতন্ত্র' ভেঙ্গে তিনটি অর্থনৈতিক এলাকা তৈরি হবে;যেন সেগুলোকে একে অপরের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ এবং মুনাফা নিশ্চিত হয়।
(বিদেশী বই অবলম্বনে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।