সকল অন্ধকারের হোক অবসান
আন্তোনিওনি কখনোই বাণিজ্যটা শিখতে পারেনি। সবসময়ই তাঁর মনযোগ ছিলো একক আদলে। চলচ্চিত্র যে আদলের ছন্দবদ্ধ প্রবাহ, ত্বরণসমৃদ্ধ সেটি তাঁর অনুধাবনের বাইরে। তবে ওঁর চলচ্চিত্রে অনেক অসাধারণ মুহুর্ত আছে, যা অস্বীকারের উপায় নেই। ’
-ইঙ্গমার বার্গম্যান (সুইডিশ এক দৈনিক পত্রিকাকে দেয়া সাাৎকারে)
কিংবদন্তী চলচ্চিত্রকার ইঙ্গমার বার্গম্যান যেদিন মারা গেলেন- ২০০৭ সালের ৩০ জুলাই- সোমবার, সেইদিনই ভোররাতে (৩১ জুলাই) মারা যান আরেক খ্যাতনামা পরিচালক মিকেলাঞ্জেলো আন্তোনিওনি।
আন্তোনিওনিকে নিয়ে বার্গম্যানের মন্তব্য তির্যক হলেও শেষ বিচারে স্বীকার করতেই হয় আন্তোনিওনি নতুন কিছু করতে চেয়েছিলেন। চিত্রধারণে গল্প বলা ও গতি আনার চাইতে কাব্যিক ও মন্তব্যনির্ভর করাই ছিলো আন্তোনিওনির উদ্দেশ্য। উদাহরণ- ‘লাভেন্তুরা’ (১৯৬০) ছবির শেষ দৃশ্য। কোদিয়া দাঁড়িয়ে আর সান্ড্রো বসে। কোদিয়ার দিকে উদগীরণচাপা বিশাল পর্বত আর সান্ড্রোর দিকে ভারী কঠিন দেয়াল: নারীর চেপে রাখা বেদনা মা আর পুরুষের অপরাধবোধ উপায়হীন অবস্থা।
আন্তোনিওনির প্রায় সব ছবিতেই দেখা যায় এমন নারী পুরুষেরা একে অপরের সাথে সম্পর্কিত কিন্তু প্রত্যেকেই বিচ্ছিন্ন একক ও বেপথু। মানুষের এই বিচ্ছিন্নতার বোধকে চলচ্চিত্রে আন্তোনিওনি আনেন মোটিফের মাধ্যমে। তাঁর চরিত্ররা সিংহভাগ সময় একে অন্যের দিকে মুখোমুখি হয়ে কথা বলে না। তারা কথা বলে পাশ হয়ে কিংবা উল্টোদিকে ফিরে। লাভেন্তুরায় এমনটি আছে বহুবার, তারমধ্যে একটি কম্পোজিশন দেখার মতো- যেখানে চরিত্রগুলো একটি দ্বীপে দাঁড়িয়ে- একে অন্যের দিকে মুখোমুখি না হয়ে।
এই দ্বীপটিও সেই বিচ্ছিন্নতার প্রতীক। এ ছবিতে টাইপেজের ব্যবহারও চোখে পড়ার মতো। বিভিন্ন অন্তরঙ্গ মুহুর্তে কোজ-আপে চিত্রধারণ, বারবার মনে করিয়ে দেয়- এদের এক বিন্দুতে মিলনাকাঙ্খা অভিন্ন বিন্দুতে পরিণত করে না বরং আরো দূরে ঠেলে পৃথক সত্ত্বায় প্রকট করে তোলে।
আন্তোনিওনি দীর্ঘণ ‘কাট’ না দিয়ে যে দৃশ্য তৈরী করেন, তাতে তিনি আমন্ত্রণ জানান চরিত্রের মনস্তত্ত্ব শুধু নয় পরিবেশ ও প্রতিবেশ বুঝতে। ‘বিয়ন্ড দি ক্লাউড’ (১৯৯৫) ছবিতেও আন্তোনিওনি ব্যবহার করেন একই কৌশল, উচ্চারণ করেন বিচ্ছিন্নতার স্তোত্র।
‘বিয়ন্ড দি ক্লাউড’ ছবিতে প্রতিটি নারী পুরুষই চায় যুক্ত হতে, কিন্তু তারা পারে না। পারে না স্বয়ংক্রিয়ভাবেই। জীবনের এতো আয়োজন থাকা সত্ত্বেও তারা একলা পথিক। ভোগ ও সম্ভোগকে পিছনে ঠেলে তারা যেন অন্য জীবনকে খুঁজতে চায়। জীবনানন্দ দাশ যেমনটা বলেন:
জানি- তবু জানি
নারীর হৃদয়- প্রেম- শিশু- গৃহ- নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়-
আরো- এক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে
ক্লান্ত- ক্লান্ত করে;
নান্দনিক দৃষ্টিকোণ থেকে আন্তোনিওনিকে বিচার করলে কিছুটা কাব্যিক ও কিছুটা প্রহেলিকাময় বলতে হয়।
দুটোকে একসাথে মিশিয়ে বিমূর্ত কবিতার নির্মাতা বললে খুব বেশী বাড়িয়ে বলা হবে না। পান্তরে বার্গম্যানকে বলতে হয় দার্শনিক। ‘পার্সোনা’তে যেমন বার্গম্যান দুই নারীর সম্পর্ককে একটি বিচ্ছিন্ন দ্বীপে নিয়ে যাচাই করতে চেয়েছেন, খুঁজতে চেয়েছেন তাদের ভেতরকার আকর্ষণ-বিকর্ষণ; তেমনি আন্তোনিওনি-ও দ্বীপের মাঝে নিয়ে যান দুই বান্ধবীকে- তাঁর ‘লাভেন্তুরা’তে। আন্তোনিওনির এক নারী চরিত্র হারিয়ে যায়; তার বান্ধবী খুঁজতে শুরু করে তাকে। বাস্তবে, অবাস্তবে এমনকি বান্ধবীর প্রেমিকের মাঝে।
দ্বান্দ্বিক অবস্থার মধ্য দিয়ে ‘লাভেন্তুরা’র ক্লোদিয়া সম্পর্কে জড়ায় কিন্তু তার অভিযান অফুরান। কিসের অভিযান? অনেক কিছুর। বান্ধবীকে, নিজেকে এমনকি প্রেমকে খোঁজার অভিযান। শেষ পর্যন্তও তার এই অভিযাত্রা চলতে থাকে। চলতে চলতে একাকিত্বের কানাগলিতে এসে দাঁড়ায়।
এজন্যই ছবিটির নাম ‘দি এডভেঞ্চার’ বা ‘লাভেন্তুরা’।
একই রকম অভিযান দেখা যায় ‘ব্লো-আপ’ (১৯৬৬)-এ। ছবিটির মূলচরিত্র, যার কোনো নাম থাকে না, পেশায় চিত্রগ্রাহক, সে পুরো ছবিতে একটি খুন সম্পর্কিত সত্যকে খুঁজে পেতে চায়। কিন্তু পরিশেষে চিত্রগ্রাহক হারিয়ে যায়- বাতাসে মিলিয়ে যায় সে- কর্পূুরের মতো- কোথায় তা কেউ বলতে পারে না। ‘লাভেন্তুরা’র ঐ হারিয়ে যাওয়া মেয়েটির মতো।
কিংবা বার্গম্যানের ‘পার্সোনা’য় আলমার একা-একা বাসে উঠে চলে যাওয়ার মতো। বার্গম্যানের সাথে আন্তোনিওনির মিল ও অমিলের দিকে তাকালে দেখা যাবে: বার্গম্যান আধ্যাত্মিক মার্গে পরমের খোঁজ করতে করতে হাজির হন দার্শনিক প্রশ্নে। আর আন্তোনিওনি মানবিক সম্পর্কের ওলিগলি পেরিয়ে উপস্থিত হন একাকিত্মের সমুদ্র সৈকতে। বার্গম্যানের চরিত্ররা অনেক বেশী গভীর ও নিবিড় হয়ে কথা বলে। অপরদিকে আন্তোনিওনির চরিত্ররা কথা বলে দূরত্ব রেখে, হাল্কাভাবে।
‘ব্লো-আপ’- ছবি থেকে এর উদাহরণ দেয়া যায়। ছবিটির আরো একটি বিষয় নজর কাড়ে- মুকাভিনেতার দল। তাদেরকে বারবারই দেখা যায়। রাস্তায়, পার্কে, টেনিস কোটে। তাদের উদ্ভট বহুরঙা পোষাক, মুখে রংচং- আলাদা করেই চোখে পড়ে।
যেন বিচ্ছিন্ন কোনো জনগোষ্ঠী। ছবির শেষ দৃশ্যে তাদের মিছামিছি টেনিস খেলায় সাড়া দেন ঐ চিত্রগ্রাহক। বিচ্ছিন্নতার প্রতি এটাও একধরনের একাত্মতা ঘোষণা। আন্তোনিওনি সম্পর্কে তাই বলা যায়, উনি যতটা না স্থিরতায় পৌঁছানোর বাসনায় ছটফট করেন তারো বেশী তিনি অস্থির হয়ে ওঠেন হারিয়ে নিজেকে পাওয়ার আকাঙ্খায়।
মিকেলাঞ্জেলো আন্তোনিওনি জন্মেছেন ১৯১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর; ইতালির ফেরারা অঞ্চলে।
মধ্যবিত্ত পরিবারে তাঁর বেড়ে ওঠা। পরিবার থেকেই পান সৃষ্টিশীলতার মন্ত্র। শিল্প সাহিত্য তো বটেই আগ্রহ গড়ে ওঠে পুতুল নাচ আর চিত্রকলার ওপর। ১৯৩১ থেকে ১৯৩৫- আন্তোনিওনি অর্থনীতির ওপর ডিগ্রী নেন বোলগনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই তিনি থিয়েটারের সাথে যুক্ত হন।
অর্থনীতিতে ডিগ্রী নিয়ে চাকুরি নেন ব্যাংকে- ব্যাংক টেলার হিসেবে। পাশাপাশি লিখতে শুরু করেন গল্প ও চলচ্চিত্র সমালোচনা- আঞ্চলিক সংবাদপত্র ‘কোরিয়ে প্যাদ্যানো'তে। এরপর চল্লিশের দশকে রোমে যাওয়ার আগে পাগলাগারদের ওপর স্থানীয়ভাবে একটি প্রামান্যচিত্র নির্মান করার চেষ্টা করেন। কিন্তু রোগীদের অপ্রকৃতস্থ আচরণ চরমে ওঠায় শেষ পর্যন্ত তা বাতিল হয়ে যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন সূচনা পর্ব পেরুচ্ছে- সেই ১৯৪০ সালে রোমে এসে আন্তোনিওনি ‘সিনেমা’ পত্রিকায় লিখতে শুরু করেন।
পত্রিকাটি রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনার জন্য প্রখ্যাত ছিলো। ফ্যাসিস্ট পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন ভিত্তোরিও মুসোলিনি- ফ্যাসিস্ট নেতা বেনিতো মুসোলিনির ছেলে। চিন্তা-চেতনায় মিল না হওয়ায় কয়েক মাসের মধ্যেই ‘সিনেমা’তে লেখা বন্ধ করে দেন আন্তোনিওনি। এরপর তিনি ফিল্ম নিয়ে পড়াশোনা করতে ভর্তি হন ‘সেন্ট্রো স্পেরিমেন্টাল দি সিনেমাতোগ্রাফিয়া’য়। এখানে একটি স্বল্পদৈর্ঘ ছবিও বানান তিনি।
তবে পরে তা আর পাওয়া যায়নি।
১৯৪২ সালে- যুদ্ধের মধ্যেই মুক্তি পেলো ভিসকন্তির ছবি ‘ওসেসন’। একেই নয়া বাস্তবাদী ঘরানার প্রথম ছবি ধরা হয়। যদিও ‘নয়া বাস্তববাদ’ শব্দবন্ধটি সেসময় চালু হয়নি। সেই একই সনে রবার্তো রসেলিনির ছবি ‘আ পিলোতা রিতর্না’র কাহিনী আন্তোনিওনি যৌথভাবে রসেলিনির সাথে লেখেন।
’৪৩ সালে আন্তোনিওনি মার্শেল কার্নের সহকারী হয়ে ফ্রান্সে যান ‘লে ভিসিতারস দু স’ ছবির শ্যুটিং করতে। ইতালিতে ফিরে চল্লিশের দশকেই আন্তোনিওনি ‘জেন্তে দেল পো’ (১৯৪৩) বা ‘পিপল অব দি পো’ নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ ছবি বানান। ছবির কাহিনী পো উপত্যকার দরিদ্র জেলেদের নিয়ে। শৈলীতে ছবিটি ছিলো নয়া বাস্তববাদী ঘরানার এবং নির্মানে প্রায়-প্রামান্যচিত্র। ১৯৫০ সালে আন্তোনিওনি নির্মান করেন তাঁর প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ চলচ্চিত্র ‘ক্রোনাকা দি উনামোর’ (ক্রোনিক্যাল অব আ লাভ)।
মধ্যবিত্তের কাহিনী নিয়ে নির্মিত এই ছবিটি দিয়ে আন্তোনিওনি নয়া বাস্তববাদী আঙ্গিক থেকে বেরিয়ে আসেন। এরপর একে একে তরুণদের বিষয় নিয়ে তিনি তৈরী করেন ‘আই ভিন্তি’ (দি ভেঙ্কুইশড, ১৯৫২), নবীন চলচ্চিত্র তারকার উত্থান-পতন নিয়ে ‘লা সিনোরা সেনজা ক্যামেলি’ (দি ল্যাডি উইদাউট ক্যামেলিয়াস, ১৯৫৩), মধ্যবিত্ত নারীর জীবন নিয়ে ‘লে আমিশে’ (দি গার্লফ্রেন্ডস, ১৯৫৫), কারখানা শ্রমিককে নিয়ে ‘ইল গ্রিদো’ (দি আউটক্রাই, ১৯৫৭) প্রভৃতি। এসব ছবির প্রতিটিতেই রয়েছে সমাজ-বিচ্ছিন্নতার গল্প।
‘লে আমিশে’ ছবিতে আন্তোনিওনি তাঁর নিরীা চালান। দীর্ঘ শটের পর দীর্ঘ শট, বিচ্ছিন্ন ঘটনার সমাবেশ- সব মিলিয়ে ছবিটি মন্দনপ্রাপ্ত হয়।
কিন্তু ‘লাভেন্তুরা’তে ফিরে আসেন পুরনো ঢঙে। ১৯৬০ সালে এই ছবিটির জন্যই তিনি আন্তর্জাতিকভাবে প্রথম স্বীকৃতি পান। কান চলচ্চিত্র উৎসবে ‘লাভেন্তুরা'কে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা হয় সে বছর। কান উৎসব বক্তৃতায় তাই লাভেন্তুরা সম্পর্কে আন্তোনিওনি বলেন:
‘আমার লাভেন্তুরা ছবিটি দোষারোপের জন্য নয়, হিতপোদেশের জন্যও নয়। এটা একটা গল্প, যা আমি বলতে চেয়েছি ছবির মাধ্যমে।
আমি আশা করি লোকজন এ ছবিতে প্রবঞ্চক আবেগের জন্ম হওয়াকে নয় বরং একজনের অনুভূতির সাথে আরেকজন কীভাবে প্রতারণা করে তা প্রত্য করবে। আমি আবারো বলছি- আমরা এখানে মৃতপ্রায় নৈতিকতা, জীর্ণ পুরাণ আর প্রাচীন প্রথাকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এটা আমরা করেছি সম্পূর্ণ সচেতনভাবে। কেন আমরা ঐ ধরণের নৈতিকতাকে শ্রদ্ধা করবো?’
‘ঐ ধরণের নৈতিকতা’ বলতে কোদিয়া যে তার বান্ধবীর প্রেমিকের সাথে প্রেমে জড়ালো, প্রেমিক সান্ড্রো যে তার পুরনো প্রেমিকাকে ভুলে কোদিয়ার সাথে প্রেম-প্রেম খেলায় মেতে উঠলো। শুধু তাই নয়, শেষ পর্যন্ত কোদিয়াকেও ঠকালো।
এই যে নৈতিকতার অভাব এবং তার সাথে সাথে একজন আরেকজনের কাছ থেকে ছিটকে পড়া- গোটাটাই লাভেন্তুরার গল্পে সুচারু কায়দায় প্রোথিত। একই ভাবনা নিয়ে আন্তোনিওনি আরো দুটো ছবি করেন। ‘লা নত্তে’ (দি নাইট, ১৯৬১) ও লে’কিস (দি ইকিপস, ১৯৬২)। আঙ্গিক ও ভাবনার দিক থেকে একইরকম হওয়ায় লাভেন্তুরা ও এ দুটি ছবিকে একসাথে ট্রিলজি বলা হয়। আন্তোনিওনির প্রথম রঙীন ছবি ‘ইল দেসার্তো রোসো’ (দি রেড ডেসার্ট, ১৯৬৪)-কে ট্রিলোজি পরবর্তী চতুর্থ ছবি হিসেবে ধরা হয়।
১৯৬৬ সালে আন্তোনিওনি প্রথম ইংরাজিতে ছবি তৈরী করেন- ‘ব্লো-আপ’। ছবিটি ব্যাপক সাফল্য পায়। ছবিটি নির্মিত হয় ইংল্যান্ডের পটভূমিতে এক চিত্রগ্রহকের সত্যানুসন্ধান নিয়ে। এতে মুকাভিনেতার একটি দল থাকে। আগেই বলেছি, এরা ইংল্যান্ডের সাথে খানিকটা খাপছাড়া, বিচ্ছিন্ন।
কিন্তু এ বিচ্ছিন্ন দলটি ষাটের দশকের ইংল্যান্ডের অস্থির তরুণ সমাজের কথাই মনে করিয়ে দেয়। কিছুটা হেয়ালিপূর্ণ হলেও সাধারণের কাছে ছবিটি জনপ্রিয়তা পায় যৌনদৃশ্যের জন্য। দ্বিতীয় ইংরাজি ছবি- ‘জেব্রিস্কি পয়েন্ট’ (১৯৭০)। এ ছবির মাধ্যমে আন্তোনিওনি প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর সেট ফেলেন। এটি ব্লো-আপের মতো বাণিজ্য সফল না হলেও পিঙ্ক ফয়েড, গ্রেটফুল ডেড ও রোলিং স্টোনের মতো তারকা দলের সাউন্ডট্র্যাক থাকায় উতড়ে যায়।
ব্লো-আপে আন্তোনিওনি যুক্তরাজ্যের তরুণদের প্রতীকি উপস্থাপনে হাজির করেছেন সাবপ্লট হিসেবে। আর জেব্রিস্কি পয়েন্টে আন্তোনিওনি দেখিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের তরুণদের অবশ্যম্ভবী বিচ্ছিন্নতার জালে জড়িয়ে যাওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের মতো সভ্য ও বৈপরীত্যের দেশে রাজনৈতিক পরিবেশকে পাশ কাটিয়ে কি করে এক তরুণ মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। জেব্রিস্কি পয়েন্ট ছবিটি শুরু হয় ছাত্রদের রাজনৈতিক বিতর্কসভার দৃশ্য দিয়ে, ছবির নায়ক সেখানেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ক্যামেরার চিত্রগ্রহণে। বিমান চুরির দৃশ্যে নায়ক যখন উড়ে চলছে, তখন পরিচালক আবারো মনে করিয়ে দেন- মানুষ পিছুটানকে নিষ্ক্রিয় করে সামনে এগিয়ে যায় প্রতিনিয়িত- একা, সেখানেও নায়ক মুখোমুখি জীবনের ঐ চরম সত্যের।
আন্তোনিওনির তৃতীয় ইংরাজি ছবি ‘দি প্যাসেঞ্জার’ (১৯৭৫)। এটিও দ্বিতীয়টির মতো ব্যবসায় লাভের মুখ দেখেনি। ইংরাজিতে করা আন্তোনিওনির এ তিনটি ছবি পুরো পঞ্চাশ দশক ও ষাটের দশকের গোড়ার দিককার ছবিগুলোর চেয়ে অনেকটাই আলাদা- আঙ্গিক বা নির্মানের দিক থেকে। এসব ছবিতে আন্তোনিওনি লং শট ব্যবহার করেছেন কম। মন্তাজের ব্যবহারে অর্থডক্স হননি।
কাট দিয়েছেন চলন্ত শটে। অনেকে মনে করেন আন্তার্জাতিক অঙ্গনে ইংরাজিতে চলচ্চিত্র নির্মান করতে এসে আন্তোনিওনি তাঁর স্বভাবসুলভ নির্মানকৌশলকে বাদ দিয়েছিলেন, আন্তর্জাতিক দৌড়ে টিকে থাকার জন্য। আবার অনেক সমালোচক বলেন, আন্তোনিওনি নিজের কাজে একধরণের পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন বলেই ঐসব পরিবর্তন তিনি এনেছিলেন। যেমন একটি উদাহরণ দেয়া যায় ব্লো-আপ থেকে। ব্লো-আপে চিত্রগ্রাহক পার্কে একটি গাছের নীচ থেকে ওপরে আকাশের দিকে তাকায়।
পরের শট বা মন্তাজে দেখা যায় আকাশ। এই আকাশ দেখার বিষয়টি চিত্রগ্রাহকের দৃষ্টিকোণ থেকে। এর পরের শটে আবার চিত্রগ্রাহককে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখা যাওয়ার কথা। কিন্তু দেখা গেলো ক্যামেরা আকাশের শট নিয়ে প্যান করে স্থির হলো চিত্রগ্রাহকের মুখে। তখন ঐ চিত্রগ্রাহক আকাশের পানে নয় দাঁড়িয়ে থেকে তাকিয়ে আছে মাটির দিকে ।
শেষ জীবনে এসে আন্তোনিওনি নির্মান করেন ‘ইল মিসতেরো ডি ওবারওয়াল্দ’ (দি মিস্ট্রি অব ওবারওয়াদ, ১৯৮০)। ছবিটি প্রথমে ভিডিওতে ধারন করে পরে ফিল্মে রূপান্তর করা হয়। পছন্দের অভিনেত্রী মনিকা ভিত্তিকে আবারো এই ছবিতে অভিনয় করান আন্তোনিওনি। বার্গম্যানের যেমন লিভ উলম্যান। আন্তোনিওনি ও বার্গম্যান- এ দুজনকেই বলা হয় ‘নারীদের পরিচালক’।
এঁদের অধিকাংশ ছবিতে ঐ দুজন অভিনেত্রী তো থাকেনই, ছবির আলোকবিন্দুও পড়ে নারীর ওপর।
১৯৮৫ সালে আন্তোনিওনি হৃদরোগাক্রান্ত হন। শরীরের কিছু অংশ পঙ্গু হয়ে যায়, বন্ধ যায় বাগযন্ত্র। তারপরও তিনি থেমে থাকেননি। ১৯৯৫ সালে নির্মান করেন ‘বিয়ন্ড দি কাউডস’।
১৯৯৬ সালে এসে একাডেমি এওয়ার্ড পান সারা জীবনের কর্মকান্ডের জন্য। এর আগে অবশ্য একাডেমি এওয়ার্ডে শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যের জন্য ‘ব্লো-আপ’ ছবিটি মনোনীত হয়। ২০০৪ সালে আন্তোনিওনি তাঁর শেষ ছবি- স্বল্পদৈর্ঘ্য- ‘দি গেজ অব মিকেলাঞ্জেলো’ নির্মান করেন।
সামাজিক ও রাজনৈতিক বক্তব্যকে ছাপিয়ে আন্তোনিওনির ছবিতে প্রকট হয়ে ওঠে- একক ও বিচ্ছিন্ন অস্তিত্বে নিজেকে আবিষ্কার। তিনি সবসময়ই ঘুণে ধরা নৈতিকতাকে নিয়ে কাজ করেছেন।
তিনি বলেন-
‘যখন মানুষ আবার প্রকৃতির কাছাকাছি চলে যাবে, শূন্যস্থান আবার ফিরে পাবে তার পুরনো চেহারা সেদিন আর ঐসব নৈতিকতা নিয়ে কাজ করার প্রয়োজন পড়বে না। ’ আন্তোনিওনি ছবি তৈরী করেছেন একটি বোধ দেয়ার জন্য, যে বোধ মানুষকে গাঢ়ভাবে নিজেকে নিয়ে ও নিজের অবস্থানকে নিয়ে ভাবাতে চায়। মানুষ কি সত্যিই বড় বিচ্ছিন্ন নাকি এরজন্য দায়ী মানুষেরই তৈরী জটিল গোলকধাঁধাঁ? শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আন্তোনিওনি কি একটি প্রশ্নেরই জবাব খোঁজেননি? বার্গম্যান যেমন করে খুঁজেছিলেন প্রভুর অস্তি¡ত্ব?
(২০০৭-এ অন্যদিন পত্রিকার ঈদুল আযহা সংখ্যায় প্রকাশিত হয় অনেকাংশ বাদ দিয়ে, এখানে পুরো লেখাটি দেয়া হলো। )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।