দাগ খতিয়ান নাইতো আমার/ঘুরি আতাইর পাতাইর...
(ভূমিকার বদলে...
সুনামগঞ্জের রামসার সাইট এলাকা জীববৈচিত্রের ভান্ডার খ্যাত টাঙ্গুয়ার হাওরকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় নয় কুড়ি কান্দার ছয় কুড়ি বিল। কান্দাভর্তি হাওরে রয়েছে সারি সারি হিজল করচ ও নলখাগড়া বন। একদিকে মেঘালয় পাহাড়। তিনটি উপজেলা তাহিরপুর, মধ্যনগর ও ধরমপাশা বেষ্টিত এই হাওরে রয়েছে ৫১টি বিল আর ৮৮টি গ্রাম। হাওরের দৈর্ঘ্য ১১ কিলোমিটার এবং প্রস্থ সাত কিলোমিটার।
বর্ষায় এ আয়তন দাড়ায় ২০ হাজার একরের বেশি আর হেমন্তে প্রায় সাত হাজার একর। এ হাওরে রয়েছে প্রায় ২০০ প্রজাতির গাছগাছালি।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট টাঙ্গুয়ার হাওর দেশব্যাপী মাদার ফিশারিজ হিসেবে পরিচিত। জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ টাঙ্গুয়ার হাওরে রয়েছে প্রায় ১৪১ প্রজাতির মাছ, দেশি প্রায় ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১১ প্রজাতির উভচর পাখি, ১০ প্রজাতির বিলুপ্ত বিদেশি পাখি, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ, ২১ প্রজাতির সাপ, ২০৮ প্রজাতির জলজ ও স্থলজ উদ্ভিদ, ছয় প্রজাতির কচ্ছপ, ছয় প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, সাত প্রজাতির গিরিগিটিসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদ।
বিশ্বের বিরল প্রজাতির প্যালাসেস ঈগল, বৃহদাকার গ্রে কিংস্টর্ক রয়েছে এখানে।
স্থানীয় জাতের পাখিদের মধ্যে রয়েছে শকুন, পানকৌড়ি, কালেম, বৈদর, ডাহুক, বালিহাস, গাংচিল, বক সারস ইত্যাদি। শীতে আসে অতিথি পাখি। বিশ্বের ১০৩১ টি রামসার সাইটের মধ্যে টাঙ্গুয়া বাংলাদেশের দ্বিতীয় রামসার সাইট।
২০০৩ সালের নভেম্বরে জেলা প্রশাসন হাওরে প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ ও আনসার পাঠায় হাওর রণাবেণে। বর্তমানে দাতা সংস্থা আইইউসিএন জেলা প্রশাসনের সঙ্গে কাজ কাজ করছে।
যুগ যুগ হাওরের উপর নির্ভরশীল লোকদের জীবনমান উন্নয়নের কথা বলে প্রশাসন রণাবেণে আসলেও তাদের কার্যক্রম প্রশ্নবিদ্ধ। প্রশাসন রামসার নীতিমালার তোয়াক্কা না করে অনিয়মের পাশাপাশি স্থানীয় লোকদের জীবনজীবিকার উপর সরাসরি আঘাত হানছে। গণেশ একটি ছোট উদাহরণ...)
গণেশ টাঙ্গুয়ার হাওর পাড়ের মৎস্যজীবী। সে উত্তরাধিকার সূত্রে মাছ ধরা শিখেছে। হাওরের জল-জাঙ্গালের ডাকে সে মাছ মারতে নামে।
মাছ ধরতে থাকে প্রলুব্ধ করে জল ও জলের কান্তার। আর এই মাছ ধরেই দুমুঠো ভাতের ব্যবস্থা করতে হয় গণেশদের মত অনেককে। আলাপকালে গণেশ জানায়, এ কাজ করতে গিয়ে আনসার-পুলিশকে ঘুষ দিতে দিতে সে এখন ফতুর। একবার ঘুষ না দেয়ায় তার জাল ও নৌকা পুড়িয়ে ফেলে আনসার-পুলিশ। গণেশের করুণ পরিণতি নাটক-সিনেমাকেও হার মানায়।
তারপরও সে মাছ ধরা বন্ধ করতে পারছে না। কারণ সে আর কোনো পেশা বুঝে না। এই পেশায়ই সে কাটিয়ে দিতে চায় বাকিটা জীবন। উপায়হীন গণেশ এই পেশায়ই তার পরবর্তী প্রজন্মকে পথ দেখিয়ে যেতে চায়।
গণেশ জানায়, ৩ ছেলেমেয়ে নিয়ে সে চরম কষ্টে আছে।
তার বাড়ি কৃষ্ণতলা তেলিগাও গ্রামে। তার বাবা রজনী দাস। মাছ ধরা তার পেশা। তার বাপেরও এই পেশা ছিল। তার বাপের হাত ধরেই সে এ পেশায় নামে।
গণেশের কোনো জমিজমা না থাকায় সে মাছেধরা জীবিকার ওপরই নির্ভরশীল। প্রথমে যখন স্থানীয় জনগণকে বোঝানো হয় টাঙ্গুয়া ইজারাদারি প্রথা বিলুপ্ত করে জেলা প্রশাসন রণাবেন করবে তখন তার মতো গণেশরা খুশি হয়। কিন্তু কিছুদিন পর জেলা প্রশাসনের পাহারাদাররা যখন তাদের রুটি-টুজির পথ বন্ধ করে দেয়, মামলা দেয় তখন তারা আবারো সরকারি নব্য ইজারাদারের নির্যাতনের মধ্যে পড়ে। টাঙ্গুয়া এই প্রক্রিয়ার রণাবেণ করায় কার লাভ এ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে হাওর পাড়ের ফতুর গণেশদের মনে।
গণেশ জানায়, গত বছর আনসারকে টাকা না দেয়ায় সে জাল ও নৌকা হারায়।
প্রতিবাদ করায় তারা তাকে মামলা দিয়ে জেলে পাঠায়। এ সময় তার এক মেয়ে চিকিৎসার অভাবে মারা যায়। চারটি গরুর দুটি মারা। বাকি দুটি গরু বিক্রি করে তার বউ তাকে জেল থেকে মুক্ত করে। এখন গণেশ ফতুর।
তার কোনো অবলম্বন নেই। সে জাল ও নৌকা হারিয়ে না খেয়ে বেচে থাকে। টাকা না থাকায় সে অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছে। কিন্তু জলের ডাক সে ভুলে থাকতে পারছে না। তাই প্রতিবেশীর সঙ্গে সে জাল ফেলতে যায় পুলিশ ও আনসারের সঙ্গে সন্ধি করে, ঘুষ দিয়ে।
এ রকম হাজারো গণেশের দেখা মেলে টাঙ্গুয়ার হাওর পাড়ের বিভিন্ন গ্রামে।
নবাবপুর গ্রামের মৎস্যজীবী জাহের মিয়া জানান, এখনো ( আইউসিএন মালিকানায় আসার পরও) রাতে আর দিনে টাঙ্গুয়ার চিত্র বদলে যায়। রাতে লাখ লাখ টাকার মাছ ধরা হয়। এর জন্য নিয়মিত প্রতিটি ক্যাম্পের আনসার ও পুলিশকে টাকা দিতে হয়। তিনি জানান, আমরা ঘুষ দিয়ে মাছ ধরছি।
টাঙ্গুয়ায় মাছ ধরা বন্ধ হচ্ছে না। কাউয়ানিদ বংশিকুন্ডার রুমালি মিয়া জানান, পৃথিবীর সকল সুখ আমরা বিসর্জন দিতে পারব কিন্তু মাছ ধরা বন্ধ করতে পারব না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।