প্রাজ্ঞপ্রবীণ তরুণ বন্ধু
টোকন ঠাকুর
গ্রাম-মফস্বলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে, আমার বয়স যখন প্রায় এগারো ছাড়িয়ে, তখনই প্রথম টেলিভিশন দেখি। শাদা কালো। সুজুকি। একটা কাঠের বাকশের মধ্যে সেই টেলিভিশন রাখা ছিল। যে বাড়িতে টিভি সেই বাড়ির উঠোনে পেয়ারা গাছের গায়ে বাঁশ টাঙিয়ে বাঁশের মাথায় এন্টেনা।
সেই এন্টেনার ওপরে গ্রাম-বাংলার পাখি বসে থাকত। সন্ধের পর, উঠোন-ভর্তি লোক। আগত-বহিরাগত। টেলিভিশন অন করতেই স্ক্রিনে দাগ দাগ... ঢেউ খেলানো দাগ, ঝিরি ঝিরি... ঝাপসা ঝাপসা ছবি আসা শুরু হতেই কেউ একজন এন্টেনার বাঁশ দু’হাতে শক্ত করে ধরে মুড়িয়ে ঘোরাত; ‘এন্টেনা আরেকটু ডানে মোড়া দে... আরেকটু ডানে... আরেকটু...’ এর মধ্যে একঝলক ছবি এসেও ছিল বা কিন্তু এন্টেনার বাঁশ বেশি ডাইনে ঘুরে যাওয়ায় ছবি এসেও থাকল না। উঠোনের দর্শকের কারো কারো আফসোস শোনা যেত।
আবার সেই বাঁশ মুড়ামুড়ি, তখন কেউ একজন টিভির বডিতে একটা একটা করে নব টিপত... এভাবেই, অনেক অপো শেষে টিভি স্ক্রিনে ছবি চলে আসত। উঠোনের মানুষ, বারান্দায় বসা নারীকুল সন্ধে থেকে রাত্রি ১১/১২টা পর্যন্ত টিভি দেখত। হয়তো সপ্তাহের সাতদিনই দেখত তারা তখনকার বাংলাদেশ টেলিভিশন থেকে প্রচারিত অনুষ্ঠান, খবর, নাটক, ধারাবাহিক নাটক, সিনেমা...। সম্ভবত টিভি সেন্টার ওপেন হতো বিকেল ৩টার পর। ধারেকাছে দু’তিন মাইলের মধ্যে ঐ বাড়িতে একমাত্র টেলিভিশন।
বাড়িটা আমাদের বাড়ির কাছেই। কিন্তু বয়স আমার মাত্র এগারো এবং পড়ি হয়তো পঞ্চম শ্রেণীতে, তাই আমার জন্য টিভি দেখায় সেন্সর চলে আসে। প্রথম কিছুদিন টানা টেলিভিশন দেখে যে নেশাটা লাগল, সেই নেশার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি হতো। সন্ধের পর বাড়িতে আমি আমার ঘরে পড়তে বসলে, বাইরে থেকে আমার ওপরে নজরদারি জারি হলো। একেবারে যে আমার ঘরের দরজার সামনে বসে থাকত গোয়েন্দারা, তা নয়, তবে আশেপাশের ঘর থেকেই নজরদারি চলত।
মাঝেমাঝে গোয়েন্দা কেউ আমাকে পাশের ঘর থেকে নাম ধরে ডেকে দেখত যে, আমি ঘরে আছি কিনা। নাকি টিভি দেখতে গোপনে ঘর থেকে পালিয়েছি?
পালাতে পারতাম। কখনো পারতাম না। না পারলে ভেতরে ভেতরে জ্বলে পুড়ে যেত। খুব কেমন যেন লাগত সে বয়সে।
তবে আমি ঠিকই পালাতাম যেদিন রাতে নাটক দেখানো হতো। যে কোনো ভাবেই সে রাতে অনেক কৌশল খাটিয়ে হলেও পালিয়ে যেতাম, নাটক দেখার নেশায়। কী নেশা ! নাটক দেখার নেশা তারপর ধীরে ধীরে বাড়ল। আমিও বড় হতে লাগলাম। এবং টেলিভিশনের নাটক, নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা-অভিনেত্রীদের চিনে উঠতে লাগলাম।
ধীরে ধীরে, দেখতে দেখতে অভিজ্ঞতা বাড়তে শুরু করল এবং একটা ভালো লাগা মন্দলাগার কৌতূহলও আপনমনে তৈরি হতে শুরু হলো। একদিন দেখলাম, আতিকুল হক চৌধুরীর নাটকগুলো আমাদেরকে বেশি বেশি টেনে নিচ্ছে। অন্যরাও আতিকুল হক চৌধুরীর নাটক দেখার জন্য অপো করত। আমার মেমোরিতে আছে, পুরো আশির দশক জুড়ে আতিকুল হক চৌধুরীর নাটকে টেলিভিশনের দর্শক, সেই আমাদের মতো বাঁশ টাঙিয়ে এন্টেনা ঘুরিয়ে দেখা দর্শক অনেক আনন্দ পেয়েছে। অনেক বেদনাও পেয়েছে তাঁর নাটকের বেদনা-সংবেদনে, হয়তো কোনো দৃশ্যের বিষাদে, আপ্লুত আনন্দে।
তিনি হয়তো সে বিষাদ, সে আনন্দ নিজের প্রেম-প্রজ্ঞা-পরিশ্রম দিয়ে তৈরি করেছেন, তারপর দর্শককে দেখাচ্ছেন, ভাবাচ্ছেন, হাসাচ্ছেন, কাঁদাচ্ছেন, সর্বোপরি দেখা শেষ হলে দর্শকের মনে ফের ভেসে ভেসে উঠেছে সেই ছবি, সেই অভিনয়, সেই ভঙ্গি...
বহুদিন আগে, সে যুগ হয়েছে বাসী। এখন ঘরে ঘরে টিভি। শতেক চ্যানেল। নব ঘুরানো লাগে না, রিমোর্ট আছে। আমি ঢাবি চারুকলা ইনস্টিটিউটের রঙ-তুলি বিদ্যায় এক যুগ পাড়ি দিয়ে, বাংলা কবিতার সঙ্গে দুইদশকের সংসার করে এসে, নিজেও যখন ডিজিটাল দুনিয়ার জন্য ফিকশন বানাতে আগ্রহী হয়েছি, দু’একটা করে কাজও করছিÑ ঠিক এরকম সময়, এই তো সেদিন সরাসরি পরিচয় হলো আতিকুল হক চৌধুরীর সঙ্গে।
প্রথম পরিচয়েই বললাম, ‘আপনাকে চিনি প্রায় বিশ বছর, আপনার নাটক দিয়ে। আপনার একটা কবিতাও পড়েছি, ভারত বিচিত্রায়, দশ/এগারো বছর আগে...’
যাঁর নাটক দেখার জন্য বাড়ি থেকে পালিয়ে টিভি দেখতে যেতাম, সেই আতিকুল হক চৌধুরী, প্রাজ্ঞপ্রবীণ এই মানুষটি একজন তরুণ বন্ধুর মতো আমার দিকে দু’হাত বাড়িয়ে দিলেন। আমি আনন্দে তাঁর বুকের মধ্যে নিজেকে স্থিত করি।
‘আমি তোমার কবিতাও পড়েছি, শামসুর রাহমানের কাছেও তোমার কথা শুনেছি...’ আতিক ভাইয়ের এই বাক্য মনে করতে করতে যখন আমি রাস্তায় হাঁটছি, ফের আমি মনে মনে বলি, এই মানুষটা শতায়ু হলেই ভালো হয়। আমি জানি, নাটক বানানো এই মানুষটার ভেতরে একজন কবি লুকিয়ে আছেন।
আতিক ভাই, আপনাকে সেঞ্চুরি করে যেতে দেখতে চাই।
২৮ অক্টোবর, ২০০৭
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।