আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পূঁজির গাজোয়ারী বাংলাদেশেই



সঠিক তথ্য তুলে ধরে নি বলে ইংল্যান্ডে যে বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ হয় সেটাই বাংলাদেশে প্রচারিত হয় কারণ সেটা বাংলাদেশের জন্য নির্মিত। ইংল্যান্ডে আজ ম্যাগি নুডলস এবং হরলিকসের বিজ্ঞাপনের প্রচারণা নিষিদ্ধ হয়েছে। বিজ্ঞাপন দুটো পণ্যের পরিচিতি তুলে ধরে নি এমন কি বিভ্রান্তিকর প্রচারণা করেছে এমন দাবিতেই এই দুটো বিজ্ঞাপনের প্রচার নিষিদ্ধ করা হয়। তবে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এই বিজ্ঞাপন মূলত বাংলাদেশে প্রচারের জন্যই নির্মিত হয়েছিলো, পরে ভুলবশত সেটা ইংল্যান্ডে প্রচারিত হয়। বিজ্ঞাপন পণ্যপরিচিতিমূলক হতে পারে, এমন কি পণ্যের বৈশিষ্ঠ্যকে কিংবা প্রতিষ্ঠানের চরিত্রকেও ধারণ করতে পারে।

বিজ্ঞাপননির্মাতা এবং বিপনন দপ্তর মূলত এই বিষয়টি নির্ধারণ করে। যখন কোনো বিজ্ঞাপন নির্মিত হয় তখন সেখানে আদতে পণ্যের বিশেষ কোন বৈশিষ্ঠ্যকে পূঁজি করা হবে, প্রতিষ্ঠানের কোন পরিচিতি তুলে ধরে হবে- এইসব বিবেচনা ও আলোচনার শেষে একটি বিজ্ঞাপন জনসমাজে প্রচারিত হয়। ইংল্যান্ডে যে পণ্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ হয়েছে মূলত পণ্যের ভুল পরিচিতির জন্য সেটা বাংলাদেশে নির্বিঘ্নে প্রচারিত হতে পারে এটাই আশ্চর্যের বিষয়। হরলিকসের বিজ্ঞাপনটির ধারণা কার উর্বর মস্তিস্ক থেকে বের হয়েছে? ভারতীয় কোনো ব্যক্তির উর্বর মস্তিষ্ক সেটা আমি নিশ্চিত। এই বিজ্ঞাপনে দেখানো হয়েছে ২ বছর এক দল ছেলে-মেয়েকে দেওয়া হয়েছিলো হরলিকস, তার লম্বায় বেড়েছে, তাদের বুদ্ধিমত্তা বেড়েছে।

যদিও শুধুমাত্র বিজ্ঞাপন ও পণ্যের প্রসারের জন্য এই বিজ্ঞাপন নির্মিত হয় তবে সেটা অনৈতিক এবং নিন্দনীয় আচরণ। অন্তত কোনো গবেষণানির্ভর বিজ্ঞাপনের মোহে যদি কেউ উন্নত ও বুদ্ধিমান শিশু তৈরির জন্য হরলিকস কিনে তার সন্তানকে খাওয়ায় এবং যদি এমনটা ঘটে যে এই গবেষণা গবেষণার নিয়ম মেনে পরিচালিত হয় নি, তবে সেটার কর্পোরেট অনৈতিকতা আমাদের সামগ্রীক মানুষকেই আক্রান্ত করে। এমন ভাবেই ম্যাগির বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে এটা শক্তিশালী শিশুর জন্য সহায়ক। শিশুদের টার্গেট করে কোনো বিজ্ঞাপনের প্রচারের সময় অনেক সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। অন্তত শিশু মনঃস্তত্ব এতটা র‌্যাশনাল হয়ে উঠে নি, তারা জীবনের অভিজ্ঞতায় এতটা সমৃদ্ধ হয়ে উঠে নি এখনও যে তারা বিজ্ঞাপনের মোড়কে উপস্থাপিত মিথ্যা এবং চটককে আলাদা করে সঠিক তথ্যটি যাচাই করতে পারে।

এমনিতেই শিশুদের টার্গেট করে বিজ্ঞাপনের বিষয়ে অনেক দেশেই নির্ধারিত নীতিমালা থাকে, এমন কি অনেক বিজ্ঞাপনের শুরুতেই বলা হয় এই বিজ্ঞাপনটি বিশেষ ভাবে দক্ষ মানুষের অংশগ্রহনে নির্মিত হয়েছে। কোনো শিশু যেনো নিজের ঘরে এই বিজ্ঞাপনের অনুকরণে কিছু না করে। হয়তো সেখানেও অতিরঞ্জিত বিষয়াদি থাকে, তবে অন্তত শিশুকে পূর্বেই বলা হয় এই স্ট্যান্টবাজির জন্য অপেশাদার কেউ উপযুক্ত নয়, তবে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপন প্রচারের নীতিমালায় এমন বিষয় অনুপস্থিত। এখানে ডানোর বিজ্ঞাপনে দেখায় একটি মেয়ে একটি ছেলে গাছের উপর থেকে ছাতা মাথায় লাফ দিয়ে নীচে নামছে। বিষয়টা হয়তো সম্ভব, তবে অধিকাংশ সময়ই এটাতে দুর্ঘটনা ঘটবার সম্ভবনা আছে।

সতর্কিকরণ ব্যতিত এই বিজ্ঞাপন প্রচারিত হচ্ছে কিন্তু কয়েকজন মানুষ ছাড়া কেউ এর বিরোধিতা করে নি অদ্যাবধি। আমরা নাটকের মানের বিষয় উচ্চকিত, সিনেমার ভায়োলেন্স আর অশালীনতা নিয়ে সভা সেমিনার করছি, আমাদের এলিট বাহিনী কাকরাইলের ফিল্মিপাড়ায় তল্লাশী করে খুঁজছে কাটপিস। কিন্তু প্রতিদিন ড্রইং রুমে বসে আমাদের শিশুরা এই সব সাম্ভাব্য দুর্ঘটনার এবং শাররীক বিকলাঙ্গতার সংবেদ পাচ্ছে টিভি বিজ্ঞাপন থেকে এটার জন্য কোনো নীতিমালা নেই। টিভিতে প্রচারিত হচ্ছে রং ফর্সাকারী ক্রীমের বিজ্ঞাপন, আফ্রিকার মানুষের রং কি বদলে ফর্সা করা সম্ভব। যে জন্মেছেই ত্বকে অতিরিক্ত মেনালিন নিয়ে এটা তার ডিএনএতে প্রোথিত, চামড়ার উপরে প্রলেপ লাগিয়ে ডিএনএ প্রোফাইল বদলে ফেলা সম্ভব? এমন কি স্পর্শ্বকাতর ত্বকে পরীক্ষিত মেক আপও ভয়াবহ এলার্জি তৈরি করে চামড়া ধ্বংস করতে পারে।

ফেয়ার এন্ড লাভলী, ফেয়ার এন্ড হ্যান্ডসামের বিজ্ঞাপনে যেমন হুট করে সফল হওয়ার গল্প বিবৃত হয় সেটা কোন গবেষণাগারে পরীক্ষিত হয়েছে, ঠিক কোন ধরণের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে এই পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে এটা নিয়ে আলোচনা করতে চাইলে তারা যা জানায়, মূলত এটা ত্বকের কালো রং সম্পূর্ণ বদলে ফেলতে পারবে না, তবে তারা রংয়ের উজ্জলতা বাড়াতে পারে। নিয়মিত পরিচ্ছন্ন থাকলে মানুষের চেহরায় যতটুকু উজ্জলতা আসবে ঠিক ততটুকুই এটা দিতে পারে। ভেনেসা উইলিয়ামস, টানা ১ বছর ফেয়াল এন্ড লাভলী ব্যবহার করলেও লিন্ডসে ডেভেন্ডপোর্ট হতে পারবে না, হতে পারবে না সানিয়া মির্জা। রং ফর্সাকারী ক্রিমমের বিজ্ঞাপন চিরতরে নিষিদ্ধ করা উচিত। এটা গণপ্রতারণা, এবং এই গণপ্রতারণার বিজ্ঞাপন নিয়মিত প্রচারিত হয়।

লিভার বাংলাদেশ বিশাল কর্পোরেট সংস্থা, তবে উপমহাদেশেই তারা মনে হয় এই ক্রিমের বিজ্ঞাপন দেয়। উপমহাদেশের বাইরে কোথাও এই বৈবাহিক বর্ণবাদীতা নেই। রং ফর্সা না হলে ভালো বর পাওয়া যাবে না সুতরাং পুরুষআকর্ষণ করো চেহারার রং উজ্জল করে এই ইতর বিজ্ঞাপন উপমহাদেশেই নির্মাণ ও প্রচার সম্ভব। কর্পোরেটের পূঁজির জোর আছে, তবে নৈতিকতার জোর না থাকলে অন্তত পূঁজির জোরে উন্নত বিশ্বে টিকে থাকা মুশকিল, তারা সেখানে সমঝোতা করে অবৈজ্ঞানিক বিজ্ঞাপন দুটি প্রত্যাহার করে নিলেও আমাদের দরিদ্র দেশের হতদরিদ্র এবং বিজ্ঞাপনসেবীভোক্তাদের জন্য নির্মিত বিজ্ঞাপনটি বাংলাদেশে প্রচারের আগ্রহ তাদের কমে নি। বাংলাদেশ পূঁজিবাদী কর্পোরেটের পূঁজিতে ধর্ষিত হওয়ার নিয়তি নিয়ে জন্মেছে, আমাদের তাবত বিবেকবান মানুষেরাই কর্পোরেট পূঁজিতে বেঁচে থাকে, কর্পোরেটের ছায়াতলে তাদের মানবিকতা বোধ প্রতিপালিত হয় এবং কর্পোরেটের নির্দেশনায় তাদের অমানবিকতাবোধগুলো নির্ধারিত হয় এবং সেসব বিষয়ে এক্টিভিজম শুরু হয়।

যারা সমাজে এই বিষয়ে কথা বলবে তারা কর্পোরেটের পকেটে বসেই টাদের জন্য এইসব বিজ্ঞাপন নির্মাণ করে জীবন ধারণ করে। সুতরাং হরলিকস যদিও শিশুর বুদ্ধিবৃত্তিক এবং শাররীক বিকাশে তেমন স্পষ্ট ভুমিকা রাখে না এরপরেও এই দাবির উপরে ভিত্তি করেই তারা বিজ্ঞাপন প্রচার করবে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের কর্পোরেটপালিত বুদ্ধিজীবিদের সেই নৈতিক জোর নেই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.