আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

Elmina Castle...Where thousands of African slaves died.

জীবন যখন যেখানে যেমন
বেশ অনেকদিন হলো ব্যস্ততার কারনে আমাদের কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি, উইকএন্ড গুলোতেও কোনো না কোনো কারনে বাইরে যাওয়া হচ্ছিল না। তাই গত শনিবার অনেকটা জোর করেই আমি বললাম যে দূরে কোথাও ঘুরতে যাব...বাসায় বসে থেকে হাপিয়ে উঠেছি। কোথায় যাওয়া যায় সেটা বলার সাথে সাথেই আমি কেপ কোষ্টের নাম নিলাম। ঘানাতে আসার পর থেকেই এই জায়গাটার নাম শুনেছিলাম। ১৮শ শতাব্দীতে বৃটিশরা আফ্রিকার বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষদের ধরে নিয়ে এসে ইউরোপে ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করতো (তখন ক্রীতদাস বাণিজ্য হত....সেটা সবারই জানা)।

ঘানার কেপ কোষ্টে বৃটিশরা এই বাণিজ্যের জন্য একটা দূর্গ (Elmina Castle) বানিয়ে ছিল,আফ্রিকার বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষদের ধরে এনে তারা এই দূর্গের ভেতরে রাখতো, তারপরে সেখানে সেই ধরে আনা নিরীহ মানুষদের উপরে চলতো বিভিন্ন ধরনের পৈশাচিক অত্যাচার। বেশ কিছুদিন তাদের সেখানে বন্দী করে রাখা হতো তারপরে যারা বেঁচে থাকতো তাদের জাহাজে করে ইউরোপে নিয়ে যেয়ে বিক্রি করা হতো। প্রায় ২০০ বছর আগের বানানো এই ঐতিহাসিক জায়গাটার এত কাছে থেকেও সেটা না দেখলেই নয় সেজন্য সেখানে ঘুরতে গেলাম সেদিন। কেপ কোষ্ট জায়গাটা প্রাকৃতিক দিক দিয়ে খুবই সুন্দর বলতে হয়। চারিদিকে বিশাল আটলান্টিকের নীলচে সবুজ জলরাশি, তার গা ঘেসেই কেপ কোষ্ট শহরটা।

আমাদের "আকরা" (ঘানার ক্যাপিটাল) থেকে কেপ কোষ্টে যেতে প্রায় ২ থেকে আড়াই ঘন্টা লেগে ছিল। রাস্তার দৃশ্য... দূরে দেখা যাচ্ছে আটলান্টিক... কেপ কোষ্টে যাওয়ার পথে রাস্তায় পড়লো "Kakum National Park" তো সেখানেও নামলাম দেখার জন্য, নীচে তার কিছু ছবি দেয়া হলো... হাতির মাথার কংকাল... কেনোপি ওয়াক ওয়েতে (Canopy Walkway) করে এক গাছ থেকে আরেক গাছে যেয়ে পুরা পার্কটা দেখতে হয়...আমরা এই এ্যাডভেঞ্চারটা করিনি, সময় কম ছিল বলে... কাকুম ন্যাশনাল পার্ক থেকে বের হয়ে আমরা আবার রওনা দিলাম কেপ কোষ্টের উদ্দেশ্যে। সেখানে যেতে যেতে দুপুর ৩টা বেজে গেছিল তাই আমরা ক্যাস্টেলে যাবার আগে তার কাছাকাছি একটা খাবার রেষ্টুরেন্টে ঢুকলাম। সেটা ছিল একদম সমুদ্র সৈকতের ধারেই, ইচ্ছা হলে খাবারের অর্ডার দিয়ে সমুদ্রের ধারে হেটে আসা যায়। আমরাও তাই করলাম, অনেকক্ষণ ধরে হাটলাম বীচে ছবিও তোলা হলো অনেক...নীচে সমুদ্র সৈকতের কিছু ছবি... রেষ্টুরেন্টের ভেতর থেকে সমুদ্র... সামনেই সেই অভিশপ্ত দূর্গ... সমুদ্র সৈকতে ঢেউয়ের আঁছড়ে পড়া... জেলেদের মাছ ধরার ছবি... মাছ হাতে এক ঘানাইয়ান পিচ্চি... খাওয়ার পরে আমরা হাঁটতে হাঁটতেই গেলাম দূর্গে।

টিকিট কাটার পরে একটা গ্রুপের সাথে একজন গাইড আমাদেরকে নিয়ে গেল তার ভেতরে। সে ঘুরে ঘুরে আমাদের সব দেখাচ্ছিল আর বলছিল যে কিভাবে বৃটিশরা আফ্রিকানদের কে এখানে ধরে নিয়ে আসতো। তারপরে অন্ধকার জায়গায় তাদের দিনের পর দিন বন্দী করে রাখা হতো... প্রথমে সে নিয়ে গেল "Male slave dungeon" সেখানে ছেলে ক্রীতদাসদের বন্দী করে রাখা হতো। আমাদের গাইড বললো যে সেখানে প্রায় ৩ মাস তাদের বন্দী রাখা হতো। এই বন্দী অবস্থায় সেখানেই তাদেরকে মলমুত্র ত্যাগ করতে হতো,সেখানেই ঘুমাতে হতো।

এই অন্ধকার গুহার মধ্যে তাদের দিনের পর দিন থাকতে হতো। আমার ঐ কিছুক্ষণ সময় ভেতরে থেকে যেন দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল আর সেই মানুষগুলো কিভাবে থাকতো ভাবতে গেলে খুব খারাপ লাগে। কোনো আলো নাই ভেতরে... এখন পর্যটকদের সুবিধার জন্য ১/২ টা লাইটের ব্যবস্থা করা হয়েছে, না হলে অন্ধকারেই সবাই ভয় পাবে। খুব উঁচুতে একটা করে ছোট জানালা (জানালা না বলে ছোট ফুটা বলাই ভাল) রাখা হয়েছে শুধু। এখনকার অনেক আফ্রিকানরা তাদের পূর্বপুরুষদের স্মরণ করে এই বন্দীখানার মধ্যে অনেক কিছু রেখে যায়...তারা মনে করে তাদের আত্মা আসবে এবং সেগুলো ব্যবহার করবে...মদের বোতল, সিগারেট এমন বিভিন্ন শখের জিনিষ তারা রেখে যায় সেখানে।

দূর্গের উপরে সারি সারি কামান বসানো...যাতে শত্রুর জাহাজকে আক্রমণ করা যায় সহজে। মহিলা ক্রীতদাসদের রাখা হতো আলাদা জায়গায়...সেটাও আলো বাতাসহীন অন্ধকার একেকটা গুহা। মহিলাদের উপরে চলতো বৃটিশদের বিভিন্ন রকমের পাশবিক অত্যাচার। তাদের কথা মত কাজ না করলে নাকি এইসব নিরীহ মানুষ গুলোকে মেরে আটলান্টিক সমুদ্রে ফেলে দেয়া হতো। দূর্গটার শেষ যে দরজা সেখানে লেখা ছিল "Door of no return" যেখান থেকে এই নিরীহ মানুষদের জাহাজে উঠানো হতো, তাদেরকে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে আটলান্টিক সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে নিয়ে যাওয়া হতো আর সেখান থেকে এই হতভাগ্য মানুষদের জীবনেও ফেরা হতো না।

সেখানে তারা অন্যের কেনা গোলাম হয়ে সারা জীবন কাজ করে যেত। "Door of no return" এই দরজার বিপরীত পাশে এখন তারা লিখে রেখেছে "Door of return" এটা তাদের স্মরণে যাদেরকে একদিন এখান থেকে এইপথ দিয়ে তাদের শেকড় ছিড়ে অন্য এক দুনিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তারা না হোক তাদের বংশধররা হয়ত কোনো এক সময় শেকড়ের টানে আবার এই পথেই ফেরত আসবে তাদের জন্মভূমিতে সেই আশায় লেখা। ফিরতে ফিরতে আমাদের বেশ রাত হয়ে গেছিল...ফেরার সময় গাড়িতে শুধু দুর্গটাই চোখে ভাষছিল আর বিভিন্ন ছবিতে দেখা ক্রীতদাসদের উপরে অত্যাচারের দৃশ্য গুলো মনে পড়ছিল...ক্রীতদাস প্রথার কথা এতদিন শুধু শুনেই এসেছিলাম তেমন কোনো অনুভূতি ছিল না এই ব্যাপারে আমার, কিন্তু সেখানে যেয়ে কিছুটা হলেও অনুভব করতে পেরেছি যে কতটা কষ্টের মধ্যে সেইসব নিরীহ মানুষদের জীবন আঁটকানো ছিল। হাজার হাজার আফ্রিকান ক্রীতদাসদের লাশের উপরে মাথা উঁচু করে আজও দাঁড়িয়ে আছে ২০০শ বছরেরও বেশী পুরোনো এই দূর্গ (Elmina Castle)।
 


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.