আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চবি ক্যাম্পাস: আড্ডা-কলরব-কোলাহল আর মশকরার পূণ্যভূমি!!

জীবন একটাই; জীবনের জয় অনিবার্য..

‘যতই কাছ থেকে দেখেছি, ততোই অবাক হয়েছি। এও কী সম্ভব? চোখের সামনে দেখছি দুনিয়ার তাবৎ সব আড্ডাবাজরা একাট্টা হয়েছে। আড্ডাবাজদের তীর্থস্থান নাকি মশাই? এদের পড়াশুনা কি লাটে উঠল? আমরা তো জানতাম ছাত্রানাং অধ্যয়নং তপঃ। কিন্তু এ বিশ্ববিদ্যালয়ে কী পড়াশুনা হয় নাকি সবাই দলে দলে আড্ডা দেয়?’ পাঠক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরতে এসে অনেক অভিভাবকরা এভাবেই অবাক হন। চট্টগ্রাম শহরের সিএনজি ট্যাক্সি, ইমারত আর হটডগ-বার্গারের দোকান থেকে ২২ কি.মি. উত্তরে হাটহাজারী থানার ফতেপুর ইউনিয়নে পাহাড়ি ও সমতল ভূমির উপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

১২৫৭.৮২ একর আয়তনের এই ক্যাম্পাসে আজ ‘অধ্যয়নং তপঃ’ ৩৫টি বিভাগে। ১৭ হাজার শিার্থী এখানে পড়ে। চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজের এ ক্যাম্পাসে কাস পরীা টিউটোরিয়ালের ব্যস্ততার মাঝেও স্থানে স্থানে বসে ‘নিত্যদিনের আড্ডা’। এ ক্যাম্পাসে আড্ডার লোকসংখ্যার একটা স্বভাবিক সীমা আছে, উর্দ্ধ সংখ্যা দশ কি বারো, নিুতম তিন। দশ-বারো জনের বেশি হলে তা যেন হয়ে যায় সমাবেশ, তেমনি যদি হয় শুধুমাত্র দুজন- তখন কুজন এসে পাহাড়া দেয় থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার যেন কাছেও ঘেঁষতে না পারে।

কিন্তু শত চেষ্টা করেও যদি আড্ডার লোকসংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করা হয় তবে কখন যে আড্ডার প্রাণপাখি ফুরুৎ করে উড়ে পালায় টেরটিও পাওয়া যায় না। চল্লিশ চাক্কার ঘরঘরানি: এটি শাটলের আড্ডা। সকাল সাড়ে সাতটা বা নিদেন পে আটটা। চল্লিশ চাক্কার শাটল ট্রেন চলছে। ট্রেন যদি আশ্চর্যজনক ভাবেই শহর থেকে নির্ধারিত সময়ে ছাড়ে তাহলে ক্যাম্পাসে পৌঁছাতে ঘন্টা দেড়েকের পথ।

এ সময়টা জুড়ে নানান নামে আর নানান রঙ্গে রাঙ্গানো এক একটা বগিতে বসে আড্ডার শত শত গ্র“প। আড্ডার বিষয়বস্তু হয়তো একাডেমিক, নয়তো একান্ত ব্যাক্তিগত। আড্ডাবাজদের পোশাক, আষাক, চেহারা, চরিত্র সর্বদিকে যেন মধ্যবিত্তিয় আধুনিকতার দৈন্যদশা! আড্ডার সমাপ্তি হয় ক্যাম্পাসে পৌঁেছ শাটল ট্রেনের শেষ ধাক্কাটি দেয়ার পর। ঝুপড়ির আড্ডা: ঝুপড়ির আড্ডা সার্বজননীন। ক্যাম্পাসের চৈত্র সন্ধ্যা, শ্রাবণের রিমঝিম দুপুর, শরতের বিকাল, শীতের মধুর উজ্জ্বল সকাল- সবই ঝুপড়ির আড্ডায় নীরব ঘন্টা বাজিয়ে যায়।

কাসের ফাঁকে ফাঁকে এখানে এসে শিার্থীরা দেয় ম্যারাথন আড্ডা। হেন কোন বিষয় নেই যা নাকি এই আড্ডায় উঠে আসে না। শিা, সংস্কৃতি, খেলাধুলা থেকে শুরু করে পরিণয়-বিচ্ছেদ সবই স্থান পায় আড্ডায়। এছাড়া ঝুপড়ির কোণায় বসে অল্প দামে চা-নাশতা খেতে কার না ভালো লাগে! অনেকে আবার শাটল ট্রেনের মতো এখানেও গানের সুর তোলে। শাটল ট্রেনে তবলা হয় বগি আর এখানে তবলা দোকানের টেবিল চেয়ার! ফ্যাকাল্টির ঝুপড়ি: এক সময় চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের ঝুপড়ি বলতে শুধু কলাভবনের সামনের ঝুপড়িগুলোকেই মনে করা হতো।

এখনো সেটি বেশি জমে ওঠে কাসের সময়টাতে। এখানেই বিজ্ঞান অনুষদ ও আশপাশের ফ্যাকাল্টি থেকে শিার্থীরা আসে। চারুকলা বিভাগের শিার্থীরা এখানে হায়দারের দোকানকে নাম দিয়েছে ‘হায়দার গ্যালারি’ এবং সেটিকে সাজিয়েছেও মনোরমভাবে। এই দোকানের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে নানা পেইন্টিং। সকাল ৯টা থেকে কলা অনুষদের ঝুপড়ি জমে ওঠে আর সেটি শান্ত হয় বেলা আড়াইটায়, যখন চবি থেকে শহরের ™ি^তীয় ফিরতি ট্রেন ছাড়ে।

কলাভবনের ঝুপড়ি ছাড়াও সমাজবিজ্ঞান অনুষদ ও বাণিজ্য অনুষদের ঝুপড়ি এবং আইন অনুষদের ঝুপড়িও জমজমাট থাকে এ সময়। তবে আইন অনুষদ একটি বিচ্ছিন্ন ™^ীপের মতো স্থানে থাকার কারণে এখানে আড্ডাটা বেশিণ স্থায়ী হয় না। রেলস্টেশনের আড্ডা: চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের রেলস্টেশনে যেসব ঝুপড়ি রয়েছে সেগুলো অনেক ঐতিহ্যবাহী হলেও এই ঝুপড়ি প্রাণ পায় প্রধানত বেলা দেড়টা ও আড়াইটায়, শাটল ট্রেন যখন চট্টগ্রাম শহরের ফিরতি পথ ধরে। এর আগে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে কিছু খেয়ে নেওয়া। তাছাড়া এ এলাকায় রয়েছে বিখ্যাত ‘মউর দোয়ান’।

সবার মামা গুরু মিয়াই এখানে প্রথম দোকান দেন। তিনি সাী হয়ে আছেন অনেক ইতিহাসের। ট্রেন চলে যাওয়ার পর রেলস্টেশনের ঝুপড়িগুলোতে নীরবতা নেমে আসে। স্থানীয় লোকজন ও বিকেলে হল থেকে বেড়িয়ে অনেকে এসব ঝুপড়িতে বসে আড্ডা দেয়। এছাড়া ছেলেদের হলের সামনের ঝুপড়িগুলো সকাল, বিকেল ও রাতে খাবারের সময় জমজমাট থাকে।

ছাত্রী হলের সামনের মাঠ: ছাত্রী হলের ঝুপড়িতে আড্ডা হয় মূলত বিকেল বেলা। চবির প্রীতিলতা হল, শামসুন্নাহার হল ও বেগম খালেদা জিয়া হলের সামনের ঝুপড়িও বিস্মৃত মাঠে জমে আড্ডা। ছেলেদের হল থেকে বা শহর থেকে বন্ধুরাই আসে দেখা করতে। এক সময় পাহাড়ি ক্যাম্পাসে সন্ধ্যা নামে, ঝিঁ ঝিঁ ডাকে, শিয়ালের হুক্কা হুয়া শোনা যায়, থেমে যায় আড্ডা। প্রিয় মানুষটির সাথে বিচ্ছেদ ঘটে ওই দিনের মতো।

তবু আশ^াস থাকে ‘কাল তো দেখা হচ্ছেই!!’ আড্ডা-ই ধর্ম, আড্ডা-ই কর্ম: নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় আবর্তিত হলেও এ ক্যাম্পাসের আড্ডা সবর্ত্রব্যাপি। মন যখন যা চায় তাই পাওয়া যায় নাকি এসব আড্ডায়। আড্ডা যা দিতে পারে তা অন্য কিছুই যেন আর দিতে পারে না। তাই ক্যাম্পাসের এ আড্ডাকে অনেকেই বলে, ‘নিষ্ফলা মাটিতে উর্বর শস্য’! কিন্তু পিচঢালা মসৃন, মন্থর গতি, স্বচ্ছন্দ আবেগ আর প্রাণময় মৃদু মশকরার মধ্যেই মাঝে সাঝে আড্ডার রস গড়াতে গড়াতে সুরুচির সীমা যায় ছাড়িয়ে। বাঁধ ভাঙ্গা উত্তেজনার প্রশমন না হওয়ায় আড্ডা মুহূর্তেই রুপ নেয় হাতাহাতিতে।

ভালোবাসার কোমল দুখানি সকরুণ নয়ন কখন যে রক্তচু হয়ে উঠে তাও টের পাওয়াও মুস্কিল। আড্ডা ছেড়ে কাসে দৌঁড়াচ্ছে এরকম চিত্র যেমন আছে আবার আছে কাস থেকে হাঁিফয়ে আড্ডায় উড়ে এসে জুড়ে বসার মানুষও আছে বিলকুল। কাসে নাইনটি পারসেন্ট পারসেন্টেজ কিংবা জিপিএ ফাইভের লোভে আড্ডা ছেড়ে অনেকে দৌঁড়ায় কাসে। এসব কাস করাদের বিরুদ্ধে আড্ডাবাজ সহপাঠির অভিযোগ ‘তারা আড্ডার স্বর্গ থেকে চ্যুত হওয়া কাস-টিউটোরিয়ালের বন্ধ্যা নিষ্ফলা ভূমির কৃষক’।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।