::::: দেখবো এবার জগতটাকে :::::
পার্ট ওয়ানের(Click This Link) পরে...
বান্দারবান চান্দের গাড়ি স্ট্যান্ড থেকে শুরু হয়েছিল আমাদের যাত্রা। জুম চাষ করতে স্বাভাবিকের চার গুন জমি লাগে। একবার যেখানে চাষ হয়। পর পর তিন মৌসুম জায়গাটা অনাবাদী রাখে। অন্য পাহাড়ে চাষ করতে হয়।
চতুর্থ মৌসুমে পাহাড়ে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। জায়গা সাফ হলে চাষাবাদ শুরু হয়। সময়টা ছিল পাহাড় পুরানোর। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছিল। এমনিতে মে মাসের তীব্র গরম।
আর হাই আল্টিচিউডে সেটা আরো অসহ্য লাগছিল। ঘন্টা তিনেক পরে আমরা গ্যারিসন নামের একটা জায়গায় আসলাম। পথে ১টা আর্মি ক্যাম্পে নাম এন্ট্রি করতে হয়েছে। সাঙ্গুর সাথে কয়েকবার দেখা হলেও এবারে প্রথম সাঙ্গু আমাদের রাস্তা বন্ধ করে দিল। এর পরে আর চান্দের গাড়ি যায়না।
ওখানে একটা আর্মি ক্যাম্পে আমরা তৃতীয় বার নাম এন্ট্রি করলাম। ওখানকার লোকেরা একটা পাহাড়ি ঝিরি দেখালো যেটার পানি অসম্ভব মিষ্টি। পাহাড়ের গভির থেকে স্রোতটা এসেছে। সম্ভবত পাহাড়ের ভেতরে কোন বিশেষ ধরনের মিনারেল মেশে পানির সাথে যার কারনে সেটা এত মিষ্টি। সবাই অবশ্য রহস্যভেদের কোন চেষ্টাও করেনা।
আল্লাহর কির্তি দেখেই সন্তুষ্ট। সাঙ্গুতে অন্য সময় ট্রলার চললেও এসময়ে পানি হাটু স্পর্ষ করেনা আমরা হেটেই পার হলাম। সাঙ্গুর পাড় ধরে পাহাড়ি রাস্তায় হাটা শুরু হল। পাহাড়ের ভেতর দিয়ে সাঙ্গুকে ডান দিকে রেখে টানা হাটা। কিন্তু কিছুদুর গিয়েই আটকে যেতে হল।
পাহাড় ধ্বসে একটা রাস্তা বন্ধ। আমরা ছোট একটা পাহাড় ক্রস করে মেইন রাস্তায় উঠলাম। ইট বেছানো রাস্তা। সোজা হাটছি, ভয়ঙ্কর রোদে কষ্ট হচ্ছিলো সবার। একটা দোকান পেয়ে হুরমুরিয়ে ঢুকলাম সবাই।
ইলেক্ট্রিসিটি নাই। কিন্তু পানি আছে। টিউবওয়েলের পানি মাথায় দিয়ে আবার হাটা। আমাদের বেশ তাড়া ছিল। রুমা বাজারে থামার কোন ইচ্ছা নেই আমাদের।
ওখানে একটা নামকরা ঝর্না আছে, রিঝুক ঝর্না কিন্তু সময় সল্পতার জন্যে আমরা ওটা দেখতে যাবনা। কিন্তু ২টার মধ্যে গাইড যোগার করে আর্মি ক্যাম্প থেকে বের হয়ে যেতে না পারলে আর যাওয়া যাবে না ঐদিন। তাই আমরা খুব তাড়াহুরা করছিলাম। যাইহোক ঠিক সময়মত আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে নাম এন্ট্রি করলাম। ওরা বললো ২টার মধ্যে গাইড বের করে নাম আউট করতে।
কিন্তু সেইদিন ওখানে কি একটা ফুটবল খেলা হচ্ছিল। কোন গাইড পাইনা। কেউ যেতে চায়না। পাহাড়িরা গাইড হিসাবে কাজ করতে পারেনা যদিও ওরা পাহাড় ভালো চেনে। গাইডকে অবশ্যই বাঙ্গালী হতে হবে এবং আর্মি ক্যাম্পে নাম ধাম ছবি এন্ট্রি থাকা লাগবে।
যাইহোক। আমরা খাওয়া দাওয়া সারলাম। ওকে নিয়ে আর্মি ক্যাম্পে গেলাম ঠিক ২টায়। কিন্তু ওখানে জেসিও ভদ্রলোক একটা ট্রুপ নিয়ে প্যাট্রলিংএ চলে গেছেন। এক ল্যান্স কর্পোরাল ইনচার্জ হয়ে বসে আছে।
এক্সপার্টদের কাছে এর বদনাম শুনেছি অনেক। ট্রেকারদের সাথে খুব দুর্ব্যাবহার করে, আমাদের সাথেও করলো, যেতেও দেবেনা। আমরা বললাম জেসিও ভদ্রলোকের সাথে কথা হয়েছে। উনি বলেছেন একটু দেরী হলে যাওয়া যাবে, ঐ লোক বললো তাকে কিছু বলে যায়নাই তাই সে যেতে দেবেনা। আমরা বোচকা বুচকি নিয়ে প্রায় মাইলখানেক দৌড়ে জ়েসিওকে ধরলাম।
রিকোয়েস্ট করাতে উনি ওয়াকি টকিতে কথা বলে আমাদের সামনে বলে দিলেন যে ঠিক আছে উনাদের যেতে দাও। আমরা আবার ক্যাম্পে আসতে ঐ লোক বললো হ্যা আমাকে বলছিল ৩টার সময়। কিন্তু এখন ৩টা দশ এখন আর যাওয়া যাবেনা। আমরা হতবম্ভ। আমরা তো সুপার ম্যান না।
ঐলোক ওয়াকীটকিতে কথা বলবে আর সাথে সাথে উড়ে আমরা ক্যাম্পে চলে আসবো। গাইড লোকটা আরো বদ। আমরা ঠিক করলাম ক্যাম্পের পার্মিশান ছাড়াই যাব।
আসার আগে টিভিতে শুনেছিলাম সাইক্লোন আসছে একটা। মায়ানমার বাংলাদেশ বর্ডারে।
আকাশে মেঘ জমছে। আমরা ঝিরি পথ বাদ দিয়ে হাটা পথ দিয়ে রওনা হলাম। ছোট একটা গ্রামের মাঝে একটা থানা। পাহাড় কেটে বানানো রাস্তা। আমরা হাটা শুরু করলাম।
এবার রাস্তা সোজা। পায়ে চলা রাস্তা। এই রাস্তায় চান্দের গাড়িতে করে ডাইরেক্ট কেওকারাডং যাওয়া যায়। কিন্তু রাস্তাটা গাড়ি চলার জন্যে বানানো হয়নাই। খুব খাড়া।
আমরা যাবার মাসেই একটা এক্সিডেন্টে চারজন টুরিস্ট মারা গেছে। হেটে যাওয়াই নিরাপদ। মাইল তিনেক যাবার পরে একটা নদী পরলো। হাতমুখ ধুয়ে ওপারে আবার হাটা। এবার জঙ্গল শুরু হলো।
বনের মধ্যে দিয়ে রাস্তা। বাশ কেটে রফতানী করে আদীবাসীরা। আরো প্রায় মাইলখানেক হাটার পরে আমরা ছোট একটা গ্রাম পেলাম নাম মুংলাই পাড়া। মুংলাই পাড়া শেষ জনবসতী বগামুখ পাড়ার আগে। আমরা এই অল্প হাটতেই প্রচন্ড ক্লান্ত হয়ে পড়লাম।
প্রচন্ড রোদ। আর সাইক্লোনের আগে একফোটা বাতাস নাই। প্রচন্ড দাবদাহে অবস্থা খারাপ। একটা দোকান আছে। দিদি দেখেই বুঝলো।
আমাদের পানি আগায় দিল। গ্রামের পিছে একটা ছোটখাট ঝর্না আছে। ওখান থেকে পানি ভর্তি করলাম আমরা। চা খেয়ে অল্প জিরিয়ে হাটা শুরু করলাম। পথে অনেক টাম বাগান।
লাল টুকটুকে টাম ফলে আছে। দেখতে আমের মত (অনেক ছোট) তাই সবাই বলে আমের ভাই টাম। খেতে ঝাঝালো টকটক অনেকটা সুন্দরবনের পাকা কেওড়ার মত। কিন্তু অনেক বেশি মজা। আর রসালো।
টাম বনের মালী খেতেই ছিল। খালি গায়ের একজন অনেক বয়স্ক আদীবাসী। এদিকে একজন বাঙ্গালীও নাই। শুধু বম আর ম্রো পল্লী। আরো দূরে ত্রিপুরারা থাকে।
অবশ্য নেক্সট পনেরো মাইলে কোন গ্রামের চিহ্ন নাই। সাধারনত আমরা সমতলবাসীরা এরসাথে অভ্যস্থ নই। ১৫/২০ মাইল সম্পুর্ন নির্জন খুব রেয়ার। মানুষ না থাকলেও চিহ্ন থাকবে। চাষের জমি, ইলেক্ট্রিকের পোল, অথবা গরুর গোবর।
যাই হোক। পাহাড়ে রাত নামে খুব দ্রুত। আমরা জোর পায়ে হাটা শুরু করলাম। কিন্তু সমতলে হাটা আর পাহাড়ে হাটা একনয়। বেশ কষ্ট হতে থাকে।
বনের মধ্যে অনেক পাখি, জাম্বো সাইজের পাহাড়ি টিয়া অনেক বেশি, আর অদ্ভুত টাইপের একটা ঝি ঝি পোকার ডাক। এই ঝি ঝি পোকাগুলোর ডাক মেশিন গানের মত অনেকটা ইলেক্ট্রিক গিটারের সাউন্ডের সাথে মিল আছে। তাই এর নামকরণ করলাম আমরা মেটাল ঝি ঝি। মেটাল ঝি ঝির ডাকের ছাপিয়ে মাঝে মাঝে হরিণের ডাক আসে। অনেকেই হরিণ, বন্য কুকুর, অজগর, গেছো বাঘ এসব দেখে।
ঝিরি পথেই বেশি। কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য বনে কোন জন্তু জানোয়ার আমাদের সাথে দেখা করলো না। । একটা বড় পাহাড়ের চুড়ায় আমরা সুর্যাস্ত দেখলাম। বিশাল লাল সুর্য টুপ করে ডুবে গেল।
আমরা সবাই বসে গায়ের শার্ট খুলে ভালো করে ওডোমস ক্রিম মেখে নিলাম। বান্দারবানের পাহাড়ি ওয়াইল্ড ম্যালেরিয়া খুব কুখ্যাত। ঘামে ভেজা শরীরে তেল তেলে অডোমস খুব বিচ্ছিরি অবস্থা সুর্য ডোবার সাথে সাথে অন্ধকার। একটু পড়েই অবশ্য অরণ্য পাতলা হয়ে এল। রাত আটটার দিকে পাহাড় গুলো বেশ খাড়া হয়ে আসছে।
বড় বড় দুটো ঢাল পাড় হতে অনেক কষ্ট হলো। এই রাস্তায় কিভাবে গাড়ি চলে ভাবা যায়না। একটু পরেই মেঘ ডাকতে শুরু করলো। আকাশে খুব কাছেই ফ্ল্যাশ হচ্ছিল। আমাদের বেশির ভাগের অবস্থা কেরোসিন।
পায়ে জোড় নাই।
কিছুক্ষন পরে জুম ঘরে আসলাম। এদিকে কোন বসতি নাই, কিন্তু উর্বর কিছু পাহাড় আছে। চাষীরা ফসলের মৌসুমে বন্য জন্তু থেকে ফসল রক্ষার জন্যে এখানে এই সব জুম ঘরে থাকে। সবাই এক্কেরে নেতায়া পড়লাম।
সামান্য রেস্টের পর আবার হাটা। মেঘ ডাকছে। বৃষ্টি হতে পারে। আমাদের সৌভাগ্য শেষ মুহুর্তে সাইক্লোন তার গতি পালটে বর্ডার এরিয়ে থেকে আরো অনেক দুরে গিয়ে রেঙ্গুন বন্দরে আঘাত হানে। প্রচন্ড অন্ধকার।
টর্চ লাইটেও যেন অন্ধকার কাটেনা। ঘন্টা খানেক পরে রাত সাড়ে দশটা এগারোটার দিকে দূরে একটা পাহাড়ের চুড়ায় দেখলাম টর্চের আলো। আমাদের আলো দেখে ওরা আলো ফেলছে। বুঝতে পারলাম বগালেক আর্মি ক্যাম্প। আমাদের মাঝে নতুন আশার আলো জাগলো।
আমরা সত্যিই রাতের অন্ধকারে হেটে চলে আসছি। কিন্তু এরিয়াল ডিস্টান্স আর জিওগ্রাফিকাল ডিস্ট্যান্স আলাদা। আমরা যতই আগাই পাহাড়টা যেন জীবন্ত সে উলটা দিকে দূরে সরে যায়। একটা বড় ঢাল পার হতে গিয়ে সবাই চুড়ান্ত কাহিল। যাত্রি ছাউনি বলে একটা যায়গা আছে।
ওখানে এসে আর নড়ার শক্তি নাই। কিছুক্ষন রেস্ট নিয়ে একটা খাদের পাশ দিয়ে পাহাড়টা লম্বার পাড় হতে হয়। আকৃতিতে বান্দারবানের নীলাচল পাহাড়ের সমান। রাতের বেলা বুঝিনাই। পড়ের দিনের বেলা বুঝেছিলাম পাশের খাদ টা কেমন দেখলে বেশ ভয় লাগে।
অনেকেই এই জায়গাটাকে পুলসিরাত বলে। চিকণ একটা পথ। পাহাড় ধ্বসে জমা ছোট ছোট নুড়ি হাটাটা আরো ভয়ঙ্কর করেছে। জংলী লতা কিংবা ঝোপ গুলাও খুব মজবুত নয়। ধরলেই উপরে আসে।
যাইহোক। কোন রকমে যখন আর্মি ক্যাম্পে এসে পৌছালাম তখন রাত প্রায় ১২টা। এই ক্যাম্পের সৈনিকেরা অনেক অমায়িক। সামনে অন্ধকার একটা লেক দেখা যায়না কিছুই। কয়েকটা চালা ঘর।
সাজ্জাদ এখানকার রেগুলার লোক। সিয়াম দিদির সাথে অনেক খাতির। আসার আগে চিঠি লিখে আসছিল। সিয়াম দিদি আমাদের জন্যে থাকার আর খাবার আয়োজন করে রেখেছিল। লাল ঢেকী চালের ভাত আর ডিম ভাজা অমৃতসম।
খেয়ে হাফপ্যান্ট আর সাবান নিয়ে লেকের পানিতে নামলাম। গা জুড়িয়ে গেল। অনেক খাড়া। পাড় থেকে কয় পা গেলেই গলা পানি। আসলে বগা লেক একসময় আগ্নেয়গীরি ছিল।
শেষ অগ্নুতপাত কবে হয়েছিল কেউ জানে না। কিন্তু আশে পাশে আগ্নেয়শিলার আধিক্যে বিজ্ঞানীদের এই ধারণা। লেকটা কত গভীর আজ পর্যন্ত কেউ মাপতে পাড়েনাই। আর্মি ক্যাম্পের লোকেরা একবার রশি ফেলে চেষ্টা করেছিল। ২০০ ফিট দড়ি ফেলার পরেও তলা পাওয়া যায়নাই।
ভয়ঙ্কর ক্লান্ত ছিলাম সবাই। শোয়ার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মরার মত ঘুম। তবুও অনেক সকাল সকাল উঠতে হলো। কেওকাড়াডং সামিট হবে আজ।
সকাল বেলা ঘুম ভেঙ্গে গরাদহীন জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বগা লেক চোখে পড়লো। হায় হায় এতো বেহেস্ত। আমি কি মরে গেছি? বেশি পাপ করছি কি না জানি না, নামাজ রোজা পড়া হয়না। ঈশ্বর আমাকে বেহেস্তে পাঠালো কেন? এক্ষুনী বোধহয় হুর পরীরা চলে আসবে। একটু পড়ে বুঝলাম, না আমি বেচে আছি।
আর বাংলাদেশের ভেতরেই বেহেস্ত আছে। দৌরে বাইরে এবে...
(চলবে...)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।