মানব জাতির আদি পুরুষ হলেন হযরত আদম (আঃ)। পরবর্তীকালে তারই বংশধর হিসেবে পৃথিবীতে মানব জাতির বিস্তার হয়েছে। আদম (আঃ) ছিলেন প্রথম মানুষ ও প্রথম নবী। মানব জাতির ইতিহাস মূলতঃ দুই ভাগে বিভক্ত। তৌহিদবাদী ও শিরকবাদী।
মক্কা বিজয়ের পর মহানবী (সাঃ) ঘোষনা করেনঃ
. . . হে কুরাইশগণ! রাব্বুল আলামীন আল্লাহ তা'য়ালা জাহেলিয়াতের সব অহংকার ও বংশ গৌরব খতম করে দিয়েছেন। সকল মানুষ এক আদমের সন্তান। আর আদমকে মাটি থেকে পয়দা করা হয়েছে। . . .
শেখ সাদী (র.) বলেন-
মাটিতে হয়েছে সৃষ্টি আদম তনয়
মাটিতেই মিশে যাবে জানিও নিশ্চয়।
গোর হতে মুর্দা যদি কর বাহির।
চিনা নাহি যায় কবো আমীর-ফকির।
দুনিয়াতে এসে কত রাজা মহারাজ
খালি হাতে চলে গেলা ফেলে তখত-তাজ।
হিন্দু ধর্মমতে মানুষে মানুষে জাতভেদ রয়েছে সেগুলো হল ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র। কিন্তু ইসলাম ধর্মে এরকম কোন কিছু নেই। ইসলামের গোড়াতেই জাতিভেদ প্রথা বা বংশ গৌরবের জড় কেটে দিয়েছে।
এ কারণে জাতিভেদ ও বংশ গৌরব নিয়ে বেহুদা বড়াই করা অহমিকা ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু আমাদের দেশের মুসলিম সমাজে হিন্দুদের ন্যায় মিথ্যা জাত পাতের দোহাই দিয়ে মানুষে, মানুষে বৈষম্য বিদ্যমান। মানুষের মূল্যায়ন হয় আমল-আখলাক, তাকওয়া বা আল্লাহভীতি ও নেক কাজের মাধ্যমে। আগের দিনে মনীষীগণ মহৎ কাজের দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে দুনিয়ার জীবনে শ্রেষ্টত্ব অর্জন করেছেন। বলা হয়, 'জন্ম হোক যথা-তথা, কর্ম হোক ভাল।
' আল্লামা ইকবাল বলেছেন-
আমলছে জিন্দেগী বনতি হ্যায়
জান্নাত ভি জাহান্নাম ভি
ইযে খাকী আপনা ফিতরত মে
না নুরী হ্যায়, না নারি হ্যায়।
অর্থাৎ মানুষের কৃতকর্ম বা আমলের দ্বারা নির্ধারণ করা হবে সে জান্নাতে যাবে না জাহান্নামী হবে। এই মাটির দেহ নিজ থেকে নূরেরও নয় আগুনেরও নয়। আমল-আখলাক, ঈমান-আক্বিদা সঠিক না হলে সৈয়দ-শায়খ, চৌধুরী-খনকার-কাজী, মোঘল-পাঠান, দেওয়ান, ফৌ্জদার, শিকদার, তালুকদার, দস্তিদার, মজুমদার ইত্যাদি লকবের তেমন কোন মূল্য নেই। কবি বলেছেন- .. নহে আশরাফ, যার আছে শুধু বংশের পরিচয়।
সেই আশরাফ যাহার জীবন কর্মময়। .. তারপরও জাত-পাতের প্রভেদ আমাদের জীবনে এমনভাবে জড় করে বসেছে যা দেখে মনে হচ্ছে এ থেকে রেহাই পাওয়া সহজে সম্ভব নয়। এ পর্যায়ে বংশগত ও পেশাগত কিছু শব্দের ব্যাখ্যা দিয়ে বিষয়টি বুঝতে সহজ হবে।
সৈয়দ, সায়্যিদঃ হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর বংশ। হযরত আলী (রাঃ) এর ঔরশজাত ও ফাতেমা (রা.) এর গর্ভজাত বংশধররা সৈয়দ হিসেবে অভিহিত হয়ে থাকেন।
তারা ফাতেমী সৈয়দ। হযরত আলী (রা.) এর অন্য স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানরা উলভী সৈয়দ হিসেবে পরিচিত। এছাড়া দলপতি, প্রভূ, প্রধান, মালিক, সর্দার ইত্যাদি বুঝায়। তবে মুসলিম দুনিয়ায় সায়্যিদ বলতে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর বংশধরদেরই বুঝায়।
শায়খ/শেখঃ অর্থ জ্ঞানী, আলেম, বিজ্ঞ, শ্রেষ্ঠ।
ইংরেজ আমলে হিন্দুরা মুসলমানদের তুচ্ছার্থে সেক বলে ডাকত। শায়খ উপাধিটি আরব দেশ বা মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমাদের দেশে এসেছে। আরব দেশে থেকে আগতরা ছিলেন মুসলমান। তাই তাদের বিদ্রুপ করে যবন ও স্লেচ্ছ বলা হত। বঙ্কিম চন্দ্রের সাহিত্যে ও ইশ্বর চন্দ্র গুপ্তের কবিতায় এর প্রচুর প্রমাণ পাওয়া যায়।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে শায়খ শব্দের অর্থ প্রবীন ব্যাক্তি। গোত্র বা বংশের প্রধানকেও বুঝায়। বর্তমানে এই উপাধিটি সম্মানসূচক আখ্যায় পরিণত হয়েছে। সর্বোচ্চ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব শায়খ উল ইসলাম, শায়খ উল হাদিস শায়খ উদ দ্বীন (ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রী)। আমাদের দেশে শায়খ শদ্বের ব্যবহার দেখা যায় যেমনঃ শায়খ উল হাদিস, শায়খ উল মাশায়েখ ইত্যাদি।
নবাবী আমলে প্রশাসন দুই ভাগে বিভক্ত ছিল- ১। নিযামত ও ২। দেওয়ানী। দেওয়ানগণ ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করতেন।
জমিন+দার=জমিদার এটি ফার্সী শব্দ।
মিরাশদার, তালুকদার, তাপাদারদের মাধ্যমে জমিদাররা রাজস্ব আদায় করতেন। নবাবী আমলে জমির মালিক ছিলেন সরকার। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে ভূমির মালিকানা জনগনের কাছে চলে আসে। পাঁচশ টাকার উপরে খাজনা প্রদানকারী হতেন জমিদার, এর নীচে অর্থাঃ পাঁচশ টাকার থেকে পঞ্চাশ টাকা পর্যন্ত খাজনা প্রদানকারী ছিলেন মিরাশদার। পঞ্চাশ টাকার নিচে হলে তালুকদার, তাপাদার ইত্যাদি লকবে ভূষিত হতেন।
কবে দেওয়ানী, জমিদারী, মিরাশদারী ও তালুকদারী চলে গেছে অথচ আজও এসব বাহারী লকব বহাল আছে।
চৌধুরীঃ মোঘল আমলে প্রশাসনিক কাঠামো ছিল পরগনা। পরগনার খাজনা আদায়কারীগণকে চৌধুরী অর্থাৎ চতুর্ধারীন। চৌধুরীগণ আদায়কৃত খাজনার চারভাগের একভাগ কমিশন পেতেন। পরগনায় আমিন, সিকদার, ফওতদার (ক্যাশিয়ার), এবং মোল্লা মুন্সীরা ফার্সী ভাষায় দলিল দস্তাবেজ সনদ ফরমান লিখতেন।
এসব কাগজপত্র ফরমান সনদে হুকুম আদেশ দিতেন দস্তিদার পদবীর কর্মচারীরা। সরকার পর্যায়ের রাজস্ব কর্মকর্তা ছিলেন শিকদার। এরা ছিলেন দেওয়ানদের অধীনে। এর নিচের পদবী ছিল মুকদ্দম ও চৌধুরী। চৌধুরীগণ আদায়কৃত খাজনা দেওয়ানের কাছে জমা দিতেন।
আমরা যদি মুঘল আমলের প্রশাসনিক ব্যবস্থার দিকে আলোকপাত করি তাহলে অনেক বিষয় পরিস্কার হয়ে যাবে। মুঘল আমলের প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিম্নরূপঃ
১। সম্রাটঃতার অধীনে- ১। উজির (প্রধানমন্ত্রী), ২। দেওয়ান (অর্থমন্ত্রী) কাজী উল কুজ্জত বা প্রধান বিচারপতি।
২। উজিরের অধীনে তিন ধরনের প্রশাসক ছিলেনঃ ক. সুবাহদার (প্রাদেশিক গভর্নর), খ. মীর ই বকসী বা বকস (প্রধান সেনাপতি), গ. মীরই ছামান বা (শিল্পমন্ত্রী) আমীরের সংক্ষিপ্ত নাম মীর।
৩। সুবাহদারের অধীনে- ক. বকশী (সেনা প্রধান), খ. ফৌজদার (জেলা প্রশাসক), গ. শিকদার বা মহকুমা প্রশাসক ঘ. মোকাদ্দম (গ্রাম প্রধান), পঞ্চায়েত (প্রাম কমিটি) পঞ্চায়েতের প্রধানকে বলা হত সরপঞ্চ। সরপঞ্চের অধীনে ছিল চৌকিদার ও দফাদার।
৪। মীর ই বকসী (প্রধান সেনাপতি)এর অধীনে- ক. আমীর উল উমরা, খ. আমীর ই আজম, গ. আমীর , ঘ. মসনবদার, ঙ. দারোগা ই তোপখানা, চ. দারোগা ই চাকচৌ ছ. মোস্তফী জ. মীর বাহারী, ঝ. মীর আরজ, ঞ. মীর মীরমনযিল, ট. মীর তোজক ইত্যাদি।
৫। মীর ই ছামান এর অধীনে- ক. সদর ই সাদু (ধর্মমন্ত্রী) খ. মুশিব (জনকল্যাণ বিভাগের ইনচার্য)
৬। দেওয়ান এর অধীনে- ক. আমীল (বিভাগীয় কালেক্টর), খ. পাটোয়ারী (হিসাব রক্ষক) বিশ্বাস, গ. আমীন (জেলা কালেক্টর) ঘ. কানুনগো (আইনের ব্যাখ্যাকারী উকিল), চ. জমিদার, ছ. রায়ত (প্রজা)
৭।
কাজী উল উজ্জত (প্রধান বিচারপতি) এর অধীনে- ক. কাজী খ. মুফতি (আইনের ব্যাখ্যাকারী), গ. মীর ই আদল (বিচারপতি) প্রভৃতি পদবীর বিচার বিভাগের লোকজন।
৮। খানঃ খান শব্দটি মূলত মঙ্গেলীয়। চেঙ্গিস খান, হালাকু খান ইত্যাদি। খান অর্থ নেতা।
পাঠান বা পোস্ত শব্দটি মধ্যযুগীয় তুর্কি শব্দ যার অর্থ বীর পুরুষ, সাহসী।
৯। কাজীঃ কাজী অর্থ বিচারক। খন্দকার একই অর্থ বহন করে। এখনও নিকাহ রেজিস্টারকে কাজী বলা হয়।
১০। লস্করঃ লস্কর একটি ফার্সী শব্দ। এর অর্থ সৈনিক বা সিপাহী। সেনাপতির উপাধি ছিল সিপাহসালার।
১১।
মজুমদারঃ এর অর্থ একাউনটেন্ট জেনারেল বা প্রধান হিসাব রক্ষক।
১২। ভূইয়াঃ অর্থ জমির বা ভূমির মালিক। জমিদারের বা চৌধুরীর সমগোত্রীয়।
১৩।
দস্তিদারঃ রাজা-বাদশাহ ও আমির ওমরাহদের নামের সিলমোহর সংরক্ষনকারী ও সিলমোহর প্রদানকারীকে বলা হত দস্তিদার।
১৪। মোল্লাঃ ইসলামী বিষয়ে গভীর জ্ঞানী ব্যক্তিকে বলা হত মোল্লা।
১৫। মুন্সীঃ দলিল-দস্তাবেজ, হুকুম ফরমান, সদন লেখক।
আইনজ্ঞ ব্যক্তি। ফার্সী নবীস। ফার্সী ভাষায় আগাধ জ্ঞান ছিল।
হিন্দু ধর্মে জাত পাতঃ
আর্যদের ধর্মগ্রন্থ ঋগবেদের মতেঃ ব্রহ্মার মুখ হতে ব্রহ্মনের জন্ম। দুই বাহু হতে জন্ম রাজ-রাজন্য ও ক্ষত্রিয়দের।
উরু থেকে জন্ম হয়েছে বৈশ্য সম্প্রদায়ের আর দুই পা থেকে জন্ম শূদ্রের ।
ব্রাহ্মনঃ ব্রাহ্মনগণ মূলত দশ শ্রেণীর- ১. বৎস, ২. বাৎস্য, ৩. ভরদ্বাজ, ৪. কৃষ্ণাত্রেয়, ৫. পরাশর, ৬. কাত্যায়ন, ৭. কাশ্যপ, ৮. মৌদগুলা, ৯. স্বর্ণ কৌশিক এবং ১০. গৌতম। এসব ব্রাহ্মণগণ ভট্টাচার্য, রায়, রায়চৌধুরী, চট্টোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়, পুরকায়স্থ, চক্রবর্তী, শর্মা, আচার্য, গুহ, ঘোষ, বসু, নন্দী, নাগ, দত্ত, কুন্ডু, ধর, দাস প্রভৃতি পদবী ব্যবহার করেন। অন্যমতে গুহ, ঘোষ, বসু, মিত্র, নন্দী, নাগ, দত্ত, কুন্ডু, ধর, রাহা, রুদ্র, দাস এরা কায়স্থ গোত্রের।
এছাড়াও হিন্দু ধর্মে পেশাভিত্তিক জাত বা গোত্র রয়েছে।
যেমনঃ কামার, কুমার, গোয়ালা, জোলা, তাঁতী, মালী, তেলী (পাল), শীল, নাপিত, চন্দ (ধোপা), কর্মকার, বারুজী, ময়রা (মিঠাই বিক্রেতা), কৈবর্ত, চামার, গন্ধবণিক (সুগন্ধি দ্রব্য বিক্রেতা), ঢুলি, দাস, পাটনী, নমঃশূদ্র, ভূইমালী, দাড়ি (মাঝি), মাহারা (পালকী বহন করে যারা),যুগী, লোহাইত, কুরি (খৈ-মুড়ি তৈরীকারী), বারুই, বৈদ্য, সূত্রধর, শাখারী, শুড়ী, সাহা-সাহু, শুক্লবৈদ্য, চুনার (চুন বিক্রেতা) মলো (মৎজীবি) ইত্যাদি। সব গোত্র বর্ণের শ্রেণী বর্ণনা করতে হলে পৃথক গ্রন্থ রচনা করা প্রয়োজন।
চন্ডী দাস বলেছেন-
শোন রে ভাই
সবার উপরে মানুষ সত্য
তাহার উপরে নাই।
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মাটির মানুষ দুনিয়ায় তার কর্মকান্ডের মাধ্যমে যে ইতিহাস সৃষ্টি করে তাই হয় সভ্যতার উপধান।
অতএব জাত-পাতের ধ্বজা না উড়িয়ে মানুষ্যত্ত্বের বিকাশের লক্ষ্যে সবার কাজ করা কর্তব্য।
(পোস্টটি সৈয়দ মোস্তফা কামাল এর লেখা হতে সংকলিত)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।