আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

প্রজন্মান্তরের গল্পঃ মাই ফাদার এ্যান্ড মাই সান

seremos como el Che সেদিন কোথায় যেন পড়লাম, 'আমাদের বাবা-মা যে সঠিক ছিলেন এটা যখন আমরা বুঝতে পারি ততদিনে আমরা নিজেরাই বাবা-মা হয়ে গেছি'। বাবা-মা এবং সন্তানদের মধ্যে বিভিন্ন সিদ্ধান্তের দ্বন্দের ফলে যে দূরত্ব সৃষ্টি হয় তা সঞ্চারিত হয় এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে। প্রজন্মান্তরের এই দূরত্ব সৃষ্টি ও মোচনের গল্পই বলা হয়েছে ২০০৫ সালের তুর্কি সিনেমা বাবাম ভে অগলুম বা মাই ফাদার এন্ড মাই সান এ। সময়কাল সত্তর দশক। ইজমির এর কাছে একটি গ্রামে হুসেইন একজন অবস্থাপন্ন খামার মালিক।

তার দুই ছেলে সেলিম এবং সাদিক। সাদিককে সে ইস্তাম্বুলে কৃষিকাজের উপর পড়তে পাঠায়। তার পরে সাদিক খামারের হাল ধরবে এটাই তার প্রত্যাশা। কিন্তু ইস্তাম্বুলে গিয়ে বাম রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়ে সাদিক। হয়ে ওঠে একজন বামপন্থী সাংবাদিক।

এটা নিয়ে বাবার সাথে মতের অমিলের কারণে সে বাড়ি ছাড়ে, বাবা-মা ও প্রেমিকাকে পেছনে ফেলে। জীবন এগিয়ে চলে, সাদিক ইস্তাম্বুলে বিয়ে করে, তার সন্তানের জন্মের সময় উপস্থিত হয়। কিন্তু একই সময় ঘটে একটি মিলিটারি ক্যু। এর মাঝে পড়ে সাদিক তার স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছুতে পারে না। রাস্তার পাশে তাঁর ছেলে ডেনিজকে জন্ম দেবার পর অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা যায় তার স্ত্রী।

এরপর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে গ্রেফতার ও নির্যাতনের শিকার হয় সাদিক। বাম রাজনীতির সাথে জড়িত থাকায় তাঁর জীবিকা নির্বাহের সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসতে থাকে এবং অন্যদের করুণায় বেঁচে থাকাটা অসহ্য হয়ে ওঠে একসময়। ইতিমধ্যে কেটে গেছে বেশ কিছু বছর, ডেনিজ কিছুটা বড় হয়ে ওঠে ততদিনে। এসময় সাদিক বাড়িতে ফিরে যাওয়া মনস্থ করে। মা'র কাছ থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলেও বাবা হুসেইন এর সাথে সাদিকের সংঘাত হয়ে ওঠে অবশ্যম্ভাবী।

ছেলে আর নাতির উপস্থিতিকেই যেন স্বীকার করতে চায় না হুসেইন। এইভাবে দুই প্রজন্মের দুই পিতার অভিজ্ঞতা ও নিজ নিজ সন্তানের প্রতি আবেগ-অনুভূতির উপলব্ধির তুলনার মাধ্যমেই এগিয়ে চলে সিনেমার ঘটনা। আর এই পুরো ঘটনাটির উপরে আলোকপাত করার কেন্দ্র হিসেবে পরিচালক চাগান ইর্মাক ছোট্ট ছেলে ডেনিজের চরিত্রটিকে বেছে নেন। সিনেমার গল্প বলার ধরণ উপভোগ্য। সাদিক বাড়িতে ফিরে আবার রাগের মাথায় হাঁটা শুরু করলে তার মা'র ডাকের সাথে মিলিয়ে ফ্ল্যাশব্যাকে চলে যাওয়াটা তার একটা উদাহরণ।

দেখা যায় অতীতের মতই মা'র ডাকে সে থামে না, কিন্তু ডেনিজের চিৎকারে সে থমকে দাঁড়ায়। এই ছোট্ট ঘটনা দিয়েই পরিচালক সন্তানের প্রতি বাবার ভালবাসাকে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছেন। একইভাবে হুসেইন একসময় সাদিককে জিজ্ঞাসা করে, 'এখন কি তুমি বাবার কাছে তার সন্তানের মূল্য বুঝতে পেরেছো?'। রাজনৈতিক ঘটনা সিনেমাটির একটি মূল অনুঘটক হলেও দৃষ্টিভঙ্গীর প্রাচুর্যতা নেই। তবে পুরনো বন্ধুদের আসরে সাদিককে বলতে দেখা যায়, 'আমি সবসময় দেশের জন্য লড়াই করতে চেয়েছিলাম।

কিন্তু এই দেশ আমাকে পাত্তাই দেয়নি'। বন্ধু উত্তর দেয়, 'আজকাল অনেক মানুষই এইভাবে চিন্তা করে'। ডেনিজ চরিত্রে একটি গুরুপ্তপূর্ণ ব্যাপার আছে। ডেনিজ বই পড়তে ভালবাসে এবং বাস্তবের যেকোন কাহিনীকে সে কোন এ্যাডভেঞ্চারের কাহিনীর সাথে মিলিয়ে কল্পনা করে। যেমন, ট্রেনের পুলিশেরা উপস্থিত হয় রেড ইন্ডিয়ান হিসেবে, ঘোড়া ছুটিয়ে আসা হুসেইন হাজির হয়ে জরোর আদলে ইত্যাদি।

এইখানে হঠাৎ করে আমার মনে পড়েছিল দ্যা ফল মুভিটির কথা। দেখতে দেখতে আমি ভাবছিলাম যে সিনেমার শেষে হয়ত এই ব্যাপারটি একটি অসাধারন মেটাফোরের সৃষ্টি করবে, কিন্তু তেমন কিছু না হওয়াতে কিছুটা হতাশ হয়েছি। শেষের দিকে দাদা-দাদীর কাছে গল্প শুনে ডেনিজ তার বাবাকে একজন সুপারহিরো হিসেবে কল্পনা করে, কিন্তু ডেনিজের কল্পনায় তার বাবা সাধারণ মানুষ হিসেবেই ফিরে আসে। পরিচালক হয়ত ডেনিজের চোখে দেখা বাবাকেই ফিরিয়ে আনতে চেয়েছেন কিন্তু আমার মনে হয় সারা মুভি জুড়ে ডেনিজের যে অসামান্য কল্পনাশক্তির পরিচয় আমরা পাই, তার পরিপ্রেক্ষিতে এর অন্যথা করলেও খুব অপ্রাসঙ্গিক হতনা। বরং ডেনিজের চোখে সাদিকের এক অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় রূপান্তরকে আরও জোরালোভাবে উপস্থাপন করা যেত।

সিনেমাটোগ্রাফীর কাজ আমাকে সন্তুষ্ট করেছে। সিনেমার লোকেশন সুন্দর, চোখের বিরক্তি উৎপাদনের কোন সুযোগ নেই। ভাল কম্পোজিশনের সাথে সাথে কিছু অর্থপূর্ণ ক্যামেরা মুভমেন্ট আমার ভাল লেগেছে। ঘোড়াকে ভয় পেয়ে ডেনিজ যখন হুসেইনের হাত ধরে ফেলে, তখন যে ক্যামেরা মুভমেন্টটা ব্যবহার করা হয়েছে সেটার মাধ্যমে যেন হুসেইনের মনে নাতির প্রতি ভালবাসার বিপরীতে সাদিকের অবাধ্য হওয়ার এক সিদ্ধান্তহীনতার চিত্র ফুটে ওঠে। একইভাবে বলা যায় হুসেইনের ডেনিজকে প্রথম বুকে টেনে নেওয়ার শটটির কথা।

সুন্দর কিছু ক্রেন আর ট্রলি শটের উদাহরণ সারাটা মুভি জুড়েই পাওয়া যায়। আর সাদিকের অজ্ঞান হয়ে যাবার দৃশ্যে ভার্টিক্যাল ক্যামেরা ধরে সেটাকে যেভাবে ১৮০ ডিগ্রী এ্যাঙ্গেলে ঘুরানো হয়েছে আর সেটা করে এই দৃশ্যের উত্তেজনাকে যেভাবে দর্শকদের মধ্যে পৌঁছে দেওয়া গেছে সেটা এক কথায় অসাধারণ। সার্থক মিজ-অঁ-সিনের উদাহরণ হিসেবে রাস্তার মাঝখানে হুসেইনের হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ার দৃশ্যটির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। যে উপাদানটি সুন্দর না হলে সিনেমাটা পূর্ণতা পেত না সেটা হল আবহসঙ্গীত। অসাধারণ টাইটেল মিউজিক এবং বিভিন্ন আবেগময় দৃশ্যে সেটার সুপ্রযোজ্য লেইট মোটিফের ব্যবহার সিনেমাটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।

যেমনঃ সাদিকের সাথে তার মা'র মিলন, ডেনিজকে হুসেইনের কাছে টেনে নেওয়ার দৃশ্য, পুরনো ভিডিও ফুটেজ দেখার দৃশ্য ইত্যাদি। এছাড়া আরেকটি মূল সঙ্গীতাংশ আছে যেটা মূলত ডেনিজ চরিত্রের জন্য তৈরী। ব্যবহার হয়েছে ডেনিজের গ্রামে আসার দৃশ্যে এবং দাদা-দাদীর সাথে ডেনিজের বেড়ে ওঠার কিছু দৃশ্যের সাথে। শিল্পীদের অভিনয় প্রশংসনীয়। ডেনিজ চরিত্রে ছোট্ট ছেলে এগে তানমান, হুসেইন চরিত্রে চেকিন তাকিন্দর, নুরান চরিত্রে হুমায়রা আকবে, সেলিম চরিত্রে ইয়েতকিন দিকিঞ্জিলার এবং সাদিক চরিত্রে ফিকরেট কুশকান এর অভিনয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

এই সিনেমাটি একটি জীবনের গল্প। শুধু তুর্কি সমাজে না, আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতেও এই কাহিনী ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। প্রতিটি বাবা এবং সন্তানের জন্য এই সিনেমাটি অবশ্য দর্শনীয়। পরিশেষে কৃতজ্ঞতা আমার কুর্দি বান্ধবীকে, যে না বলে দিলে এই সিনেমাটি হয়ত আমার অদেখাই থেকে যেত। ডাউনলোড করা যাবে এখান থেকে ।

৪ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ঢাকা।  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.