আত্মবিশ্বাসহীনতায় প্রকট হচ্ছে আত্মার দেউলিয়াত্ব, তবুও বিশ্বাস আগের মতই নিশ্চল..
আসসালামু আলাইকুম, সবাইকে স্বাগতম জানাচ্ছি আমি পদ্মলোচন; এই মু্হূর্তে আমার সঙ্গে আছেন আয়তলোচন,যদিও তার অস্তিত্ত্ব নিয়ে আমি নিজেই সন্দিহান এবং ধারণা করছি তিনি আমারই নবসত্তা হবেন, কারণ প্রতিনিয়ত আমার ভাবনা বিপরীতমুখী এবং বহুমাত্রিক হতে হতে প্রকৃতি কখন যে ভিন্ন একটি স্বতন্ত্র মানুষ সৃষ্টি করে নিয়েছে আমারই মধ্য ধেকে, টের পাইনি। আরও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এই, আয়তলোচন নিয়ত লিঙ্গ পরিবর্তনশীল: এই পুরুষ, এই নারী, হয়ত কখনোবা উভলৈঙ্গিক!যাইহোক,আমরা এখন আজিমপুর বাসস্টপেজ এ বাসের অপেক্ষায় দাড়িয়ে আছি, এখানে একটি ঐতিহ্যবাহী মহিলা কলেজ অবস্থিত। তাই স্বভাবতই এখানে পথচারীদের চলাচলের আইল্যান্ডগুলো নব্য রাধা-কৃষ্ণদের দখলে থাকে অধিকাংশ সময়। আয়তলোচনকে কোন কারণে ভীষণ অসন্তুষ্ট মনে হচ্ছে, অসন্তোষের কারণ সম্ভবত এই কপোত-কপোতীরা। সত্যি বলতে কি আমার নিজেরও এই পরিবেশটা বিশেষ পছন্দ হচ্ছেনা।
যদিও এরা কারও ক্ষতি করছেনা, তবুও সামাজিক এবং ব্যক্তিগত শিষ্টতার নিজস্ব মানদণ্ডে এই দৃশ্যগুলো সহজভাবে মেনে নিতে কেন যেন ইচ্ছে হয়না। হঠাৎ কী হল, আয়তলোচন নিশ্চুপ দাড়িয়ে না থেকে সামনের এক যুগলের মুখোমুখি গিয়ে দাড়াল। কিছু বলল না ওদের, শুধু অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মেয়েটি কিছু না বললেও ছেলেটি সরাসরি আয়তলোচনের মুখের দিকে তাকাল। আয়তলোচন একটুও না ঘাবড়ে ছেলেটির মাথায় আলতো টোকা দিতেই খুবই অদ্ভুত এক ব্যাপার ঘটল: ছেলেটার গলার স্বর ভেড়ার মত হয়ে গেল, ও এখন কোনকিছু বললেই সেটা শুনতে ভ্যা ভ্যা আওয়াজের মত লাগছে!আজিমপুরের এই অংশটায় রীতিমত আলোড়ন পড়ে গেছে, ইতোমধ্যে আয়তলোচন আরও দু’একজনের মাথায় টোকা দিয়েছে, এবং প্রত্যেকের যথারীতি একই পরিণতি.... তবে জনসমুদ্র তৈরি হলেও এখানে আর কোন কপোত-কপোতীর চিহ্নমাত্র নেই; নিজেদের মানবীয় কণ্ঠস্বরটি রক্ষা করতে সবাই ঊর্দ্ধশ্বাসে পালিয়ে বেচেছে।
অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই জনসমুদ্র কেটে গেল এবং আমরাও এখন বাসে উঠে বসেছি। আয়তলোচন যথারীতি নীরব। আমি কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার স্মৃতিচারণ করছি। আমি নিশ্চত এই যৌবনের পুজারী শিব-পার্বতীদের আর কখনই এখানে এভাবে বসে থাকতে দেখা যাবেনা, যদি আবার কেউ তাদের মাথায় টোকা দিয়ে বসে! হয়ত এই অবিশ্বাস্য ঘটনা আগামীকালের সংবাদপত্রেও স্থান পাবে, তখন অন্যস্থানের শিব-পার্বতীরাও নিশ্চয়ই সতর্ক হয়ে যাবে! খুবই হালকা বোধ হচ্ছে নিজেকে; নানা প্রতিবন্ধকতায় আমি না পারি, আমারই প্রতিরুপ আয়তলোচন তো পেরেছে!
আমাদের গন্তব্য নবীনগর; সেখানকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা সম্প্রতি একটি সামাজিক সচেতনামুলক সংগঠন গড়ে তুলেছে, নাম ‘প্রতিবাদ’। আমরা যাচ্ছি মুলত এই ‘প্রতিবাদের’ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে।
অনুষ্ঠান কাল, কিন্তু আজই যাচ্ছি, কারণ পুরো বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গন পরিভ্রমণ করে এখানে কিছু বিশেষ স্মৃতি রেখে যেতে চাই, কাল আসলে অনুষ্ঠানের ব্যস্ততায় হয়ত সেই ইচ্ছা অপুর্ণই রয়ে যাবে। এখন দুপুর সাড়ে এগারোটা, আমাদের বাসের বর্তমান দশায় আমি যারপরনাই বিরক্ত: বাসের পরিবর্তে আমরা যেন হযরত নুহ(আ)এর নৌকায় আরোহণ করেছি- মহাপ্লাবন থেকে ঢাকাবাসীকে উদ্ধার করার জন্য এই বাসটিই বোধহয় শেষভরসা!যাত্রীর ভীড়ে পা’ দুটোও মেলতে পারছি না। আয়তলোচন স্থির বসে আছে আমার পাশের সিটে, তার দৃষ্টি এখন বাসের একটি বিশেষ অংশে নিবদ্ধ : এই ঠেসাঠেসির মধ্যে এক তরুণীকে দেখতে পাচ্ছি কোনক্রমে দাড়িয়ে আছে, আর আয়তলোচনের দৃষ্টি দেখছি তরুণীর পাশের দুইলোকের দিকে, বিশেষত তাদের হাতের অবস্থানের দিকে। আমার ভীষণ ইচ্ছা করছে উঠে গিয়ে তরুণীটিকে নিজের সিট ছেড়ে দেই, কিন্তু এই বাসের মধ্যে নিজেকে হিরো হিসেবে জাহির করতে সংকোচ হচ্ছে। অন্যদিকে লোক দুটির অভব্যতা শালীনতার বিপদসীমা অনেক আগেই অতিক্রম করে গেছে, তরুণীটি ভাবলেশহীনভাবে(হয়ত নীরব অভিমানে)এই অনাচার(নাকি যৌনাচার বলব?)সহ্য করার এক পর্যায়ে আমার সঙ্গে দৃষ্টিবিনিময় হল, সম্ভবত এই দৃষ্টিতে আছে সাহায্যের আবেদন।
আমি অপরাধীর মত দৃষ্টি নামিয়ে নিলাম। হঠাৎ বাস থেমে গেল,স্টার্ট হচ্ছেনা কিছুতেই। এতক্ষণ স্থির বসে থাকা আয়তলোচন ভীড় ঠেলে সেই তরুণীর কাছে যেতেই সম্পুর্ণ অপ্রত্যাশিত ঘটনাটি ঘটল: তরুণীটি ব্রেট লি’র বলের গতিতে পাশের লোকটির গালে চড় মারল, ২য় লোকটি তরুণীর উপর চড়াও হতেই আয়তলোচন তার হাত ধরে ফেলল। এবার বাসের অন্য যাত্রীরা সরব হল, ব্যস গণধোলাইয়ের মহড়া শুরু হয়ে গেল। পুলিশের মধ্যস্থতায় লোক দুটি এ যাত্রায় রক্ষা পেলেও বাসে তাদের আর ঠাই হলনা।
ওদের নামিয়ে দিতেই বাস স্টা্র্ট নিল, আয়তলোচন সামনের সিটে গিয়ে বসল, বুঝলাম আমার অক্ষমতায় সে ক্ষুব্ধ। মনে হচ্ছে তরুণীটি চড়টা আমার গালেই যেন মেরেছে, আমি বাম গালে হাত ছোয়ালাম। ইতোমধ্যে তাকে সিট ছেড়ে দেবার জন্য প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে যাত্রীদের মধ্যে,সে আয়তলোচনের পাশে গিয়ে বসল। একই বেদিতে বীরঙ্গনা আর কাপুরুষের স্থান হতে পারেনা। তাই সে বসামাত্র আমি উঠে দাড়ালাম, বাকি পথটুকু দাড়িয়েই যাব স্থির করেছি।
শ্যামলিতে এসে আমাদের বাস পুলিশি হয়রানির মুখে পড়েছে; গাড়ির লাইসেন্স-কাগজপত্র, ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহন প্রভৃতি বহুবিধ অভিযোগ নিয়ে পুলিশ সার্জেন্ট উপস্থিত, যদিও বাসের ড্রাইভারের সঙ্গে তার এখন দেনা-পাওনা সংক্রান্ত দরাদরি চলছে; তার দাবি ৫০০, ড্রাইভার বলছে ৩০০টাকা। আরে, এ তো দেখছি শৈল্পিক ছিনতাই!আমি অবশ্য এখনো দাড়িয়েই আছি; নবীনগরের পথ কতটুকুইবা দুরত্ব। আরও একটি প্রতিবাদের সুযোগ আমার সামনে,অথচ পুলিশের খাকি পোশাকের ভয়ে আমি লুকনোর জায়গা খুজছি। আচ্ছা, আয়তলোচন কোথায়?সবার অলক্ষ্যে সে বাস থেকে নেমে পুলিশের ঘাড়ে গিয়ে হাত রেখেছে!ওরে বাপস, আজ আর যাওয়া হবে না রে; সাহস আর দুঃসাহসের তফাৎ কি আয়তলোচন বোঝেনা? আমি তো বেশ বুঝি, তাহলে ও কেন নয়?হায় হায় এটা কী করল সে, পুলিশের গায়ে পানি ঢেলে দিল?সার্জেন্টটি ড্রাইভারকে ফেলে এখন আয়তলোচনের কলার চেপে ধরেছে, সেও বোধহয় এটাই চাচ্ছিল। রাস্তায় মানুষ ভীড় করার জন্য সবসময়ই প্রস্ত্তত থাকে, এক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হবে কেন! জনসমাগম বাড়তেই এবার আয়তলোচন পুলিশটির কলার ধরে সিনেমাটিক ঢঙ্গে কোলাহল জুড়ে দিয়েছে।
‘আমার টাকা নিলেন কেন?আপনি পুলিশ হয়েছেন বলে জনগণের মানিব্যাগের ওপরও খবরদারি করবেন?’- বলতে বলতেই আয়তলোচন পুলিশটির পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে নিজের হাতে নিয়েছে, এ যে দেখছি পুলিশের উপর বাটপারি!!!বাসের অন্য যাত্রী এবং পথচারীরাও আয়তলোচনের সমর্থনে চেচামেচি শুরু করায় পুলিশটির মুখাবয়বে ভয়ের সুস্পষ্ট আভা দেখতে পাচ্ছি, এ মুহুর্তে তাকে এক মৃত্যুপথযাত্রী মনে হচ্ছে। তার সাহায্যার্থে আরও কয়েকজন পুলিশ আসলেও তারা কোন সক্রিয় ভুমিকা নিতে সাহস পাচ্ছেনা জনরোষের ভয়ে। এদিকে সমস্ত রাস্তায় যানজট বেধে গেছে, সেসব বাস থেকেও যাত্রীরা হুঙ্কার দিচ্ছে। জীবনে এই প্রথম পুলিশ আর বিড়ালকে আমার একই প্রজাতির মনে হচ্ছে। কী আর করা! মানিব্যাগটি আয়তলোচনকে দিয়ে দিতেই হল বাধ্য হয়ে।
বেচারা পুলিশ, চাদাবাজি করতে এসে নিজেই চাদার শিকার হয়ে গেল। তবে আমার ভয এখনো কাটেনি; এই দেশে পুলিশের সঙ্গে টক্কর দেয়া আর সালফিউরিক এসিড দিয়ে গোসল করা- দুইয়ের পরিণতিই তো অভিন্ন। হায়রে আয়তলোচন, কী যে অপেক্ষা করছে তোর জন্য!কিন্তু আয়তলোচনের কোন ভাবান্তর হচ্ছে বলে মনে হয়না; সে আবার আমার পাশে এসে বসেছে, তার মুখের নির্মল হাসি বুঝিয়ে দিচ্ছে যেন এইমাত্র সে পৃথিবীর পবিত্রতম কাজটি সম্পাদন করেছে।
আমি এক মহা সংকটে পড়েছি। নবীনগরে আসার পর থেকেই আয়তলোচন উধাও হয়ে গেছে;বাস থেকে নামার পর আমাকে অপেক্ষা করতে বলে সেই যে দোকানে গেছে আর ফেরার কোন লক্ষণ নেই।
আরও চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে বাস থেকে নামার কিছুক্ষণের মধ্যেই সে নারীতে পরিণত হয়েছে- ঈশ্বর তার সৃষ্টির মাঝে আরও কত আমীমাংসিত রহস্য যে লুকিয়ে রেখেছেন কে বলতে পারে! এদিকে বেলা প্রায় আড়াইটা বেজে গেছে, পানাহারের বন্দোবস্ত করা দরকার; আমি এখন কী করি!থাক বেটা/বেটি আয়তলোচন,আগে খেয়ে আসি, তারপর তোর খোজ করা যাবে। শুনেছি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাফেটেরিয়াটা খুবই চমৎকার, আজ তার সত্যতা যাচাইয়ের সুযোগ পেয়েছি। ......খাবার সংগ্রহের লাইনটাতো দেখছি দৈর্ঘ্যে যমুনা সেতুর সমান; তবুও এসেছি যখন এখানেই খাব, হোক দেরি, আয়তলোচনের শাস্তি হোক একটু। এখানকার খিচুড়িটা বেশ ভালই লাগল, তবে মাংসে অতিরিক্ত ঝাল- এখনো মুখ দিয়ে গরম নিশ্বাস বের হচ্ছে। কিছুক্ষন আগে ক্যাফেটেরিয়ার এক পিচ্চিকে প্রচণ্ড ধমক দিয়েছি একটা- পানি দিতে এত দেরি করে এরা; যাইহোক পুলিশ আর পিচ্চি- দুটো লিখতেই ‘প’ লাগে; প্রথমোক্তের সাথে না পারি, ২য় জনকে তো কথা শোনাতে পেরেছি- এই আমার পরম আনন্দ।
এতবড় ক্যাম্পাসে কোথায় যে খুজি_ সাহস বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই আয়তলোচনের বুদ্ধিমত্তা আশঙ্কাজনকহারে লোপ পেয়েছে। ওদিকটায় এত ছুটোছুটি কিসের; মারামারি বেধে গেল নাতো?হায় হায়, এই অপরিচিত ক্যাম্পাসে এখন কোথায় লুকাই, এখানকার মানুষগুলোও তো ওদিকেই ছুটছে! যা থাকে কপালে, আল্লাহর নামে ওদের সারথী হই। ......Are my eyes deceiving me, is it fiction or something like day dreaming? এ কি সত্য, সকলি সত্য?ভদ্রস্থ পোশাকের একজন মাঝবয়সী মানুষ উদভ্রান্তের মত ক্যাম্পাসময় ছুটে বেড়াচ্ছে- তার সমস্ত মুখমণ্ডল মৌমাছিতে ছেয়ে গেছে, মাথার উপর দিয়েও উড়ছে অজস্র মৌমাছি। আমার সমস্ত শরীরে কাপুনি দিয়ে উঠল; রিপ্লিজ বিলিভ ইট অর নট অনুষ্ঠানে একবার এধরনের কর্মকাণ্ড দেথেছিলাম, আজ দেখলাম সচক্ষে!কিছুক্ষণের মধ্যে লোকটি বেহুশ হয়ে পড়ে গেল, তার সমস্ত দেহাবয়ব এখন মৌমাছির মহাসম্মিলন কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। আমি বরাবরই কৌতুহলশুন্য মানুষ, তাই এই পরিবেশে নিজেকে বেমানান মনে হচ্ছে; মীর মোশাররফ হলে আমার বন্ধু থাকে, ওখানে চলে যাচ্ছি।
তবে আজকের দিনটা আমি লেমিনেট করে রাখব- জীবনের সব অতিপ্রাকৃতিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিচিত করানোর জন্য ঈশ্বর আজকের দিনটিই বেছে নিলেন!........ আরে আরে ওইতো আয়তলোচন- কী আয়েশী ভঙ্গিতে চা খেয়ে যাচ্ছে, এখন আবার পুরুষুরুপে ফিরে এসেছে। সম্ভবত আমাকে দেখতে পেয়েছে; চায়ের বিল শোধ করে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে .......
-কী, সার্কাস কেমন দেখলেন?
-মানুষের দুরবস্থা নিয়ে রসিকতা করবেননা আয়তলোচন, আহারে লোকটা বাচবে তো?(আয়তলোচন খুবই দৃষ্টিকটুভাবে হেসেই চলেছে এবং হাসির মধ্যেই কথোপকোথন চালিয়ে যাচ্ছে)
- আপনার মত বোকা এবং ভীতু লোক ‘প্রতিবাদের’ অনুষ্ঠানে কী করতে আসে কিছুতেই বুঝলাম না। (হাসি থামিয়ে)আপনি কি ‘নরপশু’ শব্দটির সঙ্গে পরিচিত? না হলে ঐ লোকটাকে আবার দেখে আসুন। সুধীমহলে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে পরিচিত। অথচ শিক্ষক শব্দটির আপেক্ষিক গুরুত্ব তার উপলব্ধির বাইরে।
আমি বাস থেকে নেমে উনার সঙ্গেই দেখা করতে গিয়েছিলাম নারী হয়ে!গিয়ে বললাম আমি অন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেছি, উনার অধীনে এমফিল করতে চাই...। বিশ্বাস করুন, সে আমার সঙ্গে যতক্ষণ কথা বলছিল তার চোখ দুটি সর্বক্ষণ আমার শরীরের একটি বিশেষ অবস্থানেই স্থির হয়ে ছিল। এটুকু সময়েই যদি এই অবস্থা হয়, যেসব ছাত্রীকে সে বারোমাস তত্ত্বাবধান করছে, তাদের আবস্থাতো বুঝতেই পাচ্ছেন! তাই আমিও দেরি করিনি, একেবারে তার সারামুখ থুথুতে সয়লাব করে দিয়েছি। কিন্তু এই মৌমাছির ব্যাপারটায় আমি নিজেও হতবা্ক; আমার থুথুর সঙ্গে মধু মিশ্রিত ছিল নাকি???
আয়তলোচনকে এখন আমার ভয় করছে; দুজন একই রিক্সায় পাশাপাশি যাচ্ছি, কিন্তু ওকে কিছু জিজ্ঞাসা করার মত সৎসাহস পাচ্ছিনা। তবে এটাও ঠিক, ওই লোকটির প্রতি আমার সমস্ত সহানুভুতি বিতৃষ্ণায় রুপ নিয়েছে; এরকম দু’একজন কুক্ষকের(!) জন্য শিক্ষকের বিশ্বাসযোগ্যতা আজ প্রশ্নবিদ্ধ!ইস, আমি কেন ঐ লোকটার মুখে থুথু দিতে পারলাম না! আয়তলোচন, তুমি আবার আমায় হারিয়ে দিলে, অবশ্য আমি তোমার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করারই তো যোগ্যতা রাখিনা।
যাইহোক, বিকালের ক্যাম্পাস যেন এক টুকরো কাশ্মীর, এখানে না এলে সৌন্দর্যের একটি আলোকিত ভুবন আমার অদেখাই রয়ে যেত; এই মুহুর্ত আমরা দুজনে মিলে একটা সিগারেট টানছি, সিগারেটের সৌজন্যে হলেও যদি আয়তলোচনের কিছুটা উত্তাপ আমার মধ্যে সঞ্চারিত হয়!
“প্রতিবাদের” শিক্ষার্থীদের স্বতস্ফুর্ততায় আমি মুগ্ধ। সবকিছুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা সম্ভব নয়,তবুও তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা অন্যদেরকে উৎসাহিত করবে প্রতিবাদ করতে। দেশবরেণ্য বেশকিছু বুদ্ধজীবীকে এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমি অবশ্য বুদ্ধজীবী নই, facebook এ এই শিক্সার্থীদের ‘প্রতিবাদ’ নামে একটা গ্রুপ আছে;মুলত সেই সুত্রেই আমার এবং আয়তলোচনের এই ভ্রমণবিলাস। .......অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে, মঞ্চে দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবীরা বসে আছেন।
আমি বসে আছি দর্শকসারির পিছনের দিকে, আর আয়তলোচন সামনের সারিতে, কারণ পিছনে বসলে বক্তার চেহারা অস্পষ্ট লাগে: তাতে নাকি বক্তব্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করা যায়না। আয়তলোচনের হাতে একটি পলিথিনের ব্যাগ দেখতে পাচ্ছি, এর ভেতরে কী আছে কে জানে!.......সত্যি বলতে কি, বুদ্ধজীবীদের বক্তব্যে আমি মুগ্ধতার পরিবর্তে হতাশ হচ্ছি বেশি; সেইসব চিরন্তন কথা-বার্তা : “ আমাদের সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, সামাজিক মুল্যবোধ গড়ে তুলতে হবে, দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে হবে............’ কথা বলতে হয় তাই বলা, আমি এইসব বক্তব্যে কোন সুচিন্তার বহিপ্রকাশ পাচ্ছিনা; অসহ্য......!আরে আচমকা বক্তব্য থেমে গেল কিভাবে?মনে মনে যা ভেবেছিলাম, তা্-ই হয়েছে: আয়তলোচন মাইকের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে!মঞ্চের আশেপাশে শোরগোল সৃষ্টি হলেও আয়তলোচন সবাইকে ঠেলে মঞ্চে উঠে পড়েছে। তার হাতের পলিথিন থেকে ভেতরের বস্তুটি বের করে ফেলেছে সে- দেখে ধারণা করছি গোলাপজল জাতীয় কিছু একটা হবে। হু তাইতো... উপস্থিত শিক্ষার্থীদের মাথায় আয়তলোচন গোলাপজল ছিটিয়ে দিচ্ছে, এ আবার কেমনতর উন্মাদনা!........আড়ম্বরপুর্ণ অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, তবে অনুষ্ঠানস্থলের বাতাসে এখনো গোলাপজলের সুবাস ভেসে বেড়াচ্ছে। আমার জীবনের আশ্চর্যতম দৃশ্যটি আমি এখন অবলোকন করছি: এক্ই চেহারার মানুষ জোড়ায় জোড়ায় বসে আছে এখানে; গোলাপজলের স্পর্শে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মধ্য থেকে আর একটি ভিন্ন মানুষের সৃষ্টি হয়েছে! এই নতুন মানুষগুলোর একহাত মুষ্টিবদ্ধ, অন্যহাত বুকের কাছে।
এই ছবিটি কোনভাবেই হারিয়ে যেতে দেয়া চলবেনা, আমি কালই এটা facebook এ upload করব। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমার তো ক্যামেরা মোবাইল নেই, এ্ই অচেনা পরিবেশে কোথায় পাব ক্যামেরা মোবাইল???
........................................................................................................................আসসালামু আলাইকুম, সবাইকে স্বাগতম জানাচ্ছি আমি আয়তলোচন। এই মুহুর্তে আমি দাড়িয়ে আছি নবীনগর বাসস্টপেজে, ঢাকার ফিরতি যাত্রায়। আপনাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে আমার সঙ্গে পদ্মলোচন নামে যে ব্যক্তিটি গত ২দিন ভ্রমণসঙ্গী হিসেবে ছিলেন কিছুক্ষণ আগে তার মৃত্যু হয়েছে। আপনারা ইতোমধ্যেই অবগত আছেন যে আমি ছিলাম তারই বিকল্প সত্তা।
যেহেতু তার মত ভীরু মানুষ পৃথিবীর আলো-হাওয়া অপব্যবহার করা ভিন্ন কোন কাজে আসছেনা, তাই প্রকৃতিই তাকে অপসারণ করে আমাকে তার স্থলাভিষিক্ত করেছে। আমি এখন আর লিঙ্গ সংকটে ভুগিনা, আমি পুরোমাত্রায় একজন পুরুষ। একটা কথা আপনাদের জানিয়ে রাখা প্রয়োজন বোধ করছি: আপনারা যেসব মানুষ দেখছেন, এমনকি আপনি নিজেও একজন “ছায়ামানুষ”। আসল মানুষটি আপনার ভাবনার গভীরে ঘুমিয়ে আছে!এ পৃথিবীর আপনাকে কোন প্রয়োজন নেই; আপনি আধারে গিয়ে আসল মানুষটিকে আলোতে আসতে দিন,‘ছায়া মানুষ’কে প্রতিরোধ করুন। ......আমার বাস চলে এসেছে, আজ এ পর্যন্তই; আল্লাহ হাফেজ।
।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।