অতি দক্ষ মিথ্যুক না হলে সত্যবাদিতা উৎকৃষ্ট পন্থা
অতিবিপ্লবী মনোভাব, যেকোনো মতকে প্রতিষ্ঠা এবং যেকোনো মতকে নাকচ করবার প্রাণান্ত লড়াইয়ে যখন স্বাভাবিক যৌক্তিক আলোচনার পন্থা থাকে না তখন সেই স্বৈরাচারী বক্তব্যে মূলত মৌলবাদীরাই উপকৃত হয়।
অনেক রকম মতধারা রয়েছে, বিশ্লেষণ এবং প্রায়োগিকতার ভিত্তিতে যদি বিজ্ঞানকেও আমি দেখতে চাই তাহলেও সকল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিই ধারাবাহিক ভুলের ভেতর থেকেই শুদ্ধ হয়ে উঠে। নির্ভুল বিজ্ঞান বলে কিছুর অস্তিত্ব সম্ভবপর নয়, বরং আমাদের অনুমাণের নির্ভূলতা কিংবা যথার্থতা প্রতিপাদ্য বিষয় হয় অনুসন্ধানে।
বিজ্ঞান বিষয়ে অন্ধ ভক্তি এবং বিজ্ঞান বিষয়ে অভক্তি দুটোই সমান রকম বিপদজনক প্রবণতা। বিজ্ঞান একটা চলমান বিষয়, এখানে সম্মলিতি ভাবে সবাই অবদান রাখে, এবং এই অবদান রাখতে গিয়ে তারা পূর্ববর্তীদের অনুমাণকে যথার্থ ভেবে নিয়েই একটা চিন্তনপদ্ধতি অনুসরণ করে।
সচলায়তনে অভিজিৎএর লেখায় আমি এই প্রবনতা খুঁজে পেলাম না, অবৈজ্ঞানিক একটা লেখায় অভিজিৎ মার্ক্সবাদের বৈজ্ঞানিকতা খুঁজবার প্রায়স নিয়েছেন। তাকে অভিনন্দন, তবে বাতাস হাতড়ে সারবস্তু খুঁজে পাওয়া কঠিন।
তার অনাবশ্যক বিশাল নিবন্ধের পয়মাল পাড়ি দিয়ে মূল বক্তব্যে পৌঁছানোর চেষ্টা ছিলো আমার। যে কথা কয়েক প্যারাগ্রাফে সমাপ্ত করা যেতো সেই সমাপ্তিতে না পৌঁছে তার লক্ষ্য ছিলো পাতার পর পাতা এমন কিছু লিখে যাওয়া যা অনাবশ্যক আড়াল তৈরি করতে সক্ষম হতে পারে।
বৈজ্ঞানিক চিন্তনপদ্ধতি সম্পর্কে অভিজিৎএর ধারণা রয়েছে এমনটা ধরে নিয়েই কথা বলা শুরু করি, তিনি অনেক বিজ্ঞানময় প্রবন্ধ রচিয়াছেন, তাই তার চিন্তন পদ্ধতির অবৈজ্ঞানিকতা প্রকাশিত হলে সেটা মূলত উদ্দেশ্যমূলক একটা পদ্ধতি অবলম্বন।
এটাও একটা প্রয়োগিক বিষয় বিবেচিত হতে পারে । আমি আমার যুক্তি কিভাবে সাজাবো, কাকে উদ্দেশ্য করে, কার পক্ষে কখন কোন যুক্তি এবং উদাহরণের তূণ সাজাবো সেটা আমি নিজেই সচেতন ভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহন করি, এই সিদ্ধান্ত গ্রহন প্রক্রিয়ায় অনেক কিছুই আমাদের প্রভাবিত করতে পারে, অর্থের লোভ, সম্মানের লোভ, একটু আলাদা একটু মানবিক হয়ে উঠবার লোভ-
আমি এখনও নিশ্চিত নই অভিজিৎএর লোভ শেষ পর্যন্ত কি? অভিজিৎএর একটা চাহিদা কিংবা উদ্দেশ্য রয়েছে বলেই এই উদ্দেশ্যমুখীনতাকে প্রশ্ন করা উচিত মনে হয়েছে আমার।
অভিজিৎএর জন্য সামান্য বৈজ্ঞানিক সূচনা- যে কোনো প্রকল্প শুরুর কিছু প্রারম্ভিকা থাকে- একটা সংশয় কিংবা অনুসিদ্ধান্ত গ্রহনের পরেই আদতে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানের সূচনা হয়-
আমি পূর্বেই একটা কিছুকে নাকচ করবো বলেই প্রকল্প শুরু করি, প্রকল্পের সমাপ্তিতে দুটো সম্ভবনা বিদ্যমান থাকে, হয় আমার অনুসিদ্ধান্ত ভ্রান্ত প্রমাণিত হতে পারে এবং দ্বীতিয় সম্ভবনা আমার অনুসিদ্ধান্ত ভ্রান্ত নয় বরং প্রচলিত বৈজ্ঞানিক বিশ্বাসে কিছুটা ভ্রান্তির সম্ভবনা রয়েছে। তাই প্রতিটা অনুসন্ধানের শেষে কিছু অনুমিতি থাকে, ভবিষ্যত পরিকল্পনা থাকে।
ডিটারমিনিস্টিক ঘারানা, আর প্রবালিস্টিক ঘারানার ভেতরেও বৈজ্ঞানিকতার দ্বন্দ্ব দেখা যায়।
তবে বৈজ্ঞানিক চিন্তন সব সময়ই সাম্ভাব্যতা যাচাই করে। তারা নিসংশয়ে কিছু বলে না বরং সামান্য একটু সংশয়ের অবকাশ রাখেই। অভিজিৎএর চিন্তন পদ্ধতিতে বরং স্থির সিদ্ধান্ত গ্রহনের একটা প্রবনতা রয়ে গেছে। সংশয়বাদী অবস্থানে নয় বরং স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেই তার বক্তব্য শুরু হয়।
যেকোনো বৈজ্ঞানিক পরীক্ষণের সমাপ্তি একটু আশাবাদী সংশয় রাখে, আমাদের জ্ঞানের কিংবা পরীক্ষণের সীমায় এই প্রচলিত বৈজ্ঞানিক ধারণার কোনো বিচ্যুতি চোখে পড়ে নি তবে সেটা আমাদের পরীক্ষণ নির্ধারিত সীমায় অপ্রমাণিক, হতে পারে আমাদের পরীক্ষণ আরও নিখুঁত হলে সামান্য বিচ্যুতি লক্ষ্যনীয় হতেও পারে।
এই সংশয়টুকুই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির জয় চিহ্নিত করে আদতে। তারা কোনো কিছুকেই অগ্রাহ্য বিবেচনা করে না, বরং এটা সত্য না হওয়ার একটা সীমা নির্ধারণ করে দেয়। এবং কোনো প্রচলিত সত্যকেও অভ্রান্ত ধরে নেয় না বরং একটা সসীমতায় এটাকে অভ্রান্ত বিবেচনা করে।
অভিজিৎএর লেখা প্রসঙ্গে আসি, সমাজ বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে মার্ক্সের অনুমাণ কিংবা মার্ক্সের চিন্তন পদ্ধতি বৈজ্ঞানিক কি না এটাই ছিলো তার প্রশ্ন এবং তার বিশাল মজমার সমাপ্তিতে তার সিদ্ধান্ত মার্ক্সবাদ বিজ্ঞান নয়, বিজ্ঞান হবার তার দরকারও নেই। কিন্তু মার্ক্সবাদ থাকুক হাজারো নিপীড়িত মানুষের হৃদয়ে মুক্তির আলোকবর্তিকা হয়ে।
এই সিদ্ধান্তটুকু দিতে গিয়ে তার অনেক উদাহরণ টানতে হয়েছে, সম্পূর্ণ আলোচনাই আদতে মার্ক্সবাদের সমালোচনা নয় বরং এর প্রায়োগিকতা ভুলের উদাহরণ। বিজ্ঞানকে তার প্রায়োগিক অবস্থান থেকে আলাদা দেখতে না পারবার ব্যর্থতা চিন্তনের অবৈজ্ঞানিকতা, বিজ্ঞাদের দায় কিংবা দোষ নয় আদতে। আণবিক বোমা সৃষ্টির সম্ভবনা বৈজ্ঞানিক একটি ধারণা, পরমাণু থেকে ফিশন প্রক্রিয়ায় এত পরিমাণ শক্তি উৎপাদন সম্ভব এটাকে নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব এবং এটাকে অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার করে সৃষ্টির বিনাশ সম্ভব, কথা হলো যেই বিজ্ঞানীরা এই সম্ভবনাটুকু বিবেচনা করে এটাকে গাণিতিক ভাবে প্রকাশিত করেছিলেন তাদের অনুমাণের এই প্রায়োগিক ভিত্তিটাতে তাদের দায় কিংবা দোষ কতটুকু?
মার্ক্স একটা সমাজ বিশ্লেষণের পন্থা আবিস্কার করেছিলেন, মহা মন্দার সময়ে কেনো মার্ক্সের অনুমান ভ্রান্ত প্রমাণিত হলো এটা মার্ক্সের চিন্তন পদ্ধতির অবৈজ্ঞানিকতা নয় বরং আবারও পরিস্কার করে বলি এটা বিশ্লেষণের ভ্রান্তি।
শ্রমিক, অর্থনৈতিক চক্র এবং ক্ষমতার চর্চা আর নানাবিধ বাগবিধি যা আমাদের চিন্তনপদ্ধতিকে নিয়ন্ত্রন করে সেটার বাইরে গিয়ে আমার স্বল্প জ্ঞানে আমার উপলব্ধি বর্ণনা করি-
সমাজে পরিবর্তন ঘটে- সমাজের পরিবর্তনগুলো এলেমেলো কিছু নয় বরং এই প্রতিটা পরিবর্তনের পেছনে কিছু সূত্র আছে। প্রতিটা পরিবর্তনের আগে প্রচলিত সমাজের কিছু মানুষের ভেতরে পরিবর্তনের আকাঙখা তীব্র হয়েছিলো, তারাই এই পরিবর্তনগুলোকে সমর্থন করে এটাকে চুড়ান্ত সমাপ্তিতে পৌঁছে দিয়েছে।
পরিবর্তনগুলো কি পূর্বে অনুমাণ করা যায়, কিংবা পরিবর্তনগুলো কি নিয়ন্ত্রনযোগ্য, আমরা কি এই পরিবর্তনের নিয়ামকগুলোকে যাদৃচ্ছিক ম্যানিপুলেট করতে পারি? মার্ক্সের ধারণা সঠিক হলে এই পরিবর্তনের নিয়ামকগুলোকে ম্যানিপুলেট করা সম্ভব।
প্রতিটা পরিবর্তনের পেছনে কিছু অনুপ্রেরণা কিছু প্রেষণা বিদ্যমান, সেই পরিবর্তনের সহযোগী প্রেষণাকে রদ করে সেটার বিরোধী কিছু প্রেষণা প্রদান করলে পরিবর্তন থেমে যাব. রাজনীতি বিশ্লেষণে এই দ্বান্দ্বিক সম্পর্কগুলো সব সময়ই একটা সমাধানে পৌঁছানোর জন্য সহায়ক।
সমাজ পরিবর্তন যে অলৌকিক অদ্ভুত কোনো ঘটনা নয়, এই বিষয়টুকুর উপলব্ধি মার্ক্সের সবচেয়ে বড় সাফল্য- ধর্মের উদ্ভবও মার্ক্সের চিন্তনপদ্ধতি অনুসারে ব্যখ্যা করা সম্ভব, এবং ধর্মের প্রায়োগিক ব্যবহারের জায়গাগুলো কিভাবে শোষণে সহায়ক হয়েছে এই ধারণাটুকুও মার্ক্সের বিশ্লেষণ থেকে অনুমাণ করা সম্ভব।
মানুষকে শোষণের স্বরুপ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা দিলে তারা শোষণের স্বরুপ ধরতে ব্যর্থ হবে এবং শোষণকে উচ্ছেদ করতে গিয়ে সমাজে পরিবর্তনের সূচনা করবে কিংবা শোষণ এড়াতে পারবে না। ভাববাদীতার সমস্যাটুকু এখানেই।
অভিজিৎ এখানে এই সমাজপরিবর্তনের প্রেষণা এবং মার্ক্সের চিন্তনপদ্ধতিকে অনুসরণ না করে এটার প্রায়োগিক দিকগুলো দিয়ে মার্ক্সকে যাচাই করবার একটা প্রচেষ্টা গ্রহন করেছেন। সমস্যাটা সেখানেই তৈরি হয়, সেখানেই মনে হয় সমাজতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে।
সমাজতন্ত্রের ব্যর্থতা মার্ক্সের চিন্তনধারার অবৈজ্ঞানিকতার প্রমাণ নয়, বরং সমাজ বিশ্লেষণে চিন্তকের ভ্রান্তির প্রমাণ। প্রতিটা সমাজ কাঠামোর নিজস্বতা বিবেচনা করে সেই অনুযায়ী মার্ক্সের চিন্তন পদ্ধতিকে প্রয়োগ করতে হয়। সকল রোগের একই ঔষধ বলে এই সমাজপরিবর্তনের ধারণায় কিছু নেই।
চীনের সমাজতন্ত্রের উন্মেষ, এর ভ্রান্তি এর ভেতরে সংশোধন এবং এর ক্রমবিবর্তন থেকে চীনকে শংকর সমাজতন্ত্র যারা বলছেন তারা হয়তো তাদের বিচারে সঠিক, তবে শেষ পর্যন্ত আমার বক্তব্য হলো, চীন রাষ্ট্র হিসেবে তার নাগরিকদের কি সুবিধা প্রদানের অঙ্গীকার করেছিলো সেই অঙ্গীকার কি চীন পুরণ করতে পেরেছে?
যদি চীন নাগরিক অধিকার পুরণা সফল হয় , যদি চীনের নাগরিক তাদের সমাজব্যবস্থা এবং জীবনযাপন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে তবে চিনে নতুন কোনো বিপ্লব হবে না, কিন্তু যদি কোনো অসন্তোষ বিদ্যমান থাকে তবে চীন একটা পর্যায়ে নিজের সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠানো পরিবর্তনের আকাঙ্খা নিজের ভেতরেই খুঁজে পাবে এবং তখন চীন নতুন কোনো একটা সমাজপরিবর্তনের দিকে অগ্রসর হবে।
সামাজিক পরিবর্তনের এই প্রবনতাটুকু রাষ্ট্র কতটুকু নিয়ন্ত্রন করতে পারে? মার্ক্সের প্রায়োগিক দিকটা বাদ দিয়ে তাত্ত্বিক দিকটা বিবেচনা করলে জনগণের অসন্তোষের কারণ যথার্থ অনুমাণ করতে পারলে যেকোনো বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব। উপযুক্ত পন্থা আছে এই পরিবর্তন রদ করবার এবং এই পন্থাটুকুও আসলে সেই বিবেচনায় মার্ক্সের অবদান। শেষ পর্যন্ত সমাজ বিশ্লেষণের অন্য কোনো পদ্ধতি কি আমাদের হাতে আছে?
অভিজিৎএর অভিযোগের জবাবেই বলি, যেকোনো মতবাদই সর্বগ্রাসী এবং স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে উঠবার প্রবণতা ধারণ করে, আমাদের মানসিকতার গড়ন এ জন্য দায়ী, তত্ত্ব এর জন্য মোটেও দায়ী নয়, তত্ত্বের প্রায়োগিক ভঙ্গি এবং কারা ক্ষমতায়, তাদের অভিসন্ধি নির্ধারণ করে এর সর্বগ্রাসী, এবং স্বৈরতান্ত্রিক ভাববাদী হয়ে উঠবার প্রবণতাকে।
মার্ক্সের মতবাদকে ধর্মীয় প্রবনতাযুক্ত না বলে বলা যায় এর প্রায়োগিক কাঠামোতে যারা এই মতবাদকে সমাজপরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে আগ্রহী তাদের মানসিকতা এবং তাদের প্রায়োগিক দক্ষতার উপরে নির্ভর করবে তারা দ্বান্দ্বিক এবং পরিবর্তনশীল সমাজ , মানুষ এবং মানসকে নিয়ন্ত্রন এবং দমনের জন্য কতটা পরিপক্কতার সাক্ষর রেখেছেন তার উপরে।
তাই রাশিয়ায় যখন সমাজতন্ত্র কায়েমের নাবে নির্বিচার সহিংসতা চলে তখন সেটা মার্ক্সের ভুল নয় বরং যেই মানুষগুলো সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা করে তাদের ভুল এবং তাদের ভ্রান্তি।
নিউটনের গতিসূত্র দিয়ে কেউ যদি অনড় বস্তুর ত্বরণ মাপতে চায় তবে সেটা সব সময়ই শূন্য হবে কিন্তু কেউ যদি দাবি করে আদতে অনড় বস্তুর মহাবিশ্বের সম্প্রসারণজণিত ত্বরণের উপস্থিতি নিউটনের তরিকার নির্ধারণ করা সম্ভব তবে তাকে বড়জোর বলা যায়, একটু ঘুমান ভাই, না ঘুমিয়ে আপনার ভাবনার জগত এলোমেলো হয়ে গেছে।
অভিজিৎকে কি বলবো?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।