হিমাদ্রি শেখর ভদ্র :
বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের জনপ্রিয় ধামাইল গানের জনক রাধারমন
জলে গিয়াছিলাম সই কালো কাজলের পাখি দেইখা আইলাম কই! ভাইবে রাধারমণ বলে.....
বাউলিয়ানা ভাটির জনপদ সুনামগঞ্জ জেলা। এজনপদের বাউল বাতাসের উড়ে বেড়ায় মন উদাস করা বাউল গানের সুর। সুবিশাল ভটিবাংলার জলস্থল আকাশবাতাস বৃরাজি মাটি ও মানুষ মনের অনেকটা মনের অজান্তে গেয়ে ওঠে বিভিন্ন বাউলের রচিত গান। এক ভিন্ন প্রকৃতির অকৃত্রিমটানে তারা বেছে নেন মাটি মানুষের কাছাকাছি বাউল গান কে। কোন এক পুর্ণিমা রাতে ভাটি বাংলার জরাজীর্ণ বসতবাড়ির আঙ্গিনায় ঢোল, ঢ¹ি, একতারা,সরোদ ও বেহালার মতো অত্যন্ত সাদামাঠা বাদ্যযন্ত্র নিয়ে বসে জম জমাট বাউল গানের আসর।
মূহূর্তের মধ্যে ছোট্ট আঙ্গিনাটি পরিণত হয় জনারণ্যে। এরকমই হলো সুনামগঞ্জের অতিসাধারন গ্রামগঞ্জ আরটিই এখানার চিরন্তন রূপ। মাত্র কয়েক দিন আগে যে শিশুটি জন্ম নিয়েছে সেও তার পুর্বসুরীদের মতোই তার পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় বাউল গানের একজন সমজদার শ্রোতায় পরিণত হয়। সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর উপজেলা তেমনি একটি বাউলিয়ানা লোকালয়। নলুয়ার হাওর আর নলজুর নদী জহন্নাথপুরের মানুষকে পুরোপুরি বাউল কওে গড়ে তোলেছে।
লোকসংগীতের প্রাণপুরুষ সহজিয়া সাধক রাধারমণ দত্তের জন্মস্থান এজগন্নাথপুর। তিনি ছাড়াও জগন্নাথপুরের মাটিতে জন্মগ্রহণ করেন কালু শাহ, আছিম শাহ,শাহ সৈয়দ হোছন আলম, সৈয়দ শাহপুর, মরমী কবি সৈয়দ আসহার আলী চৌধুরী সহ প্রমুখ বাউল। জগন্নাথপুর বাউলের সংস্কৃতিতে অত্যন্ত সমৃদ্ধশালী একটি স্থান। বহু লোককবি, গীতিকার, সাধু-সন্ত, সন্যাসী তাদের অমর রচনাবলীতে বাংলার লোকসংগীত ও সংস্কৃতির সুবিশাল ভান্ডার করেছেন। বাউল সাধকগণ তাদের নিজ নিজ মতবাদের ধারায় বাংলার মরমী সংগীতে উজ্জ^ল কৃতিত্বের স্বার রেখেছেন।
তাদের অমর সৃষ্টি মরমী গানের মধ্য দিয়ে যে অমৃত রসের সুরধারা বইয়ে দিয়েছিলেন তা আজও সাধারণ মানুষের প্রাণসঞ্চার করে। তারা মনের সুখে হয়তবা দুঃখে অনেকটা আপন মনে গেয়ে ওঠেন হাছন রাজা, রাধারমণ, শাহ আব্দুল করিমের রচিত কোন বাউল গান। বাউল গানের মধ্যদিয়ে তারা জয় করে নিতে চান জীবনের দুঃখ কষ্ট । লোকসংগীতের পুরোধা লোককবি রাধারমণ দত্ত ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে ১২৪১বাংলায় সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার আতুয়জান পরগনার কেশবপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা রাধামাধব দত্ত, মাতা সুর্বণাদেবীও ছিলেন বিদগ্ধজন।
কৈশরে রাধারমণ পিতৃহারা হন আর অনেকটা একারণে কিশোর বয়স থেকে রাধরমণ জগতের সৃষ্টিত্বত্ত নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং সৃষ্টিকর্তার স্বরূপ অনুসন্ধানে মনোনিবেশ করেন বিভিন্ন মতাবাদে। জগতের সৃষ্টিত্বত্তেবর প্রতি বিশেষ আগ্রহী হয়ে তিনি বিভিন্ন সাধুসন্তের দেয়া আদেশ উপদেশ অরে অরে পালন করতেন। এই ধারাবাহিকতায় তিনি মৌলভীবাজার এর ঢেউপাশা গ্রামের সাধক রঘুনাথ গোস্বামীর সাধন ভজনের কথা জ্ঞাত হয়ে তিনি তার শিষ্যত্ব ও দীা গ্রহণ গ্রহণ করেন। তারপর তিনি শাক্ত, বৈষ্ণব, শৈব মতবাদের উপর ব্যাপক পড়াশুনা করেন। সর্বশেষে তিনি সহজিয়া মতে সাধন ভজন করেন।
বাড়ির পাশে নলুয়ার হাওরের একটি উন্মুক্ত স্থানে পর্ণকুঠির তৈরী করে একনিষ্ঠ মনে সাধন ভজন করতে থাকেন। তিনি শ্রীকৃষ্ণভাবে বিভোর হয়ে রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলা (রাসলীলা) নিয়ে গান রচনা করেন। তিনি ভজন সংগীতে বিভোর হয়ে গান গাইতেন রাধারমণ তাঁর মুখ নিঃসৃত বাণী শিষ্যগণ কাগজে লিখে রাখতেন। একারণে তাঁর নিজ হাতে রচিত গানের কোন পান্ডুলিপি নেই। কারণ তিনি তাৎনিকভাবে ভাবরসে বিভোর হয়ে গীতরচনা করতেন।
কবি রাধারমণের পুরো পরিবারের পারিবারিক জীবন ধারায় বৈষ্ণব ও সুফীবাদের প্রভাব ছিল। পারিবারিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় উপাসনার প্রধান অবলম্বন সংগীতের সংগে তাঁর পরিচয় ছিল শৈশব থেকেই। খ্যাতিমান লোককবি জয়দেবের গীতগৌবিন্দ এর বাংলা অনুবাদ করেছিলেন তার পিতা রাধামাধব দত্ত। পিতার সংগীত ও সাহিত্য সাধনা তাকেও প্রভাবিত করেছিল। তাঁর মধ্যে শৈশব, কৈশর, যৌবন ও পরিণত বয়সে সে ধারাবাহিকতা তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল।
রাধারমণ এঅঞ্চলের বিখ্যাত মরমী সাধক ও লোককবি হাছন রাজা থেকে বয়সে প্রায় ১৪/১৫ বছরের বড় ছিলেন। বয়সের এতো ব্যাবধান সত্বেও তাদের মধ্যে খুব হৃদ্যতাপুর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান ছিল। লোকমুখে কথিত আছে, হাছন রাজা রাধারমণকে তার সুনামগঞ্জের বাড়িতে দাওয়াত করে ছিলেন। লোককবিতার ভাষায় তিনি আহবান করেছিলেন ‘রাধারমণ আছো কেমন ? হাছন রাজা জানতে চায়। ’ পত্র প্রাপ্তির পরে রাধারমণ তাঁর বাড়িতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েও একটি অসুবিধার কারণে যেতে না পেরে লিখেছিলেন-‘গানের সেরা রাজা হাছন, পেলাম না তার চরণদর্শন, বিফলে দিন গেল গইয়া।
’
তাঁর রচিত বাউল ও ধামইল গান সিলেটের আঙ্গিনা পেরিয়ে পুরো বাংলাদেশ ও র্বহিঃবিশ্বেও স্থান কওে নিয়েছে। প্রান্থ জনের গান হিসেবে বাউল গানের অমৃতরস দ্বারা মানুষের মনে ঠাইঁ করে নিয়েছেন রাধারমণ। বিভিন্ন সময়ে সাধক রাধারমণের গানের বেশ কিছু গানের বই বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। অধ্যাপক যতীন্দ্র মোহন ভট্টাচার্য প্রথমে রাধারমণ দত্তের গান সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এছাড়া গুরুসদয় দত্ত, ডঃ নির্মলেন্দু ভৌমিক,আব্দুল গফফার চৌধুরী, কেতকী রঞ্জন গুণ,মুহাম্মদ আব্দুল হাই, অধ্যাপক মুহম্মদ মনসুর উদ্দীন, হুছন আলী, সৈয়দ মুরতাজা আলী, নরেশ চন্দ্র পাল, যামিনী কান্ত র্শমা, মুহম্মদ আসদ্দর আলী, মাহমুদা খাতুন, ডঃ বিজন বিহারী পুরকাস্থ, সৈয়দ মুস্তফা কামাল, মোঃ আজিজুল হক চুন্নু, জাহানারা খাতুন, নরেন্দ্র কুমার দত্ত চৌধুরী, অধ্যাপক সুধীর চন্দ্র পাল, অধ্যাপক দেওয়ান মোঃ আজরফ ,শামসুর করিম কয়েস সহ আরও অনেক বিদগ্ধজন রাধারমণ দত্তের গান সংগ্রহ করে রেখেছেন।
মুন্সী আশরাফ হোসেন সাহিত্যরতœ ‘রাধারমণ সঙ্গীত‘ নামে ও সুনামগঞ্জের মরহুম আব্দুল হাই ‘ভাইবে রাধারমণ বলে’ নামে বই প্রকাশ করেছেন। প্রখ্যাত লোকতত্ত্ববিদ চৌধুরী গোলাম আকবর রাধারমণের প্রায় চল্লিশ বছরের সংগ্রহের গানগুলো নিয়ে সিলেট মদন মোহন কলেজ সাহিত্য পরিষদের মাধ্যমে একটি বই প্রকাশ করেন। এতে তার তিন শতাধিক গান স্থান পায়। রাধারমণের বেশ কিছু গান বাংলা একাডেমীর সংগ্রহেও রয়েছে।
বিভিন্ন সংগ্রাহকদের মতে, রাধারমণে গানের সংখ্যা তিন হাজারেরও উপরে।
রাধারমণ দত্ত একাধারে গীতিকার, সুরকার, শিল্পী, ও একজন ভাল চরিত্র অভিনেতা ছিলেন। রাধারমণ সম্পর্কে অনেক আলৌকিক কথাও লোকমুখে শোনা যায়। কথিত আছে, রাধারমণ ভাবে শ্রীকৃষ্ণভাবে বিভোর হয়ে গান রচনা করতেন। শিষ্যরা শুনে তা লিখে রাখতেন। তিনি তত্ত্ব সঙ্গীত, দেহতত্ত্ব, ভক্তিমূলক, অনুরাগ, প্রেম, ভজন, বিরহ, ধামাইলসহ নানা ধরণের গান রচনা করেছেন।
আবহমান গ্রামবাংলার বিয়েশাদীতে রাধারমণের ধামাইল গান খুব জনপ্রিয়। দুই বাংলার বেতার ও টেলিভিশনে রাধারমণের গান প্রায়স প্রচারিত হচ্ছে। ইদানিং বাংলা সিনেমাতে রাধারমণের বেশ কিছু গান সংযোজিত হয়েছে। ভ্রমর কইও গিয়া শ্রীকৃষ্ণ বিচ্ছেদেও অনলে অঙ্গ যায় জ্বলিয়ারে ভ্রমর কইও গিয়া সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গানের জনক তিনি।
ব্যক্তিগত জীবনে রাধারমণ দত্ত ছিলেন তিন পুত্রের জনক।
তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় পুত্রসহ স্ত্রী একযুগে মারা গেলে তার ভাবান্তর ঘটে এবং তার মনে বৈরাগ্য ভাবের সৃষ্টি হয়। সেই থেকেই তিনি সংসার ত্যাগী যোগীর মতো সাধন ভজনে মগ্ন হয়ে যান। তাঁর প্রথম পুত্র বিপীন বিহারী দত্ত তখন তাঁর মামার বাড়িতে মৌলভীবাজারের ভুজবল গ্রামে যান এবং সেখানে স্থায়ী বসবাস করেন। তাঁর বংশধরেরা বর্তমানে সেখানে বসবাস করছেন। রাধারমণ দত্তের সাধনা ছিল সহজিয়া বৈষ্ণবরীতির, সঙ্গীত ছিল তাঁর সাধনার অন্তর্ভূক্ত একটি বিষয়।
টানা ৩২ বছর তিনি ঈশ্বরের সাধনা করেছেন। রাধারমণ দত্ত ৮২ বছর বয়সে ১৩২২ বাংলার ২৬ কার্তিক ১৯১৫ খ্রীস্টাব্দে শুক্রবার তিনি পরলোকে গমন করেন। জগন্নাথপুর উপজেলার কেশবপুর গ্রামে প্রচলিত হিন্দুরীতি অনুযায়ী তাঁর মরদেহ দাহ না করে বৈষ্ণব মতবাদ অনুযায়ী সমাহিত করা হয়। তারই শেষ স্মৃতি শ্মশান ঘাটটি বর্তমানে সমাধিস্থল হিসাবে সংরতি রয়েছে। প্রায় দুই যুগ ধরে রাধারমণের সমাধিস্থলের সেবায়িতের কাজ করেছেন কেশবপুর গ্রামের নরসিং মালাকারের স্ত্রী নিদুমনি দাস ।
কিন্তু ৫/ ৬ বছর আগে নিদু মালাকার মারা যান তাই একই গ্রামের রমলু মালাকারের স্ত্রী অনিতা রাণী মালাকার রাধারমণ দত্তের সমাধিস্থলের মন্দিরের দেখ ভালো ও পরিচর্যার কাজ করছেন। কেশবপুর গ্রামের লন্ডন প্রবাসী একব্যাক্তি রাধারমণ দত্তের সমাধিস্থল পাকা করে দেন। খ্যাতিমান লোককবি ও মরমীসাধকের সমাধিস্থল সংরণের জন্য আজ পর্যন্ত কোন প্রকার সরকারী উদ্যোগ ল্য করা যায় নি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।