মানুষ সহজাতভাবেই সুন্দরের পূজারি। আর সুন্দর হচ্ছে জীবনের সহজাত এবং অনুভূতিসিদ্ধ সমীকরণ। মুগ্ধতা-ভালোবাসা আর নিমগ্নতার পুরোটা জুড়েই সুন্দরের অবাধ বিচরণ। পৃথিবীতে সৌন্দর্যের কথা বললেই নারীকেন্দ্রিক একটা ধারণা তৈরি হয়। সৃষ্টিকর্তা নারীদের এতটা কোমল করে তৈরি করেছেন বলেই হয়তো বিশ্বজুড়ে এই ধারণার বিকাশ ঘটেছে।
সে ধারণা অনুসারে প্রকৃত ও মোহময় সৌন্দর্যের বিকাশ কেবল নারীত্বেই। তবে প্রচলিত অর্থে সৌন্দর্য বলতে যে শারীরিক গঠন, অবয়ব কিংবা মুখশ্রীর কথা বলা হয়ে থাকে, প্রকৃত অর্থে সৌন্দর্যের মানে সেটা নয়। সুস্থ-সবল সাধারণ একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিমত্তা, প্রজ্ঞা এবং বিচার-বিশ্লেষণ ক্ষমতা সৌন্দর্যের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। কেবল শারীরিক অবয়বই যে সৌন্দর্যের শেষ কথা নয়, তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ সম্প্রতি নির্বাচিত এবারের মিস ইউনিভার্স অ্যাঙ্গোলার লাইলা লোপেজ। তিনি একজন কৃষ্ণাঙ্গ সুন্দরী।
মিস ইউনিভার্স হচ্ছে সুন্দরী নির্বাচনে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং গ্রহণযোগ্য প্রতিযোগিতা। তবে মানুষের মধ্যকার সৌন্দর্য ধারণার সুষ্ঠু বিকাশের পরপর সুন্দরী বাছাইয়ের ব্যাপারটি চলে আসে। সেই সুপ্রাচীনকাল থেকেই ব্যক্তিগত ও রাজপরিবারের প্রয়োজনে এই কাজটি চলে আসে। মে' ডে এর রাজা-রানী বাছাইয়ের বহু আগে থেকেই ইউরোপে সুন্দরী প্রতিযোগিতা শুরু হয়। আর এই প্রতিযোগিতায় একজন নারী মূলত তার দেশের প্রতিনিধিত্ব করত।
যুক্তরাষ্ট্রে এ প্রতিযোগিতা শুরু হয় ১৮৫৪ সালে। কিন্তু তখনকার রক্ষণশীলতায় একসময় তা বন্ধ হয় যায়। পরবর্তী সময়ে 'ফটো সুন্দরী প্রতিযোগিতা' নামে নতুন প্রতিযোগিতা শুরু হয়। আধুনিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার সূচনা ১৯২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে। তবে প্রথমে এটি খুব একটা সাড়া জাগাতে পারেনি।
কিন্তু পরবর্তীতে সেনাবাহিনীতে সুন্দরী নারীর প্রয়োজন দেখা দেয়। তারপর থেকে শুরু হয় 'মিস ইউনিভার্স' প্রতিযোগিতার একটি ছোট রূপ। এরপর ১৯৫১ সালে অনুষ্ঠিত সুন্দরী প্রতিযোগিতা 'মিস আমেরিকা' রক্ষণশীলদের দ্বারা প্রত্যখ্যাত হয়। এরপর আয়োজিত হয় 'মিস ইউএসএ' এবং 'মিস ইউনিভার্স'। ১৯৫২ সালে ক্যালিফোর্নিয়ায় প্রথম এই প্রতিযোগিতা শুরু হয়।
প্রথম 'মিস ইউনিভার্স' নির্বাচিত হন ফিনল্যান্ডের আরসি কুন্সিলা। টেলিভিশনে মিস ইউনিভার্স অনুষ্ঠানটির প্রচার শুরু হয় ১৯৫৫ সালে। প্রথম প্রথম 'মিস ইউনিভার্স' এবং 'মিস ইউএসএ' যৌথভাবে প্রচার হতো। পরবর্তীতে ১৯৬৫ সাল থেকে আলাদাভাবে প্রচার শুরু হয়। এভাবেই একসময় সুন্দরী বাছাইয়ের ব্যাপারটি বিশ্বজুড়ে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়।
মূলত সৌন্দর্যের যোগ্য মূল্যায়ন ও সম্মান দেওয়ার জন্য বিশ্বজুড়ে বেশ কিছু সুন্দরী প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। বেশ কিছু ক্ষেত্রে এ নিয়ে বিতর্ক থাকলেও গোটা বিশ্বজুড়ে এটি আগ্রহ এবং উন্মাদনার একটি প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে কেবল সুন্দরী প্রতিযোগিতাই নয়, সুন্দরের জন্যও রয়েছে প্রতিযোগিতা। মজার ব্যাপার হলো_ সুন্দর পুরুষদের প্রতিযোগিতায় কেবল তাদের শারীরিক সৌন্দর্যই বিবেচনা করা হয়। তবে অন্যান্য সুন্দরী প্রতিযোগিতার চেয়ে মিস ইউনিভার্সের বিষয়টি আলাদা।
কেননা এখানে সৌন্দর্যের সঙ্গে নানা বিষয়ের অনুপম সমাহারের মাধ্যমে তীব্র এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এ প্রতিযোগিতায় কেবল নারীর শরীর প্রদর্শন কিংবা শারীরিক সৌন্দর্যই মুখ্য বিষয় নয়। সেই সঙ্গে নারীর ব্যক্তিত্ব, প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞা যাচাই এবং সাহসী মনোভাবকেও দেখা হয় গুরুত্ব সহকারে।
সুন্দরী বাছাইয়ের সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতা 'মিস ইউনিভার্স' মূলত একটি বার্ষিক সুন্দরী নির্বাচন প্রতিযোগিতা। শুরুর দিকে ১৯৫২ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার ক্লথিং কোম্পানি 'প্যাসিফিক মিলস' নামের একটি প্রতিষ্ঠান এ প্রতিযোগিতা পরিচালনা করত।
১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণেই প্রতিযোগিতা চলতে থাকে। এরপর ১৯৯৬ সালে 'ডোনাল্ড ট্র্যাম্প' এই প্রতিযোগিতা আয়োজনের দায়িত্ব গ্রহণ করে। তবে বর্তমানে 'মিস ইউনিভার্স অর্গানাইজেশন' নামের একটি সংগঠন প্রতিযোগিতা পরিচালনা করে। বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত সংগঠন 'মিস ইউনিভার্স অর্গানাইজেশন' ২০০২ সালের ২০ জুন তাদের কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রতিযোগিতার আয়োজন কেবল যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
আস্তে আস্তে এই ধারণা ও আয়োজনের পরিচিতি এবং জনপ্রিয়তা দুই-ই বাড়তে থাকে। এরই মধ্যে জাতীয় পর্যায়ে সুন্দরী নির্বাচন প্রতিযোগিতা সবচেয়ে অর্থবহ হয়ে ওঠে ভেনিজুয়েলা, কলম্বিয়া ও পেত্রাকিয়ায়। অনেক দেশ যেমন নেপাল, আর্মেনিয়া অর্থ সংকটের দরুন এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে না। তবে প্রতিবারই কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্র এতে অংশগ্রহণ করে। প্রতি বছর মিস ইউনিভার্স প্রতিযোগিতা শুরুর আগে নির্ধারিত সময়ে অর্গানাইজেশন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণেচ্ছু দেশের জাতীয়ভাবে নির্বাচিত সুন্দরীদের তালিকা আহ্বান করে।
ধর্মীয় মনোভাবের কারণে সব দেশে অবশ্য সুন্দরী নির্বাচনের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয় না। ফলে নির্ধারিত মডেল এজেন্সির মাধ্যমে প্রার্থী নির্বাচন করা হয়। প্রতিযোগীর সর্বনিম্ন বয়স হতে হয় ১৮। সেমিফাইনালে পাঁচজন সুন্দরীর মধ্যে তিনজন সুন্দরী নির্বাচিত হয়। এদের মধ্যে চ্যাম্পিয়ন হন 'মিস ইউনিভার্স'।
বাকি দুজন প্রথম রানার আপ এবং দ্বিতীয় রানার আপ নির্বাচিত হন। 'মিস ইউনিভার্স' একটি চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরের মাধ্যমে চুক্তিবদ্ধ হন এবং ওই কোম্পানির পক্ষ থেকে চুক্তির মেয়াদকাল পর্যন্ত বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক কাজ করেন। পুরস্কারের ছড়াছড়ি তো থাকছেই। বিশ্বজুড়ে খেতাব অর্জনের খ্যাতি ছাড়াও নানারকম আলিশান জীপনযাপনের ব্যবস্থা করা হয়। সঙ্গে থাকে মোটা অঙ্কের আর্থিক পুরস্কার।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী এ পর্যন্ত উত্তর আমেরিকার প্রতিযোগীরা মিস ইউনিভার্স খেতাব পেয়েছেন ১৮ বার। সর্বনিম্ন খেতাব অর্জনকারী দেশ ওশেনিয়া, মাত্র তিনবার। মিস ইউনিভার্স হওয়া সত্ত্বেও মুকুট কেড়ে নেওয়ার ঘটনাও বিরল নয়। ২০০২ সালে রাশিয়ার 'আঙ্ানা সানজুয়ান' মিস ইউনিভার্স হলেও চুক্তি অনুযায়ী কাজ না করায় তার মুকুটটি পরবর্তীতে পরানো হয় প্রথম রানার আপ পানামার জাস্টিন পাসেককে। বিশ্বজুড়ে সমাদৃত এই আয়োজনটি বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় একশ কোটিরও বেশি দর্শক টিভি পর্দায় উপভোগ করেন।
এতেই বোঝা যায় বিশ্বে এর জনপ্রিয়তা কত বেশি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।