আমি পার্থিব বাস্তবতায় অস্থির, অপার্থিব স্বপ্নপায়ী কেউ একজন . . .
গল্পের শুরুটা...
স্কয়্যার হাসপাতালের আই.সি.ইউ. এর সামনের ডিভানে বসে ভীষণ কাঁপা হাতে অনিন্দিতার লেখা চিঠিটা খুললেন রুখসানা...
"মা মা মা মা মা !!!
আমি জানি মা এখন হয়তো তুমি চিঠি পড়ার অবস্থায় নেই। তাও কি করবো বলো? পারলাম-ই না কথাগুলো তোমাকে বলতে! আজকে যেই কথাগুলো আমি তোমাকে বলবো সেই কথাগুলো তোমার আমাকে বলার কথা ছিলো...যাহোক! মিলিয়ে দেখো তো মা! ঠিক বলছি কি না...
তুমি তখন মাত্র ডব্লিউ.এইচ.ও জয়েন করেছো। বয়স ছাব্বিস-সাতাশ হবে। একদিন তোমার বাসার কাজের মেয়েটা তোমার কাছে বিকারগ্রস্তের মতো এসে তার জমজ মেয়েদু'টাকে এনে দেয়। তার ছেলে দরকার।
এমনিতেই দুটা মেয়ে ছিল, তারপর এ দু'টাকে দেখলে নিজের সংসার না ভেঙে যায়! এই মেয়েদু'টাকে হয় তার মেরে ফেলতে হবে নাহলে কাউকে দিয়ে দিতে হবে। মেয়েদু'টা খুব ফুটফুটে ছিল, তুমি মানা করতে পারো নি। একটা ফেলে দেয়া মেয়েকে নিলে তুমি। মেয়েটাকে "অনিন্দিতা" করে তুললে। এর জন্য তুমি নিজের পরিবার বা বাইরের মানুষ সবার সাথে কঠিন যুদ্ধ করে গিয়েছো বেশ কয়েক বছর।
কিন্তু তুমি তোমার অনিন্দিতার ওপর এতটুকু আঁচ আসতে দাও নি। মা, আমার জন্মদাত্রী আমাকে ফেলে যে গিয়েছিল, আর কক্ষনো ফিরেও তাকায় নি। তোমার জন্য তাই আমার শিকড় লুকানোটা সহজ ছিল।
মা কখনো ভেবে দেখেছো আমার জমজ বোনটার কি হয়েছিল ? জানো মা ? মেয়েটা দেখতে অবিকল আমার মতো! আমার দেখে মনে হলো আয়না দেখ্ছি!
তুমি না করে দেয়ার পর আমার "মা" আমার বোনকে আর কোন আশ্রয় দিতে পারে নি। মেয়েটা কখনো রাস্তায় কখনো ফুটপাথে কুকুর-বিড়ালের সাথে বড় হয়েছে।
খুব অনাকাঙ্ক্ষিত হয়ায় ও শুনেছে অশ্রাব্য গালি, আর আমি তোমার কাছে শুনেছি কতো সুন্দর সুন্দর কথা! ওর ১৩-১৪ হতেই ওকে "মা" ব্রোথেলে বিক্রী করে দেয়, যেখানে আমার বড় বোন আগে থেকেই ছিল। যেখানে আমি তোমার সাথে পৃথিবীর অনেক দেশে ঘুরে অনেক কিছু জেনেছি, সেখানে ও জেনে গিয়েছিল পৃথিবীর নির্মম কিছু সত্য। আমাকে তুমি "অনিন্দিতা" করে তুলেছো, আর ওর কোন সত্যিকারের নাম-ই ছিল না। রাতের সাথে সাথে নাম বদলে যেত ওর! মা তুমি কি ভাবছো, এতো কথা আমি কিভাবে জানলাম ?? তাই না মা ???
মা! কয়েক সপ্তাহ আগের প্রথম আলোর নারীমঞ্চের একটা কলামে ছোট্ট করে একটা দেহব্যবসায়ীর মৃত্যু সংবাদ ছাপা হয়। আমি দেখিনি মা খবরটা, আমিতো পেপার-ই পড়ি না! খবরটা ধ্রুব দেখেছিল।
ও খুব অবাক হয়েই জানায়, মেয়েটা নাকি দেখতে একদম আমার মতো! আমি ওকে হালকা বকে হাসতে হাসতে পেপার নিয়ে চমকে উঠেছিলাম! আমার ছবি কেন পেপারে! তারপর কোন এক ভীষণ কৌতুহলে প্রথম আলোতে যাই। এ সময়টায় ধ্রুব আমার সাথেই ছিল মা। ধ্রুব আমার বা আমি ধ্রুবের খুব পাগলপ্রিয়! শেষ কয়েকটা মাস আমার পৃথিবীতে ধ্রুব ছাড়া খুব কম মানুষের-ই অস্তিত্ব ছিল। যাহোক, ওর সাথে গিয়ে বের করেছিলাম মৃত মেয়েটার মা-র ঠিকানা। কেন যেন করেছি তা-ও জানি না! একটা কৌতুহল টেনে নিয়ে যাচ্ছিল আমাকে ঐ রূঢ় সত্যটার দিকে।
সেই ঠিকানাটা আমাকে-ধ্রুবকে খুব নোংরা একটা টিনের বাসায় নিয়ে গেল। ওখানে কোন মৃত্যুশোক ছিল না। বাইরে থেকে অকথ্য গালি-গালাজ শোনা যাচ্ছিল। আমরা বাইরে থেকে টিনে আঘাত করতেই এক মহিলা বের হয়ে এসে আমাকে দেখে ভূত দেখার মত চমকে ওঠে! সে ভেবেছিল আমি সব জেনেশুনে ওখানে গিয়েছি। আমাকে দেখে বলে, "তুই আসলি যে?! তাড়াতাড়ি চইলা যা, তুই তো বাঁচছশ।
একটা মরসে! বাকিগুলা মরে না কেন্!" আমি বললাম আমাকে বুঝিয়ে বলতে ব্যপারটা কি। মহিলা অবাক চেয়ে, একটু পর উন্মাদের মতো হেসে একভাবে শোনায় আমার শিকড়ের কাহিনী। ফিসফিসিয়ে বলে যে তুমি না নিলে আমিও তো শরীর বিক্রী করেই বাঁচতাম। তুমি মহান... আরো বলে আমার জন্মদাতার কথা..."তোর দিকে নজর গেলে তোরেও ছাড়বো না! এমন নজর খারাপ তোর বাপের"...আরো শুনি আমার ছোট ভাইটার কথা যে ব্রাউন সুগার না পেলে শরীর ব্লেড দিয়ে আঁচড়ে-কেটে রক্তাক্ত করে!
আমার কাঁদাময় নোংরা শিকড়টা আমাকে কি যে ঘিনঘিনে অনুভূতি দিয়েছে মা! আমার "মা" কথা বলতে বলতেই দরজা খুলে "বাবা" বের হয়ে আসে। "মা" কে অশ্রাব্য একটা গালি দিয়ে আমার দিকে তাকায়।
কি নোংরা-অপবিত্র সেই দৃষ্টি! জানো মা, আমি নিজেকে অনেক ধুয়েছি সেই দিনের পর, কিন্তু শরীর-মন থেকে ঐ দৃষ্টির অপবিত্রতা ধুতে পারি নি। "মা" আমাকে নিচু গলায় বলে," কিছু থাকলে দিয়া যা মা, হাজার হইলেও তো আমি তোর মা!" আমি ওয়ালেট এর সব টাকা দেয়ার পর "মা" আমার ঘড়ি আর চেইনটাও রেখে দেয়। এরমধ্য কোথা থেকে আমার ছোট ভাইটা ঝড়ের বেগে এসে "মা"-র হাত থেকে পাচ শ'র একটা নোট ছোঁ দিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায়। "মা" অকথ্য ভাষায় চিৎকার দিয়ে ওঠেন! ছেলেটার খালি গায়ে গভীর-অগভীর আঁচড়ের মতো ক্ষত! ওখানে আর থাকতে পারি নি মা। পালিয়ে এসেছিলাম প্রায়।
মা জানো, সেদিন কেন যেন ধ্রুব আমার হাত ধরে নি।
তারপর কেটে গেছে কয়েকটা সপ্তাহ। তোমাকে আমার খুব বড় মনে হতো, আবার মাঝে মাঝে কেমন যেন "অন্যকেউ" "অন্যকেউ" লাগতো। মনে হতো শিকড় তো ওটাই আমার, চোরাবালিতে তলিয়ে গিয়েছিলাম। ঐ চোরাবালি থেকে হাত ধরে উঠিয়ে দেয় নি ধ্রুব-ও।
গত পরশু মাথা নিচু করে আমার পাগলপ্রিয় ধ্রুব বললো, ও খুব প্র্যাকটিক্যালি ভেবে দেখেছে। আমার ঐ ভয়াবহ অতীত সমাজের কাছে ওকে নিচু করে দেবে অনেক। আমাকে হাজার ঢাকলেও নাকি ঐ জন্মের কাঁদাময় দাগ মুছবে না আমার শরীর থেকে। কথাগুলো বলে অপরাধীর মতো চলে গিয়েছিল ধ্রুব। আমি ভেবে দেখলাম মা, ধ্রুব সত্যি বলেছে।
আমার জীবনে অন্য কোন ধ্রুব আসলেও তো আমাকে ওভাবেই দেখবে! কি অচ্ছুৎ আমি! কতো নোংরা!!!
আমি ঠিক করেছিলাম এই নোংরা জীবনের শেষটা খুব পবিত্রতা দিয়ে করতে। তুমি একজন অসাধারণ মা, তুমি খুবখুব পবিত্র! তুমি আমার গা থেকে কাঁদা মুছে আমাকে রাজকন্যা করে তুলেছিলে। কাকের গায়ে ময়ূরের পালক লেগেছিল মা। আমিও নিজেকে ময়ূর ভেবেছি সবসময়! মা, তোমার অবস্থান সবার থেকে অনেক অনেক উপরে। খুব বেশি ঋণ তোমার কাছে আমার।
এমন ঋণী হওয়াও হয়তো ভাগ্যের ব্যপার। তোমার মাতৃত্বে কোন খুঁত ছিল না মা। আমি সত্যি তোমার অংশ ছিলাম। এজন্য ঠিক করেছিলাম মৃত্যুর আগের প্রতিটা মুহুর্ত তোমার সাথে কাটাতে, মৃত্যু-ঘুমের মাঝেও যাতে তোমার গন্ধ আমার চারপাশ আঁকড়ে থাকে।
মা! তোমার কিন্তু একটাই অক্ষমতা ছিল, তুমি আমার পা থেকে ঐ "বাবা" নামের পশুটার পায়ের মতো কাল জন্মদাগটা মুছে নিতে পারো নি।
ঐদিন ঐ মানুষটার পায়েও ঠিক আমার পায়ের মতো গোল কাল একটা জন্মদাগ দেখেছি মা!
মা! আমি জানি তুমি-ই আমার মা কিন্তু কেন যেন ঐ জন্মদাগ ভুলে, ঐ শিকর উপড়ে নিজেকে মুক্ত করতে পারি নি। আমি একটু একটু করে মরে যাচ্ছিলাম মা। তাই তোমাকে এতোটা কষ্ট দিতে হলো। একেবারেই শেষ করে দিলাম নোংরা কাঁদায় মাখা জীবনটা।
তোমার গন্ধ আর মাথায় রাখা হাতটার আশির্বাদ নিয়ে পরের জীবনে যাচ্ছি মা।
যেখানে আমার পায়ে কোন জন্মদাগ বা কোন কাঁদাময় শিকড় থাকবে না। ঐ জীবনে আমি অনিন্দিতা হবো মা! শুধুমাত্র তোমার অনিন্দিতা!!!
মা তোমাকে সবটুকু ভালবাসা দিয়ে যাচ্ছি। তোমাকে আমি পাগলের মতো ভালবাসি মা! অনেক অনেক বেশি ভালবাসি!!!
শুধুই তোমার
আমি..."
***
এবার প্রথম আলোর নারীমঞ্চে কিন্তু বেশ বড় করেই ছাপা হলো ডব্লিউ.এইচ.ও.-র চিকিৎসক রুখসানা আহমেদ-এর সিভিয়ার এ্যটাক আর তার মেয়ে অনিন্দিতা আহমেদ এর হাই ডোজে ড্রাগস নেয়ার জন্য মৃত্যুর খবরটা! খবরটার বিষয় ছিলো..."সমাজের উচ্চবিত্তের সন্তানের প্রতি অবহেলার পরিণতি"।
|||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||||
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।