সাময়িক স্বপ্ন ও দুর্নীতিবাজদের জামিন ভাগ্য
ফকির ইলিয়াস
------------------------------------------------------------------------------
সৎ এবং যোগ্য নেতৃত্ব অন্বেষণের যে প্রকল্প বর্তমান সরকার চালু করতে চেয়েছিল, তা কতটা বাস্তবতার পরশ পাবে তা নিয়ে একটি সংশয় ক্রমেই বেড়েই চলেছে। বিশেষ করে সিটি ও পৌর নির্বাচনের গণরায়ের পর এ প্রশ্নটি আসছে খুব গুরুত্বের সঙ্গে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জে. (অব.) এমএ মতিন বলেছেন, সরকার গণরায়ের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল।
এ রায়ের মাধ্যমে আটক সিটি ও পৌর নির্বাচনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা মুক্তি পাবেন কি না তা দেখার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে সরকার সবকিছু গুছিয়ে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায় তা আপাতত মনে হচ্ছে বেশ ýপষ্টভাবেই।
বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধি সম্পর্কে মানুষের বদ্ধমূল কিছু ধারণা আছে আর তা হচ্ছে, যারা রাজনীতি করেন, যারা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হন, তাদের হাতে দুর্নীতি, টাকাকড়ি কিছুটা লেগেই যায়। জনগণের ভাষ্য মতে, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি তো কমবেশি সব নেতাই করে। যারা একটু কম করে তারাই অপেক্ষাকৃত শ্রেয়। বাংলাদেশে অত্যন্ত সৎ রাজনীতিক যে নেই তা আমি বলছি না।
এদেশ কমরেড মণি সিংহ, কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ, পীর হাবিবুর রহমান, এমনকি জীবন্ত কিংবদন্তি বরুণ রায়ের মতো ত্যাগী রাজনীতিকও জন্ম দিয়েছে।
কিন্তু ভোটের রাজনীতিতে এরা কতবার জয়ী হতে পেরেছেন? মতিয়া চৌধুরী কিংবা নূরুল ইসলাম নাহিদরা যখন ভোটে হেরে যান তাও আবার অপশক্তির কাছে, তখন আমাদের মুখ দেখানোর আর কি উপায় থাকে? তখনও আমাদের বলতে হয়, জনতার জয় হয়েছে।
দু:সময়ের কালো মেঘ কাটিয়ে সুসময় প্রতিষ্ঠা করা খুবই কঠিন কাজ। ঠিক তেমনি দু:শাসন ভেদ করে সুশাসন প্রতিষ্ঠার কাজটিও একটি সমাজে কষ্টসাধ্য বৈকি। ওয়ান-ইলেভেনের পূর্বে আমরা দেখেছি উড়ে এসে জুড়ে বসার বাসনায় বেশকিছু রাজনৈতিক দলও জন্ম দিয়েছে রাতারাতি। যারা রাষ্ট্রের মানুষের দু:সময়ে কখনই পাশে ছিলেন না।
মাঝে মাঝে তাত্ত্বিক বুলি আওড়ানো ছাড়া কোন দায়িত্ব পালনই করেননি জনগণের প্রতি।
মানুষের কল্যাণে কাজ করা যায় বুদ্ধি খরচ করেও। কিন্তু যখন প্রত্যক্ষ রাজনীতিক হওয়ার প্রশ্ন আসে, তখন এর কিছু পূর্বশর্ত থাকে। আর এর প্রথমটি হচ্ছে মাঠকর্মী হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা। কারণ জনগণের সমস্যা না জানতে পারলে তো সমাধান করা যায় না।
আর তা জানতে হলে জনগণের কাছে যেতে হবে এবং তা হতে হবে নি:স্বার্থভাবে। চৌদ্দ কোটি মানুষের দেশে এমন নি:স্বার্থ নেতৃত্ব কম গড়ে ওঠার কারণেই বারবার ব্যাহত হয়েছে গণতন্ত্রের মানস, প্রজন্মের মেধা এবং জাতির মনন। যারা ত্রাণকর্তা হিসেবে এসেছে ক্রমশ এরাই আবিভর্ত হয়েছে খেকো রাক্ষস হিসেবে। দখল হয়ে গেছে বন-বাদাড়, নদী-নালা। বৃক্ষ কর্তন করে হরণ করা হয়েছে সবুজের প্রবাস।
যদি কোন নেতা মাটি ও মানুষকে ভালবাসেন তবে তার হাতে কি এমন হীনকর্মগুলো হতে পারে? এ প্রশ্নগুলো জটিল এবং বেদনাদায়ক হিসেবেই দেখা দিয়েছে গেল সাঁইত্রিশ বছরে।
দুই
গুণগতমানের পরিবর্তনের যে স্বপ্ন বাংলাদেশ দেখেছিল তার আংশিক কি পূর্ণ হবে? এমন একটি জিজ্ঞাসা তাড়া করে ফিরছে বাংলাদেশের মানুষকে। ব্যক্তি বিশেষকে তোয়াজ করতে কিছু মানুষ কিভাবে মারমুখো হয় তার প্রমাণ আমরা আবারও দেখলাম এ জরুরি অবস্খার মধ্যেও। তারেক রহমান বাথরুমে পা পিছলে পড়ে আঘাত পাওয়ার জের ধরে বিএনপির ক্যাডারদের সহিংসতায় ঢাকায় জাহাঙ্গীর নামক একজন ব্যবসায়ী নিহত হন। তারা কিভাবে রাস্তায় নেমে ভাঙচুর করেছে তা জাতি প্রত্যক্ষ করল আবারও।
প্রকৃতপক্ষে তাহলে হচ্ছেটা কি? কারা উসকে দিচ্ছে এসব মধ্যস্বত্বভোগীদের। এরা কার মদদে মাঠ দখলের মহড়া দেখাচ্ছে।
সার্বিক পরিস্খিতি বিবেচনা করে এটা খুব স্পষ্ট হতে শুরু করেছে, একটি সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার দিকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। যে চেতনা নিয়ে ওয়ান ইলেভেন এসেছিল তার আংশিকও পূর্ণ হবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ যে হারে এখন জামিনের মহড়া শুরু হয়েছে তাতে মনে হওয়া স্বাভাবিক, আর কিছুদিনের মধ্যেই শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের গডফাদাররা আবার দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে।
এদের হাতেই আবার চলে যাবে গণমানুষের ভাগ্য।
এ বিষয়গুলো বোধগম্য না হওয়ারই কথা। কি করে একই ধরনের মামলায় আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর ১৩ বছর সাজা হয়। আর কেউ কেউ জামিন পেয়ে মুক্ত বাতাসে বিচরণ করে। ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা এখনও রয়ে গেছেন বর্ধিত জামিনে।
অথচ সম্পদ গোপন করার অভিযোগ তো তার বিরুদ্ধেও ছিল। কিংবা এখনও রয়ে গেছে। এভাবে আরও অনেক সমীকরণই এখন আর মিলছে না।
সেনাপ্রধান বারবার বলছেন, সেনাবাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতার দখল নেবে না। আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, দেশে আসছে ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান না করার পাঁয়তারা করা হচ্ছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, দেশটা তাহলে চলবে কিভাবে? গণতন্ত্র না সামরিকতন্ত্র? কোনটা দীর্ঘস্খায়ী হবে? সিইসি শেষ পর্যন্ত বলেছেন, খোন্দকার দেলোয়ারই বিএনপির বৈধ মহাসচিব। আর আমরা পত্রপত্রিকায় দেখছি, বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ করতে মাঠে নেমেছেন জামায়াতের সেক্রেটারি আলী আহসান মুজাহিদ।
জামায়াতের শেষ আশ্রয় যে বিএনপি এ ঘটনার মাধ্যমে তা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। আর এসব জগাখিচুড়ি মার্কা অনিশ্চয়তার মাধ্যমে প্রস্তুতি চলছে ডিসেম্বরে নির্বাচনের।
নির্বাচনের মাধ্যমে একটি শক্তির হাতে ক্ষমতা দিয়ে যদি বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিদায় নেয় তারপরই শুরু হবে আবার সেই ভাঙচুরের রাজনীতি।
সে লক্ষণই আমরা দেখলাম ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীরকে হত্যার মাধ্যমে।
সর্বশেষ কথা হচ্ছে, তাহলে লাভটা হলো কি? স্রেফ আই ওয়াশের জন্য এত কিছু করতে হলো? খালেদা-তারেকের জামিনের মধ্য দিয়ে হয়তো আরও অনেকের জামিন ভাগ্য খুলে যাবে।
যারা জামিনে বেরিয়ে আসবে তারা ক্ষমতার পরশ পেলে পরবর্তী সময়ে তাদের সমর্থকদের জেল থেকে ছাড়িয়ে আনবে এমন একটা হিসেব-নিকেশ চলছে আপাতত।
শীর্ষ বেশ কিছু নেতার মুখে এখন প্রায়ই শোনা যাচ্ছে ওয়ান-ইলেভেন আসলে একটা কাগুজে বাঘ এবং সাময়িক মাত্র।
বাংলাদেশে গেল সাঁইত্রিশ বছরে অনেক সাময়িক স্বপ্ন দেখেছে মানুষ।
এই স্বপ্নটিও যদি সাময়িক হয় তবে আর দাঁড়ানোর উপায় থাকবে না। উপমহাদেশের আরেকটি দেশ পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি ভাবিয়ে তুলছে সবাইকে। কিন্তু কথা হচ্ছে সে ভাবনা থেকে কে কতটা শিক্ষা নেবেন?
নিউইয়র্ক, ২৭ আগস্ট ২০০৮
---------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ । ২৯ আগস্ট ২০০৮ শুক্রবার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।