http://www.somewhereinblog.net/blog/marufk56
ইন্ডিয়া ট্যুর ২ : রমণীগণ.. ইন্ডিয়া ট্যুর - ১ : ভিনদেশে হিজড়ার খপ্পরে
পুরো ইন্ডিয়া ট্যুরে আমি ছিলাম লেটেস্ট। উহু, আধুনিকতায় না, বিলম্বের চোখ ধাঁধানো দৃষ্টান্ত স্থাপনে। অর্থাৎ কিনা লেট- এ আসার টেস্ট- এ ফার্স্ট ছিলাম। সবার খাওয়া-দাওয়া প্রায় শেষ, থালা-বাটি গুছানো শুরু হবে, এমন সময় রুম থেকে ছুটতে ছুটতে আমি বের হয়ে কেবল খেতে আসব, এটাই ছিল নিত্য দৃশ্য। গাড়ি ছাড়বে ছাড়বে, এই সময় কাঁধে সবুজের আভা মাখা পুরনো ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ছুটতে ছুটতে হোটেল গেট দিয়ে বের হব, এটাই যেন ছিল স্বাভাবিক।
আমাদের ব্যাচে একটা ছেলে ছিল (ধরি তার নাম নাসিম), ক্লাসে তার বিলম্বিত উপস্থিতি কালজয়ী ‘মিথ’-এ পরিণত হয়। স্যার আসারও ১৫-২০ মিনিট পর নির্বিকার মুখে সে ক্লাসরুমে প্রবেশ করবে। এবং পুরো কলেজ লাইফে তার চেয়ে পরে ক্লাসে ঢুকতে পেরেছে কেউ, এমন রেকর্ড বিরল-প্রায়। কোনদিন হয়তো টিচার আসতে দেরী করছেন, ১২-১৫ মিনিট পেরিয়ে গেছে, এমন সময় নাসিম রুমে ঢুকলো। অমনি আমরা সবাই দাঁড়িয়ে গেলাম - আজকে আর ক্লাস হবে না।
কারণ, নাসিমের পরে ক্লাসে কেউ ঢুকবে,এটা হতেই পারে না; প্রকৃতির সে-ই চিরন্তন নিয়মে স্যারেরও আজ আসার সম্ভাবনা সুদূর-পরাহত। এমনই নিশ্চিত ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবাহী ছিল সে। ওর সে-ই বিরলপ্রজ অবস্থানের ধারে-কাছে যেতে না পারলেও ইন্ডিয়া ট্যুরে ওরই এক ছোট সংস্করণ হিসেবে (কু)খ্যাতি পেয়ে যাই আমি।
প্রথম প্রথম বন্ধুরা বিরক্ত হতো। বাসে ওঠার সময় তাদের সম্মিলিত বাক্যবাণের আক্রমণ সামলে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেই নিজেকে বিশাল বীর যোদ্ধা বলে মনে হতো।
আগের রাতে কি কাজ করলে আমার এত দেরী হওয়ার সম্ভাবনা থাকতে পারে, এই নিয়ে সোল্লাসে ও জনসম্মুখে তাদের উর্বর-মস্তিষ্কের গবেষণালব্ধ তথ্য জাহির করতো। আমি নির্বিকার মুখে ও বিনা প্রতিবাদে তাদের ব্যাখ্যা শুনে যেতাম। তবে, পরবর্তীতে তারা ব্যাপারটা উদার ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতেই গ্রহণ করে। শুধু তা-ই নয়, তারা আমার প্রতি বিশেষ সহানুভূতিপ্রবণও হয়ে ওঠে। কারণ, ততদিনে এই বিলম্বের নেপথ্যের হৃদয়-বিদারক সত্যটুকু তাদের সামনে উন্মোচিত হয়।
হোটেলে একেক রুমে তিনজন করে থাকা হবে এটা পূর্ব নির্ধারিতই ছিল। (অবশ্যই ছেলে-মেয়ে আলাদা থাকবে, জুটিরাও)। কিন্তু শুধু দুটো রুমে চারজন করে। একটা রুমে চারটা ছেলে, আরেকটা রুমে চারটা মেয়ে। হিসাবটা বুঝিয়ে দিচ্ছি।
ট্যুরে মেয়ে ছিল ৩৪ জন, ছেলে ৪০ জন। ৩ টা মেয়ে এক রুমে থাকলে ১১ টা রুমে ৩ গুণন ১১ = ৩৩ জন, একজন বাড়তি। সুতরাং, একটা রুমে চারজন থাকতে হবে। ছেলেদের ক্ষেত্রেও ১৩ টা রুমে ৩ গুন ১৩ = ৩৯। আমি সেই অভাগা অতিরিক্ত এক।
সুতরাং ঐ একটি মাত্র রুমের চার ছেলের একজন আমি।
সমস্যাটা এই সংখ্যা-তত্ত্বে না, অন্য জায়গায়। আমার রুমমেট তিনজন ছিল সে আমলের (মানে আমাদের ব্যাচের ) সুদর্শন ব্যক্তিদের অন্যতম। মোটেও বাড়িয়ে বলছি না, আমাদের ব্যাচে একদা হয়ে যাওয়া সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় পাবলিক ভোটিংয়ে দ্বিতীয় ও তৃতীয় নির্বাচিত হওয়া দুজন ছিল আমার রুমমেট (প্রথম হওয়া সহপাঠীটি ট্যুরেই যায়নি)। এবং তারা নিজেদের সৌন্দর্য সম্পর্কে ছিল পূর্ণ মাত্রায় সচেতন।
এই সচেতনতার প্রকাশ ঘটতো তাদের ত্বকের ঔজ্জ্বল্য রক্ষা ও সাজ-সজ্জা কর্মসূচিতে। এই কর্মসূচিতে কে কত দীর্ঘ সময় নিতে পারে তার-ই এক অলিখিত প্রতিযোগিতা ছিল তিনজনের মধ্যে। ফলে, তাদের তিনজনের যাবতীয় কর্ম শেষে আমি যখন গোসলখানায় প্রবেশের সুযোগ পেতাম, তখন সময় পেরিয়ে গেছে অনেকখানি। শক্তিসামর্থে তাদের তুলনায় পিছিয়ে থাকায় তিনজনের মাঝখানে আমি সিরিয়াল পেতাম না। প্রকৃতি ডাক দিলেও সাড়া না দিয়ে চোখ-মুখ বুজে থাকতে হতো।
ঐ দীর্ঘ সময় যে আরামে নিদ্রা দিব, তারও উপায় নাই। বাকী দুজন রুমটা এমনই সরগরম করে রাখে, কোন মৃতদেহও ঐ রুমে রাখা হলে সে উঠে বলবে, বাবা আমারে অন্য রুমে রাইখা আসো, মৃত্যুর পরে অন্তত একটু শান্তি লাভ করি।
যা-ই হোক, এবংবিধ কারণে, সবার আগে নাহোক, দুর্নাম ঘুচাতে অন্তত ৫-৬ জনের আগে গাড়ির কাছে পৌঁছার আশাও আমার অপূর্ণ থেকে যায়।
কিন্তু বিস্ময়করভাবে, সে সুযোগটা আসে দিল্লীতে। দিল্লীর হোটেল তাজ-এ উঠি আমরা।
কি কারণে যেন আমরা চারজনেই সকালে যাত্রার সময়টা ভুল শুনি। এবং ভুল শোনার ফলাফল হচ্ছে, আমি পর্যন্ত যখন রেডি হয়ে খাওয়ার টেবিলে যাই, তখন পর্যন্ত মাত্র দশ জন খেতে এসেছে। আমি যখন খাওয়া শেষ করি, তখন অর্ধেক লোকজনও খাওয়ার টেবিল পর্যন্তই পৌঁছায় নি। সময় যখন আছে, তখন বিছানায় গা এলিয়ে দেয়া যাক - ভেবে আমি, নাদিম আর আকাশ চলে এলাম রুমে। সজীব এলো না।
আমার তিনজন একা (আলাদা আলাদাভাবে) হলে সজীব আবার দোকা। ব্যাচের নিশুর সাথে তার ঘোষিত বন্ধন। তা-ই সে রুমে না এসে নিশুর সাথে গল্পে মশুগুল হয়ে গেল। আমরা তিনজন রুমে ফিরে টিভি ছেড়ে দিলাম। নাদিম আর আকাশ ওর মধ্যেই ঘুমিয়েও গেল।
আমি বেকুব টিভিই দেখতে থাকলাম। ঘড়ির দিকে কেন তাকালাম না কে জানে? হঠাৎ আকাশ ঘুম ভেঙ্গে উঠে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হইলো? এখনও রওয়ানা দেয় নাই। ’ আমি বললাম, ‘নাহ কেউ তো ডাকতে আসে নাই। ’ ডাকতে যে কেউ আসবে সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিতই ছিলাম। সজীব তো ডাক দেবে! সজীব না ডাক দিক, সারা ইন্ডিয়া ট্যুর যার ব্যাগ বইতে হলো আমাকে, সে মেয়েটা তো আমার কথা ভুলে যাবে না! কিন্তু হা হতোম্মি! আমি নগণ্য মানবমাত্র, রমণীকূলকে চিনতে পারি - সে সাধ্য কি আছে আমার? দেবতাকূলই যখন চিনতে পারেনি তাদের।
নাদিমের ঘুম ভাঙিয়ে আকাশ গেল খোঁজ নিতে। সবাই চলে গেছে। দুই বাসে করে ৭১ টা ছেলে মেয়ে, ট্যুর গাইড এবং আমাদের সঙ্গে থাকা একমাত্র শিক্ষক আমাদের বেমালুম ভুলে গিয়ে দিল্লীর দর্শনীয় স্থান দর্শন করতে বেরিয়ে গেছে। আমরা তিনজন হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম রুমের ভেতর। ব্যাপারটা আমাদের তিনজনের কাছেই পুরোপুরি অবিশ্বাস্য মনে হতে থাকলো।
আমাদের তিনজনকে ফেলে সবাই ঘুরতে বেরিয়ে যাবে, তা কিভাবে হয়? কারো কি একবারের জন্যও মনে পড়বে না আমাদের কথা? আমার তিনজন তো এক বাসে, ঐ বাসে তিনজন আসেনি, কেউ লক্ষ্য করবে না? আমার কথা না হয় বাদ-ই দিলাম, ব্যাচের বাকী দুই ‘হার্টথ্রব’কে ভুলে যাবে ওরা। এমন তো না যে, ওদের উপস্থিতি আর অনুপস্থিতি সমান কথা। যেখানে থাকে চুপটি মেরে রামগরুড়ের ছানা হয়ে তো বসে থাকে না ওরা, চারদিক তো মাতিয়েই রাখে। তাহলে?
আমরা গভীর দুঃখে নিপতিত হলাম। এই বিশাল ব্রক্ষান্ডের মাঝে নিজেদের অতি ক্ষুদ্র ,তুচ্ছ, দীন-হীন মনে হতে লাগলো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।