আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যুহায়েরের কুমির



যুহায়ের- এর কুমির অফিসের কাজে বাবা যাবে বাগেরহাট- শুনেই বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুলের কেজি ক্লাসের পাঁচ বছরের যুহায়ের বলল- 'আচ্ছা বাবা, পিৎজা হাটে যেমন পিৎজা পাওয়া যায় বাঘেরহাটে কি বাঘ পাওয়া যায়?' উচ্চারণে ভুল করলেও যুহায়ের কিন্তু ঠিকই ধরেছে, ধারণা করা হয় সুন্দরবনসংলগ্ন এই বাগেরহাট এর নামকরণ হয়েছিল এ জায়গাটিতে বেশি বাঘ থাকার কারণে। যুহায়ের এর কথা শুনে বাবা বলল- 'বাগেরহাটে বাঘ দেখা যাবে না কিন্তু সেখানে কুমির আছে অনেক। ' যুহায়ের এর আব্দার 'তাহলে আমার জন্য তিনটা- না পাঁচটা কুমির আনতে হবে। ' ( যুহায়ের আবার পশুপাখি খুব ভালোবাসে, বাসায় কুকুর পুষে, মাছ পুষে ইদানিং আবার একটা কচ্ছপও পুষতে শুরু করেছে আর বায়না ধরেছে স্কুলের পরীক্ষায় র্ফাস্ট হলে একটা সবুজ সাপ পুষবে। বায়নাটা অবশ্য কেবল বাবার কাছে কারণ ওর মা আবার সাপকে ভীষন অপছন্দ করে।

) কুমির আনার কথা শুনে বাবা বললেন -'আচ্ছা। ' বাগেরহাটে বাবার ব্যস্ততা সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত। বিকেলে বাগেরহাটের স্বাস্থ্য বিভাগের সবচেয়ে বড় অফিসার- যাকে বলা হয় সিভিল সার্জন- সেই ডাঃ মোঃ আজমল হোসেন - যুহায়ের এর বাবাকে বাগেরহাটের বিখ্যাত দেখার স্থানগুলো দেখানোর ব্যবস্থা করে দিলেন। সংগে একজন গাইড- হাসিখুশি যুবক কামরুজ্জামানকে নিয়ে বাবা গেলেন-নয় গম্বুজ মসজিদ, ষাট গম্বুজ মসজিদ এবং খান জাহান আলী এর সমাধি সৌধ দেখতে। খান জাহান আলী ১৪২৯ খীস্টাব্দে বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে বাগেরহাট অঞ্চলে আসেন এবং খলিফাতাবাদ পরগনা গঠন করেন- যার রাজধানী ছিল এই বাগেরহাট।

বাগেরহাটের প্রায় সকল প্রাচীণ স্থাপনা এই শাসক ও সুফী সাধকের সময়কার কীর্তি। উনার উপাধি ছিল উলুগ খান ও খান-ই-আজম। তার সমাধি সৌধের কাছে আছে বিশাল দিঘী যা খাঞ্জালী দিঘী নামে পরিচিত। বাগেরহাটে শত ব্যস্ততার মধ্যেও কিন্তু বাবা যুহায়ের এর কথা ভোলেনি। বাবা বারবার কামরুজ্জামানকে বলছিল- কুমির দেখা যাবে কিনা? কামরুজ্জামান জানালো বছরের এই সময়টাতে সাধারণত কুমির দেখা যায়না তার উপর বছর দুয়েক আগে একটা কুিমর নাকি মারাও গিয়েছে।

সমাধি সৌধে গিয়ে জানা গেল দুটি মা কুমির নাকি ডিম দিয়েছে এবং সেই ডিমে 'তা' দিতে মা কুমির নাকি ডিমের কাছে এসে বেশিরভাগ সময় পাহারা দেয়। তবে সেখানে যাওয়া বিপজ্জনক তো বটেই এবং প্রশাসনের নির্দেশ আছে কেউ যেন কুমিরকে বিরক্ত না করে। বাবা কামরুজ্জামানকে বললেন 'দেখো তো কুমির দেখা ম্যানেজ করতে পারো কিনা?' করিৎকর্মা কামরুজ্জামান কিছুক্ষণ পর ঘুরে এসে জানালো- 'দেখা হয়তো যাবে স্যার, তবে অনেকদূর হাটতে হবে আর সাবধানে যেতে হবে, রিস্ক আছে। ' হাটতে রাজি বাবা- সাবধানীও বটে তিনি আর রিস্ক নিতেও আপত্তি নেই। শুরু হলো দিঘীর পার ধরে হাটা- ছোটো খাটো ঝোপ জঙ্গল পেরিয়ে চল্লেন দুজন- চারিদিকে আর কেউ নেই।

কিছুদূর যাওয়ার পর দেখা গেল ডালপালা দিয়ে ঘেরাও দেয়া একটা জায়গা- ওখানেই নাকি কুমির তার ডিম পাহারা দিচ্ছে। পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল তারা। কিন্তু ঘেরাওয়ের ভেতরে একটা গর্ত ছাড়া আপাতত আর কিছু দেখা যাচ্ছে না। কামরুজ্জামান বলল- 'স্যার ডরও লাগে- কুমিরটা ঘাপটি মেরে লুকায়ে আছে, আবার কখন দাবার দেবানে কেজানে- ওই গর্তের মধ্যে ডিম আছে। ' কিছুটা মন খারাপ করে বাবা পিছিয়ে এলেন- কুমির দেখা হলোনা- যুহায়ের এর জন্য নেয়া তো দূরের কথা, ফিরে আসার সময় লাকড়ি হাতে এক মধ্যবয়সীর কাছে জিজ্ঞাসা করে শোনা গেল আরেকদিকে নাকি আরেকটি মা কুমির ডিম পেড়েছে- শুনেই বাবা উৎসাহী হয়ে উঠলেন- কামরুজ্জামানের মুখেও দেখা গেল চকচকে আশার আলো- ‘আসেন স্যার’ বলে বাবাকে ফেলেই সে প্রায় দৌড়ে গেল অনেক দূর।

আবার আগের মত ঘেরাও দেয়া আরেকটি জায়গা- হ্যাঁ- কুমির এখানে আছে বৈকি। যুহায়ের এর জন্য জ্যান্ত কুমির নেয়া না গেলেও ছবি তো নেয়া যাবে- বাবা ভয়ে ভয়ে দূরথেকে ছবি তুলতে লাগলেন আর ভাবতে লাগলেন যুহায়ের এই কুমির দেখার সত্যি ঘটনাটি শুনে কত খুশি হবে। এরই মধ্যে সেখানে হাজির এক যুবক- নিজেকে সে এই সমাধি সৌধের অন্যতম সেবক বলে দাবি করলো- সে বাবাকে সাহস দিলো আরও কাছে যেয়ে ছবি তুলতে- কামরুজ্জামান সাবধান করলো- কিন্তু বাবা ততনে ঘেরাও দেয়া জায়গার মধ্যে ঢুকে পড়েছে যুবকটির সাথে- পায়ের শব্দ না করে কুমিরের ছবি তুলছে- ওদিকে নিচুস্বরে বারবার কাতরকন্ঠে ডেকে চলেছে কামরুজ্জামান- 'স্যার আসেন- আর না- আর না। ' বাবা ফিরে এলেন একসময়- যুবক আর কামরুজ্জামানকে ধন্যবাদ জানালেন। কুমিরের খাবার হিসেবে দেয়ার জন্য 'সেবক' একটি মুরগি বা কিছু গরুর মাংস কিনে দেবার অনুরোধ করলো বাবাকে।

তিনি কিছু টাকা সেবকের হাতে দিয়ে এলেন- আর বল্লেন ' ভাই , কুমিরটিকেই কিছু খাওয়াবেন। ' বাবার মনে তখন উত্তেজনা। পরদিন ঢাকা ফিরে আসলেন বাবা- কম্পুটারের পর্দায় বাবার তোলা কুমিরের ছবি দেখে যুহায়ের তো আত্মহারা, তার প্রশ্নের শেষ নেই- বাবা কুমির কি করে পানি থেকে আসলো- ডিম কত বড়- ও কী খায়- ওর দাঁতগুলো কত বড়- তোমাকে কামড়ালো না কেন- লেজটা কেন ছবিতে দেখা যাচ্ছে না- ডিম কেন মাটি দিয়ে ঢাকা- আরও কত কী। সব প্রশ্নের উত্তর কি বাবাই জানে? তিনি কুমির বিষয়ে কিছু তথ্য সংগ্রহ করে যুহায়েরকে জানালেন- কুমির একধরণের জলজ সরিসৃপ। পৃথিবীতে অসংখ্য প্রজাতির কুমির রয়েছে।

বাংলাদেশে সাধারণত দুইজাতের কুমির পাওয়া যায়। মিঠা পানির কুমির আর লোনা পানির কুমির। বাগেরহাটের কুমিরগুলো মিঠাপানির কুমির। বাংলাদেশে সুন্দরবন অঞ্চলে কুমির পাওয়া যায়। কুমির অনেকদিন বাঁচে।

আমাদের দেশী কুমিরের গড় আয়ু সাধারণত ৭০ বছর- তবে এরা ১৩০ বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে। কুমির সাধারণত লম্বায় ৫.৫ মিটার পর্যন্ত হয় তবে ১০ মিটার লম্বা কুমিরও দেখা গেছে অস্ট্রেলিয়াতে। ওজনে এরা ৫০০-২০০০ পাউন্ড পর্যন্ত হতে পারে। মে মাস এদের ডিম পাড়ার সময়। ডিম পাড়ার আগে মা কুমির মাটি ও আগাছা দিয়ে জলাভূমির পাশে ঢিবির মত বাসা তৈরি করে।

এককবারে প্রায় গড়ে ৩০-৫০ টি ডিম পাড়ে। প্রজাতিভেদে ডিমের সংখ্যার তারতম্য হয় । ডিম পাড়ার পড় ৮০-৯০ দিনের মধ্যে ডিম ফুঁটে বাচ্চা কুমির বের হয়। এ সময়টা মা কুমির সতর্কতার সাথে ডিমগুলো পাহারা দেয় ও ডিমের দিকে কেউ এগিয়ে গেলে তার প্রতি হিংস্রভাব দেখায়। কুমির সাধারণত মাছ খেয়ে থাকে।

তবে মুরগী এবং অন্যান্য প্রাণী যেমন ইঁদুর, ছাগল, গরু, হরিণ এগুলোও খায়। কুমির একটি বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী- কুমিরের চামড়া দিয়ে নানা সৌখিন জিনিস তৈরি হলেও এরকম একটি প্রাণী শিকার করা প্রায় বিশ্বব্যাপী নিষিদ্ধ। যুহায়ের কুমির ভালোবাসে- সে কুমির শিকার করা পছন্দ করে না- সে চায় কুমিরের বাচ্চা, কুমির বাবা আর কুমির মায়েরা সুখে শান্তিতে থাকুক।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.