আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাধবকুন্ডের একটা ভীতিকর স্মরণীয় দিন....

জীবন যখন যেখানে যেমন

২০০০ সালের দিকে বাংলাদেশের সিলেটে ১ বছরের জন্য থাকা হয়েছিল আমার। সিলেটের শহরে হযরত শাহজালাল (রঃ) এর দরগার কাছেই ছিল আমাদের বাসা। সেখানকার নিরিবিলি শান্ত পরিবেশে থাকতে বেশ ভাল লাগতো আমার। চারিদেকে সবুজের সমারহ,পাহাড়,টিলা সবকিছুই অন্যরকম মনে হতো সিলেটের। হয়ত এই ইট পাথরের ঢাকা শহর ছেড়ে হঠাৎ করে মফস্বলে যেয়ে থেকেছিলাম সেজন্য এত ভাল লেগেছিল আমার।

সেসময় সিলেটের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখার সুযোগও হয়েছিল। কয়েকটা জায়গায় গেছিলাম আমরা...জাফলং, শ্রীপুর, তামাবিল, শ্রীমঙ্গল, হরিপুর, মাধবকুন্ড। তার মধ্যে মাধবকুন্ড যাওয়াটা স্মরণীয় হয়ে আছে আমার কাছে। সিলেট শহর থেকে গাড়িতে করে আমরা মাধবকুন্ড গেছিলাম। রাস্তার দৃশ্য খুবই সুন্দর,চারিদিকে টিলা আর পাহাড়।

টিলা গুলো চা বাগানে সবুজ হয়ে আছে,বড় বড় গাছ টিলার উপরে। অসম্ভব সুন্দর জায়গা পুরোটা সিলেট। প্রায় ২ থেকে আড়াই ঘন্টার মত লেগেছিল আমাদের পৌঁছাতে। মাধবকুন্ডে দেখার মধ্যে পাহাড়ী ঝর্ণাটাই আসল। চারিদিকে খাসিয়া আদিবাসীদের বাস।

আমরা আশেপাশে বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে জায়গাটা দেখলাম,পাহাড় দিয়ে ঘেরা জঙ্গলের মত ছিল জায়গাটা, পাহাড়ের উপর থেকে পানি পড়ছে সজোরে। আমরা সেই পানির কাছে গেলাম নৌকা করে। তারপর দেখলাম একজনকে পাহাড়ের উপরে ঝর্ণার কাছ থেকে উঁকি দিচ্ছে। আমাদেরও মাথায় আসলো লোকটা এত উঁচু পাহাড়ে উঠলো কিভাবে নিশ্চয়ই রাস্তা আছে। খুঁজে বের করলাম রাস্তা,তখন প্রায় বেলা পড়ে এসেছিল।

মানুষজন বলছিল এখন এই পাহাড়ে উঠেন না,সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে,অন্ধকার হয়ে গেলে আর নামতে পারবেন না,রাস্তা ভাল না। সেখানে সাইনবোর্ড ও দেখলাম ২ জনের নাম ঠিকানা দেয়া আছে তাতে, তারা নাকি এই পাহাড়ের উপর থেকে নীচে পড়ে মারা গেছে। কিন্তু কে শুনে কার কথা, আমরা ৪ জন ছিলাম আর আমার বাবুটা ছিল দেড় বছরের,ওকে নেয়ার জন্য আমাদের সাথে ছিল ড্রাইভার। সবাই আমরা রাজী উপরে এখনই উঠব,হাঁটু পর্যন্ত পানি টানি পার হয়ে আমরা পাহাড়ের উপরে উঠার রাস্তা ধরলাম। মোটেও ভাল না, মাটির পাহাড়ী রাস্তা,তার মধ্যে চারিদিকে বড় বড় গাছের জঙ্গল।

আমরা উপরে উঠেই যাচ্ছি,কারো কোন কথা নাই, আজকে পাহাড়টা জয় করেই ছাড়বো, ভাব এমন যেন এভারেষ্ট জয় করতে যাচ্ছি, বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে... ড্রাইভার বাবুটাকে কাঁধের উপরে চড়িয়ে নিজেও উঠছে, আমাদের নিজের শরীর নিয়ে উপরে উঠতে জান শেষ হয়ে যাচ্ছিল, সে যে কিভাবে উঠছিল কে জানে। অনেক উপরে উঠে গেছিলাম আমরা আর চারিদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিল, দিনের আলো আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছিল। রাস্তা অনেক পিচ্ছিল ছিল,এক পা এদিক ওদিক হলে একদম পাহাড়ী জঙ্গলের ভেতরে যেয়ে পড়তে হবে এমন অসস্থা। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে আবছা আলো আসছিল,তার মধ্যেই উঠছি আমরা কয়জন আর কোন কাকপক্ষীও ছিল না,ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনা যাচ্ছিল খালি। উঠতে উঠতে আমি অনেক হয়রান হয়ে যেয়ে এক পর্যায়ে দাঁড়িয়ে গেলাম, আমার সাথের ভাবীও দাঁড়ালো আমার সাথে, উনার হাজবেন্ড আর আমার ড্রাইভারও কিছু উপরে যেয়ে দাঁড়ালো।

আমার হাজবেন্ডের দেখা নাই,ও আরো উপরে চলে গেছিল আমরা যে থেমেছি তা সে বুঝেইনি। আমার মাথায় তখন বাড়ি পড়লো যে আমরা করছিটা কি,এই ছোট বাচ্চা নিয়ে সন্ধ্যার সময় আমরা একটা অজানা অচেনা জায়গায় তাও আবার পাহাড়ের উপরে উঠছি। আসলে উপরে উঠার নেশায় আমাদের খেয়াল ছিলনা যে চারিদিকে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। একটু পরেই বিপদে পড়তে হবে। আমি ঐ ভাই কে বললাম আর যাব না ও কে ডাকেন।

উনিও আমার হাজবেন্ডকে ডাকলো,কোন সারা পাওয়া গেল না। একটু উপরে যেয়ে আরও জোরে ডাকলো তখন জবাব আসলো। বলে আর একটু পথ আছে তার পরেই নাকি একদম উপরে পৌঁছে যাব। আমি বলি এখন না নামা শুরু করলে সব শুদ্ধ একেবারে উপরেই চলে যাব সারা জীবনের জন্য, জানের মায়া থাকলে এখনি নামো, আমি নামা শুরু করলাম। কি আর করার সেও নেমে আসা শুরু করলো।

নামার সময় আরো ভয়,মরার অন্ধকার হওয়ার ভয়ে তাড়াতাড়ি নামবো তাও নামতে পারি না, খাড়া রাস্তা তার উপরে পিচ্ছিল একদম। যাইহোক কোন মতে তাড়াতাড়ি নামলাম, নেমে মনে হল জানে যেন পানি আসলো। মানুষজন দেখতে পেলাম,সবাই চলে যাচ্ছে জায়গাটা দিনে কেমন রমরমা থাকে সন্ধ্যা হওয়ার আগেই একদম সুনসান হয়ে গেছিল। আমরাও গাড়িতে যেয়ে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রওনা দিলাম। তখন পুরা অন্ধকার হয়ে গেছিল চারিদিকে,সাথের সবাই বললো আমি যদি ঐ সময় নামার কথা না বলতাম তাহলে আজকে আমাদের খবর ছিল, ঐ পাহাড়ের উপরে কিভাবে যে রাত কাটাতাম সেটা চিন্তা করলে এখনো গায়ে কাটা দিয়ে উঠে।

আবার শিয়ালের ডাকও শুনা যেত শহরেই রাতের বেলা। পাহাড়ের উপরে শিয়াল মনে হয় আমাদেরকে খেয়েই ফেলতো। তবে পরে আরেকদিন এসে,দিন থাকতেই আমরা পাহাড়ের উপরে উঠবো সেই প্রতিশ্রুতি নিয়ে বাসার পথে রওনা দিলাম। যদিও পরে আর কখনো আমাদের যাওয়া হয়নি সেখানে। খুব ভীতিকর স্মরণীয় একটা দিন আমার জীবনের সেটা,কিন্তু মাধবকুন্ড পাহাড়ের উপরে না উঠতে পারার জন্য আজও মন খারাপ লাগে... ছবিগুলো নেট থেকে নেয়া...


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.