টুকিটাকি ভাবনাগুলো
অতি সম্প্রতি বাহরাইন ও কুয়েতে বাংলাদেশের শ্রমিকদের নিয়ে যেসব লন্কাকান্ড হয়ে গেল এসব নিয়ে আরব দেশগুলোর অবস্থান কিন্তু নমনীয় না। তাদের মনোভাব এমন যে এভাবে থাকতে হলে থাকো না হলে চলে যাও।
এনিয়ে আমরা পত্রপত্রিকাতে পরস্পর-বিরোধী অনেক কথা শুনেছি। কোনটিই কিন্তু এসম্পর্কে সঠিক পরিপ্রক্ষিত দেয় না। বর্তমানে সিটিজেন জার্নালিজম ও ব্লগের যুগে আমি আশা করব আমাদের এইসব নির্যাতিত ভাইবোনেরা ব্লগের মাধ্যমে তাদের দু:খকষ্টের কথা জানাবেন।
আরব দেশগুলোর সরকারী মনোভাব এমন হলেও সাধারণ লোকজন কি ভাবছে সেটা আমাদের জানার তেমন সুযোগ নেই। গ্লোবাল ভয়েসেস অনলাইনে কিছু আরব ব্লগারদের মতামত পড়ে মনে হয়েছে যে তাদের অনেকে হয়ত এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে।
বাহরাইনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী কর্তৃক বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্য কাজের অনুমতি দেয়াতে নিষেধাজ্ঞা জারির পর সে দেশী ব্লগার খালিদ বলেছেন :
সম্প্রতি, বাহরাইনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী একটা ডিক্রি জারি করেছেন বাংলাদেশীদের নতুন কাজের অনুমোদন না দেয়ার জন্য!! এটা একজন বাংলাদেশীর জঘন্য অপরাধ করার কারনে!! এখানে আমি জানতে চাই: এই আইন করার পেছনে মূল উদ্দেশ্য কি? এর আইনী দিক গুলো কি? একটা অপরাধ হলে, তদন্ত হবে আর বিচার ব্যবস্থাও আছে তার জন্য। তাহলে বাংলাদেশের লোকের উপর এই নিষেধাজ্ঞা কেন? আর এই পক্ষপাতিত্ব কেন? আর কোন আইনের আওতায় একজন বা একদলের অপরাধের জন্য একটা গোটা জাতিকে শাস্তি দেয়া হচ্ছে? আমরা আইনের দেশে আছি না? এই সিদ্ধান্ত কি ঠিক? অবশ্যই না আর এটা একটা গুরুতর ভুল। আজকে সবাই এমন ভাবে বলছে যেন সব বাংলাদেশী অপরাধী আর খুনী, যাদেরকে বের করে দেয়া উচিত।
(বিস্তারিত গ্লোবাল ভয়েসেস বাংলায় )
দুইশোরও বেশী বাংলাদেশী শ্রমিককে কুয়েত থেকে বহিস্কার প্রসঙে সৌদি ব্লগার আহমাদ লিখেছেন :
আমি নিশ্চিত শুধু কুয়েত নয় গাল্ফ অঞ্চলের আমরা সবাই এশিয়ার শ্রমিকদের নীচু করে দেখি। তাদের কোন ধরনের প্রশংসা বা সম্মান তো করিই না, পশুর মত ব্যবহার করি। আমাদের নাগরিকরা তাদের সাথে এমনভাবে ব্যবহার করে যেন তারা মানুষ নয়, আর কোম্পানিরাতো তাদের সাথে আরও খারাপ ব্যবহার করে, কম বেতন দেয়া থেকে শুরু করে। আমি জানি যে ১২০ আমেরিকান ডলার (৪৫০ রিয়াল) হয়ত বাংলাদেশে উঁচু মাসিক বেতন অনেকের জন্যে, কিন্তু এই বেতনে রিয়াদ, দুবাই বা কুয়েতে কোন শ্রমিক জীবনধারণ করতে পারবে না, কোন টাকা জমানো তো দুরে থাক। আমরা যদি দৈনিক তিন বেলা খাবারের কথা চিন্তা করি, শ্রমিকদের কমপক্ষে ১২ রিয়াল ব্যয় করতে হবে প্রতিদিন।
এবং তার মানে তাদের ৩৬০ রিয়াল খাবারের পেছনেই ব্যয় হবে, কাপড়, যাতায়াত ও অন্যান্যর কথা বাদই দিলাম।
গাল্ফ অঞ্চলের শ্রম মন্ত্রণালয়রা দেশের নাগরিকদের কাজের ব্যাপারেই শুধু চিন্তা করে এবং এই দুর্বলতাকেই কাজে লাগায় বিভিন্ন কোম্পানি। তারা শ্রমিকদের উপর তাদের শয়তানি চাল চালে কম বেতন, অতিরিক্ত কাজ, নিকৃষ্ট বাসস্থান ইত্যাদি দিয়ে এবং সব ধরণের সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে। যদিও কাজের সময় নয় ঘন্টার বেশী হবার কথা নয় আমরা দেখছি যে নির্মানশিল্পে এমনকি রেস্টুরেন্টে সারাদিন ধরে শ্রমিকরা কাজ করছে। তারপরেও আমরা রেগে যাই যখন মানবাধিকার সংগঠনগুলো গাল্ফ অঞ্চলে দাসত্বের অভিযোগ তুললে।
সরকারী বড় বড় প্রকল্পের পাওনা যখন পরিশোধ করতে সরকার দেরী করে, অনেক কোম্পানিরাই শ্রমিকদের বেতন দেয়া বন্ধ রাখে। যখন শ্রমিকরা প্রতিবাদ শুরু করে এবং তাদের কণ্ঠ তাদের দেশের কর্মকর্তাদের কাছে পৌঁছে, ঐসব কোম্পানীরা তাদের কাছে বলে যে সরকারের কাছ থেকে টাকা পাচ্ছে না বলে তারা দিতে পারছে না। অথচ হয়ত তাদের প্রাপ্যের কিছু পরিমাণই বাকী আছে যা হয়ত সাত-আট মাস পরে পাওয়া যাবে। এর সাথে শ্রমিকদের কোন সম্পর্ক না থাকলেও তারা এ দিয়ে শ্রমিকদের জিম্মি করে রাখে। তাদের আট মাস ধরে বেতন দেয়া হয় না - তারপরেও আমরা রেগে যাই যখন তারা অপরাধ ও চুরি চামারী বেছে নেয়।
যখন আমি শ্রমিকদের দু:খ দুর্দশার আসল ঘটনাগুলো শুনি, আমার এটাই বুঝতে পারি যে তাদের দাসের মতই ব্যবহার করা হচ্ছে। কোন কোন কোম্পানি তাদের রেসিডেন্স পার্মিট নবায়নের জন্যে একমাসের বেতন কাটে, আরেক কোম্পানি শ্রমিকদের সাপ্তাহিক ছুটি থেকে বঞ্চিত করে। তাদের ছুটির জন্যে কোন ওজর শোনা হয় না, এমনকি অসুস্থ অবস্থায়ও তাদের কাজ করতে হয়। একজন শ্রমিক বলেছে যে সে তিন বছর ধরে সৌদি আরবে কাজ করছে কিন্তু একবারও হজ্জ্ব করতে পারেনি কারন তার কোম্পানি তাকে দুদিনেরও ছুটি দেয়নি।
এইসব খারাপ দিকগুলোর প্রভাব বাসার কাজেও পড়েছে।
সমস্ত উপমহাসাগরীয় দেশগুলিতে বাসার কাজের লোক বা ড্রাইভার ১৮ ঘন্টা একনাগারে কাজ করে, এবং এদের অনেকেরই ঠিকমত শোয়ার যায়গা নেই। কারও কারও শোয়ার জায়গা মিলে রান্নাঘরে, ফ্রিজ এবং ওভেনের মাঝামাঝি যায়গায়। একদা আমার এক বন্ধু বলেছিল (গর্ব সহকারে) যে সে তার কাজের মেয়েকে উঠান ঝাড়ু দিতে দেয় না কারন সে হয়ত পড়শীর ড্রাইভারের ফোন নম্বর জেনে যেতে পারে। তাই সে কখনও বাড়ীর বাইরে যাবার সুযোগ পায় নি এবং হয়ত কোনদিন সুর্যরশ্মির স্পর্শ পায় নি ছাদে কাপড় শুকানোর সময় ছাড়া। আমার বন্ধুটি বলেছিল যে তাকে পরিবারের সাথে দোকান বা রেস্টুরেন্টেও যেতে বাধা দেয়া হয় অন্যান্য কাজের লোকের সাথে পরিচিত হবে এই ভয়ে।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘সে কি জেলে বন্দী?' সে বলল, ‘কিন্তু এই কাজের মেয়ে তো সুখেই আছে!'
আমাদের সবচয়ে বড় সমস্যা ইসলাম ধর্ম নিয়ে নয়, অবশ্যই; আমরা আমাদের সংস্কৃতি এবং আমাদের ইসলামিক রীতি নিয়ে গর্ব করি কিন্তু সেগুলো পালন করি না। যে কোন দিন একটি নির্মান স্থানের সামনের ট্রাফিক লাইটে থেমে দেখবেন, কিভাবে ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস গরমে, শ্রমিকরা একটি যন্ত্রপাতির (অথবা ভেড়া বহনের) ট্রাকে গাদাগাদি করে আছে। কিন্তু কোম্পানির মালিকের লালসা বড়, তাদের বাসস্থান থেকে কার্যস্থলে আনা নেয়ার জন্যে বাস কেনে না, যা কিনতে হয়ত মাত্র ৪০,০০০ রিয়াল খরচ হত। যদি এই বিষয়টি আমার হাতে থাকত, ট্রাকে করে শ্রমিক বহনকারী কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করতাম, এবং বিচারে রায় হত মালিককে এক সপ্তাহ এভাবে যাতায়াত করতে হবে। (শুধুই আমার স্বপ্নে!)
আপনারাই বলেন, কখন আপনি আপনার ড্রাইভার বা কাজের লোকের জন্যে রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার এনেছেন? এবং আপনি ড্রাইভারকে কি আপনার মোবাইল ফোন দেন তার পরিবারের সাথে কথা বলার জন্যে? আর আপনার কাজের মেয়ের বেলায় কি হয়? সে কি এখনও পরিবারকে চিঠি লিখে পোস্টে পাঠায়?
এটি যে দাসত্ব এ ব্যাপারে আপনার কোন সন্দেহ আছে?
(সূত্র গ্লোবাল ভয়েসেস বাংলা )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।