আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফুলবাড়ী থেকে নন্দীগ্রাম : শিল্পবিকাশ, কৃষকের উচ্ছেদ এবং প্রাসঙ্গিক ভাবনা

.এই ব্লগে যে কয়টি পোস্ট আছে, সেগুলোর মন্তব্য সরাসরি প্রকাশিত হবে না। এই অক্ষমতার জন্য অগ্রিম ক্ষমাপ্রার্থী।

অনেক কাল আগের কথা। এক অলস বিকেলে চারুকলা ইন্সটিটিউটের উল্টোপাশের ‘ছবির হাট’ চত্ত্বরে গিয়েছি। উদ্দেশ্য ছবির হাটের শিল্পী বন্ধুদের সাথে একটা ম্যারাথন আড্ডা মারা।

সেখানে যাওয়ার পরই এক শুভার্থী বললেন একটু চলেন আমাদের সাথে, শাহবাগে মানববন্ধন করা হবে। মানববন্ধন বা অনশন জাতীয় ভদ্রস্থ আন্দোলনের উপর আমার কোন আস্থা নেই, এই কর্মসূচীগুলো হয়তো আন্দোলনের অংশ হিসেবে ঠিক আছে, কিন্তু চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করতে হলে সহিংস পন্থা ছাড়া কোন বিকল্প আমি জীবদ্দশায় দেখি নি। তবু মানববন্ধনের বিষয়ে আগ্রহী হলাম। যা জানতে পারলাম, সেটা বিশ্বাস করলাম না। বাংলাদেশে দিনাজপুরের অনেকগুলো গ্রাম নাকি ধ্বংস করে দিয়ে সেখান থেকে কয়লা উত্তোলন করতে আসছে এক বিদেশী কোম্পানি।

বিষয়টি আমার কাছে সত্যি সত্যিই অবিশ্বাস্য মনে হলো। একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে এরকম বর্বর এবং অমানবিক কোন কাজ যে করা যায়, সেটা আমার বিশ্বাসের বাইরে। কিন্তু বক্তার উপর আস্থা থাকার কারনে পুরো বিষয়টিকে উড়িয়ে দেয়া গেল না। খোঁজ খবর নিয়ে কয়েকদিনের মাঝেই বুঝতে পারলাম, যা বলা হয়েছিলো, তা পুরোপুরি সত্যি। তারপরের ইতিহাস পাঠকদের জানা।

অনেকগুলো প্রাণ বলি দিয়ে একটি সাময়িক বিজয় অর্জন করা গেছে বলে মনে হয়। ‘মনে হয়’ এই কারনে বলছি, এশিয়া এনার্জী এবং সরকারের মাঝে আদতে কী চুক্তি হয়েছে, সেটা সাধারন নাগরিকদের কাছে এখন পর্যন্ত পরিষ্কার নয়। এখনও এশিয়া এনার্জী ফুলবাড়িতে তাদের অফিস গুটিয়ে নেয়নি, সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি’র নাম করে সেখান থেকে টেলিভিশন-ক্যারেমবোর্ড-ফুটবল-চালের টিন এসব বিতরণ চলছে, আর সেই চর্ব চোষ্য লেহ্য পেয়-তে অনেক দালাল আর বিশ্বাসঘাতক তৈরী হচ্ছে সেই অভাবী জনপদে। আশংকা করছি, এই খেলা এতো সহজে শেষ হবে না। এবার আসা যাক পশ্চিমবঙ্গের নন্দীগ্রাম প্রসংগে।

নতুন করে কিছু বলার নেই। এখানেও সেই একই গল্প। শিল্পায়নের নাম করে বহুজাতিক কোম্পানির হাতে অগনিত কৃষকের শেষ সম্বলটুকু তুলে দেওয়ার চেষ্টা। সেই চেষ্টায় বহুজাতিক কোম্পানির বড়ো আশ্রয় আর মদতদাতা সেই সরকারই। এখানেও অনেকগুলো প্রাণের অপচয়, অনেকগুলো গুলির শব্দ, অনেকগুলো পরিবারের জন্য চিরন্তন দীর্ঘশ্বাস।

আমি বুঝতে পারি না কেন একটা সরকার, যে সরকার জনগনের ভোটে নির্বাচিত সেই সরকার জনগনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে উভয় ক্ষেত্রেই জনকল্যানকামী ‘সরকার’ বাহাদুর উচ্চকন্ঠে বলছেন, বিনিয়োগ না এলে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সেই বিনিয়োগ মানে শিল্পায়নের বিনিয়োগ, কৃষি কিংবা সেবাখাতের বিনিয়োগ নয়। সেই বিনিয়োগ লব্ধ যে উন্নয়ন আর অগ্রগতি, সেই উন্নয়ন আর অগ্রগতি আমার মতো সমাজের উচুঁ স্তরের মানুষের জন্য, সাধারন মানুষের জন্য নয়। এই দুটো আন্দোলনের যে উল্লেখযোগ্য অর্জন আমি লক্ষ্য করি, সেটা হচ্ছে তৃণমূল পর্যায় থেকে নেতৃত্ব উঠে আসা।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আন্দোলন সংগঠিত করছেন মূলত : বামপন্থীরা, আর পশ্চিমবঙ্গের বেলায় আন্দোলনের প্রতিপক্ষ হচ্ছেন বামপন্থীরা (মানচিত্রের এপারে ওপারে কী ট্রাজেডি!) কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই একেবারে পাড়ার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র এদের মাঝ থেকে একটি বিকল্প নেতৃত্ব গড়ে উঠছে। রাজনীতিকে এইভাবে জনমানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বোধহয় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো ধন্যবাদ পেতে পারে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে প্রতিরোধ একেবারেই শেকড় থেকে উঠে এসেছে এবং আসছে, এই প্রতিরোধ কি দমন করা সম্ভব? সভ্যতার ইতিহাস বলে, সেটা সম্ভব নয়। মানুষ যখন তার নিজের অস্তিত্বের জন্য লড়ে, তখন সে সর্বহারা হয়েই লড়ে, তাকে আর কিছু হারানোর ভয় দেখিয়ে আন্দোলন থেকে সরিয়ে দেওয়া সম্ভব হয় না। তাহলে কি শিল্পবিকাশ হবে না? এপারে বাংলাদেশী বাঙালি আর ওপারে পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা কি শিল্পবিমূখ হয়ে বসে থাকবে, আর বাদ বাকী জাতিগুলো খুব দ্রুতই তাদেরকে কাঁচকলা দেখিয়ে এগিয়ে যাবে? এই ঘনবসতিপূর্ণ বাংলায় তো অগনিত উন্মুক্ত জমি পাওয়া যাবে না, এখানে তো কৃষক শ্রমিকের জমি জমা, গ্রাম গঞ্জ দখল করেই শিল্পের বিকাশ ঘটাতে হবে।

এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আর এখানেই আমার প্রস্তাবটি হচ্ছে যে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষকে শিল্পবিকাশের সাথে সম্পর্কযুক্ত করা। তবে এশিয়া এনার্জীর ওপেনমাইন পদ্ধতিতে কয়লা আহরণ জাতীয় বর্বর ও পরিবেশ বিপর্যয় সৃষ্টিকারী শিল্প নয়, উৎপাদনমূখী কারখানা বিকাশের যে শিল্প, সেই শিল্পের বিকাশে ক্ষতিগ্রস্থ জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করা। এই সম্পৃক্ততা নিয়েও অনেকগুলো হাস্যকর কথা শোনা যায় ইদানিং। বলা হয়ে থাকে, শিল্পের প্রসার ঘটলে কৃষক পরিবার সেখানে কাজ পাবে, এই কর্মসংস্থান একটি বিশাল সম্পৃক্তকরণ।

এ কথাটি আসলেই হাস্যকর। কৃষককে তার জমি থেকে উচ্ছেদ করে দিয়ে তাকে শ্রমিক করে ফেলা আদতে তার জীবনযাত্রার কোন উত্তরণ নয়, বরং তার জীবনযাত্রাকে ধ্বংস করে ফেলারই নামান্তর। যেটা প্রয়োজন, এসব ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদেরকে সরাসরি কারখানার অংশীদারিত্ব বা মালিকানায় সম্পৃক্ত করা। তবে মেনে নেওয়া যেতে পারে একজন কৃষককে যদি তার জমির মূল্যের সমপরিমাণ টাকার শেয়ার সেই কোম্পানিতে দেওয়া হয়, তাহলে কৃষক একটা শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকানা পায়। এক্ষেত্রে কৃষক, নতুন শিল্পকারখানাকে তার নিজের প্রতিষ্ঠান ভাবতে পারে, কিন্তু বদলি শ্রমিক, অস্থায়ী শ্রমিক এসব লেবেল লাগিয়ে তাকে উৎপাদনের ঘানি ঘুরানোর বলদ বানিয়ে ফেললে এই ‘নিজের প্রতিষ্ঠান’ ভাবার বোধটুকু কোনভাবেই জন্মাবে না।

কৃষকের তো একটা গতি হলো, কিন্তু যাদের জমি নেই সেই অগুনতি বর্গাচাষীদের কী হবে? তাদের কথাটাও ভাবতে হবে। সেই ভাবনার কারনেই তাদেরকেও মালিকানায় অংশ দিতে হবে। সেই অংশগ্রহণ হবে তার শ্রমের বিনিময়ে। অর্থাৎ তাদেরকে কর্মসংস্থান দিতে হবে কমপক্ষে সেই পরিমান আয়ে, যা তারা এর আগে রোজগার করতেন। পাশাপাশি যাবতীয় মানবাধিকার এবং চাকুরির নিশ্চয়তা তো দিতে হবেই।

এই সব ক্ষতিগ্রস্থের জন্য যোগ্য বিকল্প বাসস্থান নিশ্চিত করতে হবে। শিল্পবিকাশে ব্যস্ত লোকজন যখন গলা ফাটিয়ে উন্নয়ন উন্নয়ন করে চেঁচাতে থাকেন, তখন তারা বোধহয় শুধু নিজেদের উন্নয়নের কথাই ভাবেন, হাজার হাজার সাধারন মানুষের কথা ভাবেন না। নিজেদের স্বার্থেই এখন এই সব বঞ্চিত মানুষের কথা তাদের ভাবতে হবে। নইলে অসংখ্য ফুলবাড়ী আর নন্দীগ্রামের উপাখ্যান লেখা হবে এই জনপদে, অসংখ্য মান্নান মিয়া আর মলয় পাল মারা যাবে ফসলের জমিতে, কিন্তু রক্তের দাগ দেওয়া মাটিতে কখনোই বেনিয়াদের সাধের শিল্প বিকাশ হবে না। =============================== অনেক অনেককাল আগে ওয়েবপত্রিকা বীক্ষন থেকে একটা লেখা চাওয়া হয়েছিল ।

লেখা দেয়ার বহুদিন পরেও বীক্ষন আপলোড হয় নি । ব্যাপারটা আমি ভুলেই গিয়েছিলাম । আজ আরেকজনের একটা কথার সূত্র ধরে বীক্ষন খুলে দেখলাম এপ্রিলে পত্রিকাটি আপলোড হয়েছে এবং সেখানে আমার লেখাটিও রয়েছে । লেখাটি নিজের ব্লগে তুলে রাখলাম ।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।