একছিলো গপ্পি,তার নাম ছিলো মোঃ আবুল কালাম। কিন্তু লোকে তাকে কালন বলী বলে ডাকতো। সে লেখাপড়া জানতো না, কিন্তু তার গফ শুনে অনেক শিক্ষিত লোকও তার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতো। পূর্বে সে নদীতে লঞ্চ চালাতো। আর তখনকার সময়ের বিভিন্ন ঘটনাকে সে মানেুষের কাছে বলতো।
তবে এর মধ্যে প্রায় সবগুলোই ছিল তার মন গড়া বানোয়াট।
সে বলতো সে নাকি সাগরের বড় বড় জীবজন্ত্রুর সাথে লড়াই করেছে। গড়ে প্রতি সপ্তাহে একটি করে সাগরের নীল তিমি অথবা একটি করে হাঙ্গর শিকার করতো। আর এগুলোর কাঁটা দিয়ে সে ঘরের খুঁটি দেয়েছিল।
একদিন সন্ধা বেলা এক চায়ের দোকানে বসে কালন বলী তার তিমি শিকারের গল্প করছিলো।
এমন সময় এক লোক তাকে বলে,
-ভাই কালন আমি একটি নতুন ঘর তৈরী করব, কিন্তু আমার কাছে প্রয়োজনীয় কাঠ নেই; তাই কাঠের অভাবে আমি ঘরের কাজ শুরু করতে পারছিনা। শুনেছি তুমি সাগরে অনেক বড় বড় তিমি মাছ শিকার করো এবং সে গুলোর কাঁটা দিয়ে তোমার ঘরের খুঁটি দিয়েছ। যদি আমাকে একটি তিমি শিকার করে এনে দাও-তাহলে আমি বিনিময়ে তোমাকে এক লক্ষ টাকা দিব আর মাছ ধরতে যাওয়ার সকল ব্যবস্থা করব,তবে যদি না পার তাহলে সাগর থেকে ফিরে আসার পর থেকে পরবর্তী এক বছর আমার বাড়িতে বিনা পয়সায় মজুরি খাটবে।
লোকটির কথা শুনে কালন বলীর মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। দেখে মনে হলো যেন তাকে ভূতে দখল করল।
কালন বলী যতটা না গপ্পি ছিলো ততটা ছিলো লোভী ও বুদ্ধিমান। সে লোকটিকে বল&লো,
-ঠিক আছে আমি আপনাকে একটি তিমি মাছ এনে দিব, তবে আমার একটি শর্ত্ আছে, শর্তটি হল আমি আপনার লাখ টাকা চাইনা। আপনি আমাকে প্রথমে একটি লঞ্চ কিনে দিতে হবে এবং আমি তিমি শিকার করে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমার পরিবারের সকল খরচ বহন করবেন। আমিও আপনাকে কথা দিচ্ছি, আমি যদি তিমি শিকার করতে নাও পারি তবুও আগামী তিন মাসের মধ্যে ফিরে আসবো এবং আপনার বাড়িতে বিনা পয়সায় মজুরি খাটবো। যদি তিন মাসের মধ্যে ফিরে না আসি তাহলে ধরে নিবেন সাগরে আমার মৃত্যু হয়েছে।
বোকা লোকটি তার সকল কথা মেনে নিল। সে কালন বলীর জন্য লঞ্চ তৈরী করা শুরু করলো। লঞ্চ তৈরী শেষ হয়েছে এমন সময় কালন এসে বলে,
-লঞ্চটিকে ভালো করে রং লাগিয়ে দিবেন এবং লঞ্চটির নাম হবে ‘কালাম। ’
বোকা লোকটি তার এসব কথাও মেনে নিল। তিমি শিকার করতে কালন সমুদ্রে যাত্রা শুরু করবে, যাত্রা শুরু করার আগে কালন গ্রামের কয়েকজন মোড়লকে ডেকে বল্ল,
-ভাইয়েরা আপনারা সবাই স্বাক্ষি থাকেন যে, আমি এই লোকটিকে একটি তিমি শিকার করে এনে দেব এর বিনিময়ে সে আমাকে এই লঞ্চটি দিয়েছেন এবং আগামী তিন মাস আমার পরিবারের সকল খরচ বহন করবে;তিমি শিকারে গিয়ে আমার খাওয়ার খরচ হিসেবে আমাকে এখন ১০,০০০ (দশ হাজার)টাকা দিবে।
আমিও আপনাদের সামনে তাকে কথা দিচ্ছি-আমি যদি তিমি শিকার নাও করতে পারি তবুও তিন মাসের মধ্যে ফিরে আসবো এবং যদি তাকে তিমি দিতে না পারি তাহলে ফিরে আসার সময় থেকে পরবর্তী একবছর তার বাড়িতে বিনা পয়সায় মজুরি খাটবো কিন্তু এই তিন মাসের মধ্যে যদি একদিনও তিনি আমার ছেলে মেয়েদেরকে কোন প্রকার কষ্টদেয় তাহলে আমিও আমার ওয়াদা ভঙ্গ করবো।
গ্রামের মোড়লদেরকে স্বাক্ষি রেখে সব কাজের সমাধা করে কালন তিমি মাছ শিকার করার জন্য সমুদ্রে লঞ্চ ভাসালো। সাগরের বুকে লঞ্চ ভাসতে ভাসতে একমাস পার হয়ে গেলো কিন্তু কালন কোন তিমির দেখা পেলনা। এইদিকে সে তার সাথে যে খাবার নিয়ে আসলো সে খাবারও শেষ হয়ে এলো।
কালন মনে মনে ভাবতে লাগলো এই বিশাল সমুদ্রে সে কোথাও কি কোন খাবারের সন্ধান পাবে? প্রায় একমাস অতিবাহিত হয়ে গেল, বাড়িতে তার ছেলে মেয়েরা কি করছে, লোকটি ওয়াদা মতো তাদের সকল খরচ বহন করছে কিনা, এই বিশাল সমুদ্রে যদি সে কোন তিমির সন্ধান না পায় তাহলে সে কি তার গ্রামে ফিরে যাবে? যদি তিন মাসের মধ্যে সে গ্রামে পিরে না যায় তাহলে লোকটি তো তার পরিবারের খরচ বহন করা বন্ধ করে দিবে, তখন তো ছেলে মেয়েরা না খেয়ে মরবে।
এসব কথা ভাবতে ভাবতে কালন তার লঞ্চকে সাগরের কূলে ভিড়ালো।
সমুদ্রের কিনারে লঞ্চ রেখে কোথাও কোন খাবার পাওয় যায় কিনা এই উদ্দেশ্যে কালন একটি বনের মধ্যে গেল। বন থেকে নানা রকমের ফল সংগ্রহ করে সে লঞ্চে এসে উঠলো। এই সময় আকাশ ছিলো খুবই মেঘলা, সমুদ্রে ছিলো অতিরিক্ত ঢেউ। এ অবস্থা দেখে কালন মনে মনে ভাবতে লাগলো।
-এই আবহাওয়ায় সমুদ্রের বুকে লঞ্চ ছাড়া উচিত হবেনা। তারছেয়ে ভালো আজকের দিনটি এখানেই কাটিয়ে দিই। সমুদ্র শান্ত হলে লঞ্চ চালু করব।
সমুদ্রের বুকে অনেক দিন ভাসতে ভাসতে কালন অনেকটা হাপিয়ে উঠেছিলো। তাই সে লঞ্চ থেকে নেমে সাগরের কূলে কূলে হাটতে লাগলো।
কিছু দূর যাওয়ার পর সে দেখতে পেলো-সাগরের কূলে একটি তিমি মাছের বাচ্ছা বাসছে। এটি দেখে কালন আনন্দে আপ্লুত হয়ে বলতে লাগলো।
-ঈশ্বর আমার কপাল খুলছে।
সে তিমির বাচ্চাটিকে টেনে তার লঞ্চের কাছে আনলো। তিমির বাচ্চাটিকে তার লঞ্চের সাথে ভালো করে ভেঁদে বাড়ির উদ্দেশ্যে লঞ্চকে সমুদ্রের বুকে ভাসালো।
পাঁচদিন পর লঞ্চ তার গ্রামের ঘাটে ভিড়লো। খবর পেয়ে তার ছেলে মেয়েরা সাগর পাড়ে ছুটে আসলো। কালন তাদেরকে বুকে জড়িয়ে জিজ্ঞেস করে,
-লোকটি তোমাদেরকে কোন কিছুতে অসুবিধায় পেলেনিতো?
-না বাবা লোকটি আমাদেরকে কোন অসুবিধায় পেলেনি,তিনি আমাদেরকে কোন কিছুতে অভাববোধ করতে দেননি। তিনি তার ওয়াদা মত আমাদের সংসারের সকল খরচ বহন করেছেন, আপনি কি আপনার ওয়াদা মত লোকটির জন্য তিমি শিকার করে এনেছেন?
-হ্যাঁ আমিও আমার ওয়াদা মত লোকটির জন্য একটি তিমি মাছ শিকার করে এনেছি।
কালন বলী পিরে এসেছে এই খবর শুনে লোকটি কালনের বাড়িতে এসে কালনকে বলে,
-ভাই কালন আমি আমার ওয়াদা মত প্রায় তিন মাস ধরে তোমার পরিবারের সকল খরচ বহন করেছি,তোমাকে একটি লঞ্চ তৈরি করে দিয়েছি, তুমি শিকারে যাওয়ার সময় তোমাকে নগদ দশ হাজার টাকা দিয়েছি।
এখন তুমি তোমার ওয়াদা মত আমার জন্য তিমি মাছ শিকার করে আনছ কিনা?
-হ্যাঁ আমি আমার ওয়াদা মত আপনার জন্য একটি তিমি মাছ শিকার করে এনেছি।
-তাহলে এখন তিমি মাছটি কোথায়?
-মাছটি লঞ্চে আছে।
-চল লঞ্চে গিয়ে আগে আমাকে তিমি মাছটি বুঝিয়ে দাও।
তারা দু’জনে নদীর ঘাটে লঞ্চের কাছে গেল। কালন লঞ্চের ডেক থেকে একটি ছোট তিমির বাচ্চা টেনে এনে লোকটির সামনে রেখে বলল্,
-এই নিন আপনার তিমি মাছ।
-কালন তুমি কি পাগল হয়ে গেছ?
আমি তোমাকে বলেছি একটা তিমি মাছ শিকার করে এনেদিতে,এখন দেখি তুমি আমাকে তিমির বাচ্চা দিচ্চ্ এটি আমি নিবনা।
-এটি আপনি নেন বা না নেন তা আমার জানার বিষয় নয়। আপনার সাথে আমার কথা ছিল, আমি আপনাকে একটি তিমি শিকার করে এনে দেওয়ার। এখন আমি আমার ওয়াদা অনুযায়ী আপনাকে তিমি শিকার করে এনে দিয়েছি; আপনার ইচ্ছা হলে এটি নেন অথবা নদীর পানিতে ভাসিয়ে দেন এতে আমার কিছুই যায় আসেনা।
কালন বলীর এই কথা শুনে লোকটি রেগে গিয়ে চিৎকার করে বলতে লাগল,
-তুমি ভণ্ড, প্রতারক।
তুমি আমার সাথে প্রতারণা করেছ। আমি তোমাকে পুলিশে দেব।
পরের দিন বিকেলে লোকটি গ্রামের মোড়লদেরকে ডেকে কালন বলীর জন্য বিচারের আয়োজন করলেন। বিচারক লোকটির মুখের কথা শুনে, কথা গুলো সত্য কিনা কালনকে জিজ্ঞাসা করলে কালন উত্তর দিল,
-তিনি যা বলেছেন তার কিছু্টা সত্য কিছুটা মিথ্যা। ওনার সাথে আমার কথা ছিলো, আমি ওনাকে একটি তিমি শিকার করে এনে দেওয়া,ওনার সাথে আমার এরকম কোন কথা হয়নি যে, আমি ওনাকে এমন তিমি শিকার করে দিতে হবে যার কাঁটা দিয়ে তিনি ঘরের খুঁটি দিতে পারেন।
আমার সাথে কথা হয়েছিল তিমি এনে দেওয়ার; আমি তিমি এনে দিয়েছি। আপনারা কেই কি বলতে পারবেন যে এই মাছ তিমি মাছ না এটি অন্য কোন মাছ? সুতরাং আমার ওয়াদা আমি পালন করেছি। আমার সকল দায়-দায়িত্ব শেষ।
কালনের কথা শুনে গ্রামের মোড়লরা সবাই লোকটিকে বলে,
কালনের কথাই ঠিক,সে তার ওয়াদা পালন করেছে। তুমি অন্যকে ফাঁদে পেলতে গিয়ে নিজেই সেই ফাঁদে পড়ে গিয়েছ।
এখন কিছু করার নেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।