আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সঙযাত্রা : বিলুপ্তপ্রায় লোকনাট্য

কাউকে উপকার করো না, তাহলে সে অপকার করতে পারবে না। বাংলাদেশের লোকনাট্যের একটি অন্যতম শাখা ‘সঙযাত্রা’। সঙযাত্রা ‘সঙখেলা’ নামেও পরিচিত। এটি একটি দলগত পরিবেশনা। সঙযাত্রার নির্দিষ্ট কোন পা-ুলিপি থাকে না।

সঙদলের ম্যানেজার ও অন্যান্য শিল্পীরা একত্রে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সঙযাত্রার কাহিনী, গান ও সংলাপ তৈরি করে থাকে। সমসাময়িক ঘটনাকে উপজীব্য করে হাস্যরস, ব্যাঙ্গরস ও আদিরসের সমন্বয়ে তৈরি হয় সঙ এর কাহিনী। একটি কাহিনীর মধ্যে একটি সঙ এর সমাপ্তি হয়। কাহিনীও হয় অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। দু’টো, তিনটা কিংবা চারটা দৃশ্যের মধ্যেই একটি সঙ এর পরিসমাপ্তি ঘটে।

সর্বোচ্চ সময় লাগে পনের মিনিট থেকে পঁচিশ মিনিট। গ্রামের অল্পশিক্ষিত, স্বশিক্ষিত লোকদের সমন্বয়ে গঠিত হয় সঙযাত্রার দল। কাজেই সঙযাত্রায় হাস্যরস, ব্যাঙ্গরসের পাশাপাশি আদিরস বা অশ্লিলতার ভাগই থাকে বেশি। সঙযাত্রার নামকরণও হয়ে থাকে আঞ্চলিক ভাষায়। টাঙ্গাইল অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে পরিবেশিত কয়েকটি সঙযাত্রার নাম নি¤েœ উল্লেখ করছি।

১. কিস্তি ২. এ্যাঞ্জেনা ৩. বিয়া বিয়া ৪. তিলিং তিলিং ৫. ঢাহা যামু ৬. বেকার বিলু ৭. ফুটানি ৮. ক্যাতুর কুতুর ৯. ঘোতর ঘোতর ১০. ফোট্টুয়েনটি ১১. গাববুইড়া ছার ১২. ঘোড়ার আ-া ১৩. বউ-শাশুড়ির ঝগড়া প্রভৃতি। একটি সঙযাত্রায় দুই থেকে পাঁচটি পর্যন্ত চরিত্র থাকে। সঙযাত্রার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হলো ‘জোকার’। একটি সঙযাত্রা দলে একাধিক জোকার থাকতে পারে। অভিনয়, নৃত্য, সংলাপ, গান এ চারটি বিষয়ে পারদর্শী শিল্পীই সঙযাত্রার জোকার নির্বাচিত হয়।

জোকারের পাশাপাশি অবশ্যই নারী চরিত্র থাকবে। তবে সংখ্যায় একজন কিংবা দু’জন। পুরুষরাই নারী সেজে অভিনয়, সংলাপ, নৃত্য ও গান গেয়ে থাকে। নারী চরিত্রের ক্ষেত্রে অল্পবয়সী ও সুদর্শন কিশোর হতে হবে। জোকার ও নারী চরিত্রে অভিনেতা-অভিনেত্রীর পায়ে ঘুঘুরি থাকে।

এ ছাড়াও থাকে দু’একটি পার্শ্ব চরিত্র। ৩ সঙযাত্রার চরিত্রগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ১. কাইনছার মাও ২. কোদাইলা ৩. পটল ৪. মতি ৫. আচমকা ৬. চুম্বুলি ৭. ছেনদি ৮. ছেনদা ৯. কুইরা ১০. কেতুইরা ১১. কুইচা মুরগি ইত্যাদি। সঙযাত্রায় চার/পাঁচ ধরনের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয়। যেমনÑ ১. বাঁশের বাঁশি ২. পাতার বাঁশি ৩. খোল ৪. করতাল ৫. হারমোনিয়াম ইত্যাদি। সঙ শিল্পীদের পোশাক, সাজ দুই’ই অদ্ভূত ও বিচিত্র ধরনের।

যেমন- ক) জোকারের পোশাক- ছেঁড়া ফুল প্যান্ট। এক অংশ হাঁটুর ওপর পর্যন্ত কাটা। জুতা- এক পায়ে একটি অথবা দু’পায়ের দুটো দুই মডেলের। সার্ট- এক হাতা বিশিষ্ট উল্টোভাবে নিচের বোতাম ওপরের ঘরে লাগানো হয়। চশমা- ছোট আকারের তৈরি বাঁশের ঠোনা বা ঠুলি।

টাই- মোটা দড়ি দিয়ে তৈরি গলা থেকে হাঁটুর নিচ পর্যন্ত লম্বা। টাইয়ের নিচের মাথায় বদনি বাধা। অন্যান্য পুরুষ চরিত্রেও প্রায় একই ধরনের পোশাক থাকলেও জোকারের পোশাক বেশি আকর্ষণীয় হয়ে থাকে। খ) নারীদের পোশাক উপকরণ Ñ চড়া রঙের খাটো পেটিকোট। ব্লাউজ, বক্ষবন্ধনী।

গামারী গোটার মালা। কালো রঙের লম্বা পরচুলা অথবা বেণী। জুতা- চপ্পর অথবা হাইহিল। সঙযাত্রা শিল্পীদের সাজ গ্রহণের উপাদানগুলো নি¤œরূপ : ১. সফেদা ২. সিঁদুর ৩. আলতা ৪. কালি ৫. আয়না ৬. চিরুনী ৭. বেলের কষ ৮. নদীর পানি ৯. ম্যাচের কাঠি ১০. গামছা ইত্যাদি। মঞ্চ কিংবা আসরের সন্নিকটে কোনো গৃহস্থবাড়ির কাচারি ঘর সঙযাত্রা দলের শিল্পীদের ‘সাজঘর’ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

প্রতি বছর চৈত্র মাসে চড়ক পূজায় নিয়মিত সঙযাত্রা হতো। এখন ততোটা হয় না। সামাজিক অস্থিরতা, ধর্মীয় গোড়ামী, গ্রাম্য কোন্দল, আর্থিক টানাপোড়েন সত্ত্বেও হিন্দুদের সামাজিক আচার অনুষ্ঠান যেমন- বিয়ে ও অন্নপ্রাসন উপলক্ষে সঙযাত্রা হয়ে থাকে। দিনে কিংবা রাতে যেকোনো সময় সঙ পরিবেশিত হতে পারে। তবে রাতই সঙযাত্রা পরিবেশনের উপযুক্ত সময়।

এ সময় মানুষের কাজ থাকে না। একই সঙ দলে হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের শিল্পী থাকতে পারে। সঙযাত্রার পরিবেশনার সময় পরিধিকাল হয় প্রায় তিন ঘণ্টা থেকে চার ঘণ্টা। সঙযাত্রার মঞ্চ কোন ধনী গৃহস্থবাড়ির ওঠোন, বাড়ির আঙ্গিনা কিংবা মাঠের মাঝখানে অথবা একপাশে নির্মাণ করা হয়। মঞ্চের চতুর্দিকে কিংবা তিন দিকে গোল হয়ে বসে দর্শক-শ্রোতা।

শুধুমাত্র সুবিধাজনক স্থান দিয়ে শিল্পীদের আগমন-প্রস্থানের জন্য জায়গা রাখা হয়। চৌকি সাজিয়ে সঙযাত্রার মঞ্চ করা হয়। দর্শক-শ্রোতা সাধারণতঃ খড়, ধারী বা চাটাই বিছিয়ে অথবা মাটিতে বসেই সঙযাত্রা উপভোগ করে। পরিচয়গীত ও বন্দনাগীত সঙযাত্রার অপরিহার্য অংশ। সব সঙযাত্রাদলের পরিচয়গীত ও বন্দনাগীত প্রায় একই ধরনের।

পরিচয় গীতে সঙযাত্রার নাম, দলের ঠিকানা, শিল্পীদের নাম, কে কোন চরিত্রে অভিনয় করবে তা স্পষ্ট করে তুলে ধরা হয়। একটি পরিচয়গীত নি¤েœ তুলে ধরছি। ভালো ফলদা গ্রামে বীণাপাণি নামে সঙযাত্রার গান। এই দলেরই ওস্তাদ আছে বলাই বাবু নাম \ এই দলেরই ম্যানেজার আছে সুধাংশু বাবু নাম \ এই দলেরই জোকার আছে কার্তিক বাবু নাম \ এই দলেরই জোকার আছে পবন বাবু নাম \ ভালো ফলদা গ্রামে বীণাপাণি নামে সঙযাত্রার গান \ এই দলেরই বাঈজি আছে অতুল বাবু নাম \ ভালো ফলদা গ্রামে বীণাপাণি নামে সঙযাত্রার গান \ বন্দনাগীত করি দুনিয়া বন্দনা ঘরের মানুষ ভালা না হইলে সংসারই চলে না করি দুনিয়া বন্দনা \ পুবেতে বন্দনা গো করি মা গো পুবের ভানুঃশ্বর এক দিকেতে উদয় ভানু চৌদিকে ফজর। করি দুনিয়া বন্দনা ... \ পশ্চিমে বন্দনা গো করি হজ্জ মক্কার শহর সেইখানেতে নামাজ গো পড়ে যতো হাজীগণ।

করি দুনিয়া বন্দনা... \ উত্তরে বন্দনা গো করি হিমালয় পর্বত সেই পর্বত ভাইঙ্গে গো গেলে দুনাই হয় গারদ। করি দুনিয়া বন্দনা... \ দক্ষিণে বন্দনা গো করি ক্ষীর নদীর সাগর সেই সাগরে চালায় গো ডিঙ্গা চান্দু সদাগর। করি দুনিয়া বন্দনা... \ আকাশে বন্দীলাম আমি আকাশের কামনী পাতালে বন্দীলাম আমি পাতালের কামনী চাইরো দিকে বন্দনা গো কইরে মইধ্যে করলাম স্থান, ভদ্রশ্রোতা শুনেন সবাই সঙযাত্রার গান। করি দুনিয়া বন্দনা ঘরের মানুষ ভালা না হইলে সংসারই চলে না করি দুনিয়া বন্দনা \ বন্দনাগীতের এই মূল পয়ারটির সাথে ওস্তাদের নাম বন্দনা করে থাকে। নি¤েœ ভূঞাপুরের ফলদার ‘বউ-শাশুড়ির ঝগড়া’ ও ‘ফুটানি’ নামক দুটি সঙযাত্রার উল্লেখ করছি।

\ ১ \ বউ-শাশুড়ির ঝগড়া চরিত্র অভিনেতা কেতুইরা : জগদীশ চন্দ্র দত্ত কেতুইরার মাও : অতুল চন্দ্র দাস হুবুচুনি : হিজরা শহীদুল ইসলাম হুবুচুনির মাও : নিশিকান্ত দাস প্রথম দৃশ্য কেতুইরার মাও : বউ মা, বউ মা। আ-বউ মা, ও-বউ মা। কই, কতো, বেইল অইলো। ঘোমে থিকা উঠো। উইঠা থালি-নোটা মাইনজা আত মুখ ধুইয়া ভাত খাও।

উঠো বউ মা। হুবুচুনি : আই আই আই আই। কিবা হরি গো। ক্যাবোল সাতদিন ধইরা বিয়া অইছে; আইজি থালি নোটা মাইনজা ভাত খাবার কয়। কিবা হরির পাল্লায় পড়লাম গো।

আই- আই- আই, ছিঃ ছিঃ ছিঃ। কেতুইরার মাও : কিবা বউ গো। ওই বউ, আইজি মোহে মোহে জব দেয়। তর মতো ছিলোান বউ হলাটি দিয়া বাইরাইয়া ছয়জন খ্যাদাইছি। আল্লারে কিবা বউ গো।

কোনো শরম-লজ্জা নাই। হরির মোহে মোহে জব দেয়। হুবুচুনি : আমিও কোম না লো। তর মতো হরি ম্যালা দেখছি। নিহা-বিয়া আগে আরো সাত জাগায়-অইছাল।

কেতুইরার মাও : আই- আই- আই- আই। ওর বিয়া বোলে আরো সাত জায়গায় অইছাল। হেই জন্যেই তো এতো জাইরা গো। ওই নটি ছিলোান বউ, তুই আমার বাড়ি থিকা যা। [চড় থাপ্পর মেরে বাড়ি থেকে বেড় করে দেয়।

এমন সময় কেতুইরা বাড়ি আসে। ] কেতুইরা : মা, ও মা-মাগো। কেতুইরার মাও : ওই ড্যাহর। ড্যাহর মা-মা করিস না। কেতুইরা : ক্যা মা! কি অইছে।

তোমগোর বউরে তো দেখতাছি না? কেতুইরার মাও : তুই অরই কতা কস। ওই জাইরা বউয়ের কতা কস। কী অইছিলো জানস। আমগোর বরই গাছের ডাইলে একটা বল্লার চাইক আছিলো না ? কেতুইরা : হ মা হ। বল্লার চাইকে কী অইছে।

কেউ চাইক কাইটা মধু চুরি করছে? কেতুইরার মাও : নারে বাজান না। হেই চাইকের মধ্যে তর বউ ড্যাল দিছাল। বল্লায় না আইয়্যা তর বউরে কামড়ান শুরু করে। আমি দিশবিশ না পাইয়্যা হলা হাছুন দিয়া বাইরাইরা থাপরাইয়া থাপরাইয়া হেই বল্লা ছাড়াইয়া দিছি। হেই জইন্যে তর বউ বাপের বাড়ি চইলা গেছে।

আমি কতো না করলাম। কোন কতাই মানলো না। রাগ কইরা চইলা গেলো। অরে আর আনমু না। কেতুইরা : হ, মা- হ।

ওইডা আর আনমু না। ন্যাগো মা ? কেতুইরার মাও : আমার পোলার কত্তো বুদ্ধি। কত্তো জ্ঞান গো। জ্ঞান বুদ্ধি অবো না ক্যা। ওয়ানটি ওয়ান পাস করছে।

জ্ঞান বুদ্ধি তো অবোই। কেতুইরা : ও মা, মাগো। তরে একটা কতা কই। কেতুইরার মাও : ক বাজান। আজারডা ‘ক’।

কেতুইরা : মা, মা গো একটাবার আনি গা। কেতুইরার মাও : ড্যাহর, ঐ ড্যাহর, ওই বউ আমি আর আনবার দিমু না। তরে আবার বিয়া করামু। ওই বউ আর আবো না। কেতুইরা : ও মা আমি একটা বুদ্ধি দেই।

মানবি কিনা তাই ‘ক’ ? তুই আর আমি যাইয়্যা পায়ে ধইরা পইড়া যামু গা। তাও কি আবো না ? কেতুইরার মাও : আমি! আমি ধরমু ঐ হারামির বাচ্চার পাও! কেতুইরা : মা-নু যাই। আর একটাবার যাই। শ্যাষম্যাষ রিক্স নেই। কেতুইরার মাও : আলাইনা ফালাইনা না তুই আমার একটামাত্র পোলা।

আমার কইজ্জার টুকরা। নু, নু যাই। (প্রস্থান) [হুবুচুনিদের বাড়ি] হুবুচুনির মাও : আ- আহারে। আইজ সাতদিন ধইরা ম্যায়াডারে দেহিনা গো। কিবা জাগায় বিয়া দিলাম কিছুই জানি না।

[এমন সময় হুবুচুনির প্রবেশ। ] হুবুচুনি : [কেঁদে কেঁদে] ও মা, মা গো। আমারে না কিবা কইরাই মারলো গো। ও মা গো। মারতি মারতি আমারে তক্তা বানাইয়াই ফালাইছে গো, ও মা গো মা ? হুবুচুনির মা : আইছোস তুই ? আহারে আয় আয় তর কতাই কইতাছি।

তর কি অইছে, অবা কইরা কান্দস ক্যা? হুবুচুনি : দ্যাহোনা ? আমারে মাইরা কিছু থয় নাই। [পিঠ দেখায়] হুবুচুনির মা : তরে মারছে ? কোন সতীনে মারছে ? তার কইলজাডা আমি টান দিয়া ছিঁড়া হালামু। হুবচুনি : খালি মারে নাই মা। গাইলও দিছে। আমি বোলে বেশি ভাত খাই, তুমি বলে ঘষি চুরি করো, এইগনা কইয়া মাগো মা... আমারে মারছে।

হুবুচুনির মা : তাই নাহি ? হুবুচুনি : [করুন সুরে গান ধরে] দারুণ শাশুড়ির জ্বালায় প্রাণে বাঁচা দায় দারুণ শাশুড়ির জ্বালায় প্রাণে বাঁচা দায় কোন কিছু কইলে পরে ঝাটা মারে আমার গায়, দারুণ শাশুড়ির জ্বালায় প্রাণে বাঁচা দায় \ মাগো তুমি করছাও ঘষিগো চুরি আমি নাকি ভাত খাই বেশি গো মাগো কোন কিছু কইলে পরে স্বামী দিয়া বাপ বানায় দারুণ শাশুড়ির জ্বালায় প্রাণে বাঁচা দায় \ (কেতুইরা ও কেতুইরার মায়ের প্রবেশ। ) কেতুইরার মাও : বিয়াইন। ও বিয়াইন। বিয়াইন, বিয়াইন। হুবুচুনির মা : বিয়াইন বিয়াইন করিস না লো।

বিয়াইন অতো সুখের না। আমার ম্যায়াডারে মাইরা কিছু থস নাই লো। সতীনের সতীন লো। ওই সতীন? কেতুইরার মাও : ওই বিয়াইন আমি আন্নের ম্যায়ারে কইল মারি নাই। আমি বল্লা খ্যাদাবার যাইয়্যা থাপরাইয়া থাপরাইয়া খালি বল্লাগোনা ছাড়াইয়া দিছি।

তাই না রে গ্যাদা ? কেতুইরা : হ মা হ। তুই খালি বল্লা ছাড়াইছস। [হুবুচুনির কাছে গিয়ে] তুমি কিবা আছো হুবুচুনি ? হুবুচুনির মাও : ওই ড্যাহর। নিমুরাইদা ড্যাহর তুই আমার ম্যায়ার কাছে যাবি না। তর মায় আমার ম্যায়াডারে বারি দিয়া পিঠ ফাঠাইয়া ফালাইছে।

তুই বালবালাই করিস না। কেতুইরা : বারি দিছে বালা কতা। টিন আইনা ঘর তুলমু। হুবুচুনির মাও : ওই ড্যাহর। মারছে ... মারছে।

আর তুই কস ঘর তুলমু। কেতুইরা : আগে তো কইন নাই। যাইগ্যা। নও এহোন বাড়ি যাই। হুবুচুনি : আমি যামু না।

ওই মা আহোছে আমরা কিরা দিয়া দেই। হুবুচুনির মাও : হ, নু কিরা দেই। হুবুচুনি হুবুচুনির মাও : ডেহির পাড়ে অক্ত কিরা অইলো শক্ত। কিরা অইলো শক্ত কিরা অইলো শক্ত কিরা অইলো শক্ত। কেতুইরা : মা গো- মা।

আমগোরে কিরা দিছে। তর কিরা নাই মা ? আয় আমরা কিরা তুইলা দেই। কেতুইরা কেতুইরার মাও : নদীর পাড়ে কাইসা কিরা গেলো ভাইসা। কিরা গেলো ভাইসা কিরা গেলো ভাইসা কিরা গেলো ভাইসা \ হুবুচুনি হুবুচুনির মাও : কান্দার উপুর কান্দা তরা মাও-পুত হুদ্দা বান্দা। বান্দা লো মাগি মান্দা বান্দা লো মাগি মান্দা বান্দা লো মাগি মান্দা \ কেতুইরা কেতুইরার মাও : মামুগো বাড়ি বউরা বাঁশ বউরা বাঁশ কাইটা চুঙ্গা একটা বানাইয়া তর সব কিরা ভইরা ম্যাচের কাটি ঘাও দিয়া কিরা দিলাম পুইড়া।

কিরা দিলাম পুইড়া লো মাগি কিরা দিলাম পুইড়া লো মাগি কিরা দিলাম পুইড়া \ [ঝগড়া শেষে দুপক্ষ মিলে যায় এবং এভাবেই সঙযাত্রাটি শেষ হয়। ] \ ২ \ ফুটানি [পটল বাবু মাচার নিচে বসে চিন্তা করছে। ময়মনসিংহের সিনেমা হলে ঝাড়–দারের চাকরি করতো সে। কিছুদিন আগে ময়মনসিংহের পাঁচটি সিমেনা হলে একযোগে বোমা হামলা করেছিলো মৌলবাদীরা। বোমা হামলায় অনেক দর্শক মারা যায়।

আহত হয় অনেক। বিধ্বস্ত হয় সিনেমা হল। সে বোমার আঘাতে ঝাড়–দার পটলও আহত হয়েছে। সেদিন হঠাৎ শখের বশত: একটা ড্যান্স দেখতে পটল দাঁড়িয়েছিলো দর্শকদের পেছনে। অমনিই আগুনের ফুলকি।

চাকরি নেই। বেকার। অভাবের সংসার। চিকিৎসাও করাতে পারছে না। তাই মাচার নিচে বসে চিন্তা করছে- ফাঁসি দেবে।

পটলের একমাত্র ছেলে। নাম ফুটানি। সারাদিন ফুর্তি করে ঘুরে বেড়ায়। একারণে তার নাম ফুটানি। এ নাম অবশ্য দিয়েছে ছাগোইলা পাড়ার গাঞ্জা পাগলা।

ফুটানি ওয়ানটি ফোর পাশ করেছে। বেকার। এদিকে চার মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি। বাড়ির মালিক গণেশ চোটটা সবেমাত্র চোখ রাঙিয়ে গেলো তিনদিনের মধ্যে বাড়ি ভাড়া দিতে হবে। নইলে পটল ঝাড়–দারের হাড় গুড়ো করে সরবত বানায়ে ছাড়বে।

পটলের স্ত্রী আচমকা কথায় কথায় পটলকে খোটা দেয়। মঞ্চে আসে আচমকা। ] আচমকা : ও বাড়ির কানাই কুইরা হেদিন চারকি নইছে। তোমার নাগালা ঘর হোরনের চারকি। দ্যাহোগা অঙ্গিন টিপি কিনছে।

ভাত ছালুন থোওনের ঠা-া বাসকো কিনছে। তুমি হারা জীবনে কি কিনছো? খালি সিনামা দেখছো। ন্যাড়ের মাতাও কিনো নাই। ব্যাইয়্যা পার ছাতাও কিনো নাই। পটল : দ্যাক বেশি ফালা ফালা কতা কবি না।

একলা একলাই ফাইলা মাছের নাগালা বলক পাইরা উঠস। কুইচা মুরগির নাগালা ঘরে বইয়্যা থ্যাকস তো ? দুইনাদারীর খবর রাহস? খাস যে পাস কুনু? কামাই করস? আচমকা : খাওয়ার খোটা দিও না কইলাম। ভ্যাবারের ডেহি কুরকা দুইডাও বেইচা খাইছো। আড়গিলার মধ্যে দিলা যে শরম করলো না? ওগোনা কার বাপের বাড়ির। আমার পোলাডা ড্যাহরের নাগাল খালি জুয়ান হইছে।

কামাই নাই। কানাই কুইরার পোলাডা খুব ভালা। হেদিন অর মার নিগা কি সোন্দর ছোট বেলারুজ কিনা আনছে। পটল : ‘হ’ ভালা লো। ডাইল খায়।

চুরি করে। আচমকা : তালি তো ভালাই। আমার পোলা নবাবজাদা। ডাইল মুখেই তুলে না। মুসুরের ডাইলি কি, আর মাশের ডাইলি কি? পটল : এবি কি কই।

তুই একটা কুইচা মুরগি। দুইনাদারীর খবর জানস না। আরে হে ডাইল না। বতলের ডাইল। ফেন্সিডাইল।

[তিন’শ ষাট বছর ধরে ফুটানির সাথে গণেশ কোলার মেয়ে চুম্বুলির প্রেম। ফুটানির কাছে চুম্বুলি সিনেমার নায়িকা মৌসুমী, শাবনুর ও রাভিনার চেয়েও সুন্দরী। আর চুম্বুলির কাছেও ফুটানি সালমান শাহ, শাহরুখ খান ও গোবিন্দর চেয়েও হ্যান্ডসাম। বোমা হামলার আগের দিন ফুটানি ও চুম্বুলি ফ্রন্টস্টলে একত্রে বসে ম্যাটিনি শোতে সিনেমা দেখেছে- কাইনজাল পট্টি ‘কইলজা ছিড়া’ সিনেমা হলে। সিনেমার নাম ‘কইলজা ফ্যাপড়া আড্ডি গুড্ডি’।

নায়ক-নায়িকা গাওয়া গানটি এ রকম-] চুম্বুলি : তুমি আমার কইলজা ফ্যাপড়া তুমি আমার জান, তুমি আমার ছায়া বেলারুজ তুমি সোনার চান। ফুটানি : তুমি আমার আড্ডি গুড্ডি তুমি কাইলা ছাগল, আমি ‘ই’ মাইসা কুত্তার নাগাল তোমার জইন্যে পাগল। [ফুটানি চাকরি খুঁজছে। চুম্বুলির ভীষণ গর্ব, তার প্রেমিক ফুটানি বাবু ওয়ানটির ফোর পাস দিয়েছে। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শিক্ষিত।

এমন সময় চাকরির সার্কুলার হাতে চিৎকার করে ডাকতে ডাকতে মঞ্চে আসে ফুটানি। ] ফুটানি : চুম্বুলি রে... চুম্বুলি। চুম্বুলি : টু ... য়ু। [পার্শ্ববর্তী আম গাছে ডালে বসেই চুম্বুলি জবাব দেয়। ] ফুটানি : চুম্বুলি।

ও চুম্বুলি? ছরকেট কট অইছে। আই এম চারকিট টু ছাইতানতলা। চুম্বুলি : গাছের ডাইলে ছাইতান মাছ পামু কুনু ? নিকলা বিলে যাও। ফুটানি : আরে ছাইতান মাছ না। ছরকিট কট অইছে।

ছরকিট কট। চুম্বুলি : দ্যাহোছে। আবার ইংরেজি কয়। বুঝি না। বাংলা লাগাও সোনার লক্ষিণধর।

ফুটানি : চাকরি পাইছি। ছাইতানতলা চাকরী করবার যামু। চুম্বুলি : চাকরির ট্যাহা দিয়া আমার নিগা শিনা বান্দুইনা একটা ‘ই’ কিনা আইনো। ফুটানি : ঠিক আছে। আগে চাকরির ফরমানডা পড়বার দে।

চুম্বুলি : পড়ো। তাড়াতাড়ি পড়ো। ফুটানি : জরুরী নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ভরসা নাই সেবা সংস্থা পদের নাম- বুইটটা ম্যানাজার এতদ্বারা জানাইতেছি যে, ভরসা নাই সেবা সংস্থায় নি¤œবর্ণিত শর্ত সাপেক্ষে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন লোক নিয়োগ করা হইবে। ২৭২ পৃষ্ঠার পিটিশন আগামী ৬৪-১৪-২০০৩ তারিখের মধ্যে অবশ্যই জমা দিতে হইবে। শর্ত ও যোগ্যতা : ১) ভোগাস কলেজ হইতে ফোর টুয়েনটি (৪২০) পাশ হইতে হইবে।

২) ইউনিয়নের চেয়ারম্যান টাউট বাবুর পরিচয় পত্র। ৩) পৌর চেয়ারম্যান বাটবার বাবুর সার্টিফিকেট। ৪) গ্যাজেটেড অফিসার লোচ্চা বাবুর চারিত্রিক সার্টিফিকেট। ৫) প্রার্থীকে চল্লিশ বৎসরের ড্যাস ড্যাস অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। ৬) একশত বিশ বৎসরের মিথ্যাবাদী হইতে হইবে।

৭) চাকরিকালীন কোন বেতন পাওয়া যাবে না। যোগাযোগের ঠিকানা- ভরসা নাই সেবা সংস্থা (মিছাপুর গুদারা ঘাটের কাছে) বাসা নং- হাওয়া রোড নং- উচানিচা ফোন নং- (মোবাইল)- ফুররুৎ ছাইতানতলা। টাঙ্গাইল জেলার মধ্যে সদর উপজেলার বড় বাশালিয়া, রসুলপুর, বিন্নাফৈর, দাইন্যা, দেলদুয়ারের পাথরাইল, বাসাইলের বাথুলি, মির্জাপুরের শেহরাতৈল, ঘাটাইলের ডাকাতিয়া, হামিদপুর, পাটিতাকান্দি, ভূঞাপুরের ফলদা, নিকরাইল ও খানুরবাড়ির সঙযাত্রা দলের সুনাম ছড়িয়ে আছে দেশজুড়ে। বর্তমানে আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবের কারণে গ্রামীণ সমাজের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম লোকনাট্য সঙযাত্রা বিলুপ্ত হতে চলেছে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.