আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যুদ্ধপর্ব: সেদিন কী ঘটেছিল প্যালেস্টাইন হোটেলে?


নোট: [বেশ কিছু নেট বন্ধুর অনুরোধে ‌'ইরাক রণাঙ্গণে' বইয়ের ই-পাণ্ডুলিপি থেকে একটি দিনের ঘটনা ব্লগে প্রকাশ করলাম। পুরোটা করলে প্রকাশক.....। -- আনিস আলমগীর] মঙ্গলবার ৮ এপ্রিল ২০০৩ আক্রান্ত প্যালেস্টাইন হোটেল: চোখের সামনে সহকর্মীর লাশ সোমবার দিনে প্রচণ্ড হামলা হলেও রাতে হামলা ছিল না বললেই চলে। আজ ৮ এপ্রিল ঘটনার শুরু হয় ভোর পৌঁনে ৫টায়। ওয়েক আপ কলের মতই এলো গুলির শব্দগুলো।

একটানা চলছেই। মনে হচ্ছে একেবারে কানের কাছে। ঠ্যা...ঠ্যা...ঠ্যা...ঠ্যা....। বু......ম। ট্যেঁ.....।

কত রকম যে অস্ত্র আছে। হরেক রকম শব্দ। সবটার সঙ্গে পরিচিতও না। ৬ দিন ধরে হোটেলে একটানা বিদ্যুৎ নেই। লন্ড্রি চলছে না।

সব কাপড়ই ময়লা হয়ে আছে, ধোয়ার সুবিধা নেই। নিজে বাথরুমে পরিস্কার করবো- সেটাও সম্ভব নয় পর্যাপ্ত পানি নেই বলে। তাছাড়া আয়রণ না করে কাপড় পরাও যাবে না। গোসল করা পর্যন- সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিজের গায়ের গন্ধ নিজেরও লাগে।

সেন্ট মেরে নেই। মিনারেলের বোতল খালি হলে সেগুলোকে হোটেলের পানি নিয়ে ভর্তি করে রাখতাম। তার অনেক বোতল খরচ করে মাঝে মাঝে গোসল সারি। বাথরুমের কাজ সারি। আমি খালি গায়েই ঘুমাচ্ছিলাম।

মনে হচ্ছিল দু’চারটা গুলি এসে আমার বুকে লাগতে পারে। উঠে একটি ময়লা জামাই পরে নিলাম। গুলি ঠেকানারো জন্য....? নিজেকে প্রশ্ন করে নিজের হাসি পেলো। বিপদে মানুষ কত কিছুই করে, কত অবলম্বনই চায়। কিন' আমার সবচেয়ে ভাললাগে পাশের মসজিদের সে লোকটিকে।

মসজিদটি বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের বদৌলতে জগৎ বিখ্যাত হয়ে গেল। সাদ্দামের মূর্তি নিয়ে ফেরদৌস স্কয়ার আর মসজিদের ছবি সব চ্যানেলে দেখা যাচ্ছে এখন। সে মসজিদের ইমাম গত প্রায় ২০ দিন একটি কাজ অনবরত চালিয়ে যাচ্ছেন। যখনই প্রচণ্ড বোমার শব্দ শুনতে পান, তখনই তিনি মাইকে ডেকে উঠেন...আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, লা ইলাহা ইল্লালাহ...। আল্লাই মহান এবং সর্বশক্তিমান- এ লোকটি বিপদে পড়লে তাকেই স্মরণ করেন।

আমাকেও স্মরণ করতে স্মরণ করিয়ে দেন। সকালে আল্লাকে আমিও স্মরণ করে প্রস'তি নেই সারা দিনের। সকালের আশংকা আমার ক্ষেত্রে ঘটেনি সত্য কিন' সারাদিনই তার প্রতিফলন পেলাম। আজ বাগদাদে একটি অভিশপ্ত, একটি ভয়ংকর দিন কাটলো আমার। যুদ্ধ মানেই অকারণে হত্যা, মৃত্যু, বিভীষিকা।

যুদ্ধ সংবাদ সংগ্রহ মানে জীবন মৃত্যুর প্রশ্নও। সেটা জেনেই বাগদাদ রওয়ানা হয়েছিলাম। আজ যখন পত্রিকার জন্য লিখছি তখন শরীর কাঁপছে। গত এক মাসের মধ্যে মনে হচ্ছে এত খারাপ সময় বাগদাদে আর কাটাইনি। চোখের সামনেই দেখলাম এক সহকর্মী মারা যাচ্ছে।

বাকি চার জন অচেতন। জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি নিজেকে খুব কম সময় দেখেছি এরকম। তখন বেলা ১২টা। বাংলাদেশ সময় ২টা। আগে বাগদাদের সঙ্গে আমাদের সময় ব্যবধান ছিল ৩ ঘণ্টা।

কিন' এদের গ্রীষ্মকালীন সময় আরও এক ঘণ্টা এগিয়ে আসায় এখন ২ ঘণ্টা ব্যবধান। সকাল থেকেই প্যালেস্টাইন হোটেলে বন্দি হয়ে আছি। হোটেলের চারপাশে হামলা। চারিদেকে গোলাগুলি। যেন আমরা একটি দ্বীপের মধ্যে আছি।

আমি ৯টার দিকে নিচে নেমে দেখলাম সাংবাদিকদের উপসি'তি তেমন নেই। কোনো বাস ট্রিপও নেই আজ। দু’চার জন পরিচিত সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করলাম পরিসি'তি সম্পর্কে। একজন বলল সবাই রুমে বসে বসে দেখছে। স্পেনিশ একটি পত্রিকার সাংবাদিক এনজেলেস ইসপিনোসার পরামর্শ চাইলাম।

সে গ্রিস পত্রিকা তানিয়ার রিপোর্টার ইয়ানিস-এর বান্ধবী বনে গেছে এখানে। ইয়ানিসের সূত্রে সে আমারও প্রিয়। দু’জন আমার সঙ্গে আফগান যুদ্ধও কভার করেছেন বেলুচিস-ান সীমানে-। ১৭ তলা ভবনের চার তলায় ৪২২ আমার নম্বর। আমার রুমটি হোটেলের সামনের দিকে।

কিন' গোলাগুলি তখন চলছিল পেছনের দিক থেকে। এনজেলেসের পরামর্শে আমি সরাসরি লিফটে নীচ থেকে ১৭ তলায় চলে যাই, সেখান থেকে চারিদিকের দৃশ্য দেখতে পাব এই আশায়। গিয়ে দেখি কারও রুমে ঢুকতে পারছি না, সবই বন্ধ। আর একটি ব্যাপার, রুম থেকে ক্যামরা চালানো নিষেধ। যদি কেউ চালায় দরজা খোলা রাখার কথাও নয়।

লিফটের সামনে বড় ধরনের ফাঁকা জায়গা আছে। আমি সেখানে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম পেছনে। অর্থ্যাৎ উত্তরে কি হচ্ছে। দেখতে পাই আগুনের শিখা হোটেল আল মনসুরের পাশে। বাগদাদ এসে প্রথমে আমি সে হোটেলেই উঠেছিলাম।

কিন' ইন্টারনেট না থাকায় এবং পাশেই একটি ব্রিজ থাকায় ছেড়ে দেই। কারণ প্রতিদিন সংবাদ দিতে আমার দরকার ইন্টারনেট। ব্রিজ হচ্ছে যুদ্ধবাজদের টার্গেট। দেখলাম ঠিক হোটেলে নয়, তার পাশে ইরাক টিভিতে আক্রমন। পাশেই তার তথ্য মন্ত্রণালয়।

সেখানে দু’দফা হামলা হয়েছে এর আগে। আজ মনে হয় হয়নি। দেখতে পাচ্ছি ব্রিজে কোনো লোক নেই। বন্ধ। এখান থেকে দুটো ব্রিজই দেখা যায়।

দুটোই বন্ধ। মানে ট্রাইগ্রিস ক্রস করে পূর্ব থেকে পশ্চিমে যাওয়ার কোন রাস-া নেই। ব্রিজের গোড়ায় ট্যাঙ্ক। বুঝতে কষ্ট হয় না এগুলো মার্কিন বাহিনীর। জানতে পারলাম তার আশপাশ, হোটেল আল রশীদ এলাকায় প্রচণ্ড গোগাগুলি হচ্ছে।

সকাল সাড়ে ৭টায় ওই এলাকায় কাতার ভিত্তিক টেলিভিশন আল-জাজিরা অফিসে হামলা হয়েছে। তাদের জেনারেটর গ্যারেজ ধ্বংস হয়েছে। একজন সাংবাদিক তারেক আইয়ুব নিহত হয়েছেন। একজন টেকনিশিয়ান এবং আরেকজন ক্যামেরাম্যান আহত হয়েছেন। নিহত সাংবাদিক প্রযোজক ছিলেন।

জর্ডানের নাগরিক তারেক মাত্র দু’দিন আগে এখানে এসেছেন। ব্রিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই শুনি কানপাটা আওয়াজ। যেন পুরো বিল্ডিং কেঁপে উঠল। সামনে পড়া রুম সার্ভিস বয়কে জিজ্ঞেস করলাম কোথায় পড়েছে। সে জবাব দেওয়ার আগেই পুর্ব পশ্চিমে খাড়া আমাদের হোটেলের উত্তর পাশের রুমগুলোর দরজা খুলে যেতে লাগল।

এই হোটেলেই হামলা হয়েছে। চিৎকার আর চেচামেছি। লিফট নিরাপদ মনে না করে ছুটলাম সিঁিড় দিয়ে। তখনও জানি না, ঠিক কোথায় হামলা হয়েছে। সব কিছু ঠিকই মনে হচ্ছে।

বিপদে সিড়িও শেষ হয়না। জীবনে ১৭তলা থেকে পায়ে হেঁটেও নামিনি। তারপরও হাঁফাতে হাঁফাতে নিচে নামলাম। বেসমেন্টে। ওপরে উঠে সরাসরি হোটেলের আঙ্গিনায় আসতে হয়।

দেখলাম ইরাকের তথ্যমন্ত্রী আল সাহাফ ডুকছেন হোটেলে। সাংবাদিকরা তাকে ঘিরে ধরল। আরবিতে সব বয়ান দিলেন। ইংরেজিতেও কিছু বলছেন না। ’আপনারা ধৈর্য ধরুন।

তারা কিছু করতে পারবে না। ধ্বংস করে দেবো। ট্যাঙ্কে পুড়িয়ে মারবো’- এ জাতীয় কথাবার্তা। মন্ত্রীর ব্রিফিং ফেলে এবার সবার দৌঁড় হোটেলের প্রধান গেটের দিকে। ধরাধরি করে বিছানাসহ উঠানো হচ্ছে আহত সাংবাদিকদের মাইক্রোবাসে।

তাদের কারই হুস নেই। এক এক করে চারজন। চারজনই রয়টারের সাংবাদিক। এদের মধ্যে একজন মহিলাও আছেন। হুদা।

লেবাননের নাগরিক। ইরাকি একজন ফটোগ্রাফার আছেন ফালহ খবার। পোলান্ডের নাগরিক টেজেস। রক্তে ভেসে যাচ্ছিল তাদেরকে জড়ানো বিছানা, জামা কাপড়। হাসপাতালে ছুটার পথেই তাদের মধ্যের টেজেস মারা যান।

বাকিরা হাসপাতলে যান আহত হয়ে। এর মধ্যে আসে আরেকজনকে নিয়ে আসা হয় ধরাধরি করে। স্পেনিশ টেলি-৫ এর ক্যামেরাম্যান জোসে কোসো। কোসোর অবস'া খুবই মারাত্মক ছিল। তার একটি পা কেটে ফেলতে হয়।

হাসপাতালে সেও মারা যায়। পুরোদিনে তিন সাংবাদিক নিহত। তাও এই বাগদাদে, যাদের সঙ্গে একস'ানে কাজ করছি, এতদিন একসঙ্গে চলেছি। এর মধ্যে জানা যায় হোটেলের ঠিক পূর্ব পাশের ১৫ তলায় হামলা হয়। একটি মার্কিন ট্যাঙ্ক থেকে সেল নিক্ষেপ করা হয়।

আক্রান- হয় তার নিচের এবং উপরের, মানে ১৪ এবং ১৬ তলার রুম। তিনটি রুমের মধ্যে রয়টারের সাংবাদিরা ছিল ১৫ তলায়। ১৪ তলায় ছিল স্পেনিশ সাংবাদিক। ১৬ তলায় ছিল স্পেনিশ সাংবাদিকরা। এবার যুদ্ধ সংবাদ সংগ্রহ করতে তাদেরই সংখ্যা বেশি।

৩৫ জন। ১৬ তলার রুমে ছিল অলগা। স্পেনিশ একটি রেডিওর জন্য কাজ করে। অলগার সঙ্গে আগেই ভাল পরিচয় ছিল। আমার আর ভারতীয় ফটো সাংবাদিক নিজামীর ভাল বন্ধু বলতে হবে।

দেখতে অনেকটা ইন্ডিয়ান চেহারার অপূর্ব সুন্দরী অলগার সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব আছে এতেও আমাদের অন্য বন্ধুরা ঈর্ষান্বিত ছিল। সুযোগ পেলে খোঁচা মারতো এক লেবাননী ফটো সাংবাদিক। প্যালেস্টাইন হোটেলের কফিশপ আলাদিনে বসে বিল পরিশোষ শেষের অনুরোাধ থাকতো- পরিচয় করিয়ে দিলে নাতো অলগার সঙ্গে। অলগার রুম ছিল আসলে ৫তলায়। দেশি সহকর্মিদের কাছে গিয়েছিল সে ১৪ তলায়।

আমি যখন ১৭ তলা থেকে নামছি, অগোছালো অবস'ায় অলগাও অনেকের সঙ্গে নামে। সে কাঁদছিল। আমি সাহস জোগালাম। বেলজিয়ান এক ডাক্তার আমাদের সঙ্গে নামছে। ডাক্তার গ্রিট মরটার থাকেন পাশের ইস-ার (শেরাটন) হোটেলে।

তারা চিকিৎসা দিতে এখানে এসেছে। অবশ্য তাকে চিকিৎসার চেয়ে ব্যস- দেখি ছাদে বসে কাটাতে। কোন সাংবাদিক লাইভে কি বলছে তা দাঁড়িয়ে দাাঁড়িয়ে শুনতে। ডাক্তার চিৎকার দিয়ে, সবাইকে আসে- আসে- নামার জন্য কমাণ্ড দিচ্ছিল। অলগা পরে আমাকে জানালো, তার ১৪ তলার সে রুম আক্রান- হয়েছে।

নিজস্ব ক্যামরাটি ভেঙ্গে গেছে। ট্যাঙ্ক সেল নাকি বোমা? কেমন করে এল- এবার সে গবেষণা চলছে। কারণ আমেরিকানরা ছিল উত্তর দিকে। রুমগুলো হচ্ছে পূর্বদিকের একেবারে শেষ প্রানে-র। কেউ কেউ বলল, এটা ইরাকিদের কাজ।

উত্তেজনা সৃষ্টির জন্য এটা করা হয়েছে। ইরাকিরা এটা করা অসম্ভব নয়- কেউ কেউ রুমের পরিসি'তি দেখলে তা মেনেও নেবে। কয়েকজন ইন্টারভিউ দিয়ে দিচ্ছে এই সন্দেহ করে। ইরাকিরা ম্পষ্ট প্রতিবাদ জানায়, এ ধরনের উদ্ভট দাবির। তথ্য মন্ত্রণালয়ের কর্তা উদে একজনের সঙ্গে বসচায় লেগে যায়।

আরেক ক্যামরাম্যান এসে আবার সেটাই ভিডিও করতে থাকে। এ ধরনের সাংবাদিতকতার প্রতিবাদ করে উদে আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। প্রচণ্ড ক্ষমতাধর এ ব্যক্তি, তার অন্যান্য সহকর্মী মহসিন বা খাদমের মত অভদ্র নয়। আমিও তার অবস'ানকে সমর্থন করি মনে মনে। না জেনে রায় দেওয়া যায় না, আর তাদের বসচাকেও ক্যামেরায় নেওয়া ঠিক না।

পরে অবশ্য আমেরিকানরা স্বীকার করে এটা তাদেরই ছোড়া সেল। ছোট আকারের ট্যাঙ্ক সেল। রুমগুলো একেবারে পুর্বপাশ্বে হলেও বেলকনিগুলো ছিল কিছুটা উত্তর দিকে মুখ করে। সেখানে দাঁড়িয়ে রয়টার্স-এর এক সাংবাদিক ছবি তুলছিলেন। মার্কিনীরা নাকি ভেবেছে তাদেরকে টার্গেট করে সে রুম থেকে আততায়িরা গুলির প্রস'তি নিচ্ছে।

ক্যামেরার ল্যান্স আর হাতিয়ার তাদের কাছে এক মনে হয়েছে। যত সব উদ্ভট যুক্তি। আমাদেরকে মানতেই হলো। বলা যায় আজ সারাদিনই ছিল হামলা আর হামলা। টাইগ্রিস নদীর পশ্চিম পাড়ের সাদ্দামের প্রাসাদ, হোটেল আল রশীদ (জনশুন্য), পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়- সবই ছিল একের পর এক টার্গেট।

মিডিয়াকে টার্গেট করেও চলেছে হামলা। সকালে আল জাজিরার পর তার কাছের আবু ধাবী টিভি অফিসেও হামলা হয়েছে। তার সাংবাদিকরা বন্দি হয়ে আছেন। জানি না কবে শেষ হবে আমাদের সবার এই বন্দিত্ব ! চ্যানেল আই থেকে আজ বুকিং করা হলেও এপিটিএন সব বুকিং বাতিল করে দেয়। আমি লাইভ দিতে গিয়ে এটা জানলাম।

কারণ তাদের কেউ হাই রিস্কে কাজ করতে চান না। ক্যামেরা চালানোর জন্য কেউ ছাদে যেতে চাচ্ছেন না। কর্মকর্তা তাহার বললেন, তিনি একাই আছেন অফিসে। সব লোকাল কর্মিরা আজ পালিয়েছে হোটেল আক্রান- হওয়ার পর পর। তাহার আমাকে ফোনে কথা বলার সুযোগ দিল চ্যানেল আই-এর সঙ্গে।

জেনারেটরের শব্দে নিচে বসে স্যাটফোনে কথা বলাই যাচ্ছে না। তারপরও কথা বললাম অনেক কষ্ট করে। তারাই আমাকে ফোন করল অন্য লাইনে। পরিচালক মামুন ভাই টেলিফোন করেছিলেন মোবাইল থেকে প্রথমে। পরে তিনি আবার করলেন ল্যান্ড ফোন থেকে।

আমি কথা বললাম। কথা বলার ফাঁকে জিজ্ঞেস করলাম আমি কি একটি পার্সোনাল ম্যাসেস দিতে পারি আপনাদের মাধ্যমে? সাংবাদিকতার নীতিতে এটা পড়ে না এই কারণেই অনুমতি চাইলাম। আমার বাবা নেই। দৃঢ় বিশ্বাস ছিল আমার অসুস' মা এবং চাচা বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী যদি আমার জন্য দোয়া করেন আমি ভাল থাকবো এবং ঠিকভাবেই দেশে ফিরবো। তাদের সঙ্গে আমার কোনও যোগাযোগ হয়নি, সরাসরি।

বলতেও পারছি না আমার জন্য দোয়া কর তোমরা। ওপ্রান- থেকে চ্যানেল আই-এর চিফ নিউজ এডিটর শাহ আলমগীর বললেন, বলেন অসুবিধা নেই। দোয়া চাইলাম আমার মা, আমার চাচা বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী, আমার পত্রিকার এডিটর কাজী শাহেদ আহমেদ এবং আমার সহকর্মীদের কাছে। দোয়া চাইলাম চ্যানেল আইএর অগণিত দর্শকদের কাছে, যাতে সুস'ভাবে দেশে ফিরতে পারি। মামুন ভাই বললেন, আমরা তোমার ম্যাসেস প্রচার করব চিন-া করো না।

তাকে আমার বাসা, ঢাকায় বড়ভাই ডাক্তার মোস-াফিজুর রহমান ভূইয়া, চট্টগ্রামের বাড়িতে আমাদের ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আরেক ভাই মিজানুর রহমান ভূইয়ার ফোন নম্বর দিলাম। ঢাকায় দু’ বোনের বাসার নাম্বারও দিলাম, যাতে আজ আমাদের হোটেল আক্রান- হলেও আমি সুস' আছি এটা তারা এখনই জানতে পারেন। আমাদের আজকের কাগজ অফিসেও একটা ফোন করে সবাইকে চিন-া না করতে বললাম। মামুন ভাই বললেন, চিন-া করবে না, আমি নিজেই এখন সবাইকে জানাচ্ছি। জিজ্ঞেস করলেন, তুমি আমার কি হও সেটা কি জান? বললাম- জানি।

সম্পর্কে আপনি আমার বেয়াই হন। তিনি হাসলেন, আমারও হাসি এল এই দুঃখের মধ্যে। সহকর্মিদের আত্মার শানি- কামনা করে আজ সন্ধ্যায় মোমবাতি জ্বালিয়ে নিরবতা পালন করছিল সাংবাদিকরা। প্যালেস্টাইন হোটেলের সামনের আঙ্গিনায় এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সেখানে যোগ দিলে দেখা পাই লারিটার।

তার পাশে দাঁড়ানো আরেক হিউম্যানশিল্ড পাকিস-ানি বংশউদ্ভূত ব্রিটিশ তরুণী উজমা। এই শোকসভায় উপসি'ত হলেন, এক ইরাকি। চিৎকার দিয়ে দিয়ে বললেন, তোমরা তোমাদের সাথীর জন্য শোক করছো। আমি আপত্তি করি না। কিন' আমার মা, ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য কে শোক প্রকাশ করবে! কি অপরাধ করেছি আমরা ইরাকিরা! এ কিসের গণতন্ত্র ‘জারজ’ বুশের! ইরাককে কেন আক্রমন? সে কি দেখে না দুর্নীতিবাজ সৌদি আর আমিরাত সরকারকে।

প্যালেস্টাইনে কি হচ্ছে! শ্যারনের বিচার কে করবে! চুপ কেন জর্ডাদের কিং- এ সন অব এ বিচ। আমাদের কোনও জবাব নেই এ সব প্রশ্নের। লারিটার চোখে জল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে উজমা। সেখান থেকে আসার পথে লারিটা আমার পাঠানো মোমবাতির প্রশংসা না করে ছাড়লেন না।

এত বড় মোমবাতি সে কম দেখেছে। উজ্জ্বল আলোতে তার লিখতে অসুুবিধা হয়না। প্রশংসাটা অবশ্য আমার গাইডের পাওয়া উচিত, সে সন্ধান করে এনেছিল। আমিও এত বড় মোমবাতি কম দেখেছি। নিজামীর সঙ্গে আজ অনেক কথা হল।

সে জানাল সতিশ খুব দুঃখ পেয়েছে আমি বিবিসির সঙ্গে কথা বলায়। নিজামীর ভাষায়, আমি সতিশের মন মেজাজ ধর্ষণ করেছি। কারণ সে বিবিসির সঙ্গে কথা বলা ছেড়ে দিলেও আমি ছাড়লাম না। আমি ছেড়ে দেবো কেন বুঝলাম না! তাকেই বা ছাড়তে কে বলেছে! আমি তার সঙ্গে কষ্ট শেয়ার করতে চাইলেও সে করেনি। সে বন্ধু ভেবেছে ফিরিঙ্গিদের।

এখন এটা কেন বলছে? নিজামী বলল, এ যুক্তি সে সতিশকেও দিয়েছে। রাতে একসঙ্গে প্যালেস্টাইন হোটেলে খেলাম আমরা। আল-ফানারে যেতে কারও মন চাইল না। রাইদ ওমর নামের তথ্য মন্ত্রলালয়ের এক কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় হল। কফিশপ আলাদিনে রাতের আড্ডা আর নারগিলা (হুক্কা) সেবনে তিনি আমার সঙ্গী হলেন।

সারাদিনের মানসিক চাপ কমাতে চাচ্ছিলাম আমি। ওমরকে পেয়ে তা হালকা হচ্ছিল। তিনি জানালেন, ইরাকের স'ানীয় পত্রিকায় তিনি কলাম লেখেন, কবিতাও লেখেন। কবি হিসেবে একটি সংগঠনের কার্ড দেখালেন। আমি বললাম মাঝে মাঝে আমিও চেষ্টা করি।

সে কারণে হয়তো আমাকে বেশি বেশি আপন করে নিলেন ওমর। ওমর রাজনৈতিক কবিতা লিখতে পছন্দ করেন, দুঃখবোধ নিয়ে লেখেন। দুটিই মনে হয় ইরাকের উপাদান। ’৮০ সাল থেকে যুদ্ধ আর যুদ্ধ। দুঃখ আর দুঃখ।

কান্না আর কান্না তাদের জীবন ভর্তি। আমার যাকে ভালো লাগে বেশি সময় লাগেনা তাকে চিনে নিতে। যাকে প্রথম দেখায় ভালো মনে হয় না তাকে কখনই ভালো লাগে না। ওমরকে আমার খুব ভালো লেগে যায়। যেমন তার ব্যবহার, তেমন তার জানাশোনা।

ইংরেজিও বলেন চমৎকার। মনে পড়লো ৭ এপ্রিল আল সাহাফ ছাদে দাঁড়িয়ে যে ব্রিফিং দেয়, রাইদ ওমর তার লাইন বাই লাইন অনুবাদ করে দিয়েছেন আমাদের সবার জন্য। সাহাফ এক লাইন বলেন আর ওমরকে অনুবাদের সময় দিয়ে আরেক লাইনে যান। গাইড হিসেবে সাফার মতো লোকের পরিবর্তে ওমরকে পেলে আমার অনেক উপকার হতো। আমাদের সঙ্গে বসেছেন রবার্ট ফিস্ক।

লন্ডনের ইন্ডিপেনডেন্ট পত্রিকার সাংবাদিক। মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ। এখানে যারা যুদ্ধ সংবাদ সংগ্রহ করতে এসেছেন তাদের ৭০ শতাংশই আফগানিস-ানে যুদ্ধ সংবাদ সংগ্রহ করেছেন। অনেকে আবার সার্বিয়া যুদ্ধও কভার করেছেন। তিনটারই পার্ট হচ্ছে আমেরিকা।

যুদ্ধের পর এখনও সার্বিয়া, আফগানিস-ানে শানি- নেই। অনেকে আবার ইরাক-কুয়েত যুদ্ধ সংবাদ সংগ্রহ করেছেন। ফিস্ক-এর অভিজ্ঞতা আরও বেশি। তিনি ইরাক-ইরান যুদ্ধও প্রায় পুরো সময় কভার করেছেন। ফিস্কের সঙ্গে ওমরের খুব ভাল সম্পর্ক।

ফিস্ককে আমি চিনতাম না। যদিও তার নাম শুনেছি এবং বাংলাদেশের পত্রিকায় তার লেখার অনুবাদ করছে দেখছি। সারাক্ষণই সে তার নাক চুলকায় বলে তার সঙ্গে কথা বলারও ইচ্ছে হয়নি। সাদা মুখে নাকটিকে চুলকাতে চুলকাতে সে লাল রক্ত বের করে দেওয়ার অবস'া করেছে। সেখানে ফোসকা পড়ে থাকে।

সম্ভবত এলার্জি। এজন্যই মনে হয় এড়িয়ে চলতাম। সেদিন বিবিসি তাবুতে ফিস ফিস করে ইরাকিদের বিরুদ্ধে কথা বলছিল রাগি ওমরের সঙ্গে। আমাকে শুনতে দেখে থেমে গেল। রাগি আশস- করে বললো, আনিস, মাই কলিগ ফ্রম বাংলাদেশ।

ফিস্ককেও আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিল রাগি। ফিস্ককে আমি চা অফার করলে সে না করলো না। কিন' খেয়েই কি এক কাজে আবার আসছে বলে উঠে গেল। ওমর তার খুব প্রশংসা করেন আমার কাছে।
 


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.