.
লোকজনের সামনে সহযোগিতার আশায় হাত পাতার সময় ভিক্ষুকদের মানসিক অবস্থার মতো একটা অনুভূতির সঙ্গে পরিচিত হলাম প্রথম পত্রিকায় চাকরি পাওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। ১৯৯৯ সালের ১২ অক্টোবর সকালে ঢাকার একটি দৈনিকের সম্পাদক(নাম বলতে চাচ্ছি না,পরিচিতদের কেউ এই লেখাটি পড়লে অনুরোধ করছি নাম না বলার। )আমাকে ৩ হাজার টাকায় একটি চাকরি দিতে সম্মত হন। অবশ্য এর আগে 'শিক্ষানবিশ রিপোর্টার নিয়োগ হবে'বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলে লিখিত পরীক্ষায়ও অংশ নিয়েছিলাম। তখন পাশে বসে পরীক্ষা দিয়েছিল এমন একজনের রিপোর্ট পত্রিকায় প্রকাশিত হতে দেখে আমিও গিয়ে অনুরোধ করলাম চাকুরি দেয়ার জন্য।
তখন খুব দুর্দশা চলছিল আমার। আগের কয়েক মাস নিয়মিত কোন উপার্জন ছিল না। দিন চলতো বন্ধুদের কাছ থেকে ধার-দেনা করে আর বিভিন্ন পত্রিকায় কন্ট্রিবিউটিং করে।
তো যাই হোক সম্পাদক সাহেব ভালোভাবে কাজ করার পরামর্শ দিয়ে চীফ রিপোর্টার মহোদয়কে ডেকে আমাকে এ্যাসাইনমেন্ট দিতে বললেন।
কোমরে হোলস্টারে রিভলবার আছে যেন এমনি ভঙ্গিতে দুহাত উচিয়ে গলার সঙ্গে চিবুকটা খানিক চেপে দৃঢ় পদক্ষেপে হাঁটেন আমার জীবনের প্রথম চীফ রিপোর্টার।
দেখে অন্য জগতের মানুষ মনে হলো। কোন একটা গোয়েন্দা বইয়ে বর্ণনা করা কেজিবির চীফের ভাবভঙ্গির সঙ্গে মিলে গেল বুঝি।
নিজের চেয়ারে বসে টেবিলের উল্টো দিকের একটা চেয়ারে বসার ইঙ্গিত করলেন। বললেন, আপনি এখন বাসায় চলে যান। রাত ৯টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত পর্যন্ত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের গাইনি ওয়ার্ড থেকে কাল রিপোর্ট দিবেন।
বড় ফ্রেমের চশমার পেছনের চোখ দিয়ে তীক্ষ্মভাবে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কোন প্রশ্ন?
আমি বুঝতে পেরেছি বলে ক্যান্টিনে গিয়ে চা খাই।
রাত ৯টার দিকে ডিএমসির গেটের সামনে পরাটা ভাঁজি খেয়ে ১৩ নং ওয়ার্ডের সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকি। দুবার গাইনি ওয়ার্ডগুলোতে ঘুরে দেখি এবং এক বেডে দুই জন করে সন্তান সম্ভাবা। মেঝেতেও শুয়ে আছেন অনেকে। অধিকাংশ মহিলাকেই নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরের মনে হলো বেশ-ভূষায়।
ট্রলিতে করে এক মহিলাকে সামনের একটা রুমে নিয়ে যেতে দেখি। একটানা তীব্র চিৎকার শুনি। কাউকে কাউকে বাচ্চসহ রুমে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন নার্সরা। রুমে কয়েকজন মহিলা লাগাতার কাতরাচ্ছেন। বাইরে করিডোরে বারান্দায় চাদর পেতে শোয়ার আয়োজন করেছেন রোগীর আত্মীয়রা।
রাত ১ টার দিকে অচেতন এক কিশোরীকে রিকশা থেকে নামিয়ে আনেন এক বৃদ্ধ ও রিকশা চালক। বৃদ্ধ লোকটি দিশেহারা হয়ে চিৎকার করতে থাকেন এবং সামনে পাওয়া এক নার্সের পা জড়িয়ে ধরেন। তার হাত, দাড়ি ও নীল পাঞ্জাবিতে রক্ত লেগে আছে। বৃদ্ধ লোকটি নার্সকে ঘোরগ্রস্থের মতো অনুরোধ করতে থাকেন তার মেয়েকে বাঁচাতে। একজন ডাক্তার চিৎকার কান্নাকাটি শুনে রুম থেকে বের হয়ে আসেন।
বলেন, রোগীতো মেরে ফেলেছেন। যান রক্ত নিয়ে আসেন। বৃদ্ধ আবার কাঁদতে শুরু করেন। তার কাছে কোনো টাকা নেই। জানান, মোহাম্মদপুরের একটি বস্তিতে থাকেন তারা।
জামাই স্কুটার চালায়। আজ বাসায় ফেরেনি। মেয়ের বেদনা ওঠে। অবস্থা খারাপ দেখে রিকশা দিয়ে হাসপাতালে আনার পথে বাচ্চা অর্ধেক বের হয়ে গেছে। আধা ভূমিষ্ট অবস্থায় অচেতন মেয়েটি তখন হাসপাতালের ফ্লোরে পড়েছিল।
কোন সিদ্ধান্ত না নিয়েই হিতাহিত জ্ঞানশূন্য বৃদ্ধটিকে সঙ্গে নিয়ে টাকা সংগ্রহ শুরু করি। আমার পকেটে ত্রিশ টাকা ছিল তা হাতে নিয়ে বারান্দায় ঘুমিয়ে থাকা রোগীদের আত্মীয়-স্বজনদের ডেকে ডেকে বলি রক্তের অভাবে একটা মেয়ে মারা যাচ্ছে তাকে কিছু টাকা দিন। কেউ ঘাঁই ঘুঁই করে আবার ঘুমিয়ে পড়ে, কেউ দশ-বিশ টাকা দেয়। একজন ১ টাকা দিলে আমরা ভিক্ষুক না বলে তেজ দেখাই। এমনিভাবে দুইশ পঁচিশ টাকা ওঠে।
আমার আর অস্থির বুড়ার কান্ড দেখেই হয়তো,একটি ছেলে এগিয়ে এসে বলে, তার কাছে ১ ব্যাগ রক্ত আছে বোনের জন্য কিনেছিল-লাগেনি। আপনাদের কোন গ্রুপের রক্ত দরকার? আমরা ৩ জন ডাক্তারের কাছে ফিরে যাই। ডাক্তার ততক্ষণে মেয়েটিকে একটি বিছানা পেতে শোয়ার ব্যবস্থা করেছেন একটি স্যালাইনও দিয়েছেন। কি গ্রুপের রক্তের প্রয়োজন হয়েছিল, এখন ভুলে গেছি, কিন্তু তা চাঁদপুরের সেলিম নামের ছেলেটির সংগ্রহে থাকা রক্তের সঙ্গে মিলে যায়। বিপত্তি বাঁধে তিন তলার ব্ল্যাড ব্যাংকে জমা থাকা রক্ত তোলা নিয়ে।
একজন দায়িত্বে ছিলেন, গ্রিলের ওপারে চেয়ারে শুয়ে ঘুমিয়ে। তাকে চিল্লাচিল্লী করে জাগালো সেলিম। কিন্তু লোকটি অনেক নিয়ম দেখায়। শেষে জোগাড় করা দুইশ পাঁচিশ টাকা থেকে পঞ্চাশ টাকা ঘুষ দিয়ে রক্তের ব্যাগ নিয়ে ডাক্তারের হাতে দেই।
চিকিৎসক ভদ্র মহিলা রক্তের ব্যাগে হাত নিয়ে আমার দিকে অবজ্ঞা ভরে তাকায়।
বলে, নিজে তো ভালোই পোষাক আশাক পরেন-বৌয়ের এই হাল করেছেন কেন? সেলিম, আমি আর বৃদ্ধটি একে অপরের দিকে তাকাই।
ততোক্ষণে চারদিকে ফর্সা হয়ে উঠেছে। গরীবের প্রান হলো কৈ মাছের প্রাণ!নিজে সংঙাহীন হলেও বাচ্চাটি জীবন্তই প্রশব করে মেয়েটি। নিজেও বেঁচে থাকে ততক্ষণ। বুড়ো দুহাতে কান চেপে ধরে গলা ছেড়ে আজান দেয় অকস্মাৎ! আজান শেষ হলে বৃদ্ধটির হাতে একশ’ পঁচাত্তর টাকা গুঁজে দিয়ে বিদায় নিই।
সেলিমের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখবো বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে অফিসের দিকে রওনা হই।
রিপোর্টটি জমা দেই, গাইনি ওয়ার্ডের দৃশ্য বর্ণনা করে, বেড, চিকিৎসা সামগ্রীর সমস্যার দিক প্রধান্য দিয়ে। রোগী ও ডাক্তারের বক্তব্যও ছিল।
চীফ রিপোর্টার ভ্রুকুচকে রিপোর্টটি পড়েন। বলেন, ধক করেই পাঠককে বাথরুমের দুর্গন্ধের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছেন।
আমার কাছে থাকলো- দেখা যাক কি করা যায়। এখন বাসায় যান, রাত ১২টার দিকে যাবেন রায়ের বাজার কসাইখানায়। দেখবেন, মহিষ জবাই করে পরীক্ষিত সিল মেরে গরু হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছে।
(আমার ওই রিপোর্টটি ছাপা হয়নি,মান সম্মত না হওয়ার কারণে। এ নিয়ে কোন দুঃখও অবশিষ্ট নেই।
জীবনের প্রথম রিপোর্ট ছাপা না হওয়ার দুঃখ পরবর্তীতে নানা ভাবে কাটিয়ে উঠেছি। আর প্রথম দিককার কথা মনে এলে এই ঘটনাটা মনে পড়ে যায়। বাচ্চাটা এতোদিন বেঁচে থাকলে প্রায় সাতে পড়লো। অবশ্য জানার বা খোঁজ নেয়ায় আর কোন উপায় নেই। )
এই লেখাটি কবি ও সাংবাদিক আদিত্য শাহীন সম্পাদিত ক্রিটিক পত্রিকার প্রথম সংখ্যায়(নভেম্বর,২০০৫) প্রকাশ হয়েছিল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।