ভাদু নাপিত
রবিউল করিম
ভাদু নাপিত জমির শেখের নারিকেল সাইজ মাথাটায় ক্ষুর চালাতে চালাতে পশ্চিম দিকে মাছ বাজারে মজিবর জাউলার তালাশে চোখ বুলাল। গেল হাটবারে মজিবর তাকে বেজায় ঠকিয়েছে পচা পুঁটি মাছ গছিয়ে দিয়ে। আজ কড়ায়গণ্ডায় সে মাসুল তুলে নেবার সংকল্প তার। কিন্তু পশ্চিম দিকে তাকিয়েই চোখটা সাৎ করে নামিয়ে নিল জুলমতকে দেখে; অনেকটা ফণা তোলা সাপ যেভাবে সাপুড়ের হাতের জড়িবুটি দেখে মাথাটা নামিয়ে নেয়।
এমনিতেই জমির শেখের মাথা চাঁচা-ছেলা করতেই তার ক্ষুরের ধার ক্ষয়ে এসেছে তার উপর যদি আবার জুলমত এসে ঘাড় গুঁজে বসে তাহলে হাটবাজার আজ তার মাথায় উঠবে।
এ ভেবে সে মনে মনে বিড়বিড় করে ওঠে, শালা একটা মানুষ নাকি! ছ মাসে একবার দাড়ি, চুল কাটে, বগল চাঁছে। জুলমতের সবই করা যায় কিন্তু ঐ বগলটা! বগলটার কথা মনে হতেই ভাদুর নাকে এক চারি পায়খানা যেন উপুড় হয়ে পড়ে। সে ওয়াক থু বলে থুথু ফেলতে গেলই হাতটা নড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে জমির শেখও ‘উ’ বলে আঙুল দিয়ে মাথার কাটা স্থান ¯পর্শ করে। ‘আহ্ দিলিন তো ক্যাটা।
’ অনুভব করতে চায় কতটা চটচটে হয়ে উঠেছে স্থানটা অর্থাৎ কতটা রক্তাক্ত। ভাদু কাঠের বাক্স থেকে দোমড়ানো মোচড়ানো রঙচটা স্যাভলন ক্রীমের টিউবটা বের করে সেটার গলায় সযতেœ ছোট্ট করে একটা টিপ মারে। পুচুত করে বহুদিন অব্যবহারে ফলে ঘিয়ে হয়ে যাওয়া রঙের এক ফোঁটা ক্রীম তর্জনীর মাথায় জমা হলে সেটা দিয়ে সে জমির শেখের মাথার কাটাস্থানে ঘষতে থাকে।
-কি বা কি ঘষিন?
-ওষুধ বা, শহরত ক্যাটাফ্যাটা গেলে দ্যায়। তোমাগের মতন ময়মুরব্বির ল্যাগা রাখিছুনু।
মিচচানা ক্যাটিছে। শালা ঐ জুলমতের ল্যাগা।
-ধুর কি কও। জুলমত আবা কি করল?
-না, না । দোষ তো হামার।
চোখ পড়ল তার গাওত। আর সে তংকেই তো হাতটা লড়ে গেল।
-ক্যাবা ক্যাংকা ওষুধ? এ্যানা ধক নাই, ধক না থাকলে সারবে কিংকা কর্যা। তুমি বাপু হামাক ঐ ফিটকিরি ল্যাগা দাও।
ভাদু আবার বাক্স থেকে ফিটকিরি বের করে সাবানের ফেনামিশ্রিত ছোট্ট অ্যালুমিনিয়ামের বাটির পানিতে চুবিয়ে জমির শেখের কাটা মাথায় চেপে ধরে।
উরি , উরি, আহ্, বলে দু হাত দিয়ে মাথাটা চেপে ধরে জমির শেখ চিৎকার করে ওঠে। ভাদু ভয় পেয়ে ফিটকিরি সরিয়ে নেয়। কিছুটা ভয় মিশ্রিত গলায় বলে, খুব জ্বলছে?
-হ বা।
-মিচচানা সবুর কর। ঠিক হয়া যাবে।
ঘাড়ত কডা কাটা বাকি আছে, বলে কাঁচি-চিরুণি দিয়ে চুলগুলোকে সাইজ করতে থাকে।
সে যতবারই ঘাড়ের চুলগুলোতে কাঁচি চালাতে গিয়েছে ততবারই তার মনে প্রশ্ন জেগেছে, মাথার চুল যদি ক্ষুর দিয়ে কাটা যায় তবে ঘাড়ের চুলে কেন ক্ষুর চালানো যাবে না? জমির শেখের প্রমাণ সাইজের বেল মাথার সাথে বেমানান এক বিঘৎ লম্বা মিশমিশে কালো দাড়ি তার এসব ধর্মীয় নাফরমানি জিজ্ঞাসার মুখে তালা মেরে রাখে। ঘাড়ের চুল কাটতে কাটতে আড়চোখে আবার জমসেদ মিয়াকে খোঁজে। কিন্তু জমসেদ মিয়া হাটের ভিড়ে লাপাত্তা। ভাদুর তখন নজরে পড়ে পশ্চিমের আকাশটায়।
এঁটেলমাটি দিয়ে কে যেন সারা আকাশটাকে লেপ্টে দিয়েছে। আকাশের এই ঘন লেপটানো ভাব তার মনে ভেতরে গত কয়েকদিনের জমানো ভীতিটাকে আরো খানিকটা লেপে দেয়। তবে কি তারও মরণ ঘনিয়ে এসেছে?
গত কয়েকদিন থেকে তার মধ্যে মরণভীতি ভর করেছে পাশের বাড়ির হাসমত আচমকা মরে গিয়ে। হাসমত মরার আগের দিনও তার দাওয়ায় বসে চুল কাটিয়েছে, দাড়ি চাঁচিয়েছে। কথায় কথায় বলেছে, শিকারপুরে ছোট জামাইয়ের বাড়িতে যাওয়ার কথা।
ছোট মেয়েটাকে অনেকদিন দেখে না। এবার জামাই ষষ্টির দাওয়াতটা দিয়ে আসবে। তারপর দুজন একই কলকেতে তামাক টেনেছে, ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করেছে অথচ রাত ফুরোতে না ফুরোতেই কান্নার রোল। হাসমতের বউয়ের মুখে যতদূর শোনা যায়, খোলার একপাশে যে জামরুল গাছ মাঝরাতে তার পাশে মুততে গিয়ে জমসেদ একটা চিৎকার করে উঠেছিল। তারপর থেকে বেহুস।
কোনো সাপে কাটা নেই, কোনো ঠাটা পড়া নেই, আচমকা একটা মানুষ মরে গেল।
পাড়ায় অবশ্য নানান রকম কথা। কেউ বলে ভূত দেখেছিল, কেউ বলে যম। তা ভূতই হোক আর যমই হোক ওমন জলজ্যান্ত দিলখোলা মানুষটা যে মারা গেল, এটা তো সত্যি। কেউ কেউ আবার ফিসফিসিয়ে বলে অন্য কথা।
কী যেন এক বিশাল ডানাঅলা পাখি গত কয়েকদিন থেকে নাকি গাঁয়ের এমাথা-ওমাথা করছে। ঐ পাখিই নাকি মৃত্যুর কারণ। তার একহাত লম্বা ঠোঁট, ইট ভাটার মতো গনগনে আগুনে চোখ, ধনুকের মতো কালো ডানা। ভাদুর বুকের ভেতরটা যেন চিনচিন করে ওঠে।
সে ভাবে, আচছা জমির শেখকে কি এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা ঠিক হবে? পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, আল্লা-বিল্লাহ করে, নিশ্চয় সে কিছু বলতে পারবে।
এমন ভেবে যেই সে কথাটা পাড়তে যায় ওমনি দেখে জমসেদ তাদের দিকেই হনহন করে হেঁটে আসছে। সে আর কথা না বাড়িয়ে মাথাটা নিচু করে তাড়াতাড়ি ঘাড়ের চুলগুলো সাইজ করে জমির শেখকে বলে, হছে।
জমির শেখ বাম হাতের আঙুল দিয়ে ঘাড়ের পিছনের চুলগুলোর অস্তিত্ব-অনস্তিত্ব পরীক্ষা করে সন্তুষ্ট হয়। কোলের ধুতির মধ্যে গুঁজে রাখা গামছাটা বের করে একটা ঝাড়া দিয়ে মুখ, মাথা, ঘাড় পরিস্কার করে। কোমরে গোঁজা তহবিল থেকে পাঁচ টাকার একটা নোট বের করে ভাদুকে দেয়।
ভাদু তাড়াতাড়ি কাঠের বাক্সে টাকাটা রেখে জমসেদের অস্তিত্ব কতদূর পরখ করার জন্য ঘাড় উচায়। কিন্তু জমসেদ আবার লা-পাত্তা। তবে কি সে ভুল দেখেছে। তা কি করে হয়। সে জলজ্যান্ত চোখের সামনে চেক লুঙি গেঞ্জি গায়ে জমসেদকে দেখল, সে কি করে হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে পারে।
তবে কি ঐটা জমসেদ না, অন্য কিছু।
তার মাথাটা গোলমেলে হয়ে যায়। কাঠের বাক্স খুলে টাকা গোনে। পঞ্চান্ন টাকা। এই আকালের বাজারে মন্দ না ভেবে সে আবার আকাশের দিকে তাকায়।
সন্ধ্যা হতে এখনো বাকী আছে কিছুটা সময়। চাইলে আরো দু/একজন খদ্দেরের চুল-দাড়ি ছাটতে পারে সে, কিন্তু তার আর কাজে মন বসে না। বাক্স-পেটরা গুছিয়ে কেরসিন আর সরিষার তেলের বোতল দুটো নিয়ে মাছ বাজারে ঢোকে। আজ মজিবর জাউলার সাথে একটা হেস্তনেস্ত করবে এই সংকল্প তার। অথচ ঘাড় উঁচিয়ে মাছ বাজারটায় একনজর চোখ বুলিয়ে সে মজিবরের অস্তিত্ব খুঁজে পায় না।
উপায়ন্ত না দেখে অন্যদের ঝুড়িতে কি মাছ আছে তা দেখতে শুরু করে। বক্করকে কয়েকটা শিং, চ্যালা আর বাইলা মাছ নিয়ে বসে থাকতে দেখে ভাদু বলে,
-ক্যা বা কত দাম?
-লিবিন কিনা সেডা কও। তোমার তংকে আবা দরদাম করা ল্যাগবে?
-না বা দাম কও। ব্যাগোত ঢোকানার পর আবা বেশি চ্যাবিন, তা হবে না।
-আরে না, না, বিশ ট্যাকা দিও।
বিলত এখন আর মাছ পাওয়া যায় না। সব সার দিয়ে শ্যাষ করে ফ্যালাছে। ২০/৩০টা কৈ পাছুনু আর এ কডা মাছ। কৈ গুলা মফিজ সরদার নিয়া গেল, তুমি এ-কডা লিয়া গেলে হাটবাজার করবার পারি। দাও ব্যাগটা দাও।
-দুর, কি কও? দশ টাকা দিমুনি।
-না বা, তোমার তংকে ১৫ টাকা । আর দামাদামি করলে পরমু না কনু।
ভাদু শিংমাছগুলো দেখেই লোভে পড়ে গিয়েছিল। অনেকদিন শিং মাছের ঝোল খাওয়া হয় না।
সে আর কথা বাড়ায় না। ব্যাগে মাছ নিতে নিতে বলে, ক্যা বা জমসেদোক দ্যাখোছিনা। আসেনি।
-নাবা, আইজক্যা বিলতও যায় নি। কিছু হছে মনে হয়।
ক্যা কি দরকার?
-না এমনি।
ভাদু ১৫ টাকা বক্করকে দিয়ে তরকারি বাজারে ঢোকে। নিত্যপ্রয়োজনীয় আলু-পটল, লবণ, তেল কিনে যখন বাড়ির পথ ধরে তখন সন্ধ্যা অতিক্রম করেছে। হাটফিরতি মানুষ নানান দলে উপদলে ভাগ হয়ে গল্প-গুজব করতে করতে বাড়ি ফিরছে, ভাদুর দলেও তিনজন; তার পাড়ারই বাসেত ও মিজান। তাদের গল্পের বিষয়বস্তু হাসমতের অকাল মৃত্যু।
মিজানই কথাটা পাড়ে। সে-গল্পের ডালপালা বিস্তার করে এমন দাঁড়ায় যে, গ্রামে সত্যি সত্যি যে যমে ভর করছে তা তাদের মনে বদ্ধমূল গেড়ে বসে। বাসেত সে ধারনাকে পাকাপোক্ত করতে ওপাড়ার কালুর মা, মঝির মণ্ডল, মধ্যপাড়ার শিমুলের দুদিনের বিয়া করা বউ, তরতাজা যুবক আমিন, উত্তরপাড়ার হরিশের বাপের মৃত্যুকে টেনে আনে। তার বক্তব্য এমন পটাপট আগে তো কোনোদিন কেউ মরেনি। প্রতিদিনই দু/একজন করে মরছে।
আজ আবার কে মারা গেল কে জানে? আগামীকাল হয়ত সেও মরে বসতে পারে। এমনিতেই আজন্ম ভীতু ভাদু। তার উপর আবার এসব যুক্তিতর্কের প্যাঁচে পড়ে মরণভীতিটা তার সমূহ সত্ত্বাকে নাড়িয়ে দেয়। সে দ্রুত বাড়ি ফিরতে চায়। সঙ্গিদেরও তাড়া দেয়।
এরই ফাঁকে বাসেত ভাদুর কানে ফিসফিসিয়ে বলে, সত্যিরে ভাদু, মোরও ভয় ভয় লাগে। কোনো অসুক-বিশুক নাই, হুট কর্যা নাই। ক দেখিন হামি মরে গেলে হামার দু দুটা ছোট ছোলের কি হবে? এমন জিজ্ঞাসার উত্তরে ভাদুর মুখে কোনো কথা সরে না। সে কোনো রকমে ঢোক গিলে অন্ধকারের ভেতরেই এদিক ওদিক তাকায়। সামনেই বিশাল বটগাছ- দূর্গার থান।
সে চোখবন্ধ করে কায়মনোবাক্যে মন্ত্রজপে, মা রক্ষে করো, মা। হঠাৎ দেখে বটগাছের ডালে দুটো গনগনে চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। ‘ওরে ভাডি রে, হামি মরা গেনু রে’ বলে ভাদু চিৎকার করে ওঠে। বাসেত আর মিজান উৎকণ্ঠিত হয়ে তাকে তাড়াতাড়ি জড়িয়ে ধরে। ‘কি হছে, ও ভাদু কি হছে’।
ভাদু কোনো রকম গোঙাতে গোঙাতে বলে, যম হামাক লিবা এ্যাসিছে রে ভাই, ওই দ্যাখ গাছত বস্যা আছে। বাসেত, মিজান দুজনেই গাছের দিকে তাকিয়ে কোনো কিছুর অস্তিত্ব খুঁজে পায় না। ভাদুর চিৎকারে হাটফেরত আরো অনেকে জটলা করে। ‘কি হছে বা, সাপে কাটিছে নাকি?’ দু একজন লণ্ঠনের সলতেটা বাড়িয়ে দিয়ে চারপাশ দেখে। ভাদুর কথা শুনে গাছেও টর্চ মারে।
কিন্তু কিছুই খুঁজে পায় না। বাদুড়-টাদুড় দেখিছিল মনে হয়- এমত ধারনা করে ভিড়টা পাতলা হয়। ভাদু বাসেতকে জড়িয়ে ধরে বলে, ও ভাডি তোরা বিশ্বাস করলু না, বিশাল বিশাল ডানা আর চোখগুলান আগুনের ভাটার লাহান, হামার দিকেই তাকা আছিল, বিশ্বাস কর। হামাক তোরা বাড়িত লিয়া চ। হামি একা যাবা পারমু না।
বাসেত, মিজান দু’জনই তাকে আস্বস্ত করে যে তাকে তারা বাড়িতে রেখে তারপর নিজেদের বাড়িতে ফিরবে। ফিরতে ফিরতে বাসেত, মিজান তাকে সান্ত্বনা দেয়, দুর কি যে কও। আর মরন অ্যালে তুমি কি ঠ্যাকাবা পারবিন। ভাদু কিছুটা ধাতস্থ হয়। মনকে বোঝায় যে, হয়ত ওটা সত্যি বাদুড় কিংবা অন্য কোনো পাখি ছিল।
বাড়ি ফিরে বাজারের ব্যাগটা বউয়ের দিকে ঠেলে দিয়ে সে তাড়াতাড়ি স্নান করার জন্য কুয়ার পাড়ে গিয়ে ধুপ করে বালতিটা কুয়ায় ছুড়ে মারে। তারপর কুয়ার মধ্যে একটু ঝুকে বালতিটা তুলতে গিয়ে তার মনে হয়, যদি সে কুয়ার মধ্যে পড়ে যায়। আতঙ্কে তার হাত থেকে দড়ি ছুটে যায়।
ঘটনার আকস্মিকতায় সে চিৎকার করে ওঠে, আহ্ গেল রে...
ভাদুর বউ ছুটে আসে, কি হলো, কি হলো বলতে বলতে। ভাদুর নিজের উপরই রাগ হয়।
এমনিতেই কিছুক্ষণ আগে সে নিজেকে ভীতু প্রমাণ করে এসেছে এখন যদি বউকে আবার মরনভীতির কথা বলে, বউ নিশ্চয় হাসবে। তার রাগ হয়। আর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে বউয়ের উপর। হারামজাদি জল তোলার সুমি দড়িডাও ভিজা রাখিছে। মাগি পিছলা দড়ি দিয়া হাত ফসকাবে না তো কি হবে?
এমনিতেই সন্তানহীন ভাদুর বউ নিরীহ গোছের।
সে মিন মিন করে বলে ওঠে, দড়িত জল না ল্যাগা জল তুলমু ক্যাংকা কর্যা।
ভাদু এমন বাস্তবতার মুখে কি বলবে ভেবে পায় না। ধুপ ধাপ পা ফেলে ঘরের দিকে যেত যেতে বলে, হয়, সব হামার কপালের দোষ!
ঘরে গিয়ে সে সটান বিছানায় শুয়ে পড়ে। বউ বাজার সদা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। শিং মাছ দেখে চুলার পাড় থেকে ভাদুকে জিজ্ঞাসা করে, ঝোল করমু ? ভাদু কোনো উত্তর করে না।
সে শুয়েই থাকে। শুয়ে থেকে উল্টাপাল্টা ভাবে। শৈশবের যাবতীয় ভূত ও মৃত্যুবিষয়ক ভয়ের স্মৃতি মগজের ভেতরে তার অজান্তেই খ্যালা করতে শুরু করে; অনেকটা শান্ত পুকুরে ঢিল ছুড়ে দিলে জলের তরঙ্গ যেভাবে বিস্তার লাভ করে তেমনিভাবে মৃত্যুভীতির বিস্তারও ভাদুকে ঘিরে বাড়তে থাকে। অন্ধকার ঘরের ভেতরে তখন তার শুয়ে থাকতেও ভয় ভয় লাগে। সে উঠে বসে।
সে যতই ভয়কে জয় করতে চায়, ততই ভয় তাকে জড়িয়ে ধরে। তার মনে পড়ে, তার কুষ্ঠিতে আছে কোনো এক অমাবস্যার রাতে তার মৃত্যু হবে? তার গলাটা শুকিয়ে আসে। অথচ বিছানা থেকে নেমে জল খেতে নিচে নামার কথা ভাবতেও ভয় করে। জল খাওয়ার জন্য সে বউকে ডাকে, এ্যানা জল দ্যাও তো। বউ কুপি হাতে ঘরে ঢুকলে সে সাহস পায়।
কলস থেকে ভাদুর বউ এক গ্লাস জল ঢেলে দিলে সে ঢক ঢক করে জল খায়। খাওয়া শেষে বউকে বলে, শুনিছু উত্তরপাড়ার হরিশের বাপ নাকি গতকাল স্বর্গত হছে। কী যে শুরু হছে গাওত। খালি মরা আর মরা। তোর ভয় করে না।
ভাদুর বউ হেসে বলে, ভয়ের কথা কি কও! মরণ আছে না! এমন আধ্যাত্মিক কথায় ভাদুর সন্তুষ্টি হয় না। সে আবার বলে, আচ্ছা, অমাবস্যা আসতে আর ক’দিন আছে ক তো? বউ আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করে, ক্যা। ভাদু মিনমিন করে বলে, ক দরকার আছে। কিছুক্ষণ হিসাব কষে ভাদুর বউ বলে, পরশু। ক্যা পুজা দিবিন নাকি।
ভাদুর বুকটা ধক্ করে ওঠে। হু, না কিছু না বলে আবার শুয়ে পড়ে।
শিং মাছের ঝোল দিয়ে অনেকদিন পর পেটপুরে ভাত খায়। আয়েশ করে ভরসা বিড়ি ধরিয়ে টানে। ভাবে এসব আজগুবি ভাবনা।
মানুষ তো মরেই। সে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ে। সারাদিনের ক্লান্তিতে তার দুচোখে জলের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে ঘুম নেমে আসে। ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্ন দেখে, যম তার ঘরের দুয়ারে এসে ডাকছে, ভাদু ওঠ্ । তোর লিবা এ্যাসিছি।
ভাদু কাকুতি মিনতি করছে। হামাক ছ্যাড়া দ্যাও। কি হামার বয়স হছে। এটা বাচ্চাকাচ্চার বাপও হনু না। ক্যান হামাক লিবা এ্যাসোছিন ? যম কিছুতেই তাকে ছাড়ে না, তার ঘাড়টা ধরে টানতে থাকে।
সে না , না করে চিৎকার করতে থাকে। তার গোঙানির শব্দে বউ তাকে ঠ্যালা মারে। এই কি হছে ? উংকা করছিন ক্যা। ও...। ভাদু ততক্ষণে স্বপ্ন থেকে ফেরে।
হঠাৎ কোয়াক, কোয়াক ভীতিকর চিৎকারের সাথে বাহিরে কোথাও ডানা ঝাপটানোর শব্দ। সে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসে বলে, দেখিছু দেখিছু যম হামাক লিবা এ্যাসিছিল। ওই দ্যাখ ফিরা গেল। ভাদুর বউ বলে, ও ভগবান এ কোন কথা। ও ভগবান।
ভাদু ক্রমাগত বলতে থাকে, ডাক শুনলু না। ঐ যে ডাক কোয়াক, কোয়াক। ভাদুর বউ বলে, ওডা কি যমের ডাক! ওডা তো কোন পক্ষীর ডাক মনে হয়। তুমি এত ভয় পাছিন ক্যা। এ্যানা জল দিমু।
জল খাবিন। ভাদু চিৎকার করে ওঠে, মাগি ওডা পক্ষীর ডাক। হামি পক্ষীর ডাক চিনি না। ডানার আওয়াজ শুনলু না। ওডাই সেই যম।
ভাদুর বউ এক গ্লাস জল এনে তাকে দেয়। সে এক নিঃশ্বাসে সবটুকু জল পান করে বলে, হামি আর এ গাঁয়োত থাকমু না। কালই গাঁ ছাড়া হমু।
-হায় ভগবান, একি কথা, কুটি যাবিন?
-ক্যান তোর বাপের বাড়ি। কোনোদিন তো জামাইয়ের একটা খোঁজখবরও ল্যায় নি।
এই বিপদের সুমি কি জাগা পামু না।
ভাদুর বউ ভাবে, মানুষটা ভয় পেয়েছে। তাই এসব উল্টাপাল্টা বলছে। নইলে কতদিন সে বলেছে তার বাপের বাড়িতে বেড়াতে যাবার কথা অথচ একবারও ভাদু সায় দেয় নি। সে তাকে প্রবোধ দেয়।
‘হয় হয়, সকাল হোক। তারপর না হয় একটা ব্যবস্থা করা য্যাবে নি। এখন শোও তো। ’ ভাদু খেঁকিয়ে ওঠে। ‘তুই শো।
’ ভাদুর বউ পাশ ফিরে শোয়। ভাদুর আবার ভয় ভয় লাগে। বউ ঘুমিয়ে পড়লে আবার যদি যম আসে। সে বউকে ডাকে, ‘বউ ও বউ কুপিটা এ্যানা জ্বালা তো। ’ বউ অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠে কুপি জ্বালায়।
তারপর কুপির আলোয় ভালো করে ভাদুর মুখটা নিরীক্ষণ করে। দ্যাখে, কালো মানুষটার মুখটাও কেমন যেন সাদা হয়ে গেছে। তার মায়া লাগে। ভাবে, সত্যি কি যম এসেছিল। হায় ভগবান, যদি সত্যি ভাদু মরে যায় তবে তার কি হবে? অবস্থার গুরুত্ব উপলব্ধি করে তার মনেও ভীতি সঞ্চার হয়।
কিন্তু এ মৃত্যুভয় থেকে বাঁচার জন্য কি করবে বা কী করা উচিত ভেবে পায় না। সেও ভাদুর সাথে সারারাত জেগে রয়।
সকালে উঠে তারা বাক্স-পেটরা গোছাতে শুরু করে। পাড়াপ্রতিবেশিরা জিজ্ঞাসা করে, ক্যা বা কুনটি যাছিন। সবকিছু গোছাচ্ছিন ক্যা।
ভাদু শুধু বলে, এই শউরের বাড়িত বা। ম্যালাদিন যাওয়া হয় না। কিন্তু কেন সবকিছু গুছিয়ে শউরের বাড়িতে যেতে হবে তার কোনো সদুত্তর তারা দিতে পারে না। বাড়ির সামনে একটি গরুর গাড়িতে মালপত্র তুলতে তুলতে ভাদু চারপাশের পরিচিত বাপ-দাদার ভিটাটার দিকে করুণ চোখে তাকায়। তার দুচোখ বেয়ে জল গড়ায়।
কাঁধের গামছার কোণা দিয়ে সে জল মুছে ভাবে, মরনের হাত থেকে বাঁচতে হলে এ ত্যাগটুকু তো না করলেও নয়। যদি সে বেঁচে থাকে বা যদি গাঁ থেকে যম দূরে চলে যায় আবার তো সে ফিরে আসবে। এ বিদায় তো চিরকালের বিদায় নয়। সে নিজেকে প্রবোধ দেয়। বউকে তাড়া দেয় এই চল্, চল্ ।
বেলা কত গড়ালো খেয়াল আছে। সে চায় দ্রুত এ অভিশপ্ত গাঁ ছেড়ে যেতে। কিন্তু বউও ভাদুর মতো শুধু এঘর ওঘর করে। কি কি যেন খোঁজে। পায় না।
অবশেষে তারা যখন গরুর গাড়িতে চেপে বাড়ি থেকে রওনা হয় তখন সকাল গড়িয়ে গেছে। পথে যেতে যেতে তারা দেখে কার যেন লাশ কাঁধে করে নিয়ে যাচ্ছে কয়েকজন। আজও তাহলে কেউ মরেছে!
ক্যাচোর-কোয়াচ শব্দ করে গরুর গাড়ি হেলতে দুলতে যখন ভাদুর শ্বশুড় বাড়ি পৌঁছে তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমেছে। বহু বছর পর জামাই ও মেয়েকে পেয়ে ভাদুর শ্বশুড়, শাশুড়ি যারপরনাই খুশি। ভাদুও হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
বাড়ির আঙিনায় নানান গাছ গাছালি। ঝিরিঝিরি বাতাসে ভাদুর শরীর মন জুড়ে আসে। তখন তার মনে হয়, গোছল করা দরকার। এই ভেবে সে আঙিনায় জামগাছের তলায় যায়। কুয়া থেকে বালতি দিয়ে জল তুলে ভালো করে রগড়িয়ে রগড়িয়ে সারা শরীর পরিস্কার করে।
জলের শীতল স্পর্শে সারাদিনের পথের ক্লান্তি, ধুলো শরীর থেকে ঝরে যায়। সেই সাথে ঝরে যায় তার মৃত্যুভয়ও। সে বউকে ডাকে, বউ, ও বউ ধুতি, গামছাডা ঘরত থ্যাকা লিয়া আয় তো। সে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে একপা দিয়ে ডলে ডলে ওপর পায়ের ময়লা পরিস্কার করে। ভাদুর বউ ধুতি, গামছা এনে দিয়ে বলে, তাড়াতাড়ি কর, খ্যাবিন না?
ভাদু শরীর মুছে ধুতি পরতে গিয়ে যেই মাথাটা উঁচু করে ওমনি দেখে জামগাছে দুটি আগুনে চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।