mostafizripon@gmail.com
বাংলাদেশের জঙ্গীবাদ এখন সরকারের আর রাখ-ঢাকের কোন বিষয় না। সব মহলেই প্রকাশ্যে আলোচিত হচ্ছে বাংলাদেশের উঠতি জঙ্গীবাদের চালচিত্র। আইন রক্ষাকারী বাহিনী নিয়মিতই গ্রেফতার করছে জঙ্গীবাদের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিদের, তাদের কাছ থেকে আমরা জানতে পারছি ভয়াবহ সব খবর। বাংলাদেশের ঘটনাবহুল রাজনীতিতে বিষয়টি এখন আর বিশেষ আবেদন রাখছে বলে মনে হয়না। আমাদের প্রতিদিনের হাজারও দুঃসংবাদের ভীড়ে মিশে যাচ্ছে এই সংবাদগুলোও।
চলমান রাজনীতি আর জীবন যাপনের অস্বাভাবিক ঘটনা দেখতে দেখতে আমাদের স্নায়ুও এখন বেশ শক্ত হয়ে গেছে। স্বাভাবিক জীবনযাপন যেখানে স্বপ্নের কাছাকাছি সেখানে জঙ্গীবাদে মানুষের কি এসে যায়! এটিকে জীবনের নতুন একটি উপদ্রব হিসেবেই আমরা মেনে নিয়েছি।
এ কথা সত্য যে, বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ আওয়ামী লীগ, বিএনপি'সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর অসৎ রাজনীতির ফসল। আর এর সাথে অবশ্যম্ভাবী অনুঘটক হিসেবে যুক্ত হয়েছে আমেরিকা পরিচালিত কথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। গত এক দশকে জেহাদী চেতনা গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে নড়বড়ে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে।
আর সুযোগসন্ধানী ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ববোধ ন্যায়-অন্যায়ের সীমারেখা অতিক্রম করেছে রাষ্ট্রসীমার বাইরে। আল কায়দা তাই আজ কোন রাজনৈতিক দল নয়, কোন কোন মুসলমানের কাছে এটি আমেরিকা বিরোধী ইসলামী চেতনার সমার্থক শব্দ। ফলে পেণ্টাগনের অধিনায়কত্বে এই ক্রুসেড আরো অনেককাল চলবে তা বলাই বাহুল্য। এই জটিল বিশ্ব রাজনীতির কাছে বাংলাদেশ উলুখাগড়া, এরসাথে গণতন্ত্রের মুখোশে আমাদের মৌলবাদী রাজনৈতিক দলগুলোতো আছেই। আশংকা হয় জঙ্গীবাদের হাতে দেশটির প্রাণবধ হয়তো সময়ের ব্যাপার মাত্র।
একথা আমরা অনেকেই মানতে নারাজ যে, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের সবচেয়ে পুরনো মৌলবাদী সংগঠন। বিএনপি'র সাথে টেক্কা দিতে সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগের আপাত নতুন এই চেহারাটির কিঞ্চিত আভাস মিলেছে। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে ইসলামী প্রজাতন্ত্রে রূপান্তরিত করতে না চাইলেও বিএনপি কিংবা জামায়াতের মতো দলটি চালিত হয় ইসলামকে সামনে রেখে। নেকাবে বা তসবিতে, সৌদী বা ইরানী অনুদানে, মাদ্রাসা বা মওলানাদের নেকদৃষ্টিতে যতখানি মুসলিম সাজা যায় আওয়ামী লীগ সে চেষ্টাই করে আসছে স্বাধীনতার পর থেকে। রাষ্ট্রের স্বার্থে নয়, দলের প্রয়োজনে জামায়াত-বিএনপি'র মতো আওয়ামী লীগ ইসলামকে ব্যবহার করে আসছে।
কার্যতঃ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর নীতি এবং আচরনগত অমিলের চেয়ে মিলের পরিমানই বেশী। বরং বলা যায় যেটুকু পার্থক্য আছে সেটুকু তাদের পোশাকে। অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরন নীতি, পররাষ্ট্রনীতি, কৃষি ও শিল্পায়ননীতিতে ন্যূনতম পার্থক্য নেই দলগুলোর। এমনকি দেশে ইসলামী জঙ্গীগোষ্ঠী তৈরীতে দলগুলো সমানভাবে কাজ করেছে। বাংলাদেশে সরকারের অজ্ঞাতে জঙ্গীবাদের উত্থান ঘটেনি।
বরং সরকারের সক্রিয় সহযোগিতা ছিলো এ জন্য।
নব্বই-এর দশকের শেষভাগ থেকেই বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গীগোষ্ঠী সক্রিয় হতে থাকে এবং একের পর এক হামলা চালাতে শুরু করে। প্রথমে বিচ্ছিন্নভাবে এসব হামলা হলেও দিন দিন পরীক্ষামূলক স্তর পার করে এসেছে তারা। এ যাবতকালে জঙ্গীদের শিকারে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় শ'তিনেক, আর পুঙ্গুত্ব বরন করেছেন সহস্রাধিক মানুষ। ২০০৭-এর জানুয়ারীতে ফখরুদ্দিন আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহনের পর থেকে আমরা বাংলাদেশের জঙ্গীতন্ত্র সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে শুরু করেছি।
যদিও বাংলাভাই, শায়েখ আব্দুর রহমান ইত্যাদি নামগুলো এর বেশ কয়েক বছরপূর্বেই আমাদের কানে এসেছে- কিন্তু সেগুলো ছিলো তাদের বীরত্বের গল্প। থানার পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে তারা যৌথভাবে সন্ত্রাসী পেটাতেন, আর চা-বিস্কুট খেতেন। জোট সরকারের শেষ দিকে বাংলাভাইসহ কয়েকজন জেএমবি নেতা গ্রেফতার হলেও নিন্দুকেরা বলছে এটি বিএনপি'র নির্বাচনী চাল। এরও আগে মুফতি হান্নানের বলে আফগানযুদ্ধ ফেরত এক জঙ্গীর নাম আমরা শুনেছিলাম। ২০০০ সালে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বোমা পেতে রাখার দায়ে মুফতি হান্নানের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিলো।
মজার ব্যাপার, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আসামী হয়েও জোট সরকারের আমলে মুফতি হান্নান প্রকাশ্য ঘুরে বেড়িয়েছে এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, তার মুক্তির জন্য তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরীর কাছে সুপারিশ করেছিলেন এক উপমন্ত্রী আর এক প্রতিমন্ত্রী। আমাদের রাজনীতি বরাবরের মতোই নীতিহীন, নির্মম, গোঁয়ার আর মানুষের বিপক্ষে সক্রিয় রয়েছে।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ফলে আমরা বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের দ্রুত আর মসৃন উত্থান লক্ষ্য করেছি। ১৯৯৯ সালে যশোরে উদিচি'র জাতীয় সম্মেলনে বোমা হামলা চালায় জঙ্গীরা। সে সময়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন আওয়ামী লীগ- বিএনপি'র সাবেক মন্ত্রী তরিকুল ইসলামকে প্রধান আসামী করে একটি মামলা দায়ের করে এবং কৌশলে বোমা বিস্ফোরনের আলামতগুলোকে নষ্ট করে ফেলে।
গোয়েন্দা রিপোর্টে এ হামলায় ইসলামী মৌলবাদী গোষ্ঠীর সম্পৃক্ততার কথা উল্লেখ থাকলেও আওয়ামী সরকার তা অগ্রাহ্য করে। এই কিছুদিন আগপর্যন্ত ইসলামী দল বা মৌলবাদী দল বলতে শুধু জামায়াতে ইসলামীকেই আমরা বুঝতাম। বিএনপি'র চাপে অস্থির আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক কারনেই জামায়াতকে চটাতে চায়নি এ ঘটনায়। পরে জামায়াত-বিএনপি'র জোট সরকার ক্ষমতায় এসে একই ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমসহ আরো কয়েকজনকে আসামী করে একটি রিপোর্ট তৈরী করে। এখানে লক্ষ্য করার মতো বিষয় যে, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার মানসিকতায় আসল অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে।
ঠিক একইভাবে আওয়ামী লীগকে শায়েস্তা করতে গোয়েন্দা রিপোর্টকে পাশ কাটিয়ে ময়মনসিংহে সিনেমা হলে বোমা বিস্ফোরনের ঘটনায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিমসহ কয়েকজনকে আসামী বানায় বিএনপি সরকার। নারায়নগঞ্জ আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা বিস্ফোরন মামলার একই পরিনতি লাভ করে বিএনপি সরকারের আমলে। মামলার বাদীদের নামেই সরকার পক্ষ মামলা ঠুকে দেয় ক্ষমতায় এসে। আর এসব ঘটনার শেষটা আমরা সবাই জানি- প্রতিপক্ষকে তথাকথিত রাজনৈতিক চাপের মুখে রাখা। কিন্তু জঙ্গীবাদকে এড়িয়ে যাওয়ার ভয়াবহ পরিনতি আমরা তখনো বুঝিনি।
যদিও এখনো বুঝি কিনা সন্দেহ করার যথেষ্টই কারন আছে।
জঙ্গীবাদ লালনের ফলাফল শেখ হাসিনা হাতেনাতে কিছুটা হলেও আঁচ করেছেন। ২০০৪ সালের ২১ আগষ্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলায় তেইশজন নিহত হন। এই বোমা হামলার বিষয়ে যত তত্ত্ব, কেচ্ছা আর চক্রান্ত হয়েছে- বাংলাদেশের রঙ্গভরা রাজনীতির ইতিহাসে এমনটি আর ঘটেনি। এই ভয়াবহ বোমা হামলা ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কাজ, আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ, জর্জ মিয়ার কাহিনী ইত্যকার নানা উপধারায় ঘটনা প্রবাহিত করেছে জোট সরকার।
মূল আসামীদের লুকানো হয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেষে। একই সরকারের আমলে খুলনার মেয়র, উত্তরবঙ্গের কয়েকজন মন্ত্রী-এমপি, বিএনপি নেতা, পুলিশ প্রশাসনের সরাসরি সহযোগিতায় জেমবি নামের খুনে সংগঠনের জন্ম হয়েছিল। ধর্মের নামে মানুষ খুন, লুট, সম্পত্তি দখল ছিল যাদের প্রতিদিনের রুটিন কাজ। এভাবেই মৌলবাদী গোষ্ঠী আর জঙ্গী রাজনীতির বিকাশ আর বিস্তার ঘটেছে বাংলাদেশে। এরা এতটাই বেপরোয়া যে, কারনে অকারনে দেশে গৃহযুদ্ধের হুমকি দিতেও পিছপা হয়না এখন।
দিনে দিনে শক্তি এরা যথেষ্টই সঞ্চয় করেছে বোঝা যায়। সারা দেশে একসাথে বোমা ফাটানোর মতো যাদের ক্ষমতা আছে তাদের শক্তিশালী মনে না করার কোন কারন নেই।
এরই মধ্যে সংবাদ শোনা গেল জঙ্গীবাদ দমনে আমেরিকা বাংলাদেশকে সামরিক আর অর্থনৈতিক সাহায্য দেয়ার কথা ঘোষনা করেছে। আমরা আমেরিকার মডারেট মুসলিম রাষ্ট্র উপাধীতে এতদিন বেশ গদগদ ছিলাম; এবার আহ্লাদে আটখানা হয়েছি। চট্টগ্রামের বহিঃনোঙ্গরে অস্ত্র খালাসের ঘটনা, আফগানস্তান আর ইরাকে মুজাহিদ সাপ্লাইয়ের অভিযোগ, কয়েকটি মাদ্রাসায় জঙ্গীদের প্রশিক্ষনের মার্কিন রিপোর্টগুলো কি তাহলে সত্য বলে মেনে নিচ্ছে সরকার? একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা- মার্কিন সহযোগিতা আর আমাদের রাজনৈতিক অবিমৃষ্যকারিতা জঙ্গীবাদকে সুপুষ্ট করে তুলবে আগামী বছরগুলোতে।
আফগানিস্তান ফেরত যোদ্ধাদের বাংলাদেশ ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে, সরকার পরিচালিত ইসলামী কর্মকাণ্ডে জামাই আদরে বসিয়েছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি। জোটবদ্ধ নির্বাচনে ইসলামী জোশ আনতে দুই দলই এদের কোলে তুলে নিয়েছে। ভাবখানা তাদের এই- আজকাল দু' একটা যুদ্ধফেরত মোল্লা দলে না থাকলে যেন চলেই না! আমরাও মেনে নিয়েছি দাড়িওয়ালা জেহাদী আর নেকাব পরা নেত্রীকে পাশাপাশি। কিন্তু সত্য এটাই, ইতিহাস বলে- তোমাকে যে হত্যা করবে সে তোমারই রাজনৈতিক শয্যাসঙ্গী আজকে। জঙ্গীবাদের সাথে ধর্মীয় বা রাজনৈতিক সখ্যতা হয়না, অনৈতিক ব্যাভিচার হয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।