বিস্মৃতি ও বিষাদটিলা
এই কবি এখন থাকেন বরিশালে, যাবতীয় কোলাহল থেকে মুক্ত, একরকম যোগাযোগহীন এবং কবিতা বিষয়ে অত্যন্ত প্রত্যয়ী। নতুন কবিতার পথ কী হতে পারে এবং কোন্ কোন্ প্রবণতাকে নতুন কবিতা বলা যাবে না, সে বিষয়ে তিনি খুব স্পষ্ট বলেই মনে হয়। তাঁর বই 'পাখি ও প্রিজম' পড়ছি। পড়তে পড়তে কিছু কিছু কবিতা ভালো লেগে গেল। ভাবলাম আপনাদের সাথেও শেয়ার করি:
পথে পথে দিশে দিশে রাষ্ট্র হয়ে গেছে
আজ বৃষ্টি হবে, আজ সকলের অবসর।
আমিও বাতাসে চুলের আভাস আশা করে
জানালা খুলেছি কফির ধূসর ধোঁয়া থেকে ;
পাখি হয়ে ওড়ে ঝরাপাতা
ঝরাপাতা হয়ে ওড়ে পাখিস্মৃতি।
মনে পড়ে, পাখি, কবে ভেঙেছিলো ডানা ?
২.
এত শব্দ এত গান হাওয়ায় হাওয়ায়,
জানতে চেয়েছি শুধু, মনে রাখবে কি ?
হায়, ও তো বড় বিস্মৃতিপ্রবণ !
আর জল ! ...সব কিছু ছায়া ফ্যালে জলে ;
জল ধরে রাখে কার মুখ
বাতাসের ঢেউয়ের নিচে, খলবল তরঙ্গের নিচে
অকম্পিত, স্থির ?
শুকনো পাতার মতো আর্তি শুধু ঘুরে ঘুরে
ঝরে পড়ে আবহমান দিবস জুড়ে, চূর্ণ হয়,
বিচূর্ণিত এই অশ্র“পাত ভেবে নাও ফুল।
তবু আজ জেনে নিতে চাই, কার মুখ
কার মূর্তি জেগে আছে, জলের ভেতর কার কণ্ঠস্বর ?
পড়ে আছি আমি—কোনো স্থাপত্যের ভুল, অসংলগ্ন বাহু !
৩.
অনেক অনেক রাত্রি, এখন যে-কোনো শব্দ ভৌতিক।
চাঁদের নিচে জ্বলছে শাদা ধোঁয়া
আর রাস্তা জুড়ে বাতাসের পদচ্ছাপ।
এখন প্রাঙ্গণের নিঃসঙ্গ দেবদারু কী অবাস্তব, উদ্ভট !
তোমার গান হেঁটে গ্যালো নিজের সামনে দাঁড়ানো
মগ্ন, একাকী পথিকের মতো,
সুরের ভেতর মৃদু গল্পাভাস রেখে
সরে গেছে শব্দ, মাঝপথে, চুপচাপ।
অনেক গল্পের প্রতিশ্র“তি ছিলো একদিন
করতলের উষ্ণতায় পরিমাপ করেছিলাম ভাবীকাল।
যে রূপকথা চেয়েছিলাম তার ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমী
উড়ে গেছে পৃথিবীর দাম্ভিক কার্নিশ থেকে,
আমাদের ছুঁড়ে দেওয়া বাদামগুলো
পড়ে আছে ইতস্তত, ভিজছে শিশিরে।
অনেক রাত্রি পৃথিবীতে। এখন যে-কোনো দৃশ্য ভৌতিক।
৪.
প্রচণ্ড কম্পনের বিহ্বল রাতেও শান্ত হয়ে শুনতে হয় মানুষের সফলতা—জীবনের হাস্যকর গল্প ডালপালা ছড়াতে থাকে ভেতরে ভেতরে।
বাগানে নিরাবেগ বাতি সাপের হিস্হিস্ শব্দে ফুলের ফুটে ওঠাকে দ্যাখে। অথচ সবই একটা তুড়ির মতো : শব্দ কম্পন ঢেউ ; আবার মিলিয়ে যাওয়া। কোনো চিহ্নই নেই বাতাসের গায়ে। বাইরে মৃত্যুর প্রহরা।
অন্ধকারে একটা গাছও এখন আততায়ী।
স্পর্শের ক্ষমতা আমরা হারিয়েছি। কেবল পা দ্রুত পালানোর জন্য। কে নেবে তোমাকে ? অরণ্যের কাছে গেলে, জেগে ওঠে কাঠ-চেরাইয়ের নিঃসীম ধ্বনি আমাদেরই মাথায়। সমুদ্র তাই পায়ের তলা থেকে বালুরাশি খশাতে থাকে।
আর্তনাদ কিংবা বিলাপের ভাঁজে ভাঁজেও আছে দম্ভের বিশ্রী সেলাই।
দ্যাখো, সমস্ত গল্পেরই জাহাজডুবি ঘটেছে। তীরভূমি খুঁজতে পাঠানো পায়রার ডানার দাগও আকাশে নেই। তবু দীর্ঘ-মাস্তুল জাহাজ আর উদ্ভাসিত বন্দরের গল্পে মুখরিত অবসর। প্রসঙ্গ বদল করে মৃত্যুকে এই ভুলতে চাওয়া... যেন মৃত্যু মরুভূমির উন্মাদ জ্যোৎøায় মুখ-ঢাকা অশ্বারোহী, মিলিয়ে গেছে দ্রুত—দিগন্তে।
চল্কে-ওঠা মদের উচ্ছ্বাস একটু পরে হতাশায় করুণ হবে।
তাই, এই রাত্রির প্রবঞ্চক মুঠি থেকে খশে যাবার আগে তোমাকে শান্ত হয়ে বলতে হবে সেই কথা, যা বলার সুযোগ একবারই পাবে !
৫
তোমার কেশগন্ধের কাছে এসে বড় বিভ্রমে পড়ে গেছি। রুটির ওপরে মাখনের মতো গলতে থাকা এক রাত্রির কক্ষে আটকা-পড়া পতঙ্গ—গর্ভরহস্যের কথাই মনে হবে এই অন্ধকারে। আসলে কি তাই, যখন হাজারো দরোজা খুলে আছে ? কাকে বেছে নেবে হাজার পৃথিবীর... পরাক্রান্ত যোনির মতো যারা তোমায় উগরে দেবে, জন্ম দেবে ভাঁড় বিপ্লবী কিংবা ভ্যাম্পায়ারের পৃথিবীতে ?
...এই পৃথিবীই বয়ে নিয়ে যাবে তুমি মানুষের মুখোমুখি এক যাদুকর ! ...ভাবো। কত বিপ্লবীকেই তো দেখলাম, রূপান্তরিত হয়েছে পেটমোটা ভাঁড়ে। কত প্রেমিক পেলো কুকুরজন্ম মুহূর্তেই, কত সমকামী আঁধারপায়ী আরশোলা অবশেষে।
বিপরীতও আছে বটে। খোজা ও বেশ্যার সঙ্গমেই জন্মাচ্ছে আজ মানুষের রূঢ় ব্যাকরণ ও বর্ণমালা ? ...মনে রেখো।
কেশগন্ধ থেকে কেশের মূলে পৌঁছুতে কত বাকি, কত বাকি পুরো তোমার মুখোমুখি হতে। তার আগে কত হাজার দরোজা পার হতে হবে। প্রতিটি শব্দই যাদুকরী।
আমার কলম মৃত বাইজীর রেখে যাওয়া সেই ঘুঙুর আজও, যে বিশ্রাম নিচ্ছে এখনও, লালসা ও লাঞ্ছনার ইতিহাসের মধ্যরেখায়।
তোমার কেশের মৃদুগন্ধ নাকে এসে লাগছে। অনিবার্য উচ্চারণের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি আজ। সব উচ্চারণের পাশেই ভয়াবহ খাদ। পতনের ভয় আছে।
তেপান্তর ছুঁয়ে আসা গল্পকে বয়ে নেবার জন্য অন্তত এক জোনাকিজন্ম চেয়েছি। আছে প্রতিশ্র“তি ভুলে ঘুমিয়ে পড়ার ভয়। ভ্যাম্পায়ার ও ভাঁড়ের সাথে বাদানুবাদের আগেই ঘটে যেতে পারে চতুর মেটামরফোসিস।
৬
আকাশের ঈগলডানার নিচে তোমরা পাঁচ দস্যু যখন অন্ধকার ঢেউয়ের পাটাতনে মেয়েটিকে ধর্ষণ করেছিলে, তার আর্তনাদ আমার জানালা ছুঁয়ে ফিরে গেছে। বাতাস-তাড়িত ডালের মতো কেঁপে কেঁপে শার্সির কাছে এসে এই ফিরে যাওয়া আমি তো দেখি নি।
সকালে নিদ্রাভঙ্গে দেখেছি জানালার কাচে সূক্ষ্ম ফাটল আর ফোঁটা ফোঁটা বেগুনি শিশির।
নভেম্বরের এই আশ্চর্য শীতের ভেতর পৃথিবীর শেষ পর্ণমোচী অরণ্যে সে নিদ্রায় বৃত হয়ে আছে। ভাঙা প্রতিমার মতো স্বেদ-রক্ত-ক্ষত স্তনে লেগে আছে শিশিরের মতো জ্যোৎøা, সারা শরীর ঢেকে আছে ঝরাপাতার শুশ্রƒষায়।
আমি জানি দ্বিতীয় রাত্রিতে তোমরা আর তাকে পাবে না। এতদিন ধরে চন্দনকাঠের যে আশ্চর্য কফিন আমি বানিয়েছি সে তো আজ তার জন্যে... বোন...।
আয়োজন ছিলো মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়ার জন্যই। আর এখন সমস্তই সেতু অতিক্রমণের ভয়াবহ গল্প—পার হওয়ার আগে যে সেতু আমাদেরকেই জোড়া-তালি দিতে হয়েছিলো, তারপর এই অপটু ভারসাম্যময় দুর্বহ অতিক্রমণ।
এদিকে যারা আওয়াজ তুলেছিলো তাদের সঙ্গে মিশে তোমাদের পাঁচটি মুখ পাঁচশো হয়ে গ্যালো। আর পরশু আদালতে আমার ভাইয়েরা যা বলবে অর্থাৎ দ্বিতীয়বার সেই ভয়ঙ্করতা। দ্যাখো, একই পাতকুয়ায় আচমন শেষে আমরা সবাই আহারে বসেছিলাম আর আহারতৃপ্ত ঢেকুরে একই খাবারের ঘ্রাণ !
কিন্তু অভিযোগনামায় আমার নাম তো নেই।
জানি। তবু বড় করুণার মতো মনে হয়। কেননা তার আর্তনাদের ঢেউ আমার ঘুমের নৌকা ছুঁয়েছিলো, তারপর ফিরে গেছে বিপরীত টানে। কোন সে চোরা স্রোতের নিঃশ্বাসে ভিজেছে শয্যা !
সিক্ত বিছানায় বসে দেখি চন্দনকাঠের সে কফিন ভেসে যায় দূরে অতলান্তিকে...। তার পরিত্যক্ত রক্তাক্ত বস্ত্রের ভার মেঘে মেঘে আকাশের গায়ে।
ভগ্ন-বৃদ্ধের মতো লাঠি ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছে রাত্রি। আমার মতো তার কীসের প্রতীক্ষা ?
৭.
বিশদ নির্দেশ-ভরা বসন্তের চিঠি আমিও পেয়েছি উল্কাবৃষ্টির রাতে। অথচ এমন রাত্রে শব-বাহকের গাড়ি এসে থামে পেছনের বিশাল মাঠে। সাথে আসে সাংবাদিক, খুনি ও ডাক্তার। একসাথে বসে মদ্যপান করে চলে যায় খুব ভোরে।
সকালে কেবল বালকেরা দ্যাখে শ্যামা ও শকুন, কাক ও কাকাতুয়ার পাখনা-পালক একাকার হয়ে আছে মাঠে।
মহানিমগাছ শুদ্ধ করে রাত্রির বাতাস। অগণন জোনাকির মতো মৃত্যু আলো জ্বালে, নক্ষত্রের বিভাময়। পোড়ামাটির ভাঙা খিলান-গম্বুজের এক মৃতদের শহর জেগে ওঠে—পাওয়া যায় তবু রাজকুমারীর কড়ে আঙুলের নখ।
আড়-চোখে প্রান্তরের দিকে চেয়ে ত্রস্ত শৃঙ্গারের শেষে যারা ঘুমিয়েছে, তাদের নাসিকা-গর্জন ঢেউ তুলে ফের ডুবে যায়।
সকলই আশ্চর্য সহজ। আমাকেও ডাকে ফেননিভ নারী, মেঘময় অনুচিত শয্যায়। মনে পড়ে, কারো হাত আর্ত চড়–ই... কিছু পরে ঘেমেছিলো ! সেই ঘাম ফিরে এলো কৃষ্ণাতিথির মৃত জ্যোৎøায় নধর পাতার পিঙ্গল ঘ্রাণে !
এই তো রাত্রি, উল্কাবৃষ্টির সৌর আতসবাজি ! বিশদ বসন্তের ষড়যন্ত্র ! এই তো সেই রাত্রি, স্বর্ণমুদ্রাভরা রহস্যের কলশেরা নেমে যাচ্ছে কালসর্পের প্রহরায় সমুদ্রের দিকে। লবণের ঘ্রাণ ডেকে আনে স্বভাবের বিচিত্র আয়োজন। বসন্ত, হে লবণবাহী হাওয়া, অবগাহনের সাধ জেগেছে আমারও !
আমি তো নামছি রাতভর, নক্ষত্রের বারান্দা থেকে পাতার পিঙ্গল দেহে শিশিরের মতো অবলীন হতে !
৮.
সমস্ত গুপ্ত চিঠিই ধরা পড়েছে।
এখন অসংলগ্ন বাক্য আর ভুল বানানের জন্য লজ্জার কোনো মানে নেই। মৃতদেহবাহী শকট ছুটে যাচ্ছে সকল কুয়াশাতন্তু ছিঁড়ে। রাজপথ জুড়ে ফুটে থাকা রক্তজবা আর তাদের অভিনন্দন জানাতে আসা সবুজ রোদ্দুরের কথা পুরনো চুইংগামের মতো বিস্বাদ। প্রতিশ্র“ত আঙরাখা বানানোর আঙুলগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। ...এ সমস্তই বিষয়বস্তু।
আমরাই এবার এসব নিয়ে মেতে উঠবো। টিকিট হারানো যাত্রীর অসম্মানের উদ্বেগ নিয়ে আত্মগোপন যেন। ধরা পড়ে গেলে নির্ভুল ঠাট্টার সূঁচ দু’চোখে গেঁথে ঘুমোতে যাবো শেয়াল-বেষ্টিত অরক্ষিত গোরস্তানে।
৯.
আমার স্মৃতির ভেতর তোমার হিমডানা আমি টের পাই, মেঘ। সেখানে গুল্মের অরণ্যে নিভে আসা সূর্যবেলায় এক ঋজু দেবদারু তোমার সাথে নিঃশব্দে কথা বলে।
ছড়িয়ে দিতে থাকে ভেজা নিঃশ্বাস আর বিগত শতাব্দীগুলোর প্রাচীন গন্ধ। আমার সকল ব্যর্থতা সেখানে গাছ বেয়ে ওঠা পিঁপড়া ; সর্বদাই নতুন খাবারের সন্ধান করে। আমার তো ডানা নাই, ডানা ঝাপটানোর হাওয়া বুকে লাগে তবু। দেখি ডানায় ডানায় রোদশিশুদের লুকোচুরি খেলা, রোদকিশোরীর ব্রীড়ানত মুখ। মেঘ, তুমি ওড়ো।
শুধু বৃষ্টি আমি চাই, কাজ শেষে ত্যক্ত কাগজের ভেসে যাওয়ার সময়।
যিশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার পর এমন বৃষ্টি নেমেছিলো, মনে পড়ে।
১০.
কল্পনায় যাদের হত্যা করেছি, পথে তাদের সাথে দেখা হলে কী রকম বিব্রত লাগে। অকস্মাৎ মৃত্যুরই মুখোমুখি হলাম আর কি ! অসহায় একাকিত্ব থেকে ভীতি আসে। তখন দু-একটা অস্বস্তিকর প্রশ্নোত্তর দেবার ভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে থাকে একটা জড় প্রচ্ছদ।
আমি দ্রুত পালাতে থাকি। পালাতে পালাতে আবার তাদের সাথেই দেখা হয়ে যায় যদি, এই ভেবে কুঁকড়ে আসে পায়ের ক্ষমতা। আর পেছন থেকে সারাক্ষণ কেউ নাম ধরে চিৎকার করছে।
কোনো এক জন্মে নির্জন উপত্যকার পথে কিংবা জনমানবহীন কোনো চরে একদিন তাদের আমি হত্যা করবো। রক্তের ফিন্কি-ধোয়া হাত-মুখ মুছে নিতে যাবো বোধি-অন্ধকারের কাছে।
যাতে রক্তচিহ্নগুলো ম্লান হয়ে ফুটে থাকে, উগ্র না হয়। একটিবার বাঁচবার জন্য হত্যা ও মৃত্যুর কত প্রয়োজনীয় আয়োজন ছড়ানো আছে। আছে পালানোরও যথেষ্ট রীতি-কানুন।
কিন্তু সব শিখেও মৌলিক অপটুতা ধরা পড়ে প্রতি পলে, চিনিভ্রমে কর্পূর মুখে তুলবার মতো। শিশু ও বৃদ্ধের সাথেই কেবল বন্ধুত্ব হলো ! অপ্রকাশের ভার নিয়ে বোবা যে বিচ্ছিন্ন গাছ জানালার পাশে আমার ঘুম পাহারা দেয়, সে-ই দ্যাখে কত গূঢ় পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলো স্বপ্নে, ফাঁকি না দিয়ে কতজনার সাথে মুখোমুখি তর্ক হলো !
১১.
হযরত খোয়াজ খিজির নামের কোনো বৃদ্ধকে চিনি না যিনি জলের অধিপতি।
তবু দেখতে পাই সমুদ্রের নিচে তার ঘর। শুভ্র অস্থির ফেনার মতো তার দাড়ি আন্দোলিত। মেঘের মতো গুমগুম করে তার কণ্ঠস্বর, শান্ত। জল-অট্টালকের মুহূর্তের সিংহাসন থেকে তার নির্দেশ আসে, আর সুমাত্রা কি জাভা কি লংকার তট নেচে ওঠে, ধেয়ে আসে লক্ষ লক্ষ পাগলা হাতির দঙ্গল। ওপরে মেঘে ও কজ্জলে মাখামাখি আকাশ নির্মেঘ, স্তব্ধ ; নিচে কূলে ও অকূলে সকলের নির্বাণ !
সেই শৈশবেই জেনেছি এমন কেউ কেউ আছে যারা পান চিবুতে চিবুতে অনায়াসে চলে যায় তার কাছে।
তারা মেহমান হয় জলের সাম্রাজ্যে। জলের গভীর হতে তাদের কাছে চলে আসে শাদা রঙের ঘোড়া সেই পূর্ণিমায়, যেদিন মানুষের মনও সেই ঘোড়ার ফুলে-ওঠা কেশরের মতো অস্থির হয়, কথা বলে ওঠে মরে-যাওয়া পাথরও !
আমি তো শৈশব থেকেই তাদের ঈর্ষা করি আর দীর্ঘশ্বাস ফেলি। আমার দীর্ঘশ্বাসের ভেতর জন্ম নেয় একটা কালো সমুদ্র। তার নোনা জলের শুভ্র উল্লাস আমাকে বার বার উগড়ে দেয় বেলাভূমিতে লাল কাঁকড়ার মতো যতবার ভেতরে ঢুকতে যাই। আমি তাই অশ্ব কি অশ্বতর, কোনো বাহন ছাড়াই নিজের ভেতরে প্রবেশ করি, সেই খোয়াজ খিজিরের সন্ধানে যার নির্দেশে সর্বস্বই ভেসে যায়, আর পরক্ষণেই যে হায় হায় করতে করতে সব কিছু জুড়তে বসে।
১২.
গাছের কোটরে ঘুমিয়েছিলো একটা সাপ। স্বপ্নে দেখলো সে রূপান্তরিত হচ্ছে একটা গাছে। দেখে প্রচণ্ড ভয়ে তার ঘুম ভেঙে গ্যালো, জেগে কোটর থেকে বেরিয়ে সামনে পেলো মন্দিরের পুরোহিতকে। বটগাছটা ছিলো একটা কালি মন্দিরের সামনেই।
কিছু বুঝে উঠবার আগেই পুরোহিতকে দংশন করলো সাপটি।
হতভম্ব পুরোহিত সাপটিকে বললো, এই প্রতিদান দিলি ! কী করলি তুই !
সাপ বুঝতে পারলো কী করেছে সে ; বললো, আমার চারিদিকে ঘুমের দেয়াল। এই দেয়ালকে প্রতিদিন আমি লেহন করেছি। আমাকে এই দেয়াল পিষে ফেলতে চেয়েছে আজ।
‘বিশ্বাসঘাতক ! (...হায় ঈশ্বর আমি কি বিশ্বাস হারাচ্ছি ?) আমাকে কামড়ে দিলি তুই !’
‘দেয়ালটাকে আমি আজ ভাঙতে চেয়েছি। অসহায় দংশন ছাড়া তো কিছুই জানি না।
...ভুল করেছি আমি। ক্ষমা করো। ’
পুরোহিত ভাবলো, দেবতা তো এ ভাষায় কথা বলেন না। সাগরের তলায় ছোট্ট যে নুড়ি, তার ভেতরেও গোপন চিঠির মতো লুকিয়ে থাকে লক্ষ বছরের ফিকে হয়ে আসা গল্প, তেমনি এই সরীসৃপের গায়ে যে চিত্রল নক্শা সেখানেও আছে হয়তো দেবতার প্রযতœ, সাশ্রয়ী ভালোবাসার ইতিহাস। পুরোহিত ওকে ক্ষমা করলো।
বললো, তুই কোটরে ফিরে যা।
সাপটি ফিরে গিয়ে ঢুকতে চাইলো ঘুমের ভেতরে পুনরায়। কিন্তু সাপের স্বপ্ন ও আতঙ্ক জেনে ফেলেছে সেই বটগাছ। তাই, তখন তার শীর্ষ আন্দোলিত হল মৃদু। মরে-যাওয়া কয়েকটা পাতাও ঝরে পড়লো এলোমেলো।
বুঝতে পেরে চিরপুরাতন আশ্রয় ছেড়ে পুরনো এই প্রাণীটি বেরিয়ে পড়লো বাইরে। নিরাশ্রয়ের যন্ত্রণায় আশ্রয় কোনোদিন আন্দোলিত নয়। সাপ দেখলো পৃথিবী জুড়ে চলার পথে পথে ফুটে আছে শুধু বিষণœ কৌতুক।
১৩.
সন্ধ্যা শেষের গলিতে দাঁড়িয়ে পাটল রঙের ঘোড়া। পিঠে তার ডানা নাই।
দূর অতীতের আরবি ঘোড়ার এদেশি সহোদর, খর্বকায়। বাঁকানো শরীরে চাবুক আর ভারবহনের ক্লেশকর দাগগুলো কেউ একদিন হয়তো ঠিকই দেখতে পাবে। হ্রেষা নাই, চুপচাপ। আমি চিনতে চেষ্টা করি : ঘোড়াই বটে।
শুনি মধ্যরাতে তার হ্রেষা অকস্মাৎ ! আমাদের সুপ্তিঘোর চিরে লক্ষ-কোটি ঘোড়ার হ্রেষা তার সাথে একযোগে ছুটে চলে, ছুটে চলে রঙিন কাগজে বাঁধাই-করা বইয়ের মতো নিয়তির নানা মাঠ-বাট পার হয়ে...।
সমস্ত নিয়তির শেষে পৌঁছানো যায় এখানে, এই প্রান্তরে, ঘোরলাগা পূর্ণিমায়। পড়ে আছে অশ্বের শাদা হাড়গোর। আর সর্বশেষ মীমাংসার শেষে যেন, অভিজ্ঞ শকুনেরা পাহারায়। তাঁরা বলে : ‘ঘোড়ারা পয়দা করে কেবলই ঘোড়া’।
মাঠের ওপারে সেই আয়ুবৃক্ষ।
তার নিচে বসে আছে প্রবীণ শকুন। পাতা ঝরানো আর নাম-ঘোষণা এখন তারই আয়ত্তে। ঘোড়দৌড় তার খুব প্রিয়। সে বলে : ‘ঘোড়া দৌড়ায় জোরে... খুব জোরে। ঘোড়ার দলেই থাকে গাধা ও খচ্চর ; তারা দৌড়ায় না, হাঁপায়।
দেখে সুখ আসে। ’ এ সময় আয়ুবৃক্ষ হতে একটি পাতা ঝরে পড়লে সে ব্যস্ত হয়।
আমাদের উড়িয়ে নিতে চায় ফের তুমুল হ্রেষারব। দেখি কোটি কোটি অশ্বের অভিযান টলায়মান চাঁদের নিচে। জগতের সমস্ত আস্তাবল ভেঙে, কবিতা সঙ্গীত বা পটচিত্র থেকে, ক্যালেন্ডারের পৃষ্ঠা থেকে, রাত্রির তালাবদ্ধ সব চিত্রশালা পিছে ফেলে, প্রাচীন গুহার প্রস্তরিত অন্ধকার থেকে, ক্যানভাসের সদ্য-সমাপ্ত ছবি থেকে, অশ্বাসীন বীরের ভাস্কর্য থেকে বীরকে ভূলুণ্ঠিত করে ছুটে এসেছে সব ঘোড়া অদম্য অদ্ভুত দুর্বিনীত উল্লাসে...।
তারা ছুটছে নির্বাধ স্রোত। উত্তেজনাবশত আমি চড়ে বসতে যাই। দেখি নিচে কাতরাচ্ছে সঙ্গিনী, এক ভয়ার্ত মাদী-ঘোড়া... গলায় আটকে গেছে হ্রেষা !
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।