আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হে কবরবাসীরা,তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক



আনমনে বিড়বিড় করে উঠি--"আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর"। বলেই একটু চমকে উঠি,নিজের মনেই। কেন বলবো আমি, হে কবরবাসীরা তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক,যেখানে আশপাশে কবরের অস্তিত্ব অন্তত খালি চোখে দেখা যাচ্ছে না? এমন না যে আমি বলি না এমন,বলি প্রায় প্রতিদিনই,মৌচাকের পাশ দিয়ে যেতে যেতে ঘুমন্ত তসলিম আর ফারুকের কবর দু'টো চোখে পড়লেই বলি,কালো ধোঁয়া আর দূষিত শব্দের শহরের ঝন্ঞ্জাটকেন্দ্রে শুয়ে থাকা দুই শহীদের আত্মায় কিছু শান্তির বাতাস যদি বয়ে যায় আমার বিশ্বাসেও,কার কি ক্ষতি? কিন্তু এখন আমি আছি কাকরাইলের কাছে,রাস্তা ঘেঁষে গড়ে ওঠা কর্ণফুলি গার্ডেন সিটির পাশে,মিষ্টি আলুর মত ভাঁপে সেদ্ধ হচ্ছি ১০ নম্বর বাসে,ঘামের বৈশাখী সুবাসে। সেদ্ধ হয়ে আসছি মৌচাক থেকেই,সময়ের মূল্য নিয়ে স্কুলে লেখা রচনাটা কতটা অর্থহীন এই দেশে সেটা নিয়ে গবেষণা করতে করতে। মাটির মানুষ বটে এই বাঙ্গালি,পুড়ে পিটিয়ে ঝামা করে কতই আকার দিচ্ছে আমাদের,সোনামুখ করে সয়ে যাচ্ছি সব,নিয়তির সাথে আপোষ করে বেশ আছি বোকার স্বর্গে।

তো,কথা হচ্ছিল কবর নিয়ে,বা কবরের অধিবাসী নিয়ে,নাকি শান্তি নিয়ে? আমাদের ভাতেও শান্তি,আলুতেও শান্তি,শীতেও শান্তি,গরমেও শান্তি। মাঝে মাঝে দু'-চারজন যে বেয়াড়া কেউটের মত ফোঁসফাঁস করে না তা না,এই যেমন এই ১০ নম্বর বাসের কন্ডাকটরটাই ময়দার বস্তার মত ঠেসেঠুসে কিছু নিরীহ বাঙাল তোলার পরেও আরেক যাত্রীকে একটু হাঁটু সরিয়ে বসতে বলায় তিনি খেঁক করে উঠে কন্ডাকটরের বংশঠিকুজী ধরে টানাটানি করলেন কিছুক্ষণ,কিন্তু অবশিষ্ট বাঙালরা সেসময় মৌনী ভিক্ষুর মত "জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক" ভেবে ভাবরাজ্যে অবস্থান নেয়ায় কেউটের ফণা নামতেও বেশি সময় লাগে না। হয়তো আমাদের জীববিজ্ঞানের শ্রেণীবিভাগটাই নতুন করে করতে হবে, ভার্টিব্রাটার আকারে প্লাটিহেলমিনথেস চলেফিরে বেড়ালে শেষমেশ কি দাঁড়ায় সেটা একটা গবেষণার বিষয়ও হতে পারে। আবারো প্রসঙ্গচ্যুতি,কথা হচ্ছিল কবর নিয়ে,বা কবরের বাসিন্দাদের নিয়ে,কাকরাইলের ট্রাফিক জ্যামে পড়েই কেন কবরের কথা মনে হল সেটা নিয়েও হতে পারে,সারাক্ষণই তো আমরা নিজেদের খোঁড়া কবরের মাঝে মহা আরামে শুয়ে আছি,বসে আছি,দাঁড়িয়ে আছি,কখনো উদ্বাহু নৃত্যও করছি। ২ দেবীর সুযোগ্য নেতৃত্বে কম্বলচোর,টিন চোর,ত্রাণচোর,কত রকম চোর-তস্কর ধীরে-সুস্থে আলোর নিশানা মুছে দিয়ে আমাদের অন্ধকারে ডুবিয়ে গেল,অন্ধ উঁইপোকার মত আঁধারকেই আলো ভেবে গভীরে,আরো গভীরেই ডুবে গেলাম।

তারপর শহরে জলপাই রঙের ট্যাংক এল,কত তস্করের ঘর পুড়লো,আলোর আশায় উঁইপোকারাও আকাশের দিকে উড়লো। গুড়ে বালি,উঁইপোকার পাখা গজাতে নেই। এখন পুরো দেশটাতেই কবরের ঘ্রাণ,দমবন্ধ অন্ধকার। রূপক নয় অবশ্যই,জ্যামে বসেই দেখছি অন্ধকারে ডুবে আছে পুরো শহর। এটা নাকি পিক আওয়ার,কাজকর্মের সময়,তাই লোডশেডিং।

বলি কাজকর্মের সময় যদি বিদ্যুৎ নাই থাকল তো বাকি সময় কি সেই বিদ্যুৎ কর্তাদের পশ্চাতে দেব? তা সেটাও মানলাম,তেনাদের পশ্চাদ্দেশ হয়তো বিদ্যুৎ অপরিবাহী,কিন্তু তাতেও আমাদের সমস্যার সমাধান হচ্ছে না,এমনকি অফপিকেও তো পাচ্ছি না,রাজধানী শহরে বসে আজকাল গাঁও-গেরামের স্বাদ পাচ্ছি,রাত ১২টায় অন্ধকার বারান্দায় বসে পূর্ণিমার চাঁদ দেখে আজকাল আর কাজলা দিদির কথা মনে পড়েনা,বাঁশবাগানের মাথার উপর ওঠা চাঁদের বদলে বাঁশটাই বেশি চোখে লাগে। পানি নেই বাসায়,এর মাঝেই মনে পড়লো। এক কবর থেকে আরেক কবরে। বাসায় ফেরার কথা ভাবলে এখন মনে আর আনন্দ জাগে না,বদ্ধ কংক্রিটের কুঠুরিতে ঢোকার আতংক পেয়ে বসে,যাকে বলে একেবারে ঢালাই করা বাঁধানো কবর। বাড়ছেই কবরের অন্ধকার,গভীরতার সাথে পাল্লা দিয়ে।

শোনা যায়,আরো বাড়বে। লোডশেডিং কমার আশা নেই,গ্যাস কোম্পানির বক্তব্য অনুযায়ী গ্যাস পাওয়া যাবে না পর্যাপ্ত,(যদিও দেশ নাকি গ্যাসের উপর ভাসছিল,সেই গ্যাস মহাশূন্যে মিলিয়ে গেল কিভাবে,সেটা এক রহস্য),কাজেই অচিরেই জ্বালানি সংকটে পড়তে যাচ্ছে দেশ,আর যাকগে যাক,কবরবাসীদের জ্বালানী লাগে না। ২০১৫ নাগাদ নাকি গ্যাস মজুদও শেষের দিকে চলে আসবে,তখন কোথায় যাবো সেটা ভাবার জায়গা অবশ্য কাকরাইল মোড় না,এই ভেবে আপাতত মনটা ঘোরাই,একটু সীসা ভর্তি হাওয়া টেনে নিই জানালা দিয়ে মুখ বের করে। এত ভেবে হবে কি? এই তো মানুষজন নিশ্চিন্তে চলেফিরে বেড়াচ্ছে, আমিও জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি। বেশ একটা শান্তি শান্তি ভাব,নেতারা সব জেলে,অনুদান দিয়ে বাহারি করছেন জেল আর নিজেদের হাজার কোটি টাকার সদ্গতি কিভাবে হবে তার পাঁয়তারা কষছেন,এই বের হলেন বলে,আর ক'টা দিন,মন্ঞ্চ তৈরি হয়ে আসছে।

উপদেষ্টারা এখন চেঙ্গিস খান,সেই চেঙ্গিস,যে দম্ভভরে বলেছিল,আমি পৃথিবীতে শান্তি চাই,কবরের শান্তি,নীরব স্তেপভূমিতে শনশন হাওয়ায় সব বিষ মিলিয়ে যাবে। আমরা কি সেই শান্তির দিকেই যাচ্ছি? দিন দিন কি আমরা জোম্বি হয়ে যাচ্ছি? চারপাশের অনুভূতিশূন্য চোখ আর ভাবলেশহীন মুখগুলো দেখে সেরকম ভয়টা মাঝে মাঝেই পেয়ে বসে,নিজের গায়ে চিমটি কেটে মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করি,কিন্তু আবারো নিজেকে আবিষ্কার করি ফাঁসবদ্ধ কবরে,দরজা নেই,জানালা নেই,চারপাশে শুধুই অন্ধকার,আর একদল জীবন্মৃত মানুষ,শুধুই নিজেকে নিয়ে ভাল থাকার মিথ্যে সান্ত্বনা নিয়ে মরে যাওয়া একপাল জিন্দালাশ, প্রতিবাদের ভাষা হারানো রক্তের আগুন নিভে যাওয়া অসংখ্য মোমের পুতুল। আরেকবার বিড়বিড় করি,আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর,হে কবরবাসীরা,তোমাদের উপর শান্তি বর্ষিত হোক,অপার শান্তি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।