আগের অংশ এখানে ( Click This Link)
সপ্তাহে ৮০ ঘন্টা
Primark, Asda এবং Tesco ইহারা সকলেই একখানা আচরণবিধিতে সহি দিয়াছিলেনঃ
কর্মীদেরকে কোনভাবেই সপ্তাহে ৪৮ ঘন্টার বেশি খাটানো যাইবেনা এবং অতি অবশ্যই সপ্তাহে একদিন পুরোপুরি ছুটি দিতে হইবে। অতিরিক্ত সময় (Overtime) কাজ করা বা না করা সম্পূর্ণরূপে কর্মীর ইচ্ছাধীন। সপ্তাহে ১২ ঘন্টার অধিক অতিরিক্ত সময় খাটানো যাইবেনা। খেয়াল রাখিতে হইবে যেন কোন ভাবেই এইটা (Overtimeটা) নিয়মিত না হয় এবং অতিরিক্ত সময়ের জন্য অবশ্যই তাহাকে উপযূক্ত হারে (Premium rate এ) পারিশ্রমিক দিতে হইবে।
বাস্তবচিত্রটা কি রকম ? অনুসন্ধানে আমরা ইহার বিপরীত বাস্তবতাই পাইয়াছি।
ছয়খানা কারখানার অধিকাংশ কর্মীদের সাথেই কথা বলিয়া আমরা জানিতে পারিয়াছি যে তাহাদিগকে প্রতিদিন ১২-১৬ ঘন্টা খাটানো হয় এবং সপ্তাহান্তে সেইটা দাঁড়ায় অনূন ৮০ ঘন্টা এবং সপ্তাহে ৬ দিন।
মিলি সেলাই করিয়া থাকে Asda এবং Primark এর জন্যে। তাহাকে প্রতিদিন ১৬ ঘন্টা কাজ করিতে হয়। আব্দুলকে, যে Asda এবং Tescoর জন্যে খাটে, প্রতি সপ্তাহে ৬০-৭০ ঘন্টা অতিরিক্ত সময় কাজ করিতে বাধ্য করা হয়। রহিমুল তাহার সহকর্মী, সে কাজ করে ৯০-১০০ ঘন্টা।
ইফাত এর ব্যাপারখানা আমাদিগকে হতভম্ব করিয়া দিয়াছে। ২০০৬ এর আগষ্টে তাহাকে ১৪০ ঘন্টা অতিরিক্ত খাটিতে হইয়াছে (মানে দাঁড়ায় প্রতিদিন ৮ ঘন্টা overtime ! )। কর্মীরা বলিয়াছে তাহারা খুব কম দিনই রাত ১১ টার পূর্বে ছুটি পাইয়াছেন। আমিবের মালিক এই Primark, Asda এবং Tesco এই তিনটাতেই মাল সরবরাহ করিয়া থাকে। সে আমাদিগকে বলিয়াছে যে কর্মীদেরকে প্রায়শই একটা লক্ষ্য বাঁধিয়া দেয়া হয় এবং কেউ সেটা শেষ না করিবা পর্যন্ত তাহাকে ছুটি দেওয়া হয় না।
ফারজানা, যে ইফাত এর সহিত কাজ করে, বলিয়াছে - "যদি নাইটশিফট থাকে তাইলে আমাগোরে ভোর ৩টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। শুক্রবার আমাগোর ছুটি থাকলেও প্রায় শুক্ররবারই আমাগোর ভিউটিতে আইতে হয়। "
শুক্রবার অফিসিয়াল ছুটি হইলেও আমরা দেখিয়াছি যে প্রতিটা সপ্তাহই শেষ হয় ৭ দিনে। রেনু বলিল যে গত দুইমাসে তাহাকে প্রতি শুক্রবারই কাজ করিতে হইয়াছে। আব্দুল ও তাহাই বলিল।
আবার যদি কেউ শুক্রবারে না আসে তবে তাহাকে গালাগালি তো করা হয়ই, সেইসাথে তাহার ১ দিনের বেতনও কাটিয়া লওয়া হয়।
Overtime duty কাগজে কলমে কর্মীর ইচ্ছাধীন বলা হইলেও বাস্তবে তাহা ঐ কারখানার management এর অধীন। management এর সিদ্ধান্তে তাহাকে মাসের পর মাস Overtime করিতে হইতেছে। Premium rate তো দূরের কথা, এইসব হতভাগারা অনেক সময় মূল বেতনটা ও ঠিকমত পায়না। মূল বেতনের দাবীতেই যেইখানে এইসব কর্মীদের আন্দোলন করিতে হইতেছে, রাস্তায় মিছিল এবং সেইসাথে উপরিপাওনা হিসেবে পুলিশের লাথি, ঘুঁসি এমনকি মাঝে মাঝেই বুলেট পর্যন্ত খাইতে হইতেছে সেইখানে Overtime এর টাকার কথা তুলিলে হয়তোবা রাস্তায় ট্যাঙ্কও নামিয়া পড়িতে পারে।
After all দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখিতে হইবে তো! এইসব মজুরের দলকে কোনভাবেই দেশের শান্তি বিনষ্ট করিতে দেওয়া যায় না। ঐ সব মজুরেরা ইহাদের প্রাপ্য দাবী জানাইলেই দেখি BGMEAর হর্তাকর্তারা AC রুমে গোলটেবিল বৈঠকে বসিয়া যান এবং কিয়ৎক্ষণ পরেই অপেক্ষমান মিডিয়াকে বলিয়া থাকেনঃ "আমরা গভীর ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন। আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পাইয়াছি এই দেশের গার্মেন্টস শিল্পকে ধ্বংস করিবার জন্যে অমুক তমুক কাজ করিতেছে........... ইত্যাদি ইত্যাদি হল্না তশকা। আমরা অনতিবিলম্বে এই প্রসঙ্গে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ কামনা করি। " আর যায় কোথা, সাথে সাথেই রাষ্ট্র তাহার সমস্ত কিছু লইয়া ঝাঁপাইয়া পড়ে এইসব নিরস্ত্র, নিরন্ন মানুষগুলার উপর।
রাষ্ট্র তো ইহাদেরই, ইহারাই ইহাদের পুঁজিকে রক্ষা করিবার নিমিত্তে রাষ্ট্রের জন্ম দিয়াছে এবং সেইসাথে রাষ্ট্রকে করিয়াছে সর্বতোভাবে সংগঠিত যাহাতে তাহারা এইসব মোকাবিলা করিতে পারে।
ঘন্টায় ৫ ট্যাহা
১৯৯৪ সাল থাইকা বাংলাদেশে একজন গার্মেন্টস কর্মীর সর্বনিম্ন মজুরী হইলো গিয়া ৯৪০ টাকা (প্রতিমাসে)। এই লইয়া তাহারা যখন ২০০৬ সালে আন্দোলনের ডাক দেয়, ডাক দেয় ধর্মঘটের, তখন The National Minimum Wage Board এর কর্তারা বৈঠকে বসেন। তাহারা প্রস্তাব করেন ইহাকে মাসপ্রতি ১৬০০ টাকায় উন্নীত করিবার। এইডা দিয়া যে চলা যায় না তাহা Primark, Asda এবং Tesco ওয়ালারাও স্বীকার করিয়াছেন।
তাহারাও মানেন যে এইখানে সর্বনিম্ন মজুরী (lowest wage নহে living wage) হওয়া উচিত অন্যূন ৩০০০ টাকা (মাসপ্রতি)। ঐ মানা পর্যন্তই। আমরা অনুসন্ধানে যাহা পাইয়াছি তাহা ৯৯৫ থেকে ১১০০ টাকার মধ্যে উঠানামা করে। গড় করিলে দাঁড়ায় ১০০০ টাকা ।
নাজেরা প্রতিমাসে পায় ১১০০ টাকা।
সে যে ফ্যাক্টরীতে কাজ করে তাহারা Asda এবং Tesco তে supply দেয়। তাহার সহকর্মী আব্দুল বেশ হতাশার সাথেই কহিল - "এইখানে কাম কইরা আমাগো কোন ভবিষ্যত নাই। " রুনা পায় ১০৫০ টাকার মত কিন্তু আরেকটু ভালো থাকিবার জন্যে সে Overtime করে। Overtime সহ সব মিলাইয়া সে পায় ১৪৫০ টাকা। মহুয়া আর হুমায়ুনের লগে আলাপ করিয়া আমরা জানিতে পারিলাম যে তাহারা মাসে প্রায় ২০০০ টাকার মতো পায় কারণ তাহার সেলাইকল চালাইতে বেশ দক্ষ।
কিন্তু এইজন্যে তাহাদেরকে সপ্তাহে ৮০ ঘন্টা খাটিতে হয়। সকল মিলাইয়া হিসাব করিলে দাঁড়ায় ঘন্টাপ্রতি তাহাদের মজুরী ৫ টাকা বা তার সামান্য কিছু বেশী। ইহাই যদি হয দক্ষ শ্রমিকের মজুরী তবে বাকীদের হিসেবের আর প্রয়োজন থাকে কি?
পুরো ২০০৬ সালটাই গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীগুলোতে একের পর এক আন্দোলন হইয়াছে। গার্মেন্টস নেতৃবৃন্দ বারংবার সরকার ও BGMEA কর্তাদেরকে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা, কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ ইত্যাদি লইয়া আলোচনায় বসিবার আহব্বান করিয়াছিলেন। তাহারা তখন অন্যত্র মগ্ন ছিলেন (হয়তোবা আসন্ন নির্বাচন লইয়া)।
এইদিকে ফেব্রুয়ারী ২০০৬ এ একখানা গার্মেন্টস ভবন পুরোপুরি ধসিয়া পড়ে। মারা পড়ে ১০০ জনেরও বেশি শ্রমিক, পঙ্গু হয় তারও বেশি। কিন্তু ইহাতেও কাহারো কিচ্ছু যায় আসে না। এই বঙ্গদেশে শ্রমিকের জীবনের দাম মশা-মাছির অধিক নহে।
আমরা য়াহাদের সাক্ষাৎকার লইয়াছি তাহারা সবাই বলিয়াছে যে তাহাদের জরুরী নির্গমন পথ (Emergency Exit) সর্বদা তালাবদ্ধ থাকে।
অতএব আগুন লাগিলে ঐখানে পুড়িয়া মরা ছাড়া তাহাদের আর গত্যন্তর থাকে না। কোট-টাই পরা ভদ্রলোকদের অফিসে আগুন লাগিলে উদ্ধারার্থে সেইখানে হেলিকপ্টার যাইতেও আমরা দেখিয়াছি কিন্তু ইহাদের বাঁচাইতে সেইরূপ কোন কর্মকান্ড অদ্যাবধি আমরা দেখিতে পাই নাই। যে দমকল বাহিনী যায় তাহাদের লক্ষ্য থাকে যন্ত্রপাতিকে উদ্ধার করা, মানবসদৃশ ঐ কীটপতঙ্গগুলিকে নয়। ইহারা মরিলেই কি ! একপাল মরিলে আগামীকালই আরো এক পাল কারখানার গেটে লাইন দিবে কাজের আশায়। যন্ত্রপাতি বাঁচানো গেলে তো ক্ষয়ক্ষতি একটু কম হয়, নাকি?
মে মাসের দিকে আন্দোলন তীব্র হইয়া উঠে।
Tesco মামাদের supply দেনেওয়ালা এক কারখানায় মজুরী হ্রাসের প্রতিবাদে শ্রমিকেরা রাস্তায় নামিয়া আসে। সাথে সাথেই আমাগো আজ্ঞাবাহী পুলিশ চাচারা লাঠিচার্জ ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ (ইদানীং ইহা বেশ পুলিশপিয় হইয়া উঠিয়াছে) শুরু করিয়া দেয়। ইহাতে একজন শ্রমিক শহীদ হয় এবং শতাধিক মারাত্মক আহত হয়। শ্রমিকরা তখন সুনির্দিষ্ট ১০ দফা দাবীনামা পেশ করে যাহতে মজুরী বৃদ্ধি, ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার এবং মাতৃত্বকালীন ছুটির অধিকার এর মত মৌলিক বিষয়গুলো ছিল যেগুলো Tesco মামুদের দেশে অনেক আগে থেকেই নাগরিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত হইয়া আসিতেছে। আসলে এইটা হঠাৎ কইরা শুরু হইয়া যায় নাই।
অনেক দিন ধরিয়াই গার্মেন্টস সেক্টরে শ্রমিক অসন্তোষ একটু একটু করিয়া বাড়িতেছিল। ২০০৫ সালের দিকে Primark কে সরবরাহকারী এক ফ্যাক্টরীতে তত্ত্ববিবায়ক মহাশয় (Superviser) তিনজন শ্রমিকের গায়ে হাত তুলিলে শ্রমিকরা management এর লগে সংঘর্ষে জড়াইয়া পড়ে। ২০০৪ সালেও এইরকম একটি ঘটনা ঘটে। ট্রেড ইউনিয়ন করা ২২জন শ্রমিকের একখানা দল তাহাদের প্রাপ্য Overtime চাহিলে management তাহদের উপর চড়াও হয় এবং মিথ্যা অভিযোগ করিয়া তাহাদের হাজতে পুরে। পুরবেই তো! ফ্যাক্টরী তাহাদিগকে বেশ কিছু সহজ প্রস্তাব দিয়াছিল - ১৯ ঘন্টার শিফট (দৈনিক, Overtime ছাড়া) এবং মাতৃত্বকালীন ছুটি ও সুযোগসুবিধা বাতিল।
ব্যাটাদের সাহস কত বড় ! দলবল লইয়া Overtime চাহিতে আসে !!!
এক্ষণে পাঠকের মনে এই প্রশ্ন উদয় হইলেও হইতে পারে যে গার্মেন্টস সেক্টরে হঠাৎ কী এমন ঘটিল যে এইসব শ্রমিকেরা জান-মালের কথা না ভাবিয়া বেপরোয়া আন্দোলন শুরু করিয়া দিয়াছে? সরকারের মূর্খনীতি (গার্মেন্টস সেক্টর লইয়া) এবং মালিকপক্ষের দৃষ্টিভঙ্গিজনিত সমস্যা এইটাই হয়ত উত্তরে আপনার মনে হইবে প্রথমত। ইহা সত্য, কিন্তু অধিকতর সত্য হইল -
i don't care how you go about it - just do it
...
চলবে...
মূল রচনাঃ
Fashion Victims/ The True Cost of Cheap Cloths at Primark, Asda, Tesco (Published December 2006)
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।