আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অথ সস্তা সমাচার



১৩ বৎসর বয়স হইতেই লিনা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরীতে কাজ করিতেছে। আট ভাইবোনের মধ্যে সেই বড়। এক ভাই অসুস্থ হইয়া পড়ায় তাহার পড়াশোনার পাট চুকিয়া যায়। টিকিট কাটিয়া ঢাকার একটি বাসে সে উঠিয়া পড়ে, চাকুরির সন্ধানে। ইহা ছাড়া তাহার অন্য কোন পথ খোলা ছিল কি? নয় বছর পর এখন সে বেশ বড়সড় একখান ফ্যাক্টরীতে কাজ করে যাহারা Primark, Asda এবং Tescoতে মাল সরবরাহ করে।

খুব অল্পদিনেই সে কাজ শিখিয়া যায় এবং তাহার বেতন দাঁড়ায় ২২৫০ টাকায়। এইজন্যে তাহাকে সপ্তাহে ৬০-৯০ ঘন্টা খাটিতে হয়। পাঠক, বলা নিস্প্রয়োজন কিংবা অবান্তর যে, উপরের এই বিবরণ অতি সরলীকৃত। ইহার ভিতর লুকাইয়া আছে একটি পরিবারের ইতিহাস এবং ইতিহাস, বিশেষ করিয়া নিম্নবর্গের ইতিহাস, অতটা সরলপথে আগায়না। কিন্তু আমরা সেই দিকে যাইতে চাহিতেছি না সেইটা আমাগো লক্ষ্যও না।

পাঠক চাহিলে নিজের পর্যবেক্ষন শক্তির সাহায্যেই গল্পের ভিতরকার খাঁজগুলো চিনিয়া লইতে পারিবেন। লিনার আয় সত্যিকার অর্থেই অনেক কম। এই আয় দিয়া ঢাকা শহরে কোন রকম টিকিয়া থাকাই খুবই কষ্টকর। তাহার স্বামী অসুস্থ এবং কোন ধরনের কাজই সে করিতে পরে না। তাহাকে নিয়মিত চিকিৎসা করাইতে হয়।

ইহা সত্ত্বেও সে তাহার গ্রামের বাড়ীতে টাকা পাঠাইবার চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। এতকিছুর পরেও সে বলিয়াছে সে সুখী। ইহাদের সুখও কত সস্তা! বিবরণখানার মাঝখানে একবার আমরা Primark, Asda এবং Tescoর নাম লইয়াছিলাম। যোগটা কোথায়? এইবার আমরা সেইদিকেই যাইব। Primark, Asda এবং Tesco ইহারা হইল খুচরা বিক্রেতা।

ইহারা আমাদের নিকট হইতে সপ্তায় কাপড় কিনিয়া ইউরোপ, আমেরিকাতে বিক্রি করিয়া থাকে। এই কোম্পানীগুলা নিজেগোর মধ্যে হামেশাই হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে লিপ্ত - কে কত সস্তায় মাল দিবার পারে। এইডা হইল বাজার দখলের পবিত্র লড়াই। এই লড়াই পবিত্র এবং পূজনীয় এই কারণে যে ইহাতে রক্তপাত হয় না এবং সেইহেতু আমরা পীড়িত বোধ করিনা। মানবতার পতাকখানি পতপত করিয়া উচ্চে উড়িতেছে।

আহা! ধীরে পাঠক ধীরে, অতটা আশ্বস্ত হইয়েন না। কাহিনী আছে। ঐ কোম্পানীগুলা কিভাবে সস্তায় কাপড় বিক্রি করে? একমাত্র তখনই এইডা সম্ভব যখন সে তাহার থেকে অনেক অনেক সস্তায় কাপড় কিনবার পারে। এবং এই অনেক অনেক সস্তাকে সম্ভব করিয়া তুলিতেছে লিনারা। এইডা করিত গিয়া রক্তপাত হয় পাঠক, তরে সেইটা বাহিরে নয়, ভিতরে।

আর আমি, আপনি আজকাল এতটাই ভোঁতা যে চর্মচক্ষুর বাইরে কোনকিছু দেখিবার পাইনা। অনেকেই বলিয়া থাকেন যে এইসব গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী না হইলে এইসব লিনারা না খাইয়া মরিত। তা আমাদের প্রশ্ন এখনই কি তাহারা বাঁচিয়া আছে? আপনারা টিকিয়া থাকিবার নাম দিয়াছেন বাঁচিয়া থাকা এবং এই ভয়াবহ শোষণকে এইভাবেই করিয়াছেন জায়েজ। লিনার মত এইরকম ছয়খানা ফ্যাক্টরীতে কর্মরত ষাট জনের সহিত আমরা কথা বলিয়াছি। এই ছয়খানা ফ্যাক্টরীই Asda এর জন্য কাপড় তৈরী করে, চারখান আবার Tescoর জন্যও কাজ করিয়া থাকে এবং Primark এর জন্যে করিয়া থাকে তিনখান।

আমরা ইহাদের মাধ্যমেই এই গার্মেন্টসের ফ্যাক্টরীগুলার ভিতরের পরিস্থিতি জানিবার চেষ্টা করিব। আইরিশ সংবাদপত্র The Post একবার Primark এর ক্রয়নীতি বিষয়ক একখান রিপোর্ট ছাপাইয়াছিলঃ একবার এক ফ্যাক্টরী মালিক Primark এর Managing Director Arthur Ryan এর নিকট একটা প্রস্তাব লইয়া আসে। প্রস্তাবটা ছিল একটা Product এর যাহার মূল্য পড়িবে 5 Pound এবং সেইটা 10 pound এ বিক্রি করা যাইবে। Ryan তৎক্ষণাৎ এই বলিয়া জবাব দিয়াছিলেন যে তিনি এই প্রস্তাব তখনই গ্রহণ করিবেন যখন Product cost হইবে 3 Pound এবং সেইটা 7 Pound এ বিক্রি করা যাইবে। এরপর তিনি বলিয়াছিলেন "আমি জানি না আপনারা এইটা কিভাবে করিবেন, কিন্তু এইটাই করিতে হইবে।

" i don't care how you go about it- just do it Asda হইল মার্কিনী Walmart এর খালতো ভাই। ইহারা বলিয়া থাকে যে ইহারা সস্তায় মাল এইজন্যে দিবার পারে কারণ তাহারা Huge volume এর Fabric কিনিয়া থাকে। কথা সত্য কিন্তু আংশিক। এই বয়ানে আমরা তাহাই বিবৃত করিব। Primark, Asda এবং Tesco প্রত্যেকেই প্রতি বছর বাংলাদেশ হইতে হাজার কোটি টাকার কাপড় ক্রয় করিয়া থাকে।

এই মহব্বতের কারণ কি? কারণটা সোজা এবং সস্তা। এই বাংলাদেশেই ১৯৯০ এর পর থাইকা গার্মেন্টস কর্মীদের বেতন অর্ধেকে নামিয়া আসিয়াছে এবং এই কারণেই তেনারা এইখানে ছুটিয়া আসিয়াছেন। মুনাফার জন্যে ইহারা পাতালে যাইতেও প্রস্তুত। যদি কোন এক সুন্দর প্রত্যুষে ইহারা এই মর্মে খবর পান যে পাতালে বাংলদেশের থাইকাও সস্তা শ্রমের হদিস মিলিয়াছে তবে তাহাদের এই মহব্বত পাতালগামী হইতে কিছুমাত্র বিলম্ব করিবে না। এইটা খালি এই বঙ্গদেশেই ঘটিতেছে না, দুনিয়ার তামাম দেশেই যেইখানে যেইখানে আমাদের ঐ আব্বাগোর সরবরাহকারী গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী আছে, সকলখানেই ঠিক একই নীতি কাজ করিতেছেঃ i don't care how you go about it- just do it ইহার মানে সোজা - জলবৎ তরলং।

শ্রমিকের মজুরী কমাও, সুযোগ সুবিধা কমাও, চিকিৎসভাতা কমাও (পারো যদি শূন্যে নামাও) এবং যত পার বেশি খাটাও, আরো বেশি খাটাও। Ryan চাচারা care করেন না কিন্তু এইসব জানেন। ঐ বাক্যমধ্যে অনেক না বলা জিনিস রহিয়াছে। কিন্তু উনারা তো এইসব সরাসরি বলিতে পারিতেন? না, পারিতেন না। কারণ ইহাতে তাহাদের ক্রেতারা অসন্তুষ্ট হইত এমনকি তাহারা হয়ত পুরোপুরি ঐ ompanyর মাল খরিদ করাই বন্ধ করিয়া দিত।

তাই Ryan চাচা ঐ কথাগুলো বলেন নাই কিন্তু যাহাকে বলিয়াছেন তিনি আবার সমস্তই বুঝিয়া লইয়াছেন। আকেলমান্দ কি লিয়ে ইশারাই কাফি হ্যায়। সপ্তাহে ৮০ ঘন্টা Primark, Asda এবং Tesco ইহারা সকলেই একখানা আচরণবিধিতে সহি দিয়াছিলেনঃ কর্মীদেরকে কোনভাবেই সপ্তাহে ৪৮ ঘন্টার বেশি খাটানো যাইবেনা এবং অতি অবশ্যই সপ্তাহে একদিন পুরোপুরি ছুটি দিতে হইবে। অতিরিক্ত সময় (Overtime) কাজ করা বা না করা সম্পূর্ণরূপে কর্মীর ইচ্ছাধীন। সপ্তাহে ১২ ঘন্টার অধিক অতিরিক্ত সময় খাটানো যাইবেনা।

খেয়াল রাখিতে হইবে যেন কোন ভাবেই এইটা (Overtimeটা) নিয়মিত না হয় এবং অতিরিক্ত সময়ের জন্য অবশ্যই তাহাকে উপযূক্ত হারে (Premium rate এ) পারিশ্রমিক দিতে হইবে। বাস্তবচিত্রটা কি রকম ?........ চলবে... মূল রচনাঃ Fashion Victims/ The True Cost of Cheap Cloths at Primark, Asda, Tesco (Published December 2006) Click This Link


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।