এক দেশে ছিল এক বুদ্ধিমান। তার মাথা ভাল কাজ করলেও ধনসম্পদ কিছুই ছিল না। তার কাজই ছিলো হেঁটে হেঁটে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানো। একবার সেই বুদ্ধিমান লোকটি হাঁটতে হাঁটতে এক মরুভূমিতে গিয়ে পৌছলো। চলার পথে হঠাৎ এক গেঁয়ো পথিকের সাথে দেখা।
পথিকটি একটি উটে চড়ে পথ চলছে। উটের পিঠে দুদিকে দুটি বস্তা ঝুলানো ছিলো। বুদ্ধিমান লোকটি পথিককে দেখেই একটি লম্বা সালাম দিলো এবং বললো :
বুদ্ধিমান : স্বাগতম! সুস্বাগতম!! তোমাকে দূর থেকে দেখেই খুব খুশী হয়েছি আমি। পায়ে হাঁটা আর ক্লান্তির কথা না হয় বাদই দিলাম ভাই, একা একা পথ চলতে গিয়ে একেবারে বিরক্ত হয়ে পড়েছিলাম। এখন যতক্ষণ এক সাথে পথে চলবো প্রাণখুলে দু'চারটে কথা বলতে পারবো, নাকি বলো ?
পথিক : আমিও ভাই একা চলতে চলতে বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত নিজে নিজেই গান গাওয়া শুরু করলাম।
তবে ভাই, পায়ে হাঁটা আর উটে চড়ার মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। আসলে পায়ে হাঁটাই ভাল। তাছাড়া তোমার যদি উট , ঘোড়া বা গাধা না থাকে তাহলে তা চোরে নেবার ভয় থাকবে না ; ঘাস, লতাপাতা খোঁজারও কোন চিন্তা থাকবে না। কবি ঠিকই বলেছেন-
চিন্তা নেই,ভাবনা নেই, যার নেই গাধা
ঘাস পাতা খড়ের তরে মন নেই বাধা।
বুদ্ধিমান: না ভাই, এটা কেমন কথা! যদি কারো গাধা না থাকে তাহলে তো তার বোঝা নিজের মাথাতেই চাপবে।
পথ যদি দূরের হয় তাহলে তো পায়েরই কষ্ট। তবে হ্যাঁ, আমার কিন্তু হেঁটে পথ চলতে তেমন খারাপ লাগে না।
এভাবে নানা বিষয়ে কথা বলতে বলতে তারা পথ চলতে লাগলো। হঠাৎ বুদ্ধিমান লোকটির মন- পথিকের উটের দু'পাশে বাধা বস্তা দুটিতে কি আছে তা জানার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলো। তাই সে কৌশলে জানতে চাইল :
বুদ্ধিমান : তা ভাই, উটের বোঝা দুটি অনেক ভারী বলে মনে হচ্ছে! বস্তা দুটিতে কি বোঝাই করেছো ?
পথিক : একটিতে রেখেছি গম আর অন্যটিতে বালি আর মাটির ঢেলা।
বুদ্ধিমান : কি বললে! বালি আর মাটির ঢেলা! কিন্তু কেন , তোমার বাড়ীতে কি বালি আর মাটির ঢেলা নেই?
পথিক : তা থাকবে না কেন? আসলে ওসব আমি কোন কাজের জন্য নিচ্ছি না। এক বস্তার বেশী গম ছিল না বলে তা উটের পিঠে কিছুতেই আটকানো যাচ্ছিলো না। তাই বুদ্ধিকরে আরেক বস্তা ভর্তি করলাম বালি আর মাটি দিয়ে; যাতে উটের পিঠে দু'পাশ থেকে বস্তা দুটি ঝুলে থাকে।
বুদ্ধিমান : হা: হা:হা:। আজব বুদ্ধি আবিস্কার করেছো দেখছি।
একেবারে বুদ্ধির ঢেঁকি! আরে ভাই, এর চেয়ে ভাল হতো না যদি গমগুলোকে দুটি বস্তায় সমান সমান করে ঢেলে নিতে। তাহলে বস্তা উঠানো-নামানো যেমন সহজ হতো, তেমনি উটের কষ্টও কম হতো।
উটওয়ালা পথিক লোকটির বুদ্ধি-সুদ্ধি আসলেই কম ছিলো। তাই পথচারী সঙ্গীর কথা শুনে সে বলে উঠলো:
পথিক : বাহ বাহ! সুন্দর বুদ্ধি তো তোমার!! শত চিন্তা-ফিকির করেও আমার বুদ্ধি এত দুর পৌছায়নি। বোঝা যাচ্ছে,তুমি সত্যিই একজন বুদ্ধিমান, জ্ঞানী ও মহাপুরুষ।
বুদ্ধিমান : না, না ওসব কিছু না। তবে ভাই এটাতো খুবই সহজ হিসাব।
পথিক : না ভাই, আমি তোমার কথা একদম মেনে নিতে পারছি না। এতোসব আক্কেল বুদ্ধি দিয়ে তুমি নিশ্চয়ই অনেক ধনসম্পদের মালিক হয়েছো। আর এখন সখের বশে হেঁটে হেঁটে সারা দুনিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছো।
বুদ্ধিমান : না ভাই তুমি ভুল বুঝছো। সত্যি বলতে কি, এই দুনিয়ায় আমার একটা কনাকড়িও নেই। এই যে এখন তোমার সাথে চলছি, অথচ আগামী কাল আমার ভাগ্যে কি আছে, কি কাজ করবো আর কিইবা খাবো তাও জানি না।
পথিক : এ্যাঁ, তুমি দেখছি একেবারে নিঃস্ব, ফতুর মানুষ। কিন্তু আমি একেবারে বুদ্ধিহীন হবার পরও আমার বাড়ীতে ১০টি উট, ১০০টি ভেড়া ও ৫০টি গরু আছো।
এছাড়া বাড়ী,জমি, চাকরবাকর সবই আছে। অথচ এতো বুদ্ধি মাথায় রেখেও তুমি নিঃস্ব ফকীর ? তাহলে এতোসব জ্ঞান-বুদ্ধি আর লেখাপড়ার ফায়দা কি ? জ্ঞান-বুদ্ধির অর্থ যদি এই হয় যে, ফালতু খেয়াল খুশীমতো যেদিকে মন যায় সেদিকেই পথ চলবো, তাহলে সত্তর বছর মুর্খ থাকাও উত্তম। না, ভাই তোমার মত ফলহীন বুদ্ধিমানের সাথে পথ চলা আমার পক্ষে আর সম্ভব না।
বুদ্ধিমান : ঠিক আছে আমি অন্য পথেই যাচ্ছি। তবে যাবার আগে বলে যাচ্ছি, তুই যেসব ধন-সম্পদ কিনেছিস, তার সবই টাকা দিয়ে কিনেছিস।
এতে অহংকার করার কিছু নেই। তবে তুই যে একটা গর্ধভ তা বুঝতে আমার আর বাকী নেই।
একথা বলে পথচারী ভিন্ন পথ ধরে হাঁটা দিল। আর ঘোড়া সওয়ারী সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। কিছুদূর যাবার পর সে এক ডাকাতদলের খপ্পরে পড়লো।
ডাকাতদের একজন পথিকের কাছে জানতে চাইলো যে, সে বস্তায় করে কি নিয়ে যাচ্ছে । পথিক ডাকাতদের কথার জবাব দিতে যখন ইতস্তত করছিল, তখন এক ডাকাত চাকু বের করে বস্তা দুটির একটি একঘায়ে কেটে ফেললো। ঘটনাক্রমে বস্তাটি ছিল বালি আর মাটির ঢেলার। এসব দেখে ডাকাত দল উটওয়ালাকে কয়েকটি লাথি লাগিয়ে সেখান থেকে চলে গেল। যাওয়ার সময় বলে গেল : তুই আসলেই একটা গাধা।
নইলে মরুভুমিতে বাস করেও কেউ কি বালি আর ঢেলা উটির ওপর বহন করে নিয়ে যায় ? ডাকাতরা চলে যেতেই পথিক তার গমের বস্তা হাতছাড়া না হওয়াতে হাসিতে ফেটে পড়লো। আনন্দ উল্লাসে বলতে লাগলো:
পথিক : এরকম বোকামী হাজার বার করাও ভাল। বোকার মতো বালি আর ঢেলা বোঝাই না করলে আমার কষ্টের উপার্জন গিয়ে পড়তো ডাকাতদের হাতে ।
ঐ দিন থেকে বোকা লোকটি একশো উট বোঝাই করলেও একপাশে গম ও অন্যপাশে বালি বোঝাই করতো। কারো বুদ্ধি পরামর্শে কান দিতো না ।
মানুষ তার বুদ্ধির বহর দেখে হাসি-তামাশা করলে জবাবে সে বলতো, আমি এমন কিছু জানি, যা তোমরা জানো না।
গল্পটি থেকে আমরা দুটি বিষয় শিক্ষা নিতে পারি। প্রথমত : কেবল বুদ্ধিমান হলেই চলে না, সে বুদ্ধিকে কাজে লাগানোর জন্য পরিশ্রম করতে হয়। নইলে অন্যের উপর নির্ভরশীল হতে হয়। অন্যদিকে বোকামী করার পরও ভাগ্য গুনে দু'একবার বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া গেলেও বোকামীকে কেউই পছন্দ করে না।
তাই আমাদের সবাইকে বুদ্ধিমান ও পরিশ্রমী হতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।