আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জোয়াও পেড্রো স্টিডাইল এর সাক্ষাতকারঃ বিষয়- অ্যাগ্রো ফুয়েল



(বর্তমানে সারা বিশ্বেই পরিবেশ এবং খাদ্য সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে তথাকথিত জৈব জ্বালানির ক্রমবর্ধমান চাষাবাদ নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। কৃষি জ্বালানির ঋণাত্মক দিক বিবেচনা করে এর বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিন ধরেই সোচ্চার ল্যাটিন আমেরিকা বাসী- তারাই প্রথম সঠিকভাবে এর নাম করেন কৃষি জ্বালানি (অ্যাগ্রো ফুয়েল)। জোয়াও পেড্রো স্টিডাইল ব্রাজিলের ভূমিহীন দের আন্দোলন এমএসটির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা। জুলাই, ২০০৭ এ সিডলিংস পত্রিকার কাছে তিনি বলেছেন কৃষি জ্বালানী বিষয়ক তার অভিজ্ঞতার কথা। ) 'জৈব জ্বালানীর' বদলে 'কৃষি জ্বালানী' শব্দটি ব্যবহারের ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত হয় সেখানে আপনিও যুক্ত ছিলেন, তাই না? সম্প্রতি আফ্রিকার মালিতে খাদ্য স্বাধীনতা বিষয়ক যে বিশ্বসভা অনুষ্ঠিত হয় সেখানে আমরা, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রতিনিধিরা মিলে আলোচনা করছিলাম যে, পুঁজিবাদ কিভাবে শস্য থেকে তৈরি হওয়া জ্বালানী তেলের নামের আগে "জৈব" শব্দটি জুড়ে দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে।

ব্যাপারটা একেবারেই হাস্যকর, কেননা প্রত্যেক জীবিত বস্তুই "জৈব"। আমরা নিজেদেরকে বলতে পারি জৈব-জনগণ, জৈব-অমুক, জৈব-সয়া ইত্যাদি। কোম্পানী গুলো তাদের তৈরি পণ্যের নামের আগে জৈব শব্দটি জুড়ে দেয় যেন লোকে মনে করে যে ঐ পণ্যটি ভালো এবং রাজনৈতিকভাবে সঠিক জিনিস। সুতরাং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ভায়া ক্যাম্পেসিনা ঠিক করলো যে এখন থেকে সঠিক পরিভাষাটিই ব্যবহার করা হবে। যেহেতু এই জ্বালানী এবং শক্তি তৈরি হচ্ছে কৃষি শস্য থেকে সুতরাং এর সঠিক পরিভাষা হওয়া উচিৎ "কৃষি-জ্বালানী" এবং "কৃষি-শক্তি"।

ব্রাজিলে কৃষি-জ্বালানী বিষয়ক উন্মাদনার ফলাফল কেমন? এ বিষয়ে আমরা বেশ উদ্বিগ্ন। আমরা দেখছি কৃষি-জ্বালানীকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি সেক্টরের বহুজাতিক পুঁজির মধ্যে একটা আঁতাত গড়ে উঠেছে; তেল সেক্টরে যারা ব্যবসা করছে তারা চাইছে খনিজ তেলের উপর থেকে তাদের নির্ভরশীলতা হ্রাস করতে; গাড়ির কোম্পানীগুলো চাইছে প্রচলিত পরিবহন কাঠামো অক্ষুন্ন রেখে তাদের মুনাফা নিশ্চিত রাখতে; কৃষি-ব্যবসায় নিয়োজিত বানজ, কারগিল কিংবা মনসান্টোর মতো বহুজাতিক কোম্পানীগুলো চাইছে একে ব্যবহার করে বিশ্ব কৃষি বাজারে তাদের একচেটিয়া আধিপত্য বজায় রাখতে। আর এখন আন্তর্জাতিক পুঁজি দক্ষিণের দেশগুলো বিশেষত ব্রাজিলের বৃহৎ ভুস্বামীদের সাথে একটা আঁতাত গড়ে তুলতে চাইছে যেন তাদের দখলে থাকা বিশাল কৃষি ক্ষেত্রগুলোকে জ্বালানী তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। তাদের এই কৃষি-জ্বালানী উৎপাদন করতে চাওয়ার পেছনে রয়েছে স্রেফ মুনাফার লোভ, তারা আমাদের মতো পরিবেশ, বৈশ্বিক উষ্ণতা ইত্যাদি বিষয়ে মোটেও চিন্তিত নয়। পুঁজির একটিই উদ্দেশ্য- তা হলো মুনাফা, আর সেই উদ্দেশ্যে সে একমনে চেস্টা করে যাচ্ছে কৃষিকে ব্যবহার করে যানবাহনের উপযোগী জ্বালানী তৈরি করতে।

কৃষি এবং খাদ্য উৎপাদনের উপর এর প্রভাব কি? পুঁজিবাদী কৃষি উৎপাদন অর্থনীতির নিয়ম মেনেই চলে যার মূল ভিত্তি হলো মুনাফার হার। ইথানল বা অন্য কোন কৃষি-জ্বালানী উৎপাদন করলে যদি [খাদ্যশস্য, তুলা, গম ইত্যাদি যেগুলো উৎপাদনে মুনাফা অপেক্ষাকৃত কম (যেহেতু এগুলোর বেশীর ভাগ ভোক্তাই নিম্ন আয়ের)] মুনাফা অপেক্ষাকৃত বেশী হয় তবে স্বাভাবিক ভাবেই কৃষক কৃষি-জ্বালানীর দিকে ঝুকে পড়বে। এটাই পুঁজিবাদের নিয়ম। এর জন্য কোন বিশেষ পরিকল্পনা করার প্রয়োজন নেই। আর ব্রাজিলে ঠিক এমনটিই ঘটছে।

ইক্ষু চাষের ক্ষেত্র বাড়ছে, যেহেতু মুনাফা বেশী আর খাদ্য শস্যের ক্ষেত্র কমছে, যেহেতু মুনাফা কম। আরেকটা ব্যাপার ঘটছে- কৃষি-জ্বালানী একক চাষাবাদ (মনোকালচার) বাড়িয়ে দিচ্ছে। একের পর এক বিশাল এবং উর্বর কৃষি জমি জ্বালানী উৎপাদনের কাঁচামাল ইক্ষু ও সয়াবিন চাষের আওতায় চলে যাচ্ছে। পরিবেশের উপর এই একক চাষাবাদের প্রতিক্রিয়া ভয়ংকর কেননা এটি অন্য চারাগাছের ক্ষতি করে এবং জৈব বৈচিত্র ধ্বংস করে। ব্রাজিলের এই মনোকালচারের উপর করা এক গবেষণায় বের হয়ে এসেছে যে এই মনোকালচার বৃষ্টিপাতের ধরণকেই পাল্টে দিচ্ছে; বৃষ্টিপাত ক্রমশ বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে, এবং ঐ নির্দিষ্ট সময়ে এর তীব্রতাও প্রবল হচ্ছে।

অন্যান্য আরো গবেষণায় দেখা যাচ্ছে একক চাষের এলাকার গড় তাপমাত্রা ও খরার সংখ্যা বাড়ছে। আর আখ চাষের বাড়তি আরেকটি সমস্যা হলো ন্যাড়া পুড়িয়ে জমি আবার চাষের উপযুক্ত করতে হয় যার ফলাফল বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি। আখ চাষে শ্রমিকের কাজের পরিবেশও খারাপ; পরিকল্পিতভাবে দূর-দূরান্তের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শ্রমিকদের এমনভাবে কাজে লাগানো হয় যেন সহজে নিজেরা একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ করতে না পারে। জমির মালিকানার ক্ষেত্রে কি কোন পরিবর্তন হচ্ছে? কৃষি-জ্বালানীর কারণে কৃষি জমির মালিকানা ব্যাপকহারে কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। বড় বড় কোম্পানীগুলো দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পুঁজির সাথে একাট্টা হয়ে বিশাল বিশাল কৃষি-জোত কিনে নিচ্ছে।

যেমন কয়েকমাস আগে কারগিল সাওপাওলোর সবচেয়ে বড় এলকোহল উৎপাদনকারী ডিস্টিলারীটিকে তার মালিকানায় থাকা ৩৬০০০ হেক্টর জমি সমেত কিনে নয়েছে। অন্যান্য বহুজাতিক কোম্পানীও একই কাজ করছে। গত বছর শুধু সাওপাওলো রাজ্যেই ৪ মিলিয়ন হেক্টর জমি আখ চাষের আওতায় এসেছে। পরিকল্পনা চলছে তিন বছরের মধ্যেই একে বাড়িয়ে ৭ মিলিয়নে নিয়ে যাওয়ার। পাশ্ববর্তী রাজ্য গোইয়াস, দক্ষিণ পূর্ব মিনা জেরিস এবং মাতো গ্রোসো দ্যো স্যুলে গত পাঁচ বছরে ৭৭টি নতুন ডিস্টিলারী হয়েছে।

পেট্রোবাস ইতিমধ্যেই মাতো গ্রোসোর রাজধানী কুইয়াবা থেকে দক্ষিণ-পূর্ব উপকূলের পারানা রাজ্য পর্যন্ত একটি এবং গোইয়ার রাজধানী গোইয়ানিয়া থেকে সাওপাওলোর বন্দর সান্টোস পর্যন্ত একটি মোট দুটি এলকোহল পাইপলাইন বসানোর কাজ শুরু করে দিয়েছে। বড় বড় আখের খামার পুরো এলাকা দখল করে নিচ্ছে। এটা কৃষি জমির এক বিশেষ ধরণের কেন্দ্রীভবন যার ফলে কারগিলের মতো কোম্পানীগুলোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পুঁজির প্রাধান্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। আখ থেকে এলকোহল উৎপাদনে ব্রাজিলের ৩০ বছরের অভিজ্ঞতাকে এক করলে আপনার কি মনে হয়? জ্বালানী হিসাবে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে আখ থেকে এলকোহল উৎপাদনের ফলে বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি কিংবা আমদানী করা তেলের উপর নির্ভরশীলতা কিছুটা কমলেও পরিবেশের উপর এর প্রতিক্রিয়া মারাত্মক। অনেক বিজ্ঞানী ছোট আকারে স্থানীয় পর্যায়ে জ্বালানী সমস্যা সমাধানের জন্য এর চাষাবাদের পক্ষে মতামত দিলেও ব্রাজিলে এটা হয়েছে বেশ বড় আকারে।

অনেক গ্রাম্য জনপদ, আখের খামারে পরিণত হয়ে খাদ্যের জন্য পুরোপুরি আমদানীর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আর, দূষণ, সেটা সামান্যও কমেনি। কেননা, প্রথমত খোদ আখ উৎপাদনেই ডিজেল প্রয়োজন আর চাষাবাদে যে সার ব্যবহার হয় তার জন্যও প্রয়োজন পেট্রোলিয়ামজাত কাঁচামালের। যে কারণএ এসব অঞ্চলে ডিজেলের চাহিদা বেড়ে গেছে ২৫%। যানবাহন গুলো মিশ্র জ্বালানী (এলকোহল + পেট্রোলিয়াম) ব্যবহার করলেও দূষণের পরিমাণ কমছে না, যেহেতু বড় বড় শহরগুলোতে যানবাহনের সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছেই।

সুতরাং এলকোহলকে জ্বালানী হিসাবে ব্যবহারের ফল স্বরূপ দূষণ কমছেই না, বরং বাড়ছে। অন্যদিকে ভূমি মালিকানার কেন্দ্রীভবন, গ্রামাঞ্চলে শ্রমিকের কর্মসংস্থান হ্রাস ইত্যাদির মাধ্যমে সামাজিক সমস্যা বাড়িয়ে তুলছে। ব্রাজিলের আখ চাষের এলাকাগুলোতেই সবচেয়ে বেশী দেখা যায় একদিকে প্রচণ্ড ধনী কিছু মানুষ আর অন্যদিকে হাজার হাজার হত দরিদ্রের সহাবস্থান। এ বিষয়ে আমি সবসময়ই সাওপাওলোর কেন্দ্রে অবস্থিত রিবিয়েরা প্রেতোর উদাহরণটি দেই- এখানকার বুর্জোয়ারা যাকে এর আখচাষের উন্নত প্রযুক্তিগত দক্ষতার কারণে ব্রাজিলের ক্যালিফোর্ণিয়া বলে থাকে। ৩০ বছর আগে এটি ছিল খাদ্য ও কৃষি অর্থনীতিতে স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি অঞ্চল যেখানে আয় বৈষম্য এত তীব্র ছিল না।

এখন একটি বিশাল আখ চাষের এলাকায় পরিণত হয়েছে যার প্রায় সবটুকুর মালিক ৩০ ডিস্টিলারী। ঘিঞ্জি একটি শহরে ১০০,০০০ লোকের বসবাস। জেলে বন্দী আছে ৩৮১৩ জন মানুষ, যা কৃষি জমিতে কাজ করা মানুষের সংখ্যার (২৪১২ জন) চেয়েও বেশী। এই হচ্ছে কৃষি-জ্বালানী উৎপাদনকারী পুঁজিবাদী সমাজের চেহারা; জমিতে কাজ করা মানুষের চেয়ে জেলে বন্দী মানুষের সংখ্যা বেশী! জীবাশ্ম জ্বালানীর সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে জ্বালানী সমস্যা সমাধানের জন্য কি করা উচিত বলে আপনি মনে করেন? জনগণের মাঝে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আমার কাছে প্রথমত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় আমাদের পরিবহন পদ্ধতিটিকে পরিবর্তনের বিষয়টিকে।

ব্যক্তিগত যানবাহন যা একজন ব্যক্তিকে পরিবহন করতে গিয়ে প্রচুর জ্বালনী পোড়ায় তার উপর নির্ভরশীলতা কমাতে হবে, বদলে চালু করতে হবে গ্যাস বা বিদ্যুতের মতো জ্বালানীতে চলে এমন কম দূষণকারী গণ পরিবহন ব্যবস্থা। দ্বিতীয়ত প্রয়োজন হলো জ্বালানীর বিকল্প উৎস যেমন জলবিদ্যুৎ, বায়োগ্যাস, উইণ্ডমিল আর সৌর শক্তির একক বা সমন্বিত ব্যবহার। তৃতীয়ত শক্তি স্বাধীনতার ধারণাটিকে উৎসাহিত করা দরকার। প্রত্যেকটি এলাকা তার নিজ নিজ সুবিধাজনক উৎস থেকে জ্বালানী উৎপাদন করবে যেন তাকে আমাদানীকৃত জ্বালানীর উপর নির্ভর করতে না হয়। আমরা আশাবাদী যে বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং আবহাওয়া পরিবর্তনের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে ক্রমশ সচেতন হয়ে উঠতে থাকা জনগণ তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারগুলোকে বাধ্য করবে জ্বালানী নীতিতে কার্যকর পরিবর্তন আনতে কেননা মুনাফালোভী কর্পোরেট কোম্পানী এবং তাদের মালিক পুঁজিপতি শ্রেণীর কাছ থেকে জনগণ এসব পরিবর্তন আশা করতে পারে না।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।