আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আলী বিহারীর কম্বল



কম্বলটা গায়ে দিয়ে আমি শুই। অথচ প্রতিবারেই মনে হয় কম্বলটাই আমাকে চাপা দিয়ে পড়ে আছে। এই ভারী অনমনীয় দুর্বিনীত বস্তুপিণ্ডটি বুকের ওপর থাকলে প্রতিরাতেই আমার মাঝপথে ঘুম ভেঙে যায়। আমি হাঁসফাঁস করতে থাকি। এটাকে কম্বল বলে ভাবাই মুস্কিল।

এই এতগুলো বছরেও, আমার নানাবিধ আত্মপ্রবোধ রচনা সত্ত্বেও, এটাকে কিছুমাত্র কম্বল হিসেবে নিতে আমি পারিনি। কম্বলটা কেনা হয়েছিল ৫০ টাকায়। আলী বিহারী ওর স্ত্রীকে নিয়ে বিকেলে আমাদের বাসায় এসেছিল। বাইরে রকে তখন মাদুর পাতা। বাবা ওদেরকে সেই মাদুরে বসতে দিয়ে মাকে বাইরে আসতে বলেছে।

সম্ভবতঃ কম্বলটা সরেজমিনে দেখাতে। আবার এও হতে পারে, দাম-টাম নিয়ে দুরূহ লেনদেনটাতে মা অংশ নিক বাবা তাও চাইছিল। আমরা মাদুরে বসে আলী বিহারীর দিকে তাকিয়ে আছি। সত্যি কথা বলতে ওর চোখের দিকে। ওর স্ত্রী আমাদের Ñ আমি আর আমার বোন Ñ দু’জনকে দেখে কিছু বলবে ভাবছিল বোধহয়।

তেমন কিছু বলা হয়নি। কেবল বাবাকে জিজ্ঞেস করল ‘এ দুইটো?’ বাবা জোরাল গলায় বলল ‘এইতো তোমাদের দোয়ায়। ’ আলীর স্ত্রী দোয়া করবার একটা বাংলা বাক্য শুরু করেও আগাতে পারল না। মা বাইরে চলে এল। ভাঁজ-করা কম্বলটা আলীর স্ত্রী সুফিয়ার বাম পাশে রাখা।

আলীকে সুফিয়া তার ডান পাশে দেয়াল হেলান দিয়ে বসিয়েছে। আমি মাদুরে আধ-পাছা ঠেকিয়ে রকের বাইরে পা ঝুলিয়ে বসেছি। ঘরে ঢুকবার যে দরজা সেই দরজার জায়গাটুকু ছেড়ে দিয়ে সুফিয়ার মুখোমুখি বাবা দাঁড়িয়ে। তার পাশে রাখা চেয়ারটাতে বসে আছে বোন, পা দোলাচ্ছে। চেয়ারের পাশে দরজার চৌকাঠের সঙ্গে ঠেস দিয়ে আলীর লাঠিখানা রাখা।

দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসে মাদুরের বাইরে পায়ের পাতার উপর বসে মা কম্বলটা ধরে দেখল। আমাদের সকলের চোখ তখন কম্বলটার দিকে। কেবল সুফিয়া আর আলী ছাড়া। সুফিয়া তাকিয়ে একদম মায়ের মুখের দিকে। ওর ছোট ছোট চোখদুটো গভীর মনোযোগে আরো ছোট হয়ে গেছে।

আর আলী কোথাও তাকিয়ে নেই। মা কী বলে তা শোনার জন্য ওকে উদগ্রীব মনে হলো। ওর পিঠ এবং ঘাড় তখন সোজা। মা দুই প্রস্থ ভাঁজ খুলে দেখল। হাতের উল্টো পিঠ কম্বলের গায়ে ঘষল।

তারপর সুফিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল ‘৫০ টাকাই দিতে হবে? কম কিছু দিলে হয় না?’ মানে দামের এক রকমের রফা বাবার সঙ্গে আগেই আলীর হয়েছিল। মা’র কথায় সুফিয়া তেমন কোনো উত্তর খুঁজে পেল না। তার আগেই মা উঠে দাঁড়াল। বাবাকে বলল ‘খুলে একটু দেখে নাও। ’ আলী হেলান দিয়ে বসল আবার।

মা ঘরে গেল। আমি জানি মা সুজি বানাচ্ছে ওদের জন্য। এইমাত্র যে কম্বলটা কেনা হলো, যদিও এই কেনায় আমার কোনোরকম কথাবার্তা পছন্দ-অপছন্দের বালাই নেই, সেটা কিন্তু আমার জন্যই কেনা হলো। পুরোটা সময় মাদুরে আধ-পাছা বসে থেকে চোখের কোণা দিয়ে আমি কম্বলটাকে দেখতে থাকলাম। মা উঠে দাঁড়াবার পর, যখন এটা না-কেনার আর কোনো সম্ভাবনাই থাকল না, তখন একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমি আমার বোনের দিকে তাকালাম।

সমস্ত ঘটনায় সেই একমাত্র নির্লিপ্ত দর্শক। এমনকি এই যে আমার হতাশা সেটাও যে ও খুব একটা ল্য করল তা আমার মনে হলো না। সুজির জন্য অপো ছাড়া আমি আর ভাল কিছু তখন মনে করতে পারলাম না। এই আধা ঘণ্টা আগেও আমি মনে মনে ভেবেছি আলী বিহারী না এলেই হয়। আবার ভেবেছি হতেও তো পারে দারুণ একটা কম্বল।

বুকের সাথে একহাতে ঠেসে এই কম্বলটা সমেত সুফিয়াকে ঢুকতে দেখেছি আমিই। তখন থেকে আমার আর মাদুরে আরাম করে বসাই হলো না। এ কথা বলার আর অপো রাখে না যে কম্বলটা আমার একেবারেই পছন্দ হয়নি। একজন ধুনকার যেবার আমাদের বাসায় এসেছিল সেবার আমার জন্য লেপ বানানো হয়নি। সে ক’ বছর আগের কথা।

বোনটাও তখন বেশ ছোট, ওর জন্য আলাদা করে কিছু করার প্রশ্নই আসে না। আর আমার তখন একটা লেপ ধরনের জিনিস ছিলই। মা-বাবার লেপটা তখন চিমসে গেছে। ধুনকার এল। এসে উঠোনে পেতে দেয়া বড় একটা হোগলায় বসে গম্ভীর মুখে সেই চিমসে লেপের সেলাই খুলতে লাগল।

পাশে স্পঞ্জের স্যান্ডেলটা খুলে রেখেছে। স্যান্ডেলটার সাদা বুক জোড়া গোড়ালিতে আর বুড়ো আঙুলের ধারে য়ে গিয়ে উৎকট একটা নীল রঙ বেরিয়ে এসেছে। গোড়ালি দুটোই বেশি য়ে গেছে। তার মধ্যে ডান পায়েরটার খানিক অংশ পাতলা হয়ে ভেঙে গেছে। ওখান থেকে ওর পা বেরিয়ে মাটিতে ঠেকবার কথা।

আর বাম পায়ের ফিতেটা সামনের মধ্যখানে বোধহয় ছিঁড়ে গেছিল। সেখানে একটা তার দিয়ে বাঁধা। একটা স্পঞ্জের স্যান্ডেল পরে আমিও তার ধারে কাছে বসে দেখছি। আমার গায়ে হাতা-কাটা একটা স্যান্ডো গেঞ্জি। আমি একবার ওর লেপের সেলাই খুলতে দেখি, একবার ওর স্যান্ডেল দেখি।

ধুনকার সেলাই খোলার ফাঁকে ফাঁকে আমাকে দেখছে। লেপের সেলাই খোলা হয়ে গেলে ও বালিশের খোলগুলো খুলতে শুরু করে। বালিশ ছিল চারটা। বাবা কিংবা মা কেউই দুটো করে বালিশ ছাড়া ঘুমাত না। মা কোথায় ছিল খেয়াল করিনি।

বালিশ খুলতে লাগার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমাকে ডেকে নিয়ে গেল Ñ ‘ভেতরে চল। তুলায় এখনি হাঁচতে শুরু করবি। ’ খুব একটা ইচ্ছে আমার হচ্ছিল না, কিন্তু অগত্যা মার সঙ্গে ঘরের মধ্যে যাই। আর একটু পর পর নানান উসিলায় বাইরে এসে ধুনকারের কাজ দেখি। প্রায় বিকেল পর্যন্ত ছিল সে।

তুলা ধুনল। তারপর আবার বালিশে ভরে সেগুলো সেলাই করল। এর মধ্যে দেখি লাল রঙের নতুন কাপড়ের খোল বের করে মা তাকে দিল। সেই নতুন লাল রঙের কাপড়ের মধ্যে ধুনে-রাখা তুলা ভরে একদম নতুন-দেখতে একটা লেপ ও বানাল। লেপের সেলাইয়ে অনেক সময় লাগল তার।

সে অনেক দিন আগের কথা। আমি চাই বা না চাই, বোনটা ঘুমাত ওই লেপের মধ্যেই, মা-বাবার সঙ্গে। আর আমার লেপটা আমারই ছিল। ছোট খাট একটা জিনিস। কিন্তু লেপই।

সাদা মার্কিন কাপড়ের ঢাকনা লাগানো, ছাপানো কাপড়ের খোল। তার ভেতরে পর্যাপ্ত তুলার একটা পরিষ্কার লেপ। আমি যখন আরো ছোট তখন শখ করে আমার কথা ভেবেই ওটা বানানো হয়েছিল। শীতের সময় লেপের মধ্যে ঢুকেই আমার মাথা মুড়ে ঘুমানোর অভ্যাস। এটা প্রায় নিত্য-নৈমিত্তিক ছিল যে আমি ওভাবে ঘুমাব আর বাবা খানিক পর এসে লেপ নামিয়ে আমার মুখ-নাক বের করে দেবে।

বাবা এটা করত আমার দম বন্ধ হয়ে যেতে পারে সেই ভয়ে। পরের বছরগুলোতে কখন যেন ওই লেপ থেকে পা বের হয়ে যেতে শুরু করেছিল। লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমাতে গেলেই আমার পা বের হয়ে যায়। ফলে মুড়ি দিয়ে ঘুমানো আমার বন্ধই হয়ে গেছিল প্রায়। সেই হিসেবে বাবা কিংবা মায়ের পে স্বাভাবিক ছিল খুশি হয়ে নতুন কোনো ব্যবস্থার কথা চিন্তা না করা।

কিন্তু ঘটেছে উল্টো। আমার একটা লেপ লাগবে Ñ এই চিন্তায় তারা পুরো একটা শীতের মৌসুম কাটাল। তাদের চিন্তা দেখে, পরিবারের একজন বিচণ সদস্য হিসেবে আমিই বরং নানা সময়ে আশ্বস্ত করেছি। আমার সেই আশ্বস্তিতে ওরা স্বস্তি পায়নি। আবার একজন ধুনকারকে বাসায় ডাকাও হয়ে ওঠেনি।

বিষয়টা কেবল ধুনকার ডাকার ছিল না। ওই লেপে যদি নিশ্চিন্তে আমার পা ঢোকাতে হয় তাহলে কিছু তুলাও ওতে জুড়তে হবে। সেটা আমি বুঝতাম। মা কিংবা বাবাও বুঝত। আর খোল-নলচে, মানে খোল আর ঢাকনাও বদলাতে হবেই।

দু’ চারদিন, আমার মনে পড়ে, বাবা এসে মাকে খবর দিত ‘কাপাশ তুলার শুনলাম ৮০ টাকা সের। ’ শিমুল তুলার প্রতি কোনোরকম ভক্তি শ্রদ্ধা বাবার কোনোকালেই ছিল না। কেবল একবার বাবার হাত ধরে বাজারে যাবার সময় পাড়ার শেষ মাথায় মোড়ের ধারে যে পরিত্যক্ত মাঠখানা, তার মধ্যে খেয়ালীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা চৈত্রমাসের শিমুল গাছটার পাগল-করা লাল ফুল দেখিয়ে বাবা বলেছিল Ñ “দেখেছিস বাবা কী সুন্দর ফুল। ” “বাবা ওটা নাকি শিমুল গাছ। তো শিমুল গাছে তুলা হয় না?” “হয় তো।

এই ফুলের পর ফল হবে। সেই ফল পাকলে তুলা হবে। তখন পাকা ফল ফেটে তুলা উড়বে। ” “ফল ফেটে তুলা হবে?” আমি তাজ্জব হয়ে জিজ্ঞেস করি। “তুই মনে করেছিস তুলাই ফুল।

” বাবা আমার মনের কথা ধরে ফেলে। “তাইলে তুলা ধরে কীভাবে? বিক্রি করে কীভাবে?” বাবার পান-খাওয়া মুখে তখন কৌতুকের হাসি। কথা শিখতে যে ক’দিন দেরি করেছিলাম, শুনেছি, সেটা বাদ দিয়ে আমার জন্মের পর সারাণ তার এইসব প্রশ্নের মধ্যেই থাকতে হয়েছে Ñ “ওড়ে তো অল্প কয়েকটা। বাকিগুলা গাছে চড়ে পাড়ে। তুলা উড়বে যখন খুব সুন্দর দেখাবে, দেখিস।

” ব্যাখ্যা করতে করতে রাস্তা দিয়ে আমাকে হাত ধরে নিয়ে চলে। আর তুলা উড়বার মৌসুমের জন্য মনে মনে একটা অস্থির অপো সমেত আমি বাবার হাত ধরে হাঁটতে থাকি। সেসব আরো আগের কথা। একদিন বাবাই সমাধান নিয়ে বাসায় ফিরল। ফিরেই মা’র সঙ্গে সেই আলাপ Ñ “রিলিফের কম্বলগুলা তো মোটা মোটা।

খুবই গরম। কী বল?” “রিলিফের কম্বল পাবা কই?” “কেমন হয় আগে বল। ” “ভালই তো হয়। কে দেবে?” মা তাড়াতাড়ি সমাধানে পৌঁছাতে চায়। “গণ্ডগোলের পর হলে তো হাত পেতে দাঁড়াই গেলেই হতো।

এখন তো আর আমাকে দেবে না। ” এসব আলাপে বাবার রসিকতার জুড়ি নেই। মা বরাবর। “দাঁড়াও গিয়া। ” “তাইলে কী বল! একটা জোগাড় করি তাইলে।

” “সেইটাই তো জি¹াস করলাম। ” “দেখি আলীকে ব’লে। ও তো দুই তিন সিজনে একটা কম্বল পায়। দেখি কী বলে। ” বাবা এমন একটা ভঙ্গিতে কথাগুলো বলল যে মনে হবে ভীষণ একটা অনিশ্চিত উপায় এটা।

কিন্তু বাবাকে চিনলে ঠিকই বোঝা যায় যে আসলে সে নিশ্চিত। মাও তাই বুঝল। বাবার স্কুলে আলী পিয়ন। কম্বলটার রঙ ভালুকের মতো। অমসৃণ রোঁয়াগুলো নারকেলের ছোবড়ার মতো ধারালো হয়ে বেরিয়ে আছে।

ওটাতে হাত দিলেই বোঝা যায় ঢাকনা ছাড়া এটা গায়ে চড়ানো অসম্ভব। আর কম্বলে ঢাকনা চড়াতেও আমাদের বাসায় বিশেষ বাধা নেই। ফলে আবারো মার্কিন কাপড়ের একটা ঢাকনা বাসায় এল। কিন্তু সেই কাপড় ভেদ করেও রোঁয়াগুলো খালি গায়ে খোঁচা দেয়। কম্বলটাকে খাড়া করে দাঁড় করিয়ে দিলে অভ্যাগত কারো ঘরের দেয়ালের হার্ডবোর্ডই মনে হবে।

বলে না দিলে সেটাকে কম্বল বলে চেনা মুস্কিল। শীতের হাত থেকে বাঁচতে যে মানুষ ওই কম্বলে ঢোকে তার শরীরের ভাঁজ নিয়ে কম্বলের এতটুকু মাথাব্যথা নেই। শরীরের সঙ্গে সে বিশেষ ছুঁয়েও থাকে না। বরং পানি-ভেজানো হার্ডবোর্ড যতটুকু নেহায়েৎ-অনিচ্ছাহেতু মোচড়াবে ততটুকু মুচড়ে ওটা গায়ের ওপর পড়ে থাকে। ফলে ওটাকে গায়ে নিয়ে বড়জোর মনে হয় একটা তক্তার নিচে চাপা পড়ে আছি।

দুর্ভেদ্য সেই কম্বল ভেদ করে অনায়াসে যা আসা যাওয়া করত তা হচ্ছে শৈত্য এবং বাতাস। এই এতকিছু আমার কম্বলটা গায়ে দিয়েই বুঝতে হয়েছে। কিন্তু প্রথম দর্শনেও কম্বলটার প্রতি কিছুমাত্র নৈকট্য বোধ করবার হেতু ছিল না। অথচ কম্বলটা আমার জন্যই নেয়া হয়েছিল। তক্তাটাকে আমার আরেকটা চলনসই লেপের সঙ্গে নিয়ে আসতে হয়েছে ঢাকায়।

এর ভিন্ন বিশেষ কোনো উপায়ও ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে দুঃসাধ্য একটা ব্যবস্থাপনায় ওই কম্বলের তেমন কোনো বিকল্প আসলে ছিলও না। লেপের সঙ্গে একটা বাড়তি, অথচ প্রয়োজনীয়, ব্যবস্থা রাখবার জন্য কম্বলটাই ছিল সম্বল। বছরের পর বছর যাচ্ছে। নিয়তির মতো এই কম্বল থেকে গেছে।

এই কম্বল আমার হকিকত। চাকরি করি যখন তখনো এই আলীর রিলিফের কম্বল আমার সঙ্গী। আমি জানি এর হাত থেকে নিস্তার পেতে পেলব তুলতুলে কম্বল একটা আমার কিনতে হবে। নানাভাবে সেটা হয়ে উঠতে পাঁচটা বছর আমার চাকরিতেও কেটে গেল। তারপর গুলিস্তানের ফুটপাত থেকে একদিন রঙিন তুলতুলে একজোড়া কম্বল কিনে আনা হলো।

শেষমেশ একদিন জামালের মাকে ডেকে এই কম্বলখানা গছিয়ে দিই। আমার বর্জ্য জিনিসেও ও খুব খুশি। আমি খুশি হই কম্বলটার বিহিত করা গেল বলে। আর জামালের মায়ের মতো নিশ্চিত বর্জ্য নিষ্কাশন ব্যবস্থা আমাদের জীবনে আছে বলে। অনেক দ্বিধা সমেত মাকে চিঠি লিখে জানাই ওই রাতেই।

আমি নিশ্চিত মা একদমই খুশি হবে না। কিন্তু আলীর কম্বল থেকে আমি পরিত্রাণ পেলাম। সারিতা সহ মুরগির টিক্কা কাবাব খেতে গেছি মোহাম্মদপুর বিহারী ক্যাম্পে। এটা আমার অত্যন্ত প্রিয় জায়গা, খাবার জন্য। সাউন্ড বক্স লাগানো ক্যাসেট প্লেয়ারে মেহেদি হাসান বাজছে Ñ ‘মুঝে তুম নজরসে গিরা তো রহে হ্যায়, মুঝে কভি ভি ভুলা না সাকোগি ...।

’ শুকনো মুখে রশিদ এসে জিজ্ঞেস করে Ñ ‘ভাল সময়ে আসছেন। কী খাবেন ভাই। আইজকাও মুরগি?’ ‘হ্যাঁ। কিন্তু আপনার কী হয়েছে?’ ‘মুন্তাকিম ভাইরে মাইরা ফালাইছে। ’ চকিতে সামনের দোকানে তাকাই।

তখনো কাপড়ে লেখা ঝুলছে ‘বিসমিল্লাহ্ কাবাব’। মুন্তাকিমের ভাই মনোযোগ দিয়ে গোশ্তে মশলা মাখাচ্ছে। উজ্জ্বল দুইশ ওয়াটের আলো ওর মুখে পড়ছে। তবু ওর মুখটা পড়া যায় না। ‘কারা?’ ‘এই তো মাস্তানেরা।

’ ‘কবে?’ আমি ঝড়ের মতো প্রশ্ন করতে থাকি। ‘চাইর তারিখ। আমরা এক সপ্তাহের এস্ট্রাইক করলাম। আইজগাই খুলছি আবার। ’ ‘কিছু হলো?’ ‘এস্ট্রাইকের মইধ্যে আবার আইল।

পিডাইল কয়জনরে এইহানে। তারপর জোর কইরা দোকান খোলাইল। মুরগি ভাইজা খাওয়াইতে হইল। ’ সামনের টেবিলে দুইটা ছেলে সরু চোখে রশিদের কথা শুনছে। আমি আর সারিতা হতভম্ব হয়ে বসে।

কী খাব আরেকবার আর রশিদ জিজ্ঞেস করল না। মাটির দিকে তাকিয়ে ও। খুব আস্তে আস্তে বলল Ñ ‘আমাদের আর এইহানে থাকা সম্ভব না। ’ তাই তো! এখানে তো আর থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু যাওয়াই বা সম্ভব কোথায়! আমরা রাখতে চাই না।

আর পাকিস্তান নিতে চায় না। বিহারী ক্যাম্পের প্রাত্যহিক জীবন এত আটপৌরে হয়ে গেছে যে হয়তো আমার আর খেয়ালও পড়ে না। নাহলে গতমাসেই তো রশিদ দুজন মেয়ের ধর্ষণের খবর জানাল। সারিতা আর আমি ওখানে আর খেলাম না। খাবার প্যাকেট করে বাসায় নিয়ে এলাম সেই রাতে।

মৃত আলী বিহারী আবার ফিরে এল আমার মনে। এ দফা কম্বল ছাড়াই। আলী বিহারী কেন অন্ধ সেই প্রশ্ন কখনো মাথায় এল না! দীর্ঘ কৃশকায় আলী বিহারীর লাঠিটা ওর প্রায় অর্ধেক সুফিয়া সামনে সামনে বয়ে নিয়ে যেত। সেভাবেই আমরা আলীকে শৈশব থেকে চিনতাম। ... নিশ্চয়ই অন্ধ আলী আর স্কুলের পিয়ন ছিল না।

সেই পরিচয় তাহলে ওর আগে-থেকে-পাওয়া পরিচয়। তাহলে কী খেয়ে বাঁচত আলী বা সুফিয়া! ... পৌরসভার কলোনিতে থাকত। কিন্তু সেই কলোনি তো সেই কোন কালেই ভেঙে ফেলা হয়েছে! তাহলে ওরা থাকত কোথায়! ... আর আলী তো অন্ধ হলো স্বাধীনতার পর! ওর কোটরে চোখ ছিল না। আগে ছিল, উপড়ে ফেলা হয়েছে। ... আচ্ছা আলী কি কখনো পাকিস্তান যেতে চেয়েছিল? কিন্তু তা চাইবে কেন! পাকিস্তান থেকে তো সে এখানে আসেনি! ... আলী মারা গেছে সেই কবে! বাবাই বলছিল।

সুফিয়াকে নিশ্চয়ই রিলিফের কম্বল দেয়া হয়। কিন্তু ওই বা কোথায়! ... এইসব আপাতঃ জ্ঞাত বিচ্ছিন্ন তথ্যগুলো জটিল এক ডিডাকশনে নিয়ে যেতে থাকে আমাকে। আমি আলীকে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ি। মধ্যরাতে আমার আবার ঘুম ছুটে যায়। দম বন্ধ হয়ে আসে।

আমি ঘেমে নেয়ে হাঁসফাঁস করে উঠি। বুকের ওপর থেকে কম্বল সরিয়ে ফেলতে চাই। কিন্তু আমার গায়ে তো তখন তুলতুলে একটা কম্বল। প্রতিটি রাত আমি তুলতুলে কম্বলের নিচে ঘুমাই। অথচ মধ্যরাতে ধড়মড় করে উঠি।

মনে হয় একটা তক্তার নিচে চাপা পড়ে আছি। জগে রাখা পানি খেয়ে লালটা বদলে নীলটা টেনে গায়ে দিই। সেই একজোড়া গুলিস্তানের কম্বলের পর লাল টুকটুকে সার্টিনের কাপড়ের একটা লেপ হয়েছে আমার। বিদেশ যাবার সময় রুমা রেখে গেছে। ঘন নীল একটা কম্বল এসেছে তারও পরে।

বাড়ি থেকে মা আমার জন্যই আলাদা করে একটা লেপ বানিয়ে পাঠিয়েছে। আমার এখন পাঁচখানা তুলতুলে লেপ কিংবা কম্বল। ষষ্ঠটা কিনে দেবে বলে আদৃতা দু’ দু’ বার আমাকে নিয়ে বাজারে গেছে। কিন্তু লেপ-কম্বলগুলো আমাকে ত্রস্তই করে রেখেছে। এর একটাও আলীর কম্বলের বেষ্টণী থেকে আমাকে মুক্তি দেয় না।

সারাটা শীত ধরে আমি গ্রীষ্মের স্বপ্ন দেখতে থাকি। তারপর গ্রীষ্মের পর যখন প্রথম শীতে আমার লেপ-কম্বলের সংগ্রহে হাত দিই, দীর্ঘদেহী আলী আমার নৈমিত্তিক সঙ্গী হয়ে আছে। গোলকবিহীন তার অেিকাটর আমাকে স্পষ্টভাবে এফোঁড় ওফোঁড় দেখে। আর আমি আগামী ভরন্ত শীতে সপ্তম কম্বল যোগাড়ের কথা ভাবি। একেক বার আমার মনে হয়, হয়তো জামালের মা আমাকে উদ্ধার করতে পারবে।

হয়তো ওর কাছ থেকে আলীর কম্বলটা আমার ফিরিয়ে নেয়াই কাজের হবে। হয়তো আলীর আমানত এখন এখানে থাকলে আমার আর হাঁসফাঁস লাগবে না। আমি জানি না। আমার মনে হয়। কিন্তু তা করতে হলে জামালের মাকে আমার তুলতুলে একটা কম্বল দিয়ে দিতে হবে।

আর তা করতেও আমি এখন রাজি। কিন্তু জামালের মা যে কোথায় তা তো আমি জানি না! (২৪ এপ্রিল ২০০৫ -- ৭ই মে ২০০৫। হিগাশি-হিরোশিমা) প্রকাশ: ইমেইলগ্রপ কবিসভা; ঈদসংখ্যা, একাত্তর ২০০৬

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।