আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধরা যাক সৈয়দ হকের জারজ গল্পটির কথা...

mahmud_shawonbg@yahoo.com

মাহমুদ শাওন সাহিত্যের ভিন্ন ভিন্ন পরিসরে সৈয়দ শামসুল হকও বিভিন্ন। তাঁর রচনার বিপুল সম্ভার, বৈচিত্র আর বিষয়ে নানামুখী অভিজ্ঞতার সংশ্লেষ থাকা সত্ত্বেও, নিজস্ব এক অসাধারণ সাহিত্যভাষা থাকা সত্ত্বেও তাঁর ভিন্ন ভিন্ন সাহিত্যিক উপকরণের খুব কম অংশই আলোচিত হয়েছে। তাঁর রচিত কাব্যনাটক, কবিতা, উপন্যাস ও প্রবন্ধসাহিত্য নিয়ে অল্প-বিস্তর আলোচনা হলেও, সৈয়দ হকের ছোটগল্প নিয়ে আলোচকদের নির্লিপ্ততা দুর্লক্ষ্য নয়। অথচ ছোটগল্পের জন্যই বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। সৈয়দ হকের জন্ম ১৯৩৫ খৃস্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর।

জন্ম সনটি উল্লেখ করতে হলো এ কারণে যে, তিনি সেই প্রজন্মের একজন- যারা একই সঙ্গে বৃটিশ , পাকিস্তান ও বাংলাদেশ শাসনামল দেখেছেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রের শাসনামলে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও তৎসংশ্লিষ্ট মানবের মানবীয় চিন্তা ও কৌশলের বিবর্তন অবলোকন করেছেন। দেখেছেন, রাষ্ট্র ভেঙ্গে রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে গড়ে উঠছে রাষ্ট্র, ধর্ম ও জাতিগত বিরোধ, শোষণের যাতনা ভুলতে না ভুলতেই আবারো শোষণের নির্মমতা, বৈষম্য। ফলে আবারও প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন দেশ। আপাত সবকিছু স্থিত হবার স্বপ্ন! কিন্তু সুস্থির হবার সেই স্বপ্নও বেশিদিন থাকে না।

বিশ্বাসঘাতকরা যুগে যুগে মাথাচারা দিয়ে ওঠে। ফলাফল- রাষ্ট্রনায়কের নির্মম মৃত্যু, দেশের সামনে ভয়াবহ নেতৃত্ব সংকট! তারপর আরও কত কত দৃশ্য-চরিত্র-পাশ্বচরিত্র বদলে যায়, মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি মেলে না। এ সবকিছু তিনি নিজ অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন, তুলে ধরেছেন তাঁর বিভিন্ন ছোটগল্পে। ফলে তাঁর লেখা ছোটগল্প সম্রাট কিংবা শীত বিকেল বা পুতুল, গাছ পাথরের চঞ্চলতা, ভাল করে কিছুই দেখা যাচ্ছে না বলে, গাধা জোছনা পূর্বাপর, জারজ অথবা পতন- যেকোনও গল্পে দেখা মেলে তাঁর সময়ের প্রতিবেশ, প্রতিচ্ছবি। ক্ষরণ।

আর কী অবাক, কখনই গল্পগুলোর প্রেক্ষাপট তাঁর স্ব সময়েই শুধু আটকে থাকে না, শুধু তাঁর সময়কে চিহ্নিত করে ক্ষান্ত হয় না; বরং তা আজকের প্রেক্ষাপটেও কী ভীষণ সাম্প্রতিক! ধরা যাক সৈয়দ হকের জারজ গল্পটির কথা। গল্পের শুরু এরকম, 'আমাদের মর্মের ভিত্তিমূল পর্যন্ত চমকে ওঠে যখন আমরা আজমল হোসেনের কথা শুনি, জলেশ্বরী ইস্টিশানের মিষ্টির দোকানে গাঢ় বিকেলের আড্ডায় বসে, যে, গতকাল রাতে সে নিজের বাড়িটি কোথায় স্মরণ করে উঠতে পারেনি। ' যে বাড়িতে আজমলের জন্ম, যে বাড়ি বাপদাদার, যে বাড়িতে বিয়ে করে বউ নিয়ে থাকে; সেই বাড়ি চিনতে পারে না- এটা আজমলের বন্ধু বেলাল, সামাদ ও মনসুরদা মেনে নিতে পারে না। তারা বিস্মিত হয়। জানতে চায় আসল কারণটা কী? এরপর আজমল তার বাড়ি না চেনার কারণ বলতে শুরু করলে, আমরা, যারা এই গল্পের পাঠক, তারা বেলাল হয়ে, সামাদ হয়ে, মনসুর হয়ে এগোতে থাকি।

আজমল বলতে শুরু করে, 'শনিবার গতকাল হাটবার ছিল। মা আমাকে বললেন, মেলা দিন রুই মাছ খাও নাইরে, হাটে যায়া রুইয়ের একখান বড় চাকা পাইলে আলু আর বিলাতি বেগুন দিয়া রান্ধিলাম হয়। মায়ের এই শখ শুনে আমার বড় কৌতূহল হয়। হঠাৎ রুই মাছের শখ ক্যানে, মাও? মা গলা নামিয়ে বলেন, এলায় যে বৌমাকে ভালমন্দ খাবার দিবার হয়। ' এরপর আজমল জেনে যায় তার বউ, যার নাম পারুল, পাঁচ মাসের পোয়াতি।

মা আঁচলের গিট খুলে তাকে একশ টাকা দিয়ে হাটে পাঠায়। আজমল খুব খুশি হয়। হাটে গিয়ে নগেন মলমাঝির কাছ থেকে দর কষাকষি করে পঁয়ষট্টি টাকা দিয়ে রুই মাছের মাথা কেনে। আলু আর বিলাতি বেগুনও কেনে, আর যেহেতু হাটের মধ্যেই কুতুবউদ্দিনের মাজার, সেহেতু মাছের মাথা হাতে নিয়েই সে মাজারে যায় দোয়া মানতে। সেখানে মাজারের খাদেম, যে কী-না আজমল ও পারুলের বিয়ে পড়িয়েছে, জিজ্ঞেস করে, 'এত দামের মাছ হঠাৎ কেনে রে? বাড়িতে কি দাওয়াত আছে?...বড় খুশি নিয়ে তাকে আমি বললাম, না হুজুর, বৌ আমার পোয়াতি।

এ কথা শুনে তিনি ভ্রু কুচকে উঠলেন। বললেন, এ কেমন রে আজমল? তোর না বিয়া দিলাম সেদিন আমি। জানতে চাইলেন, কতদিনের পোয়াতি? মা বলেছিলেন, পাঁচ মাসের। খাদেম বললেন, পাঁচ মাস?... বিয়া দিলাম তিন মাস আগে, আশ্বিনে, আর পৌষ মাসে পাঁচ মাসের পোয়াতি!' এরপরই সন্দেহ দানা বাঁধে আজমলের মনে। নানা রকম প্রশ্ন এসে ভিড় করে।

তবে কি তার মায়ের হিসেবের কোথাও ভুল হলো? কিন্তু এ ব্যাপারে তার সন্দেহের কোনও সুযোগ নেই; কেননা নিজে তিনি মা হয়েছেন, পোয়াতি খালাসে তার সুনাম আছে বেশ। তাহলে পারুলের গর্ভে কার বীজ? আজমল এবার নিজের জন্ম নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করে। সে বলে, 'এক সময় আমার ভেতরটা চমকে ওঠে। আমিও কি জারুয়া, জারজ, আমিও কি গর্ভে এসেছিলাম বাবার বীজে নয়, অন্য কারো বীজে? তাই কি আমার বাপ একদিন জামগাছের ডালে গামছায় গলা বেঁধে আত্মহত্যা করেছিলেন?' গল্পটি আরও কিছুদূর এগোয়। আজমলের সব কথা শুনে শেষ কথাটি বলে বেলাল, যে রাজনীতি করে।

বলে, 'জারুয়া সন্তান কি জারুয়া নয়, সেটা কোনো কথা নয়। দ্যাশে আইজ জারুয়ারই দল। জারজ সন্তান না হইলে মুক্তিযুদ্ধ ভুলি যায় মানুষ? পারুল তো পারুল চায়া দ্যাখ, দ্যাশ জননীর গর্ভে কত জারুয়া আইজ দিনে দিনে বড় হয়। ' বেলালের এই উক্তিটির মধ্যে দিয়ে সৈয়দ হক সেইসব জারজদের কথাই বলেছেন, যারা আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে বলে, এদেশে মুক্তিযুদ্ধ হয়নি, গৃহযুদ্ধ হয়েছে। আর স্বাধীনতা বিরোধীদের মুখে এমন কথা শুনেও আমরা যখন নমনীয় থাকি, তুমুল কোনও প্রতিবাদ গড়ে তুলি না, তখন অপরাধের অঙ্গুলি কি আমাদের দিকেও তাক করা থাকে না? জারজ গল্পটি বারবার পড়তে গিয়ে কখনো মনে হয়েছে- আজমল হোসেন, গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যার বিচরণ, সে-ই এর প্রধান চরিত্র।

আসলেই কি তাই? কিংবা, পারুল? আজমলের মা? না-কি আজমলের বাবা, যে গলায় গামছা বেঁধে আত্মহত্যা করেছিল? মাজারের খাদেম? বেলাল? না-কি কোনও ব্যক্তি নয়, বস্তু! বস্তু মানে আজমলদের বাড়ি- যা সে চিনতে পারে না? না-কি বাংলাদেশই গল্পটির মূখ্য চরিত্র?


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।