আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
স্কুল জীবনে মোট দশবছরে ত্রিশবারের মত লেখাপড়ার প্রোগ্রেস রিপোর্ট হাতে পেয়েছি। ত্রিশটির মাঝে অনেকগুলোই মাঝে মাঝে স্মৃতির পাতায় ভেসে উঠে। কিছু স্মৃতি আনন্দের, কিছু স্মৃতি গর্বের আবার কিছু স্মৃতি দুঃখের। দুঃখের না বলে বলা যায় ভয়ের, তবে সেগুলোর কথা মনে পড়লেই আজ হাসি পায়।
লেখাপড়ার প্রথম বছরগুলোতে আমি মোটেও ভাল ছাত্র ছিলাম না।
আজও মনে পড়ে অতীতের সেই করূন স্মৃতি। খুব সম্ভবত ক্লাস টু'-এ পড়ি, আমি মায়ের সামনে রিপোর্ট কার্ড নিয়ে মাথা নত করে বসে আছি। কাছেই ছোটবোন পাশের বাসার অনির সাথে নাচানাচি করছে। তখনই আমার গালে চপাট করে পড়ল এক থাপ্পড়, আমি ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে দিলাম, আর আমার বোন তার বান্ধবিকে নিয়ে দ্বিগুন উৎসাহে হাসতে হাসতে নাঁচতে শুরু করল। কেন জানি মনে হয়, মেয়েদের সামনে অপদস্ত হবার লজ্জা সেদিন প্রথম অনুভব করেছিলাম।
ক্লাস থ্রি পর্যন্ত স্কুলে প্রতিবার রিপোর্ট কার্ড দেওয়ার সময় ১ম থেকে ১০ তম মেধাতালিকার ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসটিচারের কাছ থেকে রিপোর্ট কার্ড নিত। ক্লাসরুমের দুই দিকে দুই সারি ছাত্রছাত্রীদের বেঞ্চ, তার মাঝ হতে এক একজন রাজার মত হেটে গিয়ে তাদের ভাল রেজাল্টের পুরস্কার নিত এবং সবার হাততালি দিতে থাকত। আমি বসে বসে তালি দিয়ে যেতাম, কখন স্বপ্নও ভাবি নাই আমিও এমন অভিনন্দন পেতে পারি। ক্লাস থ্রির ফাইনাল পরীক্ষায়, প্রথম তিনজনকে কার্ড দেবার পর, টিচারের মুখে শুনি আমি নাকি ফোর্থ। আহা! এল সেই দিন! আমিও বেঞ্চ হতে উঠে এগিয়ে গেলাম টিচারের দিকে।
রিপোর্ট কার্ড হাতে নেবার পর খেয়াল করলাম, কেউ তালি দিল না। মনের দুঃখে নিজের বেঞ্চে এসে পাশের বন্ধুটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কিরে তালি দিলি না যে?”। সে বলল, ক্লাস থ্রির ফাইনাল থেকে শুধু প্রথম তিনজন তালি পাবে, অন্যরা নয়। হায়রে! আমার কপাল।
ক্লাস ফাইভের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা খুব ভাল দিয়েছিলাম! ফলাফল অংকে ফেল ও বিজ্ঞানে ৩৩।
ভেবেছিলাম বিজ্ঞানে ভাল নম্বর পাব। কারন টিচার বলেছিল বিজ্ঞান প্রশ্নের উত্তরে ছবি দিতে; আরো বলেছিল কিছু উত্তর লিখে তারপর ছবি এঁকে পরে বাকিটুকু লিখতে; তাহলে নাকি ফুল মার্কস দেবে। আমিওতো তাই করেছিলাম! খাতা হাতে পেয়ে দেখলাম প্রথম অংশ ঠিকই লিখেছি, ছবিও সুন্দর এঁকেছি কিন্তু পরের অংশ আর লিখি নাই। ফলাফল রিপোর্ট কার্ডে ৩৩। দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় অংকে ৯৫ পেয়েছিলাম, যেহেতু অন্য সব বিষয়ে হাহাকার তাই কারো প্রশংসা কপালে জুটল না!
ক্লাস সেভেনে আমার বাসায় এক স্যার এসে অংক পড়াতেন।
ঢাকার এক স্কুলের হেড মাস্টার হিসেবে রিটায়ার্ড করেছেন, সময় কাটানোর জন্য পড়াতেন আমাদের। স্যার অংক বুঝাতেন না, আমাকে বলতেন আমি লিখে যেতাম। এভাবে দুই মাসে পুরো অংক বই শেষ করে স্যার আমাকে অংক করতে দিতেন আর নিজে মুখ ঢেকে পেপার পড়তেন। আমি পায়ের উপর খাতা রেখে দেখে দেখে অংক করতাম, স্যার কিছু বলতেন না। ফাইনাল পরীক্ষায় রিপোর্ট কার্ড পেলাম যখন দেখি আমার স্থান ৫ম।
বন্ধু নাসির স্যারকে জিজ্ঞাসা করল, স্যার অংকে হাইয়েস্ট নম্বর কে পেয়েছে। স্যার বলে, "বিবর্তন"। আমার মনে হল, আমি আকাশ হতে পড়ছি, আমার দুনিয়া উলটেপালটে গেল। দুটি কারনে আমি এমন উছলে উঠেছিলাম। প্রথমত, এর আগে কখনোই নিজের নম্বর সর্বোচ্চ নম্বরের সাথে মিলাবার দুঃসাহস করি নাই, কারন আমার পক্ষে ঐ নম্বর পাওয়া অসম্ভব বলেই জানতাম।
দ্বিতীয়ত, স্কুলের স্যারেরা আমার ডাক নাম জানে এটা আমার চিন্তার অতীত ছিল। আজও সেই স্মৃতি মনে পড়লে, আমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ি। আসলে দেখে দেখে সারা বছর অংক করতে করতে আমার অংক সব মুখস্ত হয়ে গেছিল, বিধায় অংকে হাইয়েস্ট নম্বর।
সেই স্যারের বদৌলতে ক্লাস এইট হতে আমি ক্লাসে অংকবিদ নামে পরিচিত। আমার অংক কেউ কাটতে পারে না, কারন পুরো বই মুখস্ত।
এমন সময় হল বার্ষিক পরীক্ষা, যথারীতি খারাপ পরীক্ষা দিয়ে মনমরা। বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট দেওয়া হত, স্কুলের মাঠে। ক্লাস থ্রি হতে ক্লাস টেন পর্যন্ত সবার রেজাল্ট দেওয়া হত। প্রথম তিনজন সেখানে হেড মাস্টারের কাছ থেকে প্রোগ্রেস রিপোর্ট নিত, স্কুলের সবাই তাদের চেহারা দেখত। রিপোর্ট কার্ড ছিল তাদের কাছে স্বর্ণের কাপ, সেটাই তারা করতালিরত জনতার সামনে নাড়ত।
প্রথম দুইজনের পরে কানে বাজল, আমার নাম। হায় হায়!! এ কি শুনি। আমি থার্ড!!! এগিয়ে গেলাম এবং এবার আর হতাশ হতে হল না। স্কুলের সবার সামনে আমি দাঁড়িয়ে হেড মাস্টারের (ভূইয়া ওরফে ভূয়া স্যার) কাছ হতে প্রোগ্রেস রিপোর্ট হতে নিলাম। সেখান থেকে দাঁড়িয়েই দেখি লাইনের পাশে বাবা দাঁড়িয়ে।
বাবাকে দেখে যে কত খুশি হয়েছিলাম লিখে প্রকাশ করতে পারব না। আমার বাবা কখনই স্কুলে প্রোগ্রেস রিপোর্ট দেবার দিন আসত না, কেন জানি না সেই দিনই বাবা গেল। তার যাওয়াকে আমি বৃথা হতে দেইনি, আজও সেই দিনটির জন্য গর্ব হয়।
এরপর ক্লাসটেনের প্রথম সাময়িক ও প্রিটেস্ট পরীক্ষায় আমি ফার্স্ট হলাম।
অংকবিদের খেতাব ছাড়িয়ে আমি ক্লাসের পদার্থবিদ হিসেবে পরিচিত (আমাদের ক্লাসে কেউ কখনোই আমার থেকে পদার্থবিদ্যায় বেশি নম্বর পায়নি)।
রিপোর্ট কার্ড যখন বাবাকে দিলাম সিগনেচার করতে, বাবা হাসতে হাসতে বলে, “তোমাকে নিশ্চয়ই স্যারেরা ইচ্ছা করে বেশি নম্বর দেয়, ফার্স্ট হবার মত লেখাপড়াতো করতে দেখি না”। বাবার স্কুল জীবনের ফার্স্ট বয় নাকি সারাদিন পড়ত, এখন নাসার বিজ্ঞানী।
এরপর আর পেছনে ফিরে তাকানো হয় নি। অসুস্থতার জন্য ক্লাস টেনে যদিও টেস্ট পরীক্ষা দিতে পারি নাই তবে এসএসসিতে স্কুলে সব থেকে বেশি নম্বর পাই। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় কোথাও রেজাল্টে খারাপ করি নি।
তবুও আজও স্কুলজীবনের প্রোগ্রেস রিপোর্ট দেবার ভয়ংকর দিনগুলোকে মিস করি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।