আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঘুরোঘুরি ব্লগ: উত্তর মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জ/ সমুদ্র যেখানে মা (৬ষ্ঠ অংশ)

যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

৭. ফিয়েস্টা রিজোর্টের সৈকতে বসে বসে আমরা যখন স্কুবা ডাইভিংয়ের মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখন বেলা আড়াইটার দিকে জীপ নিয়ে হাজির জাপানীজ এক ছেলে। আমাদের নিয়ে যাবে স্কুবা ডাইভিংয়ের আস্তানায়। ছেলেটা প্রথমে ইংরেজীতে কথা বলা শুরু করল, জাপানীদের ইংরেজীতে খানিকটা দূর্বলতা থাকে, এমনকি অনেকদিন ইংরেজী ভাষাভাষি দেশে থাকলেও অনেকের এই দূর্বলতা কাটেনা। কারণটা সম্ভবতঃ ছোটবেলায় মনের মধ্যে ধরে যাওয়া ভয়, ইংরেজী ভাষাটা না জানি কি জুজুর ভাষা! অবশ্য কোরিয়ান ভাষা ছাড়া অন্য যেকোন বিদেশী ভাষা রপ্ত করতেই জাপানীদের প্রাণান্ত হতে হয়, কারণ এভাষায় উচ্চারিত অক্ষরের সংখ্যা খুব কম। তারওপর আছে দীর্ঘদিন পৃথিবী থেকে আলাদা হয়ে একটামাত্র দ্বীপে আবদ্ধ হয়ে থাকার ইতিহাস।

সে যাই হোক, ছেলেটির কষ্ট করে ইংরেজী বলা দেখে আমি যখন মিটিমিটি হেসে বললাম, "আমি জাপানী বলতে পারি", ছেলেটা এমন এক হাসি দিল যে নিজেকে ত্রাতা মনে হলো। আকর্ণ হাসি নিয়ে ছেলেটা জিজ্ঞেস করল, "জাপানী পড়তে পারো?" আমি আবারও সবজান্তার ভাব নিয়ে বলি, "অবশ্যই"। পাশে দাঁড়ানো সুকেশদা আর বঙ্গদাও জাপানী বলতে পারে ভালোই, তারাও ভীষন খুশী, কারণ তাদের কাস্টমার (আমি) জাপানী বলতে পারে। বঙ্গদা তো বলেই ফেলল, "আরে চিন্তা করোনা, ও অর্ধেক জাপানীজ। " আমি গাড়ীর আয়নায় নিজের চেহারাকে একবার উপর/নীচে আবার ডানে/বাঁয়ে আধাআধি ভাগ করে দেখার চেষ্টা করি, কোন অংশটা জাপানীজ! ছেলেটার নাম জুন।

ভাষাসংক্রান্ত দুশ্চিন্তা দূর হবার পরই জুন সপ্রতিভ হয়ে ওঠে। আর একটু আগে জেটস্কীর দরুন খানিকটা ট্রমা গিলে ফেলা আমিই যেন অপ্রতিভ হতে শুরু করি। আবারও জিজ্ঞেস করি, "দেখো, আমরা কিন্তু আসলেই সাঁতার জানিনা, ডুবতে বসলে কিন্তু এই মোটাসোটা দেহ তোমাকেই বাঁচাতে হবে। " আমাকে যারপরনাই আশ্বস্ত করে জুন বলে, "কোন সমস্যা নাই। " তারপর যথারীতি সেই জাপানীজ কায়দায় আমাদের দেখানো শুরু করল তাদের প্ল্যান প্রোগ্রাম।

একেবারে কাগজে কলমে লিখে এনেছে কখন কি করবে। প্রথমে আমাদের নিয়ে যাবে ওদের কোম্পানীর অফিসে, গারাপানের ব্যাংক অভ সাইপানের সাথেই লাগোয়া হোটেলের দোতলায়। হোটেলের নাম মনে নেই, ওদের কোম্পানীরও। সেখানে কিছু কাগজপত্রে সাইন করতে হবে, যেটা শুনে আমি খানিকটা আঁৎকে উঠেছিলাম। কাগজপত্র সাইন করার পর নিয়ে যাবে ডুবুরী পোষাকের আস্তানায়, আমাদের মাপমতো পোষাক, অক্সিজেন ট্যাংক এবং আরো আনুসঙ্গিক জিনিস নিয়ে রওয়ানা হবে সমুদ্রের দিকে।

সাইপান দ্বীপটি সম্পর্কে একটু ধারনা দেয়া যাক। দীপটিকে মোটামুটি উত্তর-দক্ষিণে লম্বা বলা যায়। মূলত পশ্চিম উপকূলের ফিলিপাইন সাগরকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে রিজোর্ট হোটেলগুলো, পশ্চিম উপকূলটা সমতল বলে। আরেকটা কারণ, যেটা পরে জানলাম, তা হলো পশ্চিম উপকূলেই উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত কোরাল রীফের কারণে একটা বিশাল ল্যাগুন বা অগভীর পানির সমুদ্র সৃষ্টি হয়েছে এই উপকূলে। এই কোরাল রীফের কারণেই সাগরের উপকূল থেকে অনেকদূর পর্যন্ত সাগর অগভীর, যেজন্য যত ইচ্ছে ম্যারিন স্পোর্টস করা যায়।

বলা বাহুল্য, মানাগাহা দ্বীপও এই ল্যাগুনেরই অন্তর্ভুক্ত। ল্যাগুন সৃষ্টিকারী এই কোরাল রীফ বা প্রবালপ্রাচীরের কারণেই ফিলিপাইন সাগরের ঝড়ো বাতাস সাইপানে আঘাত হানতে পারেনা, যে সমুদ্র প্রলয়ংকরী হবার কথা, সেসমুদ্র মায়ের মতো আগলে রাখে দ্বীপটিকে। ফিরিয়ে দেয় বাতাসের ভয়াবহ আক্রমণ, তা না হলে পূর্বপশ্চিমে সর্বোচ্চ নয় কিলোমিটার চওড়া এই দ্বীপের কিছুই অবশিষ্ট থাকার কথা ছিলনা, সিডরের মতো এক ঝড়েই। পশ্চিম উপকূলের তুলনায় পূর্ব উপকূল জমজমাট না, সত্যি বলতে পূর্বদিকে উপকূল বলতে তেমন কিছু নেই। পশ্চিম থেকে পূবে যেতে থাকলে দ্বীপের মধ্যভাগ থেকে পাহাড় আর উপত্যকা আপনাকে নিয়ে যাবে পূবে।

সেখানে পাহাড়ের খাড়া থেকে নীচে তাকালেই সমুদ্র, হ্যাঁ, প্রশান্ত মহাসাগর। জাপানী স্কুবা ডাইভার জুন আমাদের নিয়ে যাবে দ্বীপের দক্ষিণপশ্চিম দিকে, যেদিকটাতে আগে আসিনি। আমরা গিয়ে গাড়ীতে বসব, হঠাৎই নিজের পায়ের দিকে চোখ গেল। সারা পা আর স্যান্ডেল ভরা ছোট ছোট নুড়িবালু, গাড়ীতে উঠলেই শেষ! ভাবলাম, "পয়সা তো ভালই দিচ্ছি, পরিস্কার করিয়ে নেবে!" তাও ভদ্রতা করে বলি, "দুঃখিত ভ্রাতঃ, পায়ে আর স্যান্ডেলে অনেক বালু। " এবার ওর সবজান্তার হাসি দেবার পালা, আমাকে বলে,"কোন অসুবিধা নেই।

সব ব্যবস্থা করে রেখেছি। " গাড়ীতে উঠে দেখি সীটের ওপরে টাওয়েল বিছানো, হেলান দেয়ার পিঠেও টাওয়েল। পায়ের নীচে পাপস হিসেবেই পুরোনো কার্পেট টাইপের কাপড় বিছানো। সীবিচ থেকে কাস্টমার নিতে আসছে, আগে থেকেই জানে কোন অবস্থায় কাস্টমার গাড়ীতে উঠবে। প্রফেশনাল যাকে বলে আর কি! প্রথমে হোটেলে গিয়ে বসলাম ওদের অফিসে।

অফিস না বলে একটা বিপনীকেন্দ্র কাম রেস্টুরেন্ট বলা যায়। সব ব্যবসা এক জায়গা থেকে হয়, একটা বড়সড় রূমের অর্ধেক জুড়ে শোকেসে নানান বিপনীপণ্য, মাঝখানে একটা টেবিল আর কিছু চেয়ার। বাকী অর্ধেকে কতগুলো জাপানী কায়দার ডাইনিং টেবিল, একদেড়ফুট উঁচু টেবিল, আর তার দুপাশে দুটো করে মোট চারটি জাপানীজ বসার কুশন -- এগুলো আয়তনে বেশ বড় আর খানিকটা চ্যাপ্টা ধরনের হয়। বোঝা গেল রাতে এখানে খাবার এবং পানীয় গিলতে অনেকে আসে, ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, প্রায় সবসময়েই সাইপানে তাদের নিয়মিত কাস্টমারদের বেশ কয়েকজন থাকে, প্রতিরাতেই পানাহারপর্ব চলে। আমি মনে মনে ভাবি, আহা কত সুখের চাকরী! কাগজপত্র সাইন করতে গিয়ে আমি এবং গিন্নী, দুজনেই খানিকটা বইষম খেলাম।

এতো রীতিমতো আইন আদালতী ব্যাপার স্যাপার। আমাদের মুচলেকা দিতে হলো যে আমাদের কানের অতঃবা ফুসফুসের কোন সমস্যা গত ছয়মাসে ধরা পড়েনি, এবং খুব বড় ধরনের কোন সমস্যা এর আগে হয়নি। তারপর, কোন ধরনের এ্যাক্সিডেন্ট যদি হয়, তাহলে কেউ দায়িত্ব নেবেনা!! আমি প্রশ্নবোধক চেহারা নিয়ে জুনের দিকে তাকাই, সে ইশারায় আমাকে আশ্বস্ত করে। বলে, "তোমাদেরকে সাগরের যে অংশে নিয়ে যাব, সেখানে কিছুই হবেনা। শুধুই ফর্মালিটি বলে লিখে দাও।

" আমি মনে মনে ভাবি, "শুধু ফর্মালিটি হলে ব্যাটা লেখানোর দরকার কি? দিলি তো আমাদের টেনশন বাড়িয়ে!!" মুখে কিছু বলিনা, চুপচাপ হেসে সায় দিই। মোনা উদ্বিগ্নভাবে জিজ্ঞেস করে, "সমস্যা কি?" আমি বললাম সব খুলে, দেখি সেও স্বাভাবিকভাবেই নিয়েছে, বাঁচা গেল, মনে মনে ভাবি। কস্টিউমের আস্তানায় গিয়ে সহজেই পেয়ে যাই নিজের মাপমতো একটা ডাইভিং ড্রেস। সাথে পরতে হবে রাবারের একজোড়া জুতো, লম্বা লম্বা মতো স্কুবা ডাইভিংয়ের দুটো পায়ের পাতাও বেছে নিতে হলো। এরপর আসল মাথার ক্যাপ আর শ্বাসপ্রশ্বাস নেয়ার এক নল, যেটার সাথে চোখ ঢাকার চশমাও আছে।

এসব নিয়ে আমরা গাড়ীতে উঠতে উঠতে দেখলাম জুন গাড়ীর পেছনে কয়েকগ্যালন পানি আর তিনটি অক্সিজেন সিলিন্ডার ওঠাচ্ছে। একটা একটা করে ওঠাতে দেখেই বোঝা গেল সিলিন্ডারগুলো বেশ ভারী। আমরা আরেকদফা চিন্তায় পরে যাই, স্কুবা ডাইভিংয়ের পৃথিবীটা বড় বেশী অজানা ছিল আমাদের কাছে। এত হ্যাপা জানলে হয়ত করতেই আসতামনা, অন্ততঃ এরকম চমৎকার অবসর কাটানোর মাঝে। মোনা মুখ ফসকে বলেই ফেলল, "ধূর, এটা না করলেও হতো।

" আমি আস্তে আস্তে করে বলি, "কি করবো, আমার অনেকদিনের শখ; ইচ্ছে ছিল বিয়ে করলে বউকে নিয়ে স্কুবা ডাইভিং করব, সেজন্য শখটা জিইয়ে রেখেছিলাম। " মোনার মুখের হাসি দেখেই বুঝেছি, "এ্যানাদার গুড শট, এন্ড টু রানস এ্যাট লীস্ট"। সমুদ্রে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা তিনটের বেশী বেজে গেল। গাড়ী থেকে নেমেই জুন আমাদের বলল পোষাক পাল্টে নিতে। কি ভয়ংকর কথা! এই ভরা সৈকতে এখন আমি এত লোকের সামনে ট্রাউজার খুলে বক্সারপ্যান্ট পরা অবস্থায় ডাইভিংস্যুট পরবো নাকি! মোনার অবস্থা তো আরো শোচনীয়।

ও বলল, "জামার উপর দিয়ে না পরতে পারলে আমি ডাইভিংই করবোনা। " আমি নিরূপায় চোখে তাকাই, বলি, "ঠিক আছে চেষ্টা করে দেখ। " আমি নিজেও টিশার্ট খুলে, ট্রাউজারের ওপর দিয়েই চাপিয়ে দিলাম। মোনাও পারল, কিছুটা টানাটানি, হ্যাঁচড়াহ্যাঁচড়ি তো করতেই হলো। তাও অবশেষে স্যুটের চেইন গলা পর্যন্ত উঠিয়ে দিয়ে আমরা নিশ্চিন্ত ভাবে ফিরে আসলাম জুনের গাড়ীর কাছে।

আমাদের কর্মকান্ড দেখে বেচারা যে বিষম খায়নি, সেটা নিশ্চিত করে বলতে পারছিনা। এখানেই শেষ না, একটার পর একটা যেন গোলা ছুটে আসতে লাগল। জুন ভারী ভারী অক্সিজেন সিলিন্ডার গুলো নামিয়ে একটা একটা করে বেঁধে দিল আমাদের পিঠে। কমসেকম বিশ কিলো ওজন হবে, এমন ভারী! আমার ভার বহন করে অভ্যেস আছে, তাও যখন বেশ কষ্ট হতে লাগল, তখন বুঝলাম, মোনা বেচারী আমার শখ মেটাতে এটা সহ্য করছে। আমি সহানুভুতির সুরে বললাম, "বেশী ওজন হয়ে গেছে।

" মোনা যেন হালে পানি ফিরে পেল, বলল, "বাবু, আমি বাদ দেই?" আমার মুখ কালো হয়ে গেল। বলতে যাচ্ছিলাম, "ঠিক আছে কি আর করা", তখনই মোনা নিজেই বলে উঠল, "থাক! দেখি কি করা যায়?" আমরা জুনের পেছনে পেছনে সাগরে নেমে গেলাম। সাগরের এই অংশটা ঠিক বিস্তৃত উপকূলের মতো না, উপকূল থেকে একটু সাগরের ভেতরে ঢুকলেই পানি গভীর হয়ে যায়। জুন আমাদের পানির ভেতর হাঁটাতে হাঁটাতে প্রায় গলা পানি পর্যন্ত এক জায়গায় নিয়ে এলো। তারপর দেয়া শুরু করলো স্কুবা ডাইভিং নিয়ে জ্ঞান।

কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পেলাম গলা পানি পর্যন্ত নিয়ে আসার রহস্য, অক্সিজেন ট্যাংকটি এখন পুরোপুরি পানির নীচে, কোন ওজনই বোঝা যাচ্ছেনা!! মোনাকে বললাম, "দেখছো, কোন ওজনই নেই। " ও বাচ্চাদের মতো করে হাসল। খুবখুশী, মাঝপথে ছেড়ে দেয়নি বলে। জুন খুব গম্ভীরভাবে শিক্ষকসুলভ ভঙ্গিতে আমাদেরকে জ্ঞান দিতে লাগল, বলল, "স্কুবা ডাইভিংয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হলো দুটো। এক, ঠিকমতো রিদমে নিঃশ্বাস নেয়া, খুব ঘনঘন না নেয়া, আবার লম্বাসময় ধরে নিঃশ্বাস বন্ধ করে না রাখাটা মূল পয়েন্ট।

আর, দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, কানের চাপ। ডাইভিং চলাকালে ধীরে ধীরে কানে চারপাশের পানির চাপ বাড়তে থাকে, তখন নাক চেপে ধরে, গাল ফুলাতে হবে কয়েকবার। কানে চাপ অনুভব করা কমে গেলেই হবে। " তারপর দেখালো কিভাবে চোখের গ্লাসকে কাজ করাতে হয়, বলল যে, চোখের গ্লাস পানিতে নামার সাথে সাথেই ঘোলাটে হয়ে যাবে। এরজন্য গ্লাসের ভেতরের দিকে মুখ থেকে দুদফারমতো থুতু ছিটিয়ে, তারপর আঙুল দিয়ে সেই থুতু ঘষে দিতে হবে পুরো গ্লাসে।

তাহলে আর ঘোলাটে হবেনা। এটা শুনে মোনার যা চেহারা হলো, সেটা তুলতে পারলে পুলিটজার প্রাইস নিশ্চিত। থুতু নিজহাতে ঘষবে, এটা সে মানতেই পারছেনা। কপাল খারাপ, ডাইভিংয়ে ক্যামেরা নিয়ে নামা যায়না, জুনদের অফিস ক্যামেরা ভাড়া দেয়, স্বচ্ছ প্লাস্টিকের কেইসবন্দী, কিন্তু ভাড়াই প্রায় ক্যামেরার দামের সমান। কিপ্টেমী করে আর ভাড়া নেইনি, মনের এ্যালবামে ছবি তুলে রাখব ভেবে।

জুন আমাদের দুজনের পায়েই ফিনগুলো বেঁধে দিলো। তারপর বলল, এখন "এসো কিছুক্ষণ এই এয়ারমাস্ক মুখে দিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস নেয়া প্র্যাকটিস করি। " এয়ার মাস্কটা হলো একটা রাবারের মতো স্থিথিস্থাপক নলের মাথায় আলগা দাঁতের সেটের মতো একটা জিনিস, ওটাকে মুখের ভেতর পুরে রাখতে হয়। আর যে গ্লাসটা ব্যবহার করা হয় ওটা দিয়ে চোখ ঢাকে এয়ারটাইট অবস্থায়, এবং নীচের দিকে চলে যাওয়া নাকের আকৃতির রবারের অংশটি নাকও ঢেকে ফেলে। এ অবস্থায় পানিতে ডুব দিয়ে, "হুপ, হুপ, হুসসসসসস", "হুপ হুপ হুসসসস" এই রিদমে শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ত নিতে হবে।

কোনভাবেই লম্বাসময় শ্বাসবন্ধ রাখা যাবেনা, এবং খুব জোরেজোরে দ্রুত শ্বাস নেয়া যাবেনা। আমরা বেশ কয়েকবার চেষ্টা করলাম, পানির নীচে শ্বাসপ্রশ্বাস নিরন্তর চালিয়ে যাওয়া আসলেই কঠিন। কতক্ষণ পর এমনিই দম বন্ধ হয়ে আসতে। দম বন্ধ হয়ে আসলেই আমরা হুমড়ি খাওয়ার মতো করে পানির নীচ থেকে ভেসে উঠতে লাগলাম। শ্বাসপ্রশ্বাসের তুলনায় কানের চাপের ব্যাপারটা সহজ ছিল, কানে ব্যাথা টের পাওয়া যায়, তখন নাক চেপে ধরে গাল ফুলিয়ে বসে থাকলেই হয়; যাদুর মতো কানের ব্যাথা চলে যায়।

এটা রপ্ত করতে বেশী সময় লাগলনা। মিনিট দশেক অনুশীলন করে, আমরা তিনজন হাত ধরাধরি করে চলে গেলাম সাগরের নিচের জগতে। অদ্ভুত সুন্দর এই জগতটা, চারদিকে যেদিকে টাকাবেন দেখা যাবে নানারকমভাবে উঁচু নীচু হওয়া বালির স্তুপ, তার বুকে অসংখ্য রঙের শ্যাওলা । আর ভ্বেসে বেড়াচ্ছে অনেক অনেক রকমের মাছ আর সরু সরু নানারকম কীটপতঙ্গ। মিনিট দুয়েকও হয়নি, শ্বাসপ্রশ্বাসের ভারসাম্য হারিয়ে হড়বড় করে আমি উপরে ভেসে উঠলাম, মোনার হাত ধরা ছিল, মোনাও উঠে এলো।

আমাদের দূরাবস্থা দেখে জুনও ভেসে উঠল। তখন জুন বুঝতে পারল শ্বাসপ্রশ্বাসের রিদমটা ঠিকমতো রপ্ত করা হয়নি। আবারও অনুশীলন, "হুপ, হুপ, হুসসসস", "হুপ, হুপ, হুসসসসস"। আবারও আমরা পানির নীচে। কিন্তু এ দফা মিনিটখানেক যেতে না যেতেই দেখি মোনা ছিটকে উপরে উঠে গেল।

এভাবে উপরে ভেসে উঠলে সাধারণত পিঠ নীচের দিকে রেখে ভেসে উঠতে হয়, কিন্তু ভেসে উঠতে গিয়ে মোনার শরীর উল্টে যায়। ফলে বেচারী মুখ ডুবে যায় পানিতে। আমি ঝট করে ওর পেট চেপে ধরে ভাসি্যে তুলি, টেনে এনে দাঁড়ানো যায় এমন উচ্চতায় চলে যাই। জুনও ছুটে আসে। মোনার চেহারা দেখেই বুঝতে পারি ও ভীষন ভয় পেয়েছে, আমাকে বলল, "আর সম্ভব না"।

পরে জেনেছিলাম, খানিকটা পানি গিলে ফেলেছিল ও, তাই ভেবেছিল ডুবে যাচ্ছে, সেখান থেকে ট্রমার সৃষ্টি। তাছাড়া, শুরু থেকেই ঐ ভারী এয়ারট্যাংকের আইডিয়াটাই ও পছন্দ করেনি। আমি বুঝলাম, আর জোর করা উচিত হবেনা। ধরে নিয়ে গেলাম পাড়ের দিকে, সৈকতে উঠেই সবার আগে যেটা করল সেটা হলো এয়ারট্যাংকটা ধপাশ করে ফেলে দেয়া। বসে বসে দেখতে লাগল আমাদের স্কুবা অভিযান।

মন খারাপ হলেও আমি ভাবলাম আরেকটু দেখি। এখানেই প্রেমিক-প্রেমিকা আর স্বামী-স্ত্রীর পার্থক্য। আগের স্ট্যাটাসে থাকলে এই স্বার্থপরতার মাশুল আমাকে গুনতে হতো হয়ত হাড়ে হাড়ে, এখানে কিছুই হলোনা। টের পেলাম, আমিও এই স্বার্থপরতাটা তখন টের পাইনি, মোনাও কিছুই মনে করেনি। জুনকে নিয়ে আমি আবার চলে গেলাম সাগরের তলে।

সেই নানান রঙের সমুদ্রের জীব, মনে পরে গেল নিমো মুভিটি। নিমো টাইপের মাছও দেখা গেল, একটা মাছ দেখলাম একেবারে কুচকুচে কালো। আরেকটা মাছ মনে আছে কালো দেহের উপর শরীরের মাঝবরাবর হলুদ ডটডট দাগ। আরেকটা মনে রাখার মতো মাছ ছিল একদম গাঢ় নীল এক ঝাঁক মাছ। একটু পরে ঘোড়ার মুখের মতো অদ্ভুত মুখের কেঁচো টাইপের একটা পতঙ্গ ধরলাম, অনায়াসেই হাতে এলো।

কিছুক্ষণবাদে জুন আমার হাতে ধরিয়ে দিল একটা মাছ, বলল আঁজলির মধ্যে নিয়ে আঁজলীর আয়তন বাড়িয়ে দিতে। আমি আয়তন বাড়াচ্ছি, মাছ তার শরীর ফোলাচ্ছে, একদম আমার হাতের আঁজলী পুরোপুরি ভরে গেল! হ্যাঁ, এই সেই বিষাক্ত পটকা মাছ, আমি কি আর জানতাম তখন? জানলে জুনের বারোটা বাজিয়ে ফেলতাম, কোন সন্দেহ নেই। মিনিট পনের-বিশ সাগরের নীচে ঘোরাঘুরি করে আমরা তীরে ফিরে আসি। মোনা বলে, "তোমরা কোথায় হারিয়ে গেলা? আমি তো চিন্তায় পড়েছি তুমি ডুবে গেছ!" আমি বীর বেশে ফিরে আসার হাসি দিই। বহুদিনের পুরোনো একটা শখ, ভেঙেচুরে হলেও পূরণ হলো, সেটাই শান্তি।

পরের আবার জোর করে মোনাকেসহ স্কুবাডাইভিংয়ে যাব -- এঘোষনা অবশ্য আমি সেদিন সন্ধ্যায়ই দিয়ে রেখেছি, গিন্নীও কিছু বলেনি, মিটিমিটি হেসেছে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।