সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ...
[গীতি আরা নাসরীন ও ফাহমিদুল হকের বইমেলায় প্রকাশিতব্য 'বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প: সঙ্কটে জনসংস্কৃতি' শীর্ষক গ্রন্থের একটি অধ্যায়ের সিরিজ পোস্ট]
শূন্য দশকে এফডিসিকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র-শিল্পের রুগ্ণ দশার অবকাশে বেসরকারী টেলিভিশন চ্যানেলগুলো চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে আসে। তারা উন্নত চলচ্চিত্র প্রযোজনা করার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে, এবং চ্যানেল আইয়ের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইমপ্রেস টেলিফিল্ম এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছে। এটিএন বাংলা ও এনটিভিও কয়েকটি চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছে। সা¤প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র-ডিসকোর্সে টিভি-চ্যানেল প্রযোজিত চলচ্চিত্র একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হিসেবে হাজির হয়েছে।
টেলিভিশন-চ্যানেলের চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্টতা পৃথিবীর নানা দেশেই ঘটেছে।
মার্কিন চ্যানেল এইচবিও, যুক্তরাজ্যের চ্যানেল ফোর, ফ্রান্সের কানাল প্লুস, জার্মানির জিডিএফ, জাপানের এনএইচকে, অস্ট্রেলিয়ার এবিসি, কানাডার সিবিসি প্রত্য বা পরোভাবে চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে পরোক্ষ ভূমিকাই বেশি দেখা যায়। কোনো দেশের কোনো টেলিভিশন-প্রতিষ্ঠানই সরাসরিভাবে ও নিয়মিত চলচ্চিত্র-প্রযোজনায় যুক্ত হয়নি। উল্লিখিত চ্যানেলগুলো বরং, চলচ্চিত্রের স্বত্ব কিনে প্রদর্শন কিংবা নির্মাণের ক্ষেত্রে আর্থিক সহায়তা প্রদান, এই ধরনের ভূমিকা রেখেছে। ভারতের দূরদর্শন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিটি চলচ্চিত্র কিনে নিতে এবং তা প্রদর্শনে বাধ্য থাকে।
কিন্তু বাংলাদেশে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম নিয়মিতভাবে চলচ্চিত্র প্রযোজনায় যুক্ত হয়েছে। তাদের প্রযোজিত চলচ্চিত্র একাধারে টেলিভিশন ও প্রোগৃহে মুক্তি পেয়েছে। চলচ্চিত্র-শিল্পের দৈন্যদশার মধ্যে এই উদ্যোগকে অনেকেই সাধুবাদ জানিয়েছেন। মূলধারার অনেক নির্মাতা, যারা প্রায় অবসর নিয়ে ফেলেছিলেন, তারা পুনরায় চলচ্চিত্র নির্মাণের সুযোগ পেয়েছেন। স্বাধীন ও বিকল্পধারার অনেক নির্মাতা এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণে এগিয়ে এসেছেন এবং নিয়মিত হবার চেষ্টা করছেন।
কিন্তু টেলিভিশন-চ্যানেল প্রযোজিত চলচ্চিত্রগুলোর মান নিয়ে এবং সার্বিক চলচ্চিত্র-সংস্কৃতিতে এর অবদান নিয়ে অনেক প্রশ্ন উঠেছে। কারণ যে-প্রক্রিয়ায় এই চলচ্চিত্রগুলো নির্মিত হচ্ছে এবং যেভাবে এর প্রদর্শন-পরিবেশন হচ্ছে তা থেকে সার্বিক চলচ্চিত্র-শিল্পের উন্নয়নে কোনো বড়ো ভূমিকা চ্যানেলগুলো রাখতে পারছে না। কারণ এই চলচ্চিত্রগুলোর দর্শকনির্ভর নয়, কর্পোরেট পুঁজিনির্ভর। এই চলচ্চিত্রগুলোর প্রথম প্রিমিয়ার হয় টেলিভিশনে। সেই প্রিমিয়ারে বিজ্ঞাপনদাতাদের প্রদত্ত অর্থ পুঁজি ফেরত ও মুনাফাকে নিশ্চিত করে।
এরও আগে কোনো একটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আগাম অর্থ সংগ্রহ করা হয়, ফলে সেই প্রতিষ্ঠানের কোনো পণ্যকে চলচ্চিত্রটির ‘নিবেদক’ হিসেবে দেখানো হয়। কখনো কখনো কৌশলে চলচ্চিত্রের মধ্যে সেই পণ্যটির বিজ্ঞাপন প্রবিষ্ট করানো হয় । টিভি-প্রিমিয়ারের পর বলাকা বা স্টার সিনেপ্লেক্স-এর মতো ঢাকার দুয়েকটি প্রেক্ষাগৃহে ‘প্রতীকী মুক্তি’ দেয়া হয়। বৃহত্তর দর্শকের সঙ্গে এই চলচ্চিত্রগুলোর কোনো যোগাযোগ তৈরী হয়না, যতটুকু হয় তাও টিভি-প্রিমিয়ারের মাধ্যমে। কিন্তু বিজ্ঞাপনবিরতির কারণে টেলিভিশনে পুরো চলচ্চিত্রটি দেখে সমাপ্ত করা একটা অসম্ভব ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।
চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ টেলিভিশন-চ্যানেন প্রযোজিত চলচ্চিত্রগুলোর মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেন:
চলচ্চিত্রের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র হচ্ছে প্রোগৃহ। এখানেই জনগণের সাথে চলচ্চিত্রের প্রত্য যোগাযোগ। এখানেই দর্শকরা প্রতিটি টিকেটের শতকরা ৬০% টাকা শুল্ক কর দিয়ে চলচ্চিত্র-শিল্পের পৃষ্ঠপোষকতা করছে। ... দর্শককে যদি সিনেমা হলেই না আনা গেল -- সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি যদি চাঙ্গা না হলো -- তাহলে সেলুলয়েডে শুটিং করা কেন? বিজ্ঞাপনের টাকায় টিভি প্রিমিয়ারের মাধ্যমে বিনিয়োগ তুলে ফেলে একটি বা দুটি হলে প্রতীকী মুক্তি দিয়ে চলচ্চিত্র-শিল্পের আরাধ্য মুক্তি সম্ভব নয়। (মাসুদ, ২০০৬)
ইমপ্রেস টেলিফিল্মের মাধ্যমে মূলধারার চাষী নজরুল ইসলাম, শহীদুল ইসলাম খোকন কিংবা আমজাদ হোসেনের মতো নির্মাতারা যেমন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, তেমনি স্বাধীনধারার মোরশেদুল ইসলাম, আবু সাইয়ীদ, তৌকীর আহমেদ কিংবা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীসহ অনেকেই চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।
এই চলচ্চিত্রগুলোর মূল্যায়ন করতে গেলে বলা যায়, এক মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর 'ব্যাচেলর' (২০০৩) ছাড়া আর কোনো চলচ্চিত্রই ব্যববসায়িকভাবে সফল হয়নি বা প্রচুর দর্শককে সিনেমা হলে টানতে সম হয়নি।
ইমপ্রেস-প্রযোজিত চলচ্চিত্রগুলোর দর্শকবিযুক্ততার পাশাপাশি, বলা যায়, এগুলো চলচ্চিত্রমানেও উত্তীর্ণ নয়। পরিচালক আবু সাইয়ীদ সাাৎকারে ইমপ্রেসের চলচ্চিত্রগুলোর মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেন, ইমপ্রেসের ২৬টি ছবির মধ্যে ৬টি ছবির মান ভালো বলা যাবে। বাকী ২০টি ছবিই অতি সাধারণ মানের। অনেক বিখ্যাত পরিচালকই তাদের সঙ্গে কাজ করেছে, কিন্তু উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র বেরিয়ে আসেনি।
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন যে, তারা ‘প্রযোজক’-এর ভূমিকা পালন করছে না। তাদের নির্দিষ্ট কোনো ল্য নাই। তাদের মূল লক্ষ্য টিভি-প্রিমিয়ার এবং সেখানে প্রচারিত বিজ্ঞাপন থেকে মুনাফা নিশ্চিত করা। তারা যা প্রযোজনা করছে, তা না শৈল্পিক, না বাণিজ্যিক। তারা প্যাকেজ ডিল কায়দায় পুরো কাজটি করে, হয়তো তারা চলচ্চিত্রের কাহিনী পর্যন্ত জানেনা।
আবু সাইয়ীদ বর্ণিত ৬টি চলচ্চিত্রের মধ্যে কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পুরস্কৃত ও খ্যাত হয়েছে। যেমন আবু সাইয়ীদের 'নিরন্তর' (২০০৬), গোলাম রব্বানী বিপ্লবের 'স্বপ্নডানায়' (২০০৭) আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পুরস্কৃত হয়েছে এবং তৌকীর আহমেদের 'জয়যাত্রা' (২০০৫), এনামুল করিম নির্ঝরের 'আহা!' (২০০৭) দর্শক-সমালোচকের কাছে প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু ইমপ্রেস-প্রযোজিত এসব চলচ্চিত্র সীমিত পরিবেশনার কারণে দেশের দর্শকদের কাছে পৌঁছতে পারেনি। শূন্য দশকের সবচেয়ে ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে কোনোটিই ইমপ্রেস-প্রযোজিত নয়। মনের মাঝে তুমি (২০০৩), কোটি টাকার কাবিন (২০০৬), চাচ্চু (২০০৬), মোল্লা বাড়ির বউ (২০০৬), হৃদয়ের কথা (২০০৬), আমার প্রাণের স্বামী (২০০৭) -- এইসব ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রগুলো মূলধারার বিনোদননির্ভর সামাজিক-পারিবারিক ছবি হিসেবেই নির্মিত হয়েছে, পরিবেশিত-প্রদর্শিত হয়েছে।
জনসংস্কৃতি হিসেবে চলচ্চিত্রে ইমপ্রেসের চলচ্চিত্রগুলোর তেমন কোনো অবদান নেই, বরং এই চলচ্চিত্রগুলোর জনবিযুক্ততা প্রশ্নবোধক চিহ্ন আকারে রয়ে যাচ্ছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।