. বাউল সাধক লালন শাহ(১৭৭৪-১৮৯০) ছিলেন বাউল শ্রেষ্ঠ। তাঁর ব্যক্তি জীবন ঘাটলে জানা যায়, তিনি তীর্থযাত্রাকালে ব্যধিগ্রস্ত হয়ে নিজ স্বজন কতৃক পথে পরিত্যক্ত হন। পরে একটি মুসলিম পরিবারের সেবা পেয়ে সুস্থ হয়েও নিজ বাড়িতে ঠায় পাননি। সমাজ তাঁকে গ্রহণ করেনি। তাই মা, স্ত্রী, বিষয়-সম্পত্তি ত্যাগ করে এবং জাতপাত সংস্কারের স্বীকার হয়ে বৈরাগ্যের জীবন বেছে নিয়েছেন।
লালন একশতাব্দীর অথিককাল জীবিত থেকে সাধনা করেছেন। কুষ্টিয়া শহরের উপকণ্ঠে ছেঁড়ড়িয়ায় আখড়া নির্মাণ করে সাধনা শুরু করেন। জীবিত থাকা কালে তাঁর শিষ্য সংখ্যা ছিল প্রায় দুই লক্ষ্। রংপুরের রেয়াজুদ্দিন আহমদ- বাউল ধ্বংস ফৎওয়া- নামে দুই খণ্ড গ্রন্থ প্রকাশ করেন যথাক্রমে ১৯২৫(২য় খণ্ড) ও ১৯২৬ সালে। এই গ্রন্থে বাউলের সংখ্যা ৬০/৭০ লক্ষ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাউল একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়। সতের আঠার শতকে এদেশে এ সম্প্রদায়ের অভ্যুদয় হয়। এ সম্প্রদায়ের ধর্মমত লৌকিক। বাউল সাধনায় জ্ঞান, যোগ ও বামাচার-সবকটি ধারার মিশ্রণ আছে। বাউল যেমন দেহবাদী ধর্ম তেমনি গুরুবাদীও।
তাই গুরু ধরেই বাউল আধ্যাত্ন সাধনা, পরমাত্নার অন্বেষণ এবং জীবনের সকল প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করার সংগ্রাম করে। সাধন-সঙ্গিনী হিসাবে নারীর সংসর্গ এবং যোগ সাধনার অঙ্গ হিসাবে নারী-সম্ভোগ বাউল ধর্মে স্বীকৃতি পায়। তন্ত্রে বামাচারী যোগ-সাধনায় নারী-সম্ভোগের কথা আছে। সহজিয়া বৌদ্ধমতেও নর-নারীর দেহ মিলনকে ধর্মসাধনার সোপান রূপে গণ্য করা হয়। বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের বৈরাগী-বোষ্টমী একই ধারার অনুসারী।
বাউলরা আধ্যাত্ন প্রেমাস্বাদনের জন্য দেহজ প্রেমকে গ্রহণ করে যৌনাচরণে স্বাধীনতা নিয়ে আসে। যদিও প্রচলিত ধর্মশাস্ত্রে অর্থাৎ হিন্দু বা মুসলিম সম্প্রদায়ে বিবাহ-বন্ধনছাড়া নর-নারীর প্রেম, দেহমিলন সামাজিক ও নৈতিক দিক থেকে একেবারে নিষিদ্ধ। বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাউল ধর্মমতে নারী পণ্য নয়, পুতুলও নয়, সাধন সঙ্গিনী হিসাবে নারীকে গ্রহণ করে তারা নারীকে সামাজিক মর্যাদা দিয়েছে এবং নারী ব্যক্তিত্বের স্বীকৃতি পেয়েছে।
বাউল ধর্মমতের প্রবর্তক কে ? তা নিশ্চিত করে জানা বলা যায় না। তবে বাউল ধর্মমতে ও দর্শনে হিন্দু তান্ত্রিক, নাথযোগী, সুফি, বৈষ্ণব প্রভৃতি শাস্ত্রীয় ধর্মের প্রভাব রয়েছে।
বাউলগণ মনে করেন, দেহের মধ্যে আত্না আছে, বিশ্বের মধ্যে পরমাত্না আছেন। তাই দেহ খণ্ড, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড, ভাণ্ড-ব্রাহ্মাণ্ড তত্ত্ব বাউল ধর্মমতের তত্ত্ব। আর বাউল শ্রেষ্ঠ লালন শাহ এমতকে জনপ্রিয় করে তোলেন। সমাজের নিম্নবর্ণের ও পেশার তাঁতি, জোলা, যুগী, কৃষক শ্রেণীর দলছুট নরনারী স্বস্ব সমাজবন্ধন ত্যাগ করে বাউল হয়েছে। বাউলরা ভাবের পাগল অর্থাৎ তারা প্রেম-ভাবের পাগল।
তাদের ঈশ্বর হলেন -মনের মানুষ-,সোনার মানুষ কিংবা অচিন পাখি। তিনি কল্পিত স্বর্গলোকে বাস করেননা, মানুষের অর্ন্তলোকে বাস করেন। যা প্রেম-ভক্তির পথে দেহ সাধনার মাধ্যমে তাকে পাওয়া যায়। বাউলদের শ্রেষ্ঠ সম্পদ বাউলগান। এক লালন শাহই প্রায় দুই হাজারের বেশি গান রচনা করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ১৯২৫ সালে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন-মহাসভায় সভাপতির অভিভাষণে ফিলোসফি অফ আওয়ার পিপল- বিষয়ে এবং ১৯৩০ সালে বৃটেনের ফোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে হিবার্ট বক্তৃতায় -রিলিজিয়ন অফ ম্যান- বিষয়ে লিখিত ভাষণে বাউল ধর্ম, দর্শন ও গান সম্পর্কে কিছু কমপ্লিমেন্ট প্রদান করেন যা আজও স্মরণীয়।
বাউলরা মুক্তমন ও স্বাধীন চিন্তার অধিকারী ছিলেন। লালনের ভাষায়- মনের মধ্যে মনের মানুষ কর অন্বেষণ। তাই লালন জতির বিচার মানেননি; তিনি নিজেকে মানব জাতির একজন বলেই পরিচয় দিয়েছেন। আর এখানেই প্রতিফলিত হয় লালনের বিশ্বমানবতাবাদের দর্শন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।