আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

টমাসের ধ্যান



অন্ধকারে মৃদু আলোছায়ার খেলা। ঘরজুড়ে স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ। কালো রংয়ের অদ্ভুত মাকড়সাগুলোকে পায়চারি করছে। ইতস্তত ভাব। ভীত চাহনী।

বইয়ের র‌্যাকে নিপুণ হাতে কেউ ধূলো ছড়িয়ে দিয়েছে। তার ঠিক পাশেই আছে দরজাটা। দেয়ালে মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিকসের সঙ্গে প্রাচ্য কারুকাজের অদ্ভুত গোঁজামিল থাকলেও নকশায় সিমেট্রি আছে। মাধ্যাকর্ষণ নেই। মেঝের উপর ভেসে ভেসে দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

এখানে পৌঁছানোর আগে অতিকায় এক আলোকিত টানেল পেরিয়ে আসতে হয়েছে তাকে। তবে কান্তি বোধ করছেন না। সামান্য উত্তেজিত হতে পারেন। দরজা খোলার কায়দাটা ভেবেছিলেন পাল্টে দেবেন। কিন্তু এ স্তরে পৌঁছার পর বাস্তব অবাস্তবে মারাত্মক প্যাঁচ লেগে যায়।

নতুন কিছু ভাবতে গেলে পুরোটাই মাটি হয়ে যাওয়ার সমূহ আশঙ্কা। তাই পুরনো কৌশলেই গেলেন। আগেই চোখ বুঁজে ছিলেন। এবার কল্পনার 'আমি'টাকেও চোখ বুঁজতে বাধ্য করলেন। তারপর ধরে নিলেন দরজাটা খোলাই ছিল।

কল্পনার 'আমি' চোখ খুলল। দরজাটা খোলা। বাইরে কুয়াশা। তবে তাতে শীত নেই। থাকলে বিশেষ মুহূর্তটা মাটি হয়ে যেতে পারে।

মুহূর্তটা অনেক প্রতীতি। একটু পরেই দরজার বাইরে পা রাখবেন তিনি। পা রাখতেই ফিরে আসবে মাধ্যাকর্ষণ। ঘটে যেতে পারে বিশেষ ঘটনাটা। বাস্তব জগতের ফেভারও চলে আসতে পারে! আর একটু বাকি! কিন্তু একি! দরজার বাইরে কে দাঁড়িয়ে! অফিসের বসের মতো দেখতে! হ্যাঁ, বসই তো! 'দিস ইজ কমপ্লিটলি খামখেয়ালি! স্টুপিড! তোমাকে এখানে আসতে বলেছে কে!' বীকট কাল্পনিক চিৎকারে ধ্যানের প্রতিটি পরত ভেঙে খানখান।

এবার বাস্তব জগতেই চোখ খুললেন তিনি। 'এতদিন কোথায় ছিলেন? বরিশালের টমাস প্রবাল সেন?' প্রশ্নকর্তার দিকে এটেনশন টাইপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন টমাস। দুদিনের জায়গায় চারদিন ছুটি কাটানোয় বাড়তি দুদিন হয়ে গেছে 'এতোদিন'। প্রশ্নকর্তা আবারো বললেন, 'বসের কাছে বললে এখনই চাকরি নট। ' চোখে মধ্যযুগীয় হাসি।

টমাসের চাকরি এখন তার হাতের মুঠোয়। সেই তার রাকর্তা। অনেকে লিকলিকে বললেও নিজেকে টমাস বরাবরই মেদহীন সুপুরুষ ভেবে অভ্যস্ত। তার মতে, তিনি নিজেকে যা ভাবেন, তিনি মূলত তা'ই। এই কারণে প্রশ্নকর্তাকে মুহূর্তের মধ্যে অর্বাচীন ভেবে নিলেন টমাস।

মনে মনে ভাবলেন, 'যা ব্যাটা, তোর চাকরিতে আমার পাড়ার নেড়ি কুত্তা ইয়ে করে'। এটা মনের সবচে উপরের স্তুরের ভাবনা। ঠিক তার পরের স্তরটা বলল, 'কল্পনার জগতে খিদে কল্পনার বিষয়বস্তুর চেয়ে হাজার গুণ নগণ্য। কিন্তু বাস্তব জগতের খিদে বাস্তবতার চেয়েও ভয়াবহ। সুতরাং সাবধান, চাকরি ধরে রাখা চাই।

' টমাস প্রবাল সেন নিজেকে দার্শনিক মনে করার প্রয়োজন বোধ করেননি কখনও। ওসব ধ্যান ও কল্পনাপ্রসূত ভাবের কথাবার্তা তার কাছে স্বকীয়তার উপকরণ মনে হয়। এছাড়া, কাজের সময় নিজেকে কেবল একজন কম্পিউটার এক্সপার্ট ভাবতে পছন্দ করেন। সন্ধ্যের সময় কবি, রাতে প্রেমিক পুরুষ। একেক সময় নিজের একেক পরিচয়ে মোটেও আত্মশ্লাঘায় ভোগেন না টমাস।

কিন্তু গতরাতে ধ্যানের সেই বিশেষ মুহূর্তে কেন বসের ঝাড়ি শুনতে হলো তা নিয়ে খানিকটা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। যাই হোক, লক্ষ্মণ সুবিধের নয়। ওই বিশেষ স্তরে পৌঁছাতে কষ্ট হলেও তিনি আবার চেষ্টা করবেন বলে মনস্থির করলেন। কিন্তু হায়! মন না স্থির হলো, মগজের ভেতর স্মৃতির ইঁদুড় দৌড় তো আর বাধ সাধে না। আধ খাওয়া টমেটোর মতো লারা গোমেজের হাস্যজ্জ্বোল ঠোঁটদুটোই কেবল ঘুরেফিরে ঘুরপাক খায়।

মাঝে মাঝে সেই ঠোঁটের ফাঁক গলে বেরিয়ে আসতে চায় মফস্বল প্রতিনিধির পাঠানো পাঁচ হাত নিউজের ফ্যাক্স। নেপথ্যে চিৎকার, 'এখুনি কম্পোজ করে দাও!' আজকের রাতটা বিশেষ। ধ্যানের প্রস্তুতি নিতে হবে ঘণ্টার এককে। মিনিটে মিনিটে দৃশ্য পাল্টালে ছন্দপতন অনিবার্য। টমাস নিজেকে বললেন, 'মোর কনসেন্ট্রেশন, মোর... মোর...।

' চারপাশে মোমবেষ্টনি। এতে টমাসের স্থিরতা আসে। বৃত্তাকারে মোমের আগুনের হাল্কা আঁচ মনের ভেতর স্থির থাকার মৃদু সতর্কতা তৈরি করে। ঢলে পড়লেই ছ্যাঁকা খাওয়ার শঙ্কা। আজ কোনো স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে গেলেন না।

তার পরিবর্তে চারপাশে সাদার বন্যা তৈরি করলেন। চোখ ধাঁধানো নয়, চোখ মাতানো অফ-হোয়াইট রংয়ে ধ্যানের চার দেয়াল সাজালেন টমাস। মেঝেতে একটি ক্যানভাস। ক্যানভাসের ফ্রেম সাদা, স্ট্যান্ডও সাদা। তারপরও সাদার মাঝে সেটা হারিয়ে যায়নি।

টমাস তা স্পষ্টই দেখতে পেলেন। জীবনে কখনো হাতে তুলি না তুলে নিলেও কল্পনার সেই ক্যানভাসে দক্ষ পটুয়ার মতো ছবি আঁকা শুরু করলেন টমাস। বাঁ থেকে ডানে একটি উপবৃত্তাকার আঁচড় দিলেও ক্রমে তা বৃত্তচাপের মতো হয়ে গেল। কল্পনায় ছবি আঁকার এই এক সুবিধা। কোনরকম তুলি চালালেই হল।

স্ট্রোক নিখুঁত করার দায়িত্ব মনের। ছবি আঁকার ফাঁকে একটু ফ্যাশব্যাকে যাওয়া যাক। তরুণ বয়স পাড়ি দিলেও তখনও যৌবনে পা রাখেননি টমাস। মনের ভেতর অদ্ভুত এক বয়সের ভার। সঙ্গে প্রেমে পড়ার সদা জাগ্রত দায়িত্ববোধ।

ফ্যামিলি স্ট্যাটাস, আর্থিক সঙ্গতি, পড়াশোনা, দৈহিক গঠন, ইত্যাদি বিষয়কে ধ্রুবক বিবেচনা করে অর্থনীতির সূত্রের মতোই একদিন লারা গোমেজকে মনের কথা জানিয়েছিলেন টমাস। প্রেমও এক প্রকার বস্তু। তাই আইনস্টাইনের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন পূর্বক ই ইকুয়েল এমসি স্কয়ার সূত্র অনুযায়ী টমাসের প্রেমের ভেতর লুকিয়ে থাকা একরাশ শক্তি লারা গোমেজের মনকে ভীষণভাবে কাঁপিয়েছিল সেদিন। আকস্মিক দোলায় টমাসও ছিলেন মৃতপ্রায়। ধ্যানে বসার আগেই ধ্যানমগ্ন ছিলেন টমাস? বোধহয়! পেছনের একটা মোম ঠিকমতো বসাননি।

গলিত মোমের চাপে তা ক্রমশ একদিকে হেলে পড়ছে! তা যদি পড়েই যায়, তবে পাঞ্জাবীর পেছন দিকটায় নির্ঘাৎ...। লারার সঙ্গে প্রেমের চেয়েও গভীর একটা কিছু হয়ে গিয়েছিল টমাসের। কেননা, প্রেমের অনুভূতি কেমন হতে পারে তা প্রেমে পড়ার আগে টমাস একাধিকবার ভেবে রেখেছিলেন। দুটো অনুভূতির মাঝে কোনো মিল খুঁজে পাননি। দিনগুলোও কেমন যেন আহ্নিক গতিতে তালগোল পাকিয়ে ফেলছিল।

ধীরে ধীরে একপ্রকার সিম্বায়োটিক সম্পর্কের দিকে যাচ্ছিল দুটো মন। ছবিটা ক্রমশ স্পষ্টতর হয়ে উঠছে। টমাসের একাগ্রতা দেখে ধ্যানও লজ্জা পাবে। তবে রেখাগুলো বেশ নড়বড়ে। এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে।

একবার একেক চেহারা তৈরি করছে। উপন্যাসের চরিত্রের মতো ছবির রংও কি স্বাধীনতা পায়? অবশ্য টমাস চিত্রশিল্পী নন। তাই তুলির আঁচড় যেমনই হোক, অন্য সবাইকে ছাড়িয়ে লারার ছবিই ফুটে উঠছে ক্যানভাসে। শেষপর্যন্ত মোমটা ভার সইতে পারলো না। ছবি আঁকা শেষ।

ক্যানভাসে স্পষ্ট হাসছেন লারা গোমেজ। ধ্যানের ভেতর টমাসও হাসছেন। এবার সাদা ঘরের যেকোন এক দিকের দেয়ালে একটা ফোকর তৈরি করতে হবে। ফোকর তৈরি। বাইরে অবারিত সবুজ মাঠ।

মাঠ পেরোলেই কাঠের ছাদওলা একটা বাড়ি। বাড়ির ভেতর অপোয় লারা গোমেজ। আগুন এখনও পিঠ ছোঁয়নি। মোম গলে পড়ায় পাঞ্জাবীটা সলতে হিসেবে কাজ করছে। ধ্যানমগ্ন টমাস হাঁটছেন সবুজ মাঠে।

তাড়াহুড়ো নেই। লারা গোমেজ টমাসের ওপর কখনই রাগ করেননি। মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত তিনি টমাসের সঙ্গে হেসে হেসে ঝগড়া করেছিলেন। শুধু মৃত্যুর ক্ষণটায় খানিক নীরব থেকেছিলেন। বিদায় জানাতে গিয়ে মৃদু অভিমান জন্মেছিল হয়তো।

সবুজ ঘাসের নরম স্পর্শে পায়ে খানিক শিরশিরে অনুভূতি টের পেলেন টমাস। হুট করে মনে হলো সূর্যের তেজ বেড়ে গেছে। এমনটা তো হওয়ার কথা ছিল না! বাড়িটাও কেমন যেন দূরে সরে যাচ্ছে। বহুল প্রতীতি মুহূর্তটা এভাবে..। কিন্তু না! ঐ তো! স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন! চকোলেটের প্যাকেট হাতে টমাসকে ইশারায় ডাকছেন লারা গোমেজ।

হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলেন টমাস। আগুন এবার পিঠ ছুঁলো। সূর্যের তাপে টমাসের পিঠ পুড়ে যাচ্ছে। বাড়িটাও দূরে সরে যাচ্ছে। ধ্যানের ভেতরের টমাস হাঁপাচ্ছেন।

পা টলমলে। ভাবছেন, একি! উল্টো দিকে দৌড়াচ্ছি কেন! আবার ঘুরে দৌড়। একেক দফায় বাড়িটা যেন মাইলখানেক সরে যাচ্ছে। তবু লারা গোমেজের মুখ পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছেন টমাস। মৃত্যুর দীর্ঘ এক যুগ পর এই প্রথম লারাকে দেখে টমাস সেই প্রেম প্রেম অনুভূতি আবার টের পাচ্ছেন।

সূর্যের তাপে পিঠ পুড়ে ছাই প্রায়। টমাস তবু হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন না। লারা গোমেজকে সুদ্ধ বাড়িটা একবার কাছে এসে আবার যোজন যোজন দূরে সরে যাচ্ছে। বিশ দিন পর চোখ খুললেন টমাস। দৃষ্টিতে চাকরি বিষয়ক চিন্তা নেই।

আছে তৃপ্তি। হাসপাতালের কেবিনটাকে ফাইভ স্টার হোটেলের রুম মনে হলো। এমনটা মনে হওয়ার জন্য তাকে ধ্যানে বসতে হয়নি। আনন্দের ঢেউ তার চোখে মুখে প্রশান্তির বালি রেখে গেছে। অচেতন থাকায় ধ্যানমগ্ন হতে বিশেষ কষ্ট করতে হয়নি টমাসকে।

ব্যথানাশক ইনজেকশনের কল্যাণে অহেতুক ধ্যানভঙ্গ হয়নি। বেশ সময় নিয়েই এঁকেছিলেন লারা গোমেজের দ্বিতীয় ছবিটি। বাড়িটাও বেশ নতুনের মতো দেখাচ্ছিল। এবং খুব কাছে ছিল। দরজার বাইরে টমাস চুপচাপ দাঁড়িয়েছিলেন।

ওপাশ থেকে কেউ একজন বলেছিল, 'এমন পাগলামী করলে আর কখনও ঢুকতে দেবো না। '

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.