আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জাতিরাষ্ট্র, ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণ এবং সমসাময়িক বিশ্বব্যবস্থা প্রসঙ্গ



জাতিরাষ্ট্র, ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণ এবং সমসাময়িক বিশ্বব্যবস্থা প্রসঙ্গ জাতিরাষ্ট্রের উত্থান জাতিরাষ্ট্রের উত্থান আধুনিক প্রপঞ্চ। যা ইউরোপ উৎসারিত এবং মাত্র দুশো বছর আগে এই উত্থান পর্বের সুত্রপাত । প্রাথমিক দশায় কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের ভিত্তি ছিল তিন আন্ত:সম্পর্কিত প্রক্রিয়া: রাজনৈতিক ক্ষমতার ঘনীভবন, অর্থনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীভূতকরণ এবং সাংস্কৃতিক হেজিমনি। শক্তিশালী স্বপ্রত্যয়ী অভিজাততন্ত্র, বিশেষত বিশাল সামন্ততান্ত্রিক বিত্ত- বৈভবশালী ব্যক্তি, ভূসম্পত্তি যাদের শক্তিশালী আঞ্চলিক মতা সরবরাহ করেছিল, তাদের উপর রাজতান্ত্রিক প্রভূত্ব প্রতিষ্ঠা ছিল দীর্ঘ এক সংগ্রাম। ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠা নয়া রাজতন্ত্রের জন্য জরুরী হয়ে উঠে রাজ্যগুলোকে সামন্ততান্ত্রিক রাজনীতির প্রভাব মুক্ত করে পুনর্গঠনের যেন সেগুলোকে ব্যবহার করে সর্বোচ্চ পরিমান কর আদায় করা সম্ভব হয় (এন্ডারসন ১৯৭৩: অধ্যায় ১ এবং ২)।

কেন্দ্রীভূত কর ব্যবস্থার পত্তনের ফলে অর্থের উৎস সরাসরি রাজতন্ত্রের অধীনস্ত হয়ে পড়ে যার উপর ভর করে সামরিক শক্তির প্রসারন ঘটে। ‘ রাজপুত্রদের’, ম্যাকিয়াভেলী লিখেছেন, ‘ যুদ্ধ ব্যতিরেকে অন্যকিছু কখনোই ভাবনার প্রসঙ্গ কিংবা ল্য হওয়া উচিত নয়। সেনা ও নৌবাহিনী শুধু রোগমুক্তিকারক চৌম্বক সংগ্রহেই ব্যবহৃত হয়নি, আভ্যন্তরীন বাজারের সুরা ও বৈদেশিক বাণিজ্য বিস্তারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সম্প্রসারনও ঘটিয়েছে। কেন্দ্রীভূত রাজতন্ত্রে সকলকিছুর ঘনীভবন সাংস্কৃতিকভাবেও, অন্যান্য প্রাদেশিক সংস্কৃতির উপর আধিপত্য তৈরী করে; যেমন প্যারিস সন্নিকটস্থ এজল ডি ফ্রান্সের লোকভাষার ‘জাতীয়’ ভাষা ‘ফরাসীতে রুপান্তরণ ঘটে এবং পূর্ব মধ্য ভূভাগের ভাষা ‘আদর্শ’ ইংরেজী’ তৈরী করে। কিন্তু সাংস্কৃতিক আদর্শকীকরন নিরঙ্কুশ রাজতন্ত্রে অর্জিত হয়নি।

এন্ডারসনের মন্তব্য হলো: ‘জাতীয়তাবাদের মতাদর্শীক প্রত্যয়ন সদ্যপ্রসুত নিরঙ্কুশতন্ত্রের তখনো পর্যন্ত অজানা ছিল’ (এন্ডারসন, ১৯৭৩)। বুর্জোয়ারাই ছিল নিরঙ্কুশ শাসকদের তৈরী কেন্দ্রীভূত রাজনীতির উত্তরাধিকার যারা শিল্পভিত্তিক সমাজের চাহিদা এবং নাগরিকদের রাষ্ট্রের সাথে যুক্ত করার প্রয়োজনে (গেলনার, ১৯৮৩) জাতীয় শিা ব্যবস্থা তৈরী করে - পরবর্তীতে যা বাকী দুনিয়ায় রপ্তানী করা হয় । ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক সম্প্রসারনকালে অইউরোপীয় রাজনীতি সম্প্রসারনকালে যেসকল সমাজের মুখোমুখি ইউরোপ হচ্ছিল সেগুলো ছিল বৈচিত্রপূর্ণ, ক্যারিবীয় অঞ্চলে কলম্বাসের পাওয়া ‘রাষ্ট্রবিহীন’ সমাজগুলো যেমন, তেমনি ছিল তুরস্ক বা চীনের মত বিশাল সাম্রাজ্য। শেষোক্তটি আকৃতি এবং সম্পদ দু বিবেচনাতেই ছিল যেকোন ইউরোপীয় রাষ্ট্রের চেয়ে অনেক বিশাল। যখন এলিজাবেথ উত্তরাধীকার সূত্রে পাওয়া রাজ্যের মাত্র ৫ মিলিয়ন অধিবাসীর সম্রাজ্ঞী তখন ৫০ মিলিয়ন শাসিতের শাসক অটোম্যানদের তুলনায় ইউরোপের অধ:স্তনতা ছিল জোজুল্যমাণ: ১৯৬৬ তে ফরাসী রাজদূত অটোম্যান দরবারের মূখ্য উজির কর্তৃক আখ্যায়িত হয়েছিলেন ‘অবিশ্বাসী’ ‘লোভী’ ‘কুকুর’ ‘বিষ্ঠা খাদক’ হিসেবে।

এরও পঞ্চাশ বছর পরে ফোর্ট উইলিয়াম (কলকাতা) এর প্রশাসক অলিভার ক্রমওয়েলস গর্ডন মোঘল সম্রাটের দরবাওে অভিবাদন জানিয়েছিলেন এভাবে ‘দাসের তরফ থেকে গভীর শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন’ (ষ্টেব্রিয়ানোস ১৯৮১:১৫৭) প্রযুক্তিগত দিক থেকেও বৃহৎ জাহাজ শিল্প থেকে পরিশীলিত বস্ত্র কারখানা অব্দি সমপ্রসারিত এশীয় অর্থনীতিসমুহের উপর ইউরোপের কোন আধিপত্য ছিলনা। সামরিক উপকরনাদিতে শ্রেষ্ঠত্ব ইউরোপকে আজটেক ও ইনকা সাম্রাজ্য বিজয়ী কওে এবং সমুদ্রে শ্রেষ্ঠত্ব এবং নৌ কৌশল তাদেরকে ছোট বাণিজ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় কামিয়াব কওে তোলে। তাসত্বেও ভাস্কো দা গামার আড়াইশ বছরের মধ্যেও এদেরকে ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরেই রাখা সম্ভব হয়েছিল। এমনকি নিজেদের স্বর্ণ সময়েও এশীয়ায় পর্তুগীজরা ছিল এশীয়ার আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য, যেখানে ইউরোপীয় পণ্য ছিল একেবারেই গুরুত্বহীণ, তার নিছকই এক মধ্যস্বত্তভোগী দালাল। (ষ্টেব্রিয়ানোস ১৯৮১: ১৫৮, ২৩০, ভ্যান লিওয়ার, ১৯৫৫:২৮১) এশিয়া একইসাথে সেই কেন্দ্র যা থেকে উৎসারিত প্রধান ‘বিশ্বধর্ম’গুলো সংলগ্ন অঞ্চলসমুহ অব্দি পৌছে : হিন্দুত্ববাদ দণি ভারত এবং দণিপূর্ব ভারত পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়; বৌদ্ধধর্ম উত্তর ভারত থেকে ক্রমশ দেিণ, খৃষ্টের জন্মের কয়েকশত বর্ষ আগেই এটি আজকের শ্রীলঙ্কাতে (গইজার, ১৯৮৬, গুনাওয়ার্ডানা, ১৯৭৯), এবং একইসাথে দণিদিকে হিমালয় অঞ্চল, চীন এবং উপমহাদেশের দণি ও পূর্বদিকের দেশগুলোতে বিস্তার লাভ করে।

কোরিয়া, জাপান এবং ইন্দোচীনের উপর চীনের আধিপত্য ছিল রাজনৈতিক, এবং একইসাথে সাংস্কৃতিক। এই দেশগুলোতে ধর্মীয় ‘গ্রেট ট্রেডিশন’ এর বিকাশ যত প্রবল ছিল, ততই তীব্র ছিল ইউরোপীয় সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ (টাম্বিয়া, ১৯৭০)। ইউরোপীয় অভিঘাতে আসা সমাজগুলোর প্রতিটিই ইতিমেেধ্যই রাষ্ট্র হয়ে উঠেছিল তা নয় , ছিল বিশাল সাম্রাজ্য ছিল এমন নয়। অনেক দেশই ওয়েবারের ‘যৌক্তিক- আইনী’ আদর্শ ধাচের ছিলনা, আমাজান বিধৌত দণি আমেরিকা এবং দৃশ্যত পুরো উত্তর আমেরিকা সেই সাথে অস্ট্রেলিয়া এবং বিশ্বের অন্যান্য অংশ এমন সমাজ গুলোর অন্তর্ভুক্ত ছিল যাদের কোণো রাষ্ট্রযন্ত্র ছিল না। ‘রাষ্ট্রবিহীন’ সমাজগুলোর সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানাাদি ছিল বৈচিত্র পূর্ণ।

চীফ এবং উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া স্বৈরতন্ত্র যেমন ছিল তেমনি ছিল দাসসমাজ, একই সাথে ছিল এমন সমাজ গুলো যেখানে বয়স এবং লিঙ্গীয় পরিচয় ছিল মর্যাদা পদবী এবং কর্তৃত্বের নির্ধারক (৩৪ নম্বর প্রবন্ধ দেখুন)। এই ধরনের সমাজগুলোকে অনেক েেত্র আখ্যায়িত করা হয়েছে ট্রাইব অথবা ব্যান্ড হিসেবে এবং এরা মূলত কৃষিভিত্তিক এবং শিকারীসমাজ। এই ধরনের উপাধি মানুষজনের মধ্যকার ভিন্নতা অগ্রাহ্য করেছে। ‘রাষ্ট্রবিহীন’ প্রত্যয় হিসেবে নেতিবাচক, অবশিষ্ট এক বর্গ, যা আমাদের দেখায় কি এই সমাজগুলো নয়। এদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য গুলোকে ইতিবাচক উপাধি দেয়ার চেষ্টায় উলফ এই সমাজগুলোকে আখ্যাায়িত করে জ্ঞাতিসম্পর্ক ভিত্তিক উৎপাদন পদ্ধতি হিসেবে।

(উলফ ১৯৮২, ৮৮-১০০)। জ্ঞাতিসম্পর্ক ব্যবস্থার ধরন বিবিধ; জ্ঞাাতিসম্পর্ক সকল রাষ্ট্রবিহীন সমাজে সমান গুরুত্বপূর্ণ যেমন নয় তেমনি ভূমিকাও একই নয়। কিন্তু তা স্বত্ত্বেও সব সমাজেই বংশানুক্রম এবং বিয়ে নিয়ন্ত্রণে ব্যবহৃত হয়েছে, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মতার বিস্তারনেও প্রভাব রেখেছে। এই মানুষদের বস্তুগত উপকরনাদি এবং ধর্মীয় বিশ্বাস ব্যবস্থা ছিল সমৃদ্ধ ও জটিল এবং প্রতিবেশ বিশেষ করে যে উদ্ভিদ ও প্রাণীকূলের উপর তারা নির্ভরশীল সেসব সম্পর্কে তাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞান ছিল বিস্তৃত এবং বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে সংগঠিত। (ওয়াডি,১৯৮৮). এ সমাজগুলোতে বস্তু কিংবা সম্পদ নয় বরং সবচে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক সম্পদ ছিল মানুষ ও জ্ঞান, তাদের শ্রমশক্তি, তাদের দতা, এবং নারীদের েেত্র সন্তান পুনরুৎপাদন স্বমতা।

তারা উনবিংশ শতাব্দীর জাতিতত্ববিদ বর্ণিত ‘আদিম সমাজ’ ছিলনা: সমাজগুলোতে প্রাতিষ্ঠানিক স্তরাঢণ ছিল, বিশেষ কওে লিঙ্গীয় পার্থক্য ও বয়স, এগুলো প্রজন্মেও পর প্রজন্ম ধরে চলে এসেছে । অসমতা ছিল ভূমির আদি বসতিস্থাপনকারী এবং নতুন বসতিস্থাপণকারীদেও মধ্যে, বয়োজেষ্ঠ ও কনিষ্ঠদের মধ্যেও (৩৭ নম্বর প্রবন্ধ দেখুন)। রাজা, চীফ কিংবা বিশেষায়িত সামরিক বাহিনী না থাকলেও রাষ্ট্রবিহীন এই মানুষেরা নিজেরা সংগঠিত হতে পারতো, প্রতিরোধ করতে পারতো এবং একই সাথে এরা প্রতিবেশীদের উপর আগ্রাসনও চালাতো। নুয়ারভূমিতে বৃশি ঔপনিবেশিক শক্তির আগমনের সময় ধর্মীয় নেতৃত্বই বিশাল এক জনতাকে সংগঠিত করেছিল। একইভাবে মেলিনেসিয়াতে ব্যক্তিরা ও সম্প্রদায়গুলো এমন এক ধর্মীয় নেতৃত্বে বিশ্বাস স্থাপন করেছিল যার বক্তব্য ছিল এমন এক সময় আসবে যখন ্ংরেজরা পরাজিত হবে এবং তাদেও যাবতীয় সম্পদ স্থানীয় অধিবাসীদেও কাছে পৌছবে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।