জাহাঙ্গীর আলী
এটা একটা আত্মজৈবনিক রচনার খন্ডিত গল্পাংশ
হায়ানার থাবা
তখন ও শহরে মানুষের মন্বন্তর কাটেনি। শহর ছাড়াগুলি দ্বিধাগ্রস্থ বিচলিত। এরই মধ্যে গ্রামের পাট-চুকিয়ে নিজ বাসস্থানে চলে এসেছি বটে, কিন্তু শহরের জনশুন্যতায় আমিও চিন্তিত। চেনে মুখগুলিকে খুঁজে পাওয়া যায়না। কেমন যেন নিঃসঙ্গ একা একা মনে হয়।
বিকালের আগেই চারিদিকে নির্জনতা নেমে আসে। সন্ধ্যায় সারা শহরকে ভূতুড়ে শহর বলে মনে হয়। সরকার বার বার রেডিও টিভিতে নানারকম আশ্বাস দিলেও তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।
ক্রমে জনসংখ্যা কিছুটা উন্নতি হলেও স্বাভাবিক বলা যায় না। এরই মধ্যে একদিন খবর ছড়িয়ে পড়লো রাজশাহী ন্যাপের সভাপতি এডভোকেট আতাউর রহমানকে মিলিটারী ধরে নিয়ে গেছে।
তিনি রাজশাহী তথা এতদঞ্চলের পরিচিত ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব সাহসী ও সৎ রাজনৈতিক নেতা। ভীষণ অসুস্থ অবস্থায় নিজ বাড়ীতে অবস্থান করছিলেন। এই অবস্থায় মিলিটারীরা তাকে ধরে নিয়ে যায়। সম্ভবত অসুস্থতার কারনে অল্প দিনের মধ্যেই ছাড়া পেলেন বটে, তবে নিজ গৃহে নজরবন্দি অবস্থায় থাকলেন। কারো সাথে দেখা করা বা কোথাও যাওয়া একেবারে নিষেধ।
উনি ছোট চাচার বাল্যবন্ধু আমাদের পরিবারের আপনজন। (দেশ স্বাধীনের পর রাজশাহী জেলা গভর্নর হয়েছিলেন। ) আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আমি তার রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারি ছিলাম।
একদিন চুপি চুপি তার সঙ্গে দেখা করতে গেলে ভূত দেখার মত আঁতকে উঠে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললেন-কোন সাহসে তুমি এভাবে চলাফেরা করছো? তোমার প্রাণের কি একটুও মায়া নেই? আমাকে তো ওরা জিন্দা ছেড়েছে, তোমার লাশও কেউ খুঁজে পাবে না।
তিনি আমার সমস্ত ঘটনাই জানেন বলে মনে হলো।
বললাম-সাত্তার সাহেব (সাত্তার ব্রাদার্স এর মালিক আমার দলের একজন, বর্তমানে মৃত) ভারত থেকে প্রায়ই চিঠিতে ডেকে পাঠাচ্ছেন আমার নিরাপত্তার জন্য। কিন্তু আমি বলে দিয়েছি এদেশ ছেড়ে কোথাও যাবনা- মরতে হলে দেশের মাটিতেই মরবো। সবাই ভারত চলে গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য সহযোগিতা-আশ্রয়ের ব্যবস্থা করবে কে?তবুও তিনি আমার জন্য খুবই উদ্বেগ প্রকাশ করে সাবধানে থাকতে বারবার উপদেশ দিলেন এবং যোগাযোগ রাখতে বললেন।
গা ঢাকা দিয়ে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছিলাম, তাই ক দিন একটু চিন্তামুক্ত থাকবো এবং রাজধানীর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করবো বলে জুলাই মাসে ঢাকার উদ্দেশ্যে চুপিচুপি রওয়ানা দিলাম।
সে সময় ঢাকার সঙ্গে সরাসরি কোন বাস সার্ভিস ছিল না, নগরবাড়ী থেকে ফেরি পার হয়ে আরিচায় গিয়ে কোন বাস ধরে ঢাকা যেতে হতো। যে বাসটিতে চলেছি দেখি অধিকাংশ যাত্রীই বিহারী, ওদের দাপটেই অস্থির। ভয়ে ভয়ে চলেছি কখন ওরা কি করে বসে।
রাস্তায় রাস্তায় সেনা-তল্লাশী, ভয়ংকর পরিবেশ। এমনই এক তল্লাশী ফাঁড়ীতে কাকতালীও ভাবে দেখা হয়ে গেল জামান সাহেবের সঙ্গে।
আমাদের একজন গোড়া সমর্থক। ওকে দেখে একটু বল পেলাম। এতক্ষণ একই বাসে চলেছি অথচ কেউ কাউকে খেয়াল করিনি। নিচু গলায় বললেন- এ মহাদুর্যোগের মধ্যে কোথায় চলেছেন আলী সাহেব?
ঢাকা যাচ্ছি শুনে অনেকটা শাসনের সুরে বললেন, বাড়ী থেকে না বের হলে কি চলছিলো না।
মিথ্যে করে বললাম- ভাই, ঢাকায় একটু বিশেষ কাজ আছে।
আপনাকে পেয়ে কি যে ভালো লাগছে বুঝাতে পারছিনা।
এরই মধ্যে এক মজার কান্ড ঘটে গেল, এক তল্লাশী ফাঁড়িতে কয়েকজন বিহারী যুবককে পাক-সেনারা বাস থেকে নামিয়ে নিয়ে গেল, অনেক তর্কাতর্কি চেঁচামেচি করেও কোন ফল হলো না। আত্বীয়-স্বজনদের কান্নাকাটি ও আহাজারি থেকে জানি গেল ওরা নাকি ইপক্যাপের সদস্য। বর্তমান বিডিআরএর পাকিস্তানী নাম ছিল ই.পি.আর। এর অধিকাংশ জোয়ান ছিল বাঙালি।
পাক সেনাদের পরিকল্পিত আক্রমনে অনেকে নিহত হলে বাকিরা পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। পাক সরকার এদেশের রিফিউজি যুবক দ্বারা (যারা ওদের বিশ্বস্ত বশংবদ) সংস্থাটি পূনর্গঠন করে এর নাম রাখে ইপক্যাফ। ইপক্যাফএর নওজোয়ানরা বাংলাদেশের ধনসম্পদ লুটপাট করে আরাম আয়েশ ও নিরাপত্তার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে (বর্তমান পাকিস্তান) পালিয়ে যাচ্ছে। এধরনের খবর পেয়ে ওই লুটেরা পলাতকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে।
এত অঘটনের পরেও পাক বাহিনীর এ উদ্দ্যোগকে সাধুবাদ না জানিয়ে পারলাম না।
জামান সাহেব এ লাইনে অভিজ্ঞ মানুষ কিন্তু আজকের এই বিহারী ধরে নিয়ে যাওয়া দৃশ্যটা তার কাছেও কেমন যেন আজগুবী ব্যাপার মনে হল। এ দেশের বিহারী সম্প্রদায়ই তো ওদের প্রধান হাতিয়ার। বিশ্বস্ত বন্ধু। অথচ তাদের গায়েই হাত! নগরবাড়ী পার হয়ে যখন আরিচায় পৌছলাম তখন বেলা দুপুর।
ঢাকায় পৌঁছে বাস থেকে নেমে রিকসায় চড়ে নবাবপুরে জামান সাহেবের পরিচিত দিলসাদ হোটেলের দিকে যখন এগুতে থাকলাম।
দেখি রাস্তাঘাট কেমন যেন ফাঁকা মানুষের মধ্যে একটা আতংকের ভাব। জামান সাহেব নিজে নিজেই বলেন এরকম অবস্থাতো সাধারনত দেখা যায় না। যা হোক হোটেলে পৌঁছা মাত্র ম্যানেজার সাহেব দৌড়ে এসে জানতে চাইলেন,আমরা কোন পথ দিয়ে এলাম।
জানার পর আঁৎকে উঠে বললেন, সাংঘাতিক বাঁচা বেঁচে গেছেন। কিছুক্ষণ আগে মুক্তিবাহিনী অপারেশন করেছে।
মিলিটারিরা ভীষন ক্ষীপ্ত, এলাকা জুড়ে ধরকাপড় শুরু করেছে। দেরি না করে উপরে আমাদের জন্য রুম ঠিক করে হুঁশিয়ারী দিয়ে বললেন, এখুনি হোটেল তল্লাশী হবে। কোন ক্রমেই যেন বাইরে পা না দিই। এত আতংকের মধ্যেও আমাদের মুক্তিবাহিনীর কৃতিত্বে মনটা আনন্দে নেচে উঠল।
সারাদিনের ধকল।
পেটে নাই দানাপানি,কাহিল অবস্থা। জামা পাপড় ছেড়ে লম্বা হয়ে বিছেনায় শুয়ে কড়িকাঠ গুঞ্ছি আর ভাবছি এত রিস্কের মধ্যে না এলেই ভাল করতাম। জামান সাহেব তখন ঠিকই বলেছিলেন,প্রানটা নিয়ে এখন বাড়ি ফেরা দায়!
হঠাৎ দরজায় ভারী আঘাতে চমকে উঠে দুজনে একে অপরের দিকে আতংকিত চোখে তাকাতে থাকি। আঘাতের বহর বাড়তে গলা শুকিয়ে কাঠ, বাঁচার বুঝি আর কোন আশা নেই। যমদুত একেবারে দোরগড়ায়।
জামান সাহেব ফ্যাকাসে মুখে জানতে চাইলেন,কে? কন উত্তর নেই। আবারও ধাক্কা। জামান সাহেব এবারে আমাকে একটু আড়ালে যেতে ইংগিত দিয়ে খুব আস্তে দরজা খুললেন-
স্যার আর কোন ভয় নেই,জল্লাদরা তল্লাশী সেরে চলে গেছে। কথাগুলো শুনে ‘যেন ধড়ে প্রান এলো’। জামান সাহেব একটা কড়া ধমক দিয়ে বললেন-
ব্যাটা যা ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি।
বয়টি একগাল হেসে বললো, ম্যানেজার সাহেব আপনাদের খাবারের ব্যাবস্থা করতে পাঠালেন। রাতের খাবারটা ওর মাধ্যমে সেরে বিছানায় গা গড়ালাম।
জামান সাহেব সিগারেটে টান দিতে দিতে বললেন, ঢাকায় যে কদিন থাকেন, এখানেই থাকবেন,ম্যানেজার সাহেবকে বলে যাবো, ও আমার খুব বিশ্বস্ত লোক অসুবিধা হবে না। বললাম, ঢাকায় যে অবস্থা দেখছি,থাকার ইচ্ছা আর নাই, মরলে রাজশাহীতেই মরবো, তবুও লাশটা অন্ততঃ আত্বীয় –স্বজনরা পাবে, এখানে বেওয়ারিশ হয়ে কুকুর-শিয়ালের খোরাক হতে চাইনা, আপনার সঙ্গেই ফিরব।
কিন্তু আপনার কাজের কি হবে?
বললাম, ও পরে দেখা যাবে।
একদিন পরেই তার সঙ্গে ঢাকা ত্যাগ করলাম। পথের তল্লাশী শেষ করে আরিচা ঘাটে পৌছে প্রথমে যে দৃশ্যটি চোখে পড়লো, সঙ্গে সঙ্গে মনটা বিদ্রোহী হয়ে উঠলো। হাতে একটা গ্রেনেড বা স্টেন থাকলে এক্ষুণি একটা হেস্ত নেস্থ করে ফেলতাম। দেখি পেছনে হাত বাঁধা চোখে কালো পট্টি, একদল বাঙ্গালি যুবককে ট্রাকে করে নিয়ে চলেছে কোন বধ্য ভূমিতে। কসাইরা যেমন গরু-ছাগল জবাই করতে কসাইখানায় নিয়ে যায়।
ঐ যুবকগুলির মানসিক অবস্থা চিন্তা করে কিছুতেই স্থির থাকতে পারছিলাম না। বারবার বিদ্রোহী হয়ে উঠছিলো মনটা। এরই মধ্যে ফেরি পার হয়ে কখন যে নগরবাড়ী পৌছে গেছি টের পাইনি।
জামান সাহেবের ডাকে স্বম্বিত ফিরে পেয়ে দেখি মধ্যাহ্ন বেলা। স্ট্যান্ডে মাত্র একটি বাস দাঁড়িয়ে রয়েছে-তাড়াতাড়ি আমরা ঐ বাসড়িতেই চেপে বসলাম, কেননা এর পর রাজশাহী ফিরার আর কোন উপায় নেই।
জামান সাহেব সিগারেটে টান দিতে দিতে আয়াশের ভঙ্গিতে বললেন-
এবারই প্রথম ঢাকায় যেতে এবং আসতে আমাদের বাসের কোন বাঙ্গালীকে মিলিটারিরা নামিয়ে নেয়নি। এমনটি কিন্তু এর পূর্বে কখনও ঘটেনি।
বললাম,ভাই স্বস্থির অবকাশ নেই,পাড়ি দিতে এখনও অনেক পথ বাকি।
বললেন, -না ইনশাল্লাহ আর কোন ভয় নাই।
তার কথা শেষ না হতেই এক তল্লাশী ফাঁড়িতে নামার নির্দেশ এলো,ব্যাগ হাতে সবাই নেমে লাইন দিয়ে দাঁড়ালাম।
একজন সেনা আমাদের দিকে রাইফেল তাক করে রয়েছে,অপরজন তল্লাশীতে ব্যস্ত। দুজনেই যুবক তবে তল্লাশীরত যুবকটি বেশ হ্যান্ডসাম,নায়কের মত চেহারা। একটু-আধটু ইংরাজীও জানে। আমি ওর সুন্দর মুখের দিকে চেয়ে চিন্তা করছি,এত সুন্দর একজন যুবক কি করে মানুষ হত্যা করতে পারে। ইতিমধ্যে ও আমার কাছে এসে আমাকে খুব ভালো করে আপাদ-মস্তক পর্যবেক্ষণ করে ওর জবানীতে বললো-
তোম ঠাইরো! (তুমি দাঁড়াও)।
কথাটা শুনে পিলে চমকে উঠলো,তাহলে এবার বুঝি আমার পালা। কেন বোকার মত ওর মুখের দিকে চেয়ে ছিলাম, ও নিশ্চয় অন্য কিছু সন্দেহ করেছে। বোকামির জন্য নিজেকেই ধিক্কার দিলাম। তল্লাশী শেষে সবাইকে বাসে উঠার হুকুম দিলো। শুধু আমি একা দাঁড়িয়ে রইলাম।
ভয়ার্ত যাত্রীরা ধীরে ধীরে বাসের দিকে এগুচ্ছে। আর করুনার দৃস্টি মেলে আমাকে শেষ দেখা দেখে নিচ্ছে। জামান সাহেবকে একেবারে ফ্যাকাসে রক্তশূন্য হলুদ দেখাচ্ছে।
এ অবস্থায় খুব ক্ষীণ কন্ঠে তাকে বললাম, ভাই দয়া করে বাড়ীতে সংবাদটা পৌছে দিবেন, আমার ওয়ারিশানরা অন্ততপক্ষে জানতে পারবে, পাক-জল্লাদরা আমাকে এখানে লাশ বানিয়েছিল। জামান সাহেব চোখ বন্ধ করে কি যেন বলার চেস্টা করলেন, কিন্তু বুঝতে পারলাম না।
ধীরে ধীরে সবাই উঠার পর অনেকটা হতাশার সুরে ওদের জবানীতে বললাম,
এরপরে তো আর কোন বাস নেই আমি যাবো কিভাবে ?
আমার কথাটা বুঝতে পেরে ওদের একজন হাসতে হাসতে উত্তর দিলো, ফিকির মাত করো, তোমকো ঘরমে ভেজ দেগা (চিন্তা করোনা তোমাকে বাড়ী পাঠিয়ে দেব)।
হাতের ইশারায় বাস ছাড়ার হুকুম দিলো। বাস্টি অতি মন্থর গতিতে গড়াতে শুরু করেছে। দেখে মনে হচ্ছে আমাকে ফেলে রেখে যেতে ওরও ভীষণ কস্ট হচ্ছে। বাসের সব যাত্রীর দৃস্টি আমার দিকে নিবন্ধ।
বাঁচার আর যখন কোন আশাই নেই শেষ চেস্টা করে দেখি না কি হয়। স্কুল জীবনে শেখা ঐ চ্ছিক বিষয় উর্দু জবানটা-কাজে আসে কিনা। খুব বিনয়ের সঙ্গে, তোয়াজের ভঙ্গিতে একজনকে বললাম-(সেই সুন্দর মুখো যুবকটিকে) আপতো বহুত শরীফ আওর ঈমানদার আদমী মালুম হোতা হ্যায়। আউর এলেমভি জানতাহ্যায় ( আপনি তো খুব ভদ্র এবং লেখাপড়ার মানুষ) কথাগুলি শুনে কৌতুহলী দৃস্টি মেলে আমাকে দেখলো।
আবারও বললাম- হাম মুসলমান হ্যায়, গভরমেন্ট অফিসার হো, ঢাকা মে কামকে লিয়ে গিয়াথা আভি রাজশাহী ফিরতা।
( আমি মুসলমান, সরকারী অফিসার ঢাকায় কাজে গিয়াছিলাম এখন রাজশাহী ফিরছি) আমার দিকে তীর্যক দৃস্টিতে তাকিয়ে সেনাটি বললো,
সাচ তোম মুসলমান হো, গভরমেন্ট অফিসার হো! (তুমি সত্যি কি মুসলমান; একজন সরকারী অফিসার)।
তড়িঘড়ি উত্তর দিলাম, জরুর হাম সাচ্চা মুসলমান হো। ( হ্যাঁ, সত্যিই আমি মুসলমান)।
আমার আইডেনটিটি কার্ডটা আবারও পড়তে শুরু করলো, যেটা এতোক্ষণ ওর হাতেই ছিলো, ভাঙ্গা ভাঙ্গা উচ্চারণে বললো, -জা-র-জি-স আ.....
ওর কথা শেষ না হতেই চেঁচিয়ে বললাম, হাঁ, হাঁ ওহি হ্যায় ( হ্যা ওটাই)। যদিও ওটা আমার নাম নয় ও পড়তে ভুল করছে।
এবারে আরো যাচাই এর জন্য আমাকে কালেমা পড়তে বললো। তারপর দুহাতের কনুই,দু’পায়ের হাঁটুর কাপড় তুলে খুব ভালো করে পরখ করলো। শেষে কিছুটা প্রসন্ন মুখে বললো,-
ঠিক হ্যায়, আপ যাইগে, (ঠিক আছে আপনি যান) বলে আমাদের চলন্ত বাসটিকে হাত উঠিয়ে থামার ইঙ্গিত দিলো। হঠাৎ ওর তোম থেকে আপে প্রমোশনে আমার কেমন যেন সন্দেহ হলো। আমাদের দেশে সাধারনতঃ কোন মৃত পথ যাত্রীকে সবাই বেশী বেশী আদর যত্ন করে।
আমার ভাগ্যে কি তেমন কিছু ঘটতে চলছে নাকি?
যাবার হুকুম পেলাম বটে কিন্তু বি.বি.সি. আকাশবাণী, স্বাধীনবাংলা বেতারে অহরহই শুনি। ওরা ছেড়ে দিয়ে পিছন থেকে গুলি করে মারে। আমার ভাগ্যে কি সেই টেকনিকই আপেক্ষা করছে! কাপুরুষের মতো পিছনে গুলি খেয়ে মরার একদম ইচ্ছে নেই।
যা হোক ওদের একটা লম্বা সালাম জানিয়ে ব্যাগটা হাতে নিয়ে আল্লাহকে স্বরণ করে বাসের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম,ততক্ষণে বাসটা দাঁড়িয়ে পড়েছে। বাস আর আমার মধ্যে ব্যবধান বেশী না হলেও, ওই মুহুর্তে মনে হচ্ছে যোজন মাইল দূর।
পা’টা কিছুতেই চলছে না। কে যেনো দু’পায়ে ভারী পাথর বেঁধে দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। চেস্টা করেও গতি বাড়াতে পারছিনা। পাক-সেনারা কি আমার দিকে রাইফেল তাক করেছে? এরা কি আমাকে পিছন থেকে মারার প্রস্তুতি নিচ্ছে ? এই বুঝি আমি মুখ থুবড়ে পড়লাম। অপরাধীর মতো পিছনে তাকানোর সাহস নেই, দৌড়াতেও পারছিনা।
ভয় পেলে মানুষ নাকি দৌড় দেয় কিন্তু ও থিওরি আমার বেলায় এখন অচল। ওই মুহুর্তে মনের অবস্থা প্রকাশ করার কোন ভাষাই আমার জানা নেই। আমি একটা প্রাণহীন কায়া। বাসের অনেকটা কাছাকাছি এসে গেছি মনে হচ্ছে, না বাসটাই আমার কাছে চলে এসেছে ঠিক বুঝতে পারছিনা। দেখি অসংখ্য হাত আমার দিকে এগিয়ে আসছে, আমি মাতালের মত টলছি।
মনে হচ্ছে আমি শূন্যে ঝুলছি।
সম্বিত ফিরে এলে দেখি সবাই আনন্দে আমাকে নিয়ে লাফালাফি করছে। হায়নার মুখ থেকে বের হয়ে আসা তখন আমি এক সাহসী বীর। আমাকে একটু স্পর্শ কারার জন্য সবাই ব্যস্ত। জামান সাহেব আমাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরে রয়েছেন।
আমাদের বাসটি দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে রাজশাহীর অভিমুখে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।