যেতে চাও যাবে, আকাশও দিগন্তে বাঁধা, কোথায় পালাবে!
১৪ই ডিসেম্বর দুপুর বেলা ব্যাগ গোছাচ্ছিলাম, Commonwealth Commission কর্তৃক আয়োজিত Global Science and Technology Conference এ যাওয়ার জন্য। Conference টি চলবে ১৪ই ডিসেম্বর সন্ধ্যা থেকে ১৬ই ডিসেম্বর বিকেল বেলা পর্যন্ত। Great Windsor Park এর Royal Cumberland Lodge এ আয়োজিত এই কনফারেন্স এ অংশ নেবে কমনওয়েলথভুক্ত সকল দেশের বিজ্ঞানী ও পিএইচডি গবেষনারত ছাত্ররা। ব্যাগের ভিতর যখন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাটা ঢুকাচ্ছিলাম তখন বউ অবাক হয়ে বলল এটা দিয়ে কি করবে!! বললাম ১৬ তারিখ বিজয় দিবস, দেখি কিছু করা যায় কিনা!!
১৪ তারিখে বিকালে সম্মেলনস্থলে পৌছালাম। আনুষ্ঠানিক উদ্ধোধনের পরে শুরু হলো বিভিন্ন গবেষক এর প্রবন্ধ উপস্থাপনের পালা।
১৫ তারিখ সারাদিন ব্যাপী বিভিন্ন বিষয়ে আলোকপাত হলো। অদ্ভূত রকমের বৈচিত্র গবেষণার বিষয়ে, সাধারনত: কনফারেন্সগুলি বিষয়ভিত্তিক হয়ে থাকে কিন্তু এখানে নামিবিয়ার জেলিফিশ ব্লুম সংক্রান্ত সমস্যা থেকে শুরু করে নিউজিল্যান্ড এর উপকূলীয় জীব বৈচিত্র আর দক্ষিন আফ্রিকার মুঠোফোন ব্যাংকিং কি নেই আলোচ্য বিষয়ে!! এর মধ্যে আমার ক্যান্সার গবেষণাই বরং ম্যাড়মেড়ে লাগছিল।
১৫ তারিখ সন্ধ্যায় আয়োজকদের সাথে কথা বললাম পরদিন বাংলাদেশের বিজয় দিবস নিয়ে। সরাসরি প্রস্তাব দিলাম যে আমরা দিনের কার্যসূচীর শুরুতেই বিজয় দিবস উপলক্ষে সম্মেলনকক্ষে ছোট আকারের একটি কিছু করতে চাই । আয়োজকদের অন্যতম কমনওয়েলথের কমিশনার মনিকা ডারনবরো মুঠোফোনে কিছু আলাপ করে নিয়ে রাজি হয়ে গেলেন প্রস্তাবে।
বললেন দিনের শুরুতে ১৫ মিনিট বরাদ্দ হলো আমাদের জন্য। এত অল্প চেষ্টাতেই রাজি হয়ে যাবেন বুঝতে পারিনি। বুকের মধ্যে ছোট্ট একটা আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল। সাথে সাথে যোগাযোগ করলাম বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিধিত্ব করা মোট চারজনের মধ্যে। এদের মধ্যে দুইজন আবার সিনিয়র প্রফেসর।
খুলে বললাম আমার প্ল্যান। শুরুতে বাংলাদেশ নিয়ে একটা স্লাইড শো থাকবে, তারপর স্বাধীনতা সংগ্রামের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস এবং সবশেষে সমবেত কন্ঠে জাতীয় সংগীত ।
একবাক্যে রাজী হয়ে গেলেন বাংলাদেশ কন্টিনজেন্ট। আমাকে অবাক করে দিয়ে সবচাইতে উৎসাহী হয়ে উঠলেন দীর্ঘ শশ্রুমন্ডিত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোজাফফর হোসেইন স্যার। ব্যাস আর যায় কোথা!! সবাইকে হাতে লিখে জাতীয় সংগীতের কপি ধরিয়ে দিলাম যাতে অনুষ্ঠানস্থলে কোন ভুল না হয়।
তারপর রাত জেগে বাংলাদেশ নিয়ে একটি স্লাইড শো তৈরী করলাম, জাতীয় সংগীতের ইন্সট্রুমেন্টাল ভার্সন ডাউনলোড করে ঠিক করে রাখলাম। সাথে থাকল সংগে আনা সেই জাতীয় পতাকাটি।
১৬ই ডিসেম্বর ২০০৭, সকাল বেলা সম্মেলনস্থলে যেয়েই প্রথমেই প্রজেকশনের কাজে ব্যবহৃত ল্যাপটপে স্লাইডশো আর জাতীয় জাতীয় সংগীতের ইন্সট্রুমেন্টাল ভার্সনটি কপি করে নিলাম। অনুষ্ঠান সূচী অনুযায়ী নামিবিয়ার এক বিজ্ঞানীর একটি প্রবন্ধ উপস্থাপনের কথা। সভাস্থলে গুনগুন শুরু হলো যখন সভাপতি একটি চমকের কথা বললেন এবং বাংলাদেশের বিজয় দিবেসর কথা উল্লেখ করে আমাদেরকে মন্চে আহবান করলেন।
আমরা পাঁচজন সারিবদ্ধভাবে মন্চে দাড়ালাম। প্রথমেই শুরু করলাম বাংলাদেশ নিয়ে স্লাইড শোটি, মন্চে দাড়িয়েই নানা জনের চোখে যখন মুগ্ধতা আর বিস্ময় দেখতে পাচ্ছিলাম বাংলাদেশের সৌন্দর্যে তখন এক অদ্ভুত আনন্দে বুকের ছাতি ফুলে উঠছিল। স্লাইড শোটি শেষ হলো আমাদের জাতীয় পতাকা দিয়ে। এরপর আমি শুরু করলাম আমাদের স্বাধীনতার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণনা। ৫২ থেকে শুরু করে তারপর যখন মুক্তিযুদ্ধে আমাদের প্রতিরোধ আর হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার কথা বলছিলাম সম্মেলন স্থলের প্রতিটি মানুষ শিউড়ে উঠছিল।
চোখের কোন দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম মাথা নিচু করে বিব্রত মুখে বসে আছে পাকিস্তানী প্রতিনিধিদল।
এরপর শুরু হলো জাতীয় সংগীতের ইন্সট্রুমেন্টাল ভার্সন এর সাথে সাথে আমাদের পাচজনের সর্বশক্তি দিয়ে গাওয়া জাতীয় সংগীত। সে এক অন্যরকম অনুভূতি। টের পাচ্ছিলাম চোখর কোণ ভিজে উঠছে। সমগ্র সভাস্থলের সবাই দাড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করলো আর শেষ হবার সাথে সাথে মুহুর্মুহু হাততালি।
এক মিনিটেরও অধিক সময় ব্যাপী চলল দাড়িয়ে থেকে সেই হাততালি। সবার শেষে ইংরেজীতে ট্রান্সলেট করে শোনালাম আমাদের জাতীয় সংগীতের প্রথম আট লাইন। তারপর মাথা উচু করে করতালির মধ্যে নেমে আসলাম মন্চ থেকে। সম্ভবত: আমার জীবনের সবচেয়ে গর্বের এক বিজয় দিবস পালন করে। নিজেদেরকে মনে হলো স্বদেশভূমির পাচ সন্তান যারা বিশ্বের কাছে মায়ের পরিচয় তুলে ধরলো।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।