আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নারীরাজ্যে কয়েক মাস

সঙ্গে সাহিত্যের সুবাস ...

মালয়শিয়ার পেট্রোনাস টাওয়ারের কথা, এর চমৎকার পর্যটনস্থলগুলোর কথা, মাহাথিরের নেতৃত্বে অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে এর উত্থানের কথা সবসময় শুনে এসেছি। কিন্তু সেখানে গিয়ে কয়েক মাস থেকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো মালয়শিয়ার নারীদের অগ্রযাত্রা। বেগম রোকেয়া তার সুলতানার স্বপ্নতে যেরকম নারীরাজ্যের চিত্র এঁকেছিলেন, মালয়শিয়া যেন সেই নারীরাজ্য। রোকেয়ার চিত্রিত নারীরাজ্যের পুরোপুরি না-হলেও বেশ খানিকটাই সেখানে দেখা মিলবে। রোকেয়ার পূর্ববঙ্গের মতোই মালয়শিয়াও মুসলমান-প্রধান দেশ, যেখানে নারীরা তসলিমার র‌্যাডিকাল অবস্থানের মতো নয়, রোকেয়ার যুগের মতোই, ধর্মকে মেনে নিয়ে পর্দায় থেকেই যাবতীয় কাজ করে চলেছে।

এমনিতেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নারীদের জন্মহার বেশি। মালয়শিয়ায় নারী ও পুরুষের শতকরা হার যথাক্রমে শতকরা ৫৫ ও শতকরা ৪৫ ভাগ। আর নারীরা এখানে কেবল সংখ্যায়ই বেশি নয়, পড়াশুনা ও সম্মানজনক কাজের হিসেবে তারাই এগিয়ে। মালয়শিয়ায় রাজনীতি ও ব্যবসায় পুরুষরাই এগিয়ে, তবে সরকারী চাকরিসহ অন্যান্য সব পেশায় নারীদের দাপট। যেকোনো অফিসে গেলে দেখা যাবে টেবিলের পেছনে বেশিরভাগ চেয়ার দখল করে রেখেছে নারীরা।

বেশিরভাগ পরিবারের মূল উপার্জনকারী নারী। উচ্চশিক্ষায় নারীদের অগ্রবর্তিতা সত্যিই আমাদের মতো দেশের নাগরিকদের কাছে বিস্ময়কর ঠেকবে। আমার কাছে সঠিক হিসেব নেই, তবে অনুমান করে বলতে পারি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শতকরা ৭০ ভাগ শিক্ষার্থীই নারী। মোট জনসংখ্যার হারের তুলনায় শিক্ষায় পুরুষরা আরও পিছিয়ে পড়েছে। আমি পেনাংয়ের ইউনিভার্সিটি সায়েন্স মালয়শিয়ায় পিএইচডি প্রোগ্রামের জন্য এসেছি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউটার বাসে চড়ে মাঝে মাঝে আমি নিজেকে আবিষ্কার করেছি বাসভর্তি ছাত্রীর মধ্যে আমি একা পুরুষ। একথা ঠিক, ছাত্রীদের তুলনায় ছাত্ররা মোটরবাইক বা প্রাইভেট কার বেশি ব্যবহার করে, এজন্য কমিউটার বাস তারা কম ব্যবহার করে। কিন্তু বাইক বা গাড়ি তো মেয়েরাও ব্যবহার করে। প্রায় ছাত্রহীন কমিউটার বাস বলে দেয় শিক্ষাক্ষেত্রে নারীদের অবস্থান কতখানি। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নারীর স্বামী ঐ বিশ্ববিদ্যালয়েই কেরানির কাজ করেন।

ঘানার নাগরিক জর্জ কম্পিউটার সায়েন্স পড়তে এসেছে। সে একদিন জানালো সে এমন একটি কোর্স নিয়েছে যেখানে সে ছাড়া আর মাত্র সাতজন ঐ কোর্সটি নিয়েছে, এবং ঐ সাতজনই ছাত্রী, তবে তারা চায়নিজ বংশোদ্ভূত। এবেলায় বলে নেয়া ভালো মালয়শিয়ায় মোট জনসংখ্যার শতকরা ৩০ ভাগ চায়নিজ, ১০ ভাগ ভারতীয় তামিল। অস্থায়ীভাবে কিছু ইন্দোনেশীয় ও বাংলাদেশীসহ বিদেশীরাও সেখানে বসবাস করে। বাদবাকী শতকরা ৫২-৫৩ ভাগই কেবল স্থানীয় মালয়শীয় বা ভূমিপুত্র।

ভূমিপুত্রদের মধ্যে পুরুষদের তুলনায় নারীদের অগ্রবর্তিতা আরও স্পষ্ট, তুলনায় চায়নিজ নারী-পুরুষ উভয়েই সবদিক থেকে এগিয়ে রয়েছে। মালয়শিয়ার যে-অর্থনৈতিক অগ্রগতি, তাতে মূল অবদান মাহাথিরের নেতৃত্ব এবং চায়নিজদের বুদ্ধি-শ্রম। সাধারণ মালয় বা ভূমিপুত্র পুরুষরা অলস প্রকৃতির, নারীদের ওপরে অর্থোপার্জন, সংসার সবকিছুর ভার ছেড়ে দিয়ে তারা অকর্মণ্য বা আধা-অকর্মণ্য সময় কাটায়। অবশ্য চায়নিজ নারী-পুরুষ উভয়েই পরিশ্রমী, ব্যবসায়িক বুদ্ধি তাদের প্রখর। রোলাঁ বার্থ বলেছেন পোশাক নিজেই একটি দ্যোতক (সিগনিফায়ার)।

পোশাক বা ফ্যাশন অর্থ বহন করে। এবার মালয়শীয় নারীদের পোশাক নিয়ে কিছু আলোচনা করা যাক। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পোশাকের মাধ্যমে একটি সমাজে নারীদের অবস্থান পরিমাপ করা যায়। বিশেষত মুসলমান সমাজে নারীদের পর্দা করা না-করা একটি বৃহত্তর বিষয়। মালয়শীয় মুসলিম মেয়েরা পর্দার আওতায় ভালোভাবেই রয়েছে।

তারা সাধারণত রঙচঙা-সিনথেটিক-ঢিলেঢালা একটি পোশাক পরে। লুঙির মতো নিচের অংশটির প্রায় অর্ধেক ঢেকে রাখে ওপরের কামিজটি। আবার কামিজটির প্রায় অর্ধেকটি ঢেকে রাখে মাথা থেকে নেমে আসা স্কার্ফ। সাদাটে স্কার্ফটি মেয়েদের মুখমণ্ডলই কেবল দেখতে অনুমোদন করেÑ থুতনির নিচে স্কার্ফটি শক্ত করে আঁটা থাকে। বিষুবীয় যে-দেশের তাপমাত্রা ২৩ ডিগ্রির নিচে কখনোই নামে না, সেদেশের মেয়েদের সিনথেটিক কাপড় পরিয়ে, স্কার্ফটিকে শক্ত করে বাঁধার রীতিটি চালু করে তাদের প্রতি অন্যায়ই করা হয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে।

এটা বড়োই পরিহাসের বিষয় যে এ-গোলার্ধের যেসব দেশে প্রবল শীত সে-দেশের মেয়েদের পোশাক সংপ্তি হতে বাধা নেই, অথচ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশের মেয়েদের পোশাক দীর্ঘতম হবার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যাহোক, মালয়শিয়ার মেয়েদের জন্য ওটাই অফিসিয়াল বা আনুষ্ঠানিক পোশাক। তবে মালয়শিয়ার মেয়েদের পোশাকের এই বজ্র আঁটুনির কিছু ফস্কা গেরোও রয়েছে। যেমন এই আনুষ্ঠানিকতা সবসময় বজায় থাকে না। ধর্ম-সমাজ-রণশীলতা মেনে নিয়েও অগ্রবর্তী নারীরা একটি কৌশল বেছে নিয়েছে।

অনেক মেয়েই আছে যারা কেবল স্কার্ফ রেখে দিয়ে, বাকি রঙচঙা জোব্বাকে ছুঁড়ে ফেলেছে। বদলে পরে ব্লু-জিন্স ও টি-শার্ট। দু'কূল রক্ষাকারী এই মেয়েদের সংখ্যা একেবারে কম নয়। বিকেলে-সন্ধ্যায়-ডিনারে বেরুবার সময় আবার স্কার্ফটুকুও তাদের মাথায় থাকেনা। আর যারা পুরো পোশাকটি পরে পর্দায় অভ্যস্ত, সেই সংখ্যাগরিষ্ঠরাও দিনের দ্বিতীয়ভাগে পরনে জিন্স-টিশার্ট চাপায়, স্কার্ফটুকু রাখে।

এতো গেল মালয়শীয় মুসলিম নারীর পোশাকের বর্ণনা। চায়নিজ মেয়েদের বিষয়টি একেবারেই আলাদা। অমুসলিম হবার কারণে ওইসব পোশাকের বাধ্যবাধকতা তাদের একেবারেই নেই। বলা যায় পুরো পাশ্চাত্য-পোশাকে অভ্যস্ত তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিসিয়াল ড্রেসকোড অনুসারে শিক্ষার্থীদের শর্টস পরে ক্যাম্পাসে ঢোকা নিষিদ্ধ।

কিন্তু চায়নিজ মেয়েদের ফ্যাশনেবল প্যান্টটি প্রায়ই হাঁটু অতিক্রম করতে চায়। তারা মালয়শীয়দের মতো ব্লু-জিন্স পরে না, বরং মোটা সুতি বা গাবাডিন জাতীয় প্যান্ট পরে তারা, জিন্সের তুলনায় যেগুলোর দাম অনেক বেশি। ওপরে তারা পরে শার্ট বা টি-শার্ট। আর দিনের দ্বিতীয় ভাগে তাদের শর্টস ছাড়া একেবারেই দেখা যায়না, শর্টসের সংপ্তিতায় অরুচিও নেই তাদের। তবে পোশাকের দৈর্ঘ্য যাই হোক না কেন, কোনো কাজেই মালয়শীয় নারীদের কোনো সমস্যা হয়না।

জোব্বা-জাব্বা পরে যেকোনো কাজে তারা অভ্যস্ত। প্রখর বিকেলে উত্তপ্ত প্যারেড গ্রাউন্ডে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের দেখা যায় চেপে-ধরা-স্কার্ফ মাথায় ড্রিল করছে, শরীরচর্চা করছে। পেশাজীবী মেয়েরা টোল-প্লাজায় টোল নিচ্ছে, কিনার হয়ে আপনমনে মপার ঠেলছেÑ ব্যাংকগুলোতে, অফিসগুলোতে, ফ্যাক্টরিতে জটিল-অজটিল-দায়িত্বপূর্ণ কাজগুলো অবলীলায় করছে। পূর্বের সংস্কৃতি আর পশ্চিমের উন্নয়নধারাÑ এই দুই মিলে মালয়শিয়া মধ্যবর্তী একটি সংস্কৃতিতে বিরাজ করছে। নারীরা এখানে তাই অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী অথচ পশ্চিমাদের মতো যৌনাচারণের ক্ষেত্রে তারা নিজেদের সহজলভ্য করে তোলেনি।

ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক জুটিসংস্কৃতি একেবারেই নেই। মেয়েদের মাঝরাতেও ক্যাম্পাসে ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়, কিন্তু ঝোপের ছায়ায় নিবিড় কোনো জুটিকে কখনোই দেখিনি আমি। ছাত্রীনিবাস আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায় একেবারেই অরক্ষিত, যেকোনো ছাত্র যেকোনো সময় যদি ঢুকে যেতে চায়, বাধা দেবার কেউ নেই। অথচ সেরকম ঘটনা সেখানে তেমন ঘটেনা, যদিও ছাত্র-ছাত্রীদের হোস্টেল একেবারে পাশাপাশি রয়েছে। তবে বিবাহবিচ্ছেদের হার মালয়শিয়ায় অনেক বেশি, তার সঙ্গে নারীদের স্বাবলম্বিতার যোগাযোগ কতটুকু তা আমার এখনও পরীক্ষা করা হয়নি।

শোনা যায়, মালয়শীয় নারীরা, বিশেষত গ্রামের মেয়েরা, স্বামী হিসেবে বাংলাদেশীদের বেশ পছন্দ করে, কারণ মালয় পুরুষদের চেয়ে তারা নাকি বেশি বিশ্বস্ত হয়। আর অভিবাসী বাঙালিরা এটাকে স্থায়ী হবার মওকা হিসেবেও দেখে। বাঙালি শ্রমিকদের বিষয়ে মালয়দের পক্ষ থেকে একটা বড়ো অভিযোগ রয়েছে, মালয় নারীদের ব্যাপকভাবে বিয়ের মাধ্যমে জাতিসত্তায় ভেজাল ঢুকিয়ে দিচ্ছে। [রচনাকাল: মার্চ ২০০৭; সৌমিত্র দেব সম্পাদিত 'পর্যটক' (২০০৭) পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত। ]



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.