Do not pray for easy lives. Pray to be stronger men. "Do not pray for tasks equal to your powers. Pray for powers equal to your tasks. Then the doing of your work shall be no miracle, but you shall be the miracle. " --Phillips Brooks
(১)
গতকাল রাত পৌনে এগারটার দিকে হঠাৎ নিজেকে আমি আবিষ্কার করি জেভিয়ার টাওয়ারের সতেরো তলার লিফটের সামনে। মাথায় প্রচণ্ড টেনশন। বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডটা এতো জোরে ধকধক করছে যে কান পাতলে আওয়াজ শোনা যাবে। খুব জরুরী একটা কাজ করতে হবে। কাজটা করতে না পারলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
এদিকে হাতে সময় নেই।
কিন্তু কি নিয়ে আমি এতো টেনশন করছি?
মনে করতে পারলাম না। মাথা একদম ব্ল্যাংক। যেন একটা সিনেমা থামিয়ে রাখা ছিল। এইমাত্র সেটা প্লে করা হল।
আমার অবস্থা হল সেরকম। নিজেকে আচমকা এরকম একটা অবস্থায় আবিষ্কার করে আমি একটা ধাক্কা মতো খেলাম।
কিছু বুঝতে না পেরে নিজের দিকে নজর দিলাম। আমার হাতে চামড়া দিয়ে বানানো কালো রঙের হালকা একটা ব্যাগ। গায়ে সাদার ওপরে নীল নীল স্ট্রাইপ দেয়া দামি একটা শার্ট।
গলায় স্ট্রাইপের সাথে ম্যাচিং করা টাই। নিচে কালো রঙের একটা প্যান্ট। পায়ে মানানসই চকচকে কালো জুতো। নিজের জামা কাপড় দেখে আমার ধারণা হল - আমি সম্ভবত খুব তাড়াহুড়া করে কোথাও যাচ্ছিলাম।
কিন্তু কোথায়?
ঘাড় ঘুরিয়ে লিফটের দুপাশে চেয়ে দেখলাম।
লবিতে একটা মাত্র লাইট। এছাড়া চারপাশ প্রায় অন্ধকার। আধো অন্ধকারে তেমন কিছুই দেখা যায় না। দুদিকেই ফাঁকা করিডোর আর সারি সারি দরজা। কোনটা খোলা, কোনটা বন্ধ।
কিছু খোলা দরজা দিয়ে রুমের ভেতরে জ্বলে থাকা বাতির সাদা আলো বাইরে করিডোরে এসে পড়েছে। আর তাতেই এখানে আলো আঁধারির রহস্য তৈরি হয়েছে। চারপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে পরিত্যাক্ত জনমানবহীন একটা জায়গা।
সামনে চেয়ে দেখলাম লিফটের দরজার ওপরে নীল আলোতে সতেরো লেখাটা জ্বলজ্বল করছে। চারদিক একদম নিস্তব্ধ।
পিন ড্রপ সাইলেন্স বোধহয় একেই বলে। আমি হতভম্ব হয়ে সতেরো লেখাটার দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ। একসময় নিজের মনেই বলে উঠলাম, “আশ্চর্য!!?”
অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। তারপরও সাহস করে এদিক ওদিক তাকিয়ে একবার ডাক দিলাম, “এই যে ভাই!!! কেউ কি আছেন!!!!? আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন!!!!?”
কিসের কি? আমার কথাগুলো শূন্য দেয়ালে দেয়ালে প্রতিফলিত হয়ে ফিরে এলো। কোথাও কেউ নেই।
ব্যাগটা পায়ের কাছে রেখে গা-হাত-পা একটু নেড়েচেড়ে দেখলাম। নাহ, কোথাও কোন সমস্যা নেই।
তাহলে? কি ঝামেলায় পরলাম রে ভাই। অ্যাবসার্ড অবস্থা তো!
কেমন যেন অস্থির লাগছে। মাথাটা ঠাণ্ডা করে একটু চিন্তা করা দরকার।
জোরে জোরে কয়টা গভীর শ্বাস নিলাম। একটু ধাতস্থ হওয়ার পর হাতের ব্যাগটা রেখে এদিক সেদিক একটু ঘুরে বেড়ালাম। কোথাও কেউ নেই। একদম জনশূন্য বিরান ভূমি। বিল্ডিঙটার সামনের দিকে বিশাল একটা টেরাস আছে।
বেশ গাছ গাছালি লাগানো। সেখান থেকে নিচে রাস্তাটা দেখা যায়। আমি কাঁচের রেলিঙের ওপর উবু হয়ে কিছুক্ষণ গাড়ি ঘোড়া দেখলাম।
টেরাসে বেশী ক্ষণ ভালো লাগল না। আকাশে খানিকটা মেঘ জমেছে।
বৃষ্টি পড়বে বোধহয়। ওখান থেকে আমি আবার লিফট লবিতে ফিরে এলাম। নাহ! কিছুই বোঝা যাচ্ছেনা। কিছুই চিনতে পারছি না। ব্যাগটা ঘাটা ঘাটি করে দেখলাম।
সেটাও ফাঁকা। খালি একটা ব্যাগ হাতে কোথায় যাচ্ছিলাম আমি? আজব ব্যাপার।
একবার মনে হল, নিচে নেমে দেখলে কেমন হয়?
যেই ভাবা, সেই কাজ। লিফটে চড়ে গ্রাউন্ড ফ্লোরের বোতাম টিপে অপেক্ষা করতে লাগলাম। একটু গরম গরম লাগছে।
কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে বুঝতে পারছি। লিফটে বসানো স্টেইনলেস স্টিলের চকচকে দরজাটায় নিজের চেহারাটা একবার দেখলাম। মাথা ভর্তি ব্যাকব্রাশ করা ঘন কালো চুল, বড় বড় বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, টানা ভ্রু – সব মিলিয়ে সুদর্শন এক যুবকের প্রতিচ্ছবি। লম্বা আর খাড়া নাকটা চেহারায় একটা বিশিষ্ট এনে দিয়েছে। সুদর্শন চেহারার কোথায় যেন একটা কাঠিন্য আছে।
নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে মুগ্ধ হলাম। তবে নিজের চেহারাই যে দেখছি সেটা ঠিক নিশ্চিত হতে পারলাম না।
আমি কি তাহলে পাগল হয়ে গেলাম? কি জানি! অবশ্য শর্টটার্ম মেমোরি লস হতে পারে, হয়তো দেখা যাবে কিছুক্ষণের মধ্যে আবার আমার সব কিছু মনে পড়েছে। কিন্তু তাই বলে নিজের চেহারা চিনবো না?
নিচে নেমে আমি স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেললাম। যাক! রিসেপসনে ইউনিফর্ম পড়া একজন বসে আছে।
তার কাছে জিজ্ঞেস করলে কিছু না কিছু অন্তত জানা যাবে।
চারদিক দেখতে দেখতে ধীর পায়ে কালো গ্রানাইট বসানো টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেলাম। গ্রাউন্ড ফ্লোরটা বিশাল আর এমন চমৎকার ভাবে সাজানো যে আমি বিস্মিত হয়ে গেলাম। মেঝেতে ধব ধবে সাদা মার্বেল বসানো। উঁচু ছাদ থেকে ঝুলে থাকা বর্ণিল ঝাড়বাতিগুলো উজ্জ্বল ঝলমলে আলো বিকিরণ করেছে।
মার্বেলের মেঝেতে সে আলো প্রতিফলিত হয়ে চারপাশে কেমন একটা আভা ছড়িয়ে দিচ্ছে। একটা দেয়ালে চমৎকার কিছু পেইন্টিংও দেখলাম। অ্যাডাম আর ইভের একটা ছবি দেখে তো আমার মাথা ঘুরে গেল। ছবিতে অ্যাডাম, ইভের সাথে গা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনেরই খালি গা।
একটা গাছের পাতা কোনোরকমে তাদের লজ্জা ঢাকার চেষ্টা করছে। ব্যাকগ্রাউন্ডে কালো মেঘে বিপদের ঘনঘটা। কিন্তু এই দুই জনের সেদিকে খেয়াল নেই। একজন আরেকজনের দিকে মধুর ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে।
রিসেপসন ডেস্কের সামনে এসে আমি হাসি মুখে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম, “ এক্সকিউজ মি ভাই।
এদিক একটু শুনবেন?”
কিন্তু না। নিজেকে চরম হতবাক করে দিয়ে আমি বলে বসলাম, “অ্যাই, গাড়িটা সামনে নিয়ে আসো। ”
গাড়ির কথাটা এমন ভাবে বললাম যেন আমি না, অন্য কেউ আমার মুখ দিয়ে কথাটা বলল। আমি তখন কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মনে হল আমি আর আমার মধ্যে নেই।
হঠাৎ করেই আমি যেন অন্য কেউ হয়ে গেছি। যা করার সেই করছে, আমি কেবল দেখছি। টের পেলাম আমার মাথায় অসংখ্য চিন্তা ভাবনা গিজ গিজ করছে। ভাসা ভাসা কিছু বুঝতে পারছি, কিছু বুঝতে পারছি না। কিন্তু কোনটার সাথেই আমি পরিচিত না।
ইউনিফর্ম পড়া লোকটা আমাকে দেখে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। জুতো জোড়া মেঝেতে ঠকাস করে ঠুকে দিয়ে লম্বা একটা সালাম দিল। নিচেই দু’এক জন লোক বোধহয় আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। আমাকে দেখে তারাও দাঁড়িয়ে গেল। কাউকেই আমি চিনতে পারলাম না।
সব অপরিচিত চেহারা। কিন্তু তারপরও কিভাবে যেন আমি ওদের চিনি বলে মনে হল। ওদের মধ্যে সৌম্য দর্শন একজন প্রবীণ লোকও ছিল। লোকটাকে দেখা মাত্র আমার মাথায় “জুবায়েরের বাবা” নামটা ঘুরতে থাকল।
হ্যাঁ ভদ্রলোককে তো আমি চিনি, ইনিই জুবায়েরের বাবা।
কিন্তু কিভাবে চিনি, কি চায় এ আমার কাছে? একে আমি আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ল না, তাহলে আমি এঁকে চিনলাম কিভাবে? ভদ্রলোকের চেহারায় অভাবের ছাপ স্পষ্ট এবং জামা কাপড় দেখে তার গরিবি হাল ভালভাবেই টের পাওয়া যাচ্ছে। তার হাঁটার ভঙ্গি দেখে বুঝলাম শরীরের অবস্থাও ভালো না, বেশ দুর্বল।
আমাকে দেখে তার চেহারায় একটা ভরসা হারানো ভাব চলে এলো। ভাবভঙ্গী মনে হল সেই বুড়ো চাচা আমাকে কিছু বলতে চায়। আমি তাকে আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে ভাবছিলাম এগিয়ে গিয়ে একটু ধরি।
লোকটার ভরসা হারানো চেহারা দেখে মনটা যেন কেমন কেমন করে উঠেছিল। কিন্তু আমি সেই সুযোগ পেলাম না। ওঁর দিকে একবার তাচ্ছিল্যের একটা দৃষ্টি দিয়ে আমি অন্যদিকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম। এবারও সেই একই ব্যাপার। অন্য কেউ যেন আমাকে নিয়ন্ত্রন করছে।
তারপর ওদের দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে কাঁচের দরজা ঠেলে বাইরে বেড়িয়ে এলাম।
বাইরে এসে আমি কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালাম। হলুদ নিয়ন বাতিতে সব কিছু আধভৌতিক দেখাচ্ছে। রাস্তায় লোকজন তেমন একটা নেই। দুই একটা ট্যাক্সি ছাড়া আর কোন গাড়িও দেখা গেল না।
আমি হাত দিয়ে মাথার চুলগুলোকে পেছন দিকে টেনে ধরলাম। কেমন যেন একটা অধৈর্য ভাব। রাতের আঁধারে একটা কালো রঙের লম্বাটে গাড়ি ধীর গতিতে নিঃশব্দে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। সেই একই ইউনিফর্ম পরা আরেকজন লোক ছুটে এসে গাড়ির দরজা ধরে দাঁড়িয়ে রইল আমার অপেক্ষায়। সেখানে দাঁড়িয়ে উশখুশ করতে করতে পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করলাম।
পকেটে যে এতক্ষণ সিগারেট ছিল আমি জানতামই না। পকেট হাতড়ে ম্যাচ খুঁজলাম। নেই।
হঠাৎ পাশ থেকে কে যেন ফস করে একটা ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে আমার মুখের সামনে ধরল। আমি স্ট্রিট লাইটের আলোতে চেহারাটা দেখে চিনতে পারলাম না।
তবে একটা জিনিষ আমি জানি, এর নাম জামশেদ। কারন ওকে দেখা মাত্র এই নামটা চট করে আমার মাথায় চলে এলো। জামশেদের পেশিবহুল গাট্টাগোট্টা শরীর, কালো কুৎসিত চেহারা। দেখেই বোঝা যায় যে দাগী আসামী। মুখে তেল তেলে একটা হাসি মেখে বলল,
“স্যার, আগামীকালের প্রোগ্রাম কি তাইলে ফিক্স?”
আমি আড় চোখে ওঁর দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে সিগারেটটা ধরালাম।
বুক ভরে একরাশ ধোঁয়া নিয়ে স্থির দৃষ্টিতে লোকটার দিকে একবার তাকালাম। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে লোকটা কেমন যেন মিইয়ে গেল। হাসি বন্ধ করে বিব্রত চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমি হুস করে ওঁর মুখের উপরই সিগারেটের নীল ধোঁয়াটা ছাড়লাম। লোকটা চোখমুখ কুঁচকে একটু দূরে সরে গেল।
আমি বরফ শীতল গলায় বললাম, “তোকে না একবার বলেছি আমার সাথে এখানে এভাবে দেখা করবি না?”
আমার গলায় এমন একটা কিছু ছিল যেটাতে আমি নিজেই চমকে উঠলাম। সেই লোকটার চেহারাতেও ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল। হাত জোড় করে বলল,
“মাফ কইরা দেন বস। গতকাল আমারে একটা কাজ দিলেন। কিন্তু কারে কি করতে হইবো কিছুই কইলেন না।
আবার আজকেও সারাদিন আপনি কিছু জানাইলেন না। তাই ভাবলাম আপনার লগে একবার দেখা কইরা যাই। ”
কথা পুরোপুরি শেষ করার আগেই আমি লোকটার কলার চেপে ধরলাম। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঠাশ ঠাশ করে কয়টা চড় বসিয়ে দিলাম ওর গালে। ও হাত তুলে মাথা গুঁজে মার ঠেকাবার চেষ্টা করল।
মার খেতে খেতে অস্ফুট ভাবে বলল,
“মাফ কইরা দেন বস। মাফ কইরা দেন বস। ভুল হইয়া গ্যাসে। ”
কিন্তু আমার শরীরে যেন অসুরের শক্তি ভর করেছে। আমি ওর কলার ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে আরও কয়টা চড় দিয়ে ওকে ছেড়ে দিলাম।
লোকটা তখনো মাথা গুঁজে আছে। রাগে আমার শরীরের রক্ত যেন টগবগ করে ফুটছে। জোরে একটা লাথি দিয়ে আমি ওকে ফুটপাথে ফেলে দিলাম। লাথি খেয়ে ও ফুটপাথে শুয়েই রইল। আমি দাঁতে দাঁত ঘষে বললাম,
“কার কি হচ্ছে সেটা তোর জানার প্রয়োজন নেই।
তোকে ঠিক যা করতে বলেছি শুধু তাই করবি। কাজটা কিভাবে করবি সেটা নিয়ে চিন্তা না করে তুই আমাকে জিজ্ঞেস করতে এসেছিস “প্ল্যান কি ফিক্স?! শুয়োরের বাচ্চা!”
জামশেদ উঠে দাঁড়ানোর একটা চেষ্টা করছিল। আমি ওর পেট বরাবর আরেকটা লাথি বসিয়ে দিলাম। লোকটা কুঁকড়ে উঠে আবার শুয়ে পড়ল। আমি সেদিকে তাকিয়ে শান্ত মুখে সিগারেটে আরেকটা টান দিলাম।
ধোঁয়াটা ছেড়ে ঠাণ্ডা গলায় বললাম,
“কালকে কাজ শেষ করে ছয় মাসের জন্য নাই হয়ে যাবি। কবে আসবি সেটা পরে সময় মতো জানতে পারবি। ”
জামশেদ কিছুক্ষণ ঝিম মেরে থেকে উঠে চলে গেল।
(২)
আমি এতক্ষণ দম বন্ধ করে এসব দৃশ্য দেখছিলাম। এমনিতেই কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
তার মধ্যে এসব ব্যাপার স্যাপার দেখে আমি ঘাবড়ে গেলাম। লিফট দিয়ে নিচে আসার পর মনে হয় আমার মধ্যে কিছু একটা পরিবর্তিত হয়ে গেছে। মাঝখানে কিছুটা সময় এই শরীরে আমি ছিলাম। এখন সম্ভবত সব কিছু আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। শুধু একটা জিনিষ বাদে, সেটা হলাম আমি।
কোন এক রহস্যময় উপায়ে আমি অন্য কারো শরীরে রয়ে গেছি। আমি এর চিন্তা ভাবনা সব ধরতে পারছি। কারন এখন আমি জানি আমার নাম আসিফ। সমস্যা হল আমি জানি না এই “আসিফ”টা কে? এই “আসিফ” কি এই আমি? নাকি ওই আমি? ও যা দেখছে বা শুনছে আমি ঠিক তাই দেখছি বা শুনছি। কিন্তু কিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না।
আমি কি তাহলে অন্য কারো শরীরে আটকা পড়েছি? নাকি আমিই আসিফ, অন্য কেউ আমার শরীর দখল করেছে?
হঠাৎ কি মনে হওয়াতে আসিফ পেছনে ফিরে তাকালো। কাঁচের গেটটা দিয়ে একজনকে দ্রুত পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসতে দেখলাম। এর নাম শাহেদ, আসিফের বন্ধু, বিজনেস পার্টনার। আরো যেন কি সব চিন্তা ওর মাথায় খেলে গেল, ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।
কাছাকাছি এসে শাহেদ ওকে জিজ্ঞেস করল, “কিরে তুই হঠাৎ কোথায় হারিয়ে গেলি? তোকে বললাম আমার জন্য একটু অপেক্ষা করতে।
আর তুই এই ফাঁকে উধাও হয়ে গেলি?”
আসিফ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “মানে?”
“অফিস থেকে বেরিয়ে তোকে বললাম একটা সেকেন্ড দাঁড়াতে আর তুই আমাকে ফেলে নিচে নেমে এলি?”
আসিফ অন্যমনস্কভাবে বলল, “লিফটটা তখনই চলে এলো। ”
“আর তুই আমার কথা ভুলে গেলি?”
অনিশ্চিত ভাবে সে জবাব দিল, “কি জানি!”
আমার সামনে আকাশ ছোঁয়া উঁচু বিল্ডিংটা অন্ধকারে নিমজ্জিত। সামনে নীল নিয়ন সাইনে সুন্দর করে লেখা, জেভিয়ার টাওয়ার। শরীরটা বাঁকিয়ে আমি দালানটার শীর্ষে তাকালাম। আকাশে কি মেঘ করেছে? বিদ্যুতের ঝলকে বিল্ডিংটার সরু হয়ে আসা চূড়াটা দেখা গেল।
“কিরে তোর আবার কি হলো?” শাহেদ আসিফের কাঁধ ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করে।
“কি হবে?”
“কেমন যেন অন্যমনস্ক লাগছে তোকে। ”
সে অস্ফুট ভাবে “হুমমম” বলে চুপ করে আকাশে চেয়ে রইল।
“আচ্ছা, যা হওয়ার হয়েছে। বাদ দে।
এখন চল। ”
আসিফ একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ঘুরে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। আমাদের এগিয়ে আসতে দেখে গার্ডটা দরজা খুলে দিয়ে একটা স্যালুট দিল। আমরা গাড়িতে বসার সাথে সাথে সেটা মসৃণ গতিতে চলতে শুরু করল। শাহেদ পকেট থেকে সেল ফোনটা বের করে ঘাঁটাঘাঁটি করা শুরু করল।
আসিফও ওর দেখাদেখি পকেট থেকে ফোনটা বের করল।
ঈশিতা দু’বার ফোন করেছিল। নামটা দেখার সাথে সাথে একটা স্নিগ্ধ চেহারার মেয়ের মুখ আমার মনে ভেসে উঠল। হ্যাঁ, একে তো আমি চিনি। ঈশিতা আসিফের স্ত্রী।
ভালবেসে বিয়ে করেছিল ওরা। কিন্তু...
অনিচ্ছা সত্ত্বেও যেন সে কল ব্যাক করল। ওপাশে ফোন রিসিভ করার পর তার কণ্ঠে রাজ্যের বিরক্তি ঝরে পড়ল,
“হ্যালো! কি ব্যাপার? বার বার ফোন করছো কেন?
“তোমার কি আসতে দেরী হবে? বাসায় কেউ নেই। একা একা আমার খুব ভয় করছে। ”
আমি মেয়েটার সিল্কের মতো নরম আর মোলায়েম কণ্ঠ শুনে মুগ্ধ হলাম।
মেয়েটার কথা বলার ভঙ্গি বা গলার আওয়াজে এমন একটা কিছু ছিল যেটা শুনে আমার মনে হল মেয়েটা অনেক কষ্ট তার বুকে চেপে ধরে রেখেছে। বৃষ্টির দিনে আঁধার হয়ে আসা ঘন কালো মেঘের মতো। একটু ছোঁয়াতেই অঝোর ধারায় শ্রাবণ নেমে আসবে যেন।
আসিফ রূঢ় স্বরে জবাব দিল, “যতসব আজেবাজে কথা। বাসায় এতো কাজের লোক।
রহিমা কোথায়? ওকে তোমার কাছে এনে রাখ। ”
“রহিমা অনেক কথা বলে। এতো কথা শুনলে আমার মাথা ধরে যায়। শরীরটা এমনিতেই ভালো না। ”
“শরীর ভালো না তো ডাক্তার দেখাও, টেক সাম মেডিকেশন।
আমাকে বিরক্ত করছ কেন? একা লাগলে নিচ তলা থেকে মা’কে ডেকে নিয়ে আসো। “
“মা ঘুমাচ্ছে। তুমিই একটু তাড়াতাড়ি আসো প্লিজ। অনেক রাত হয়েছে। “
সে আর কথা না বাড়িয়ে লাইনটা কেটে দিল।
শাহেদ মোবাইল থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, “কে, ভাবি?”
“হ্যাঁ। ”
“এমন করিস কেন ওর সাথে?”
“আমি কি করলাম?”
“নিজের বউ এর সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?”
পাশ ফিরে দেখলাম। সেল ফোনের আলোতে শাহেদের মুখটা দেখা যাচ্ছে। চোয়াল শক্ত করে বসে আছে।
আসিফ প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলল, “তুই কোথায় নামবি?”
“এই তো সামনেই।
”
আর কোন কথা খুঁজে না পেয়ে সে অপ্রাসংগিক ভাবে বলে উঠল, “বাইরে যখন দাঁড়িয়ে ছিলাম, তখন কেন যেন মনে হচ্ছিল আড়াল থেকে কেউ একজন আমাকে দেখছে। ”
শাহেদ মোবাইল বন্ধ করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “আসিফ, তুই মনে হয় একটু বেশী স্ট্রেস নিয়ে ফেলছিস। বাসায় যা, খাওয়া দাওয়া করে শান্ত হয়ে একটা ঘুম দে। ”
আমি ওর কথা শুনে নরম সিটে গাটা এলিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণ পর, পথে এক জায়গায় শাহেদ নেমে গেল।
অন্ধকার গাড়িতে বসে থাকা নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ বলে মনে হল আমার।
দশ মিনিট পর আমরাও বাসায় চলে এলাম। দরজা খুলল ঈশিতা। উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে বলল,
“এতো দেরী হলো তোমার?”
আসিফ ওর কথার উত্তর না দিয়ে ঘরে ঢুকে গেল। ঈশিতা দরজা লাগিয়ে ওর পেছন পেছন আসলো।
ঘরে ঢুকে সে সোজা নিজের রুমে চলে এল। তারপর জামা কাপড় ছেড়ে দ্রুত ওয়াশ রুমে ঢুকে গেল। আসিফ আজ অনেক সময় নিয়ে গোসল করল। আসলেই সারাদিন অনেক স্ট্রেস গেছে। গোসল করে খুব ফ্রেশ লাগলো ওর।
ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে দেখি ঈশিতা তখনো জেগে আছে। খাটের ওপর মাথা নিচু করে বসে আছে। আসিফকে দেখে মুখ তুলে তাকাল।
“তোমার কি একটু সময় হবে? তোমাকে একটা কথা বলার ছিল। ”
এতো মায়া ভরা বিষণ্ণ মুখ আমি আগে কখনো দেখি নি।
ওর চোখে চোখ পড়তেই বুকটা আমার হুহু করে উঠল। অথচ আসিফের মনে এক বিজাতীয় ঘৃণার উত্তাপ টের পেলাম আমি।
আসিফ হাত নেড়ে জবাব দিল,
“দেখ, সারাদিন অনেক যন্ত্রণা গেছে। এখন আর বিরক্ত করো না। “
ঈশিতা ক্লান্ত স্বরে বলল, “আচ্ছা।
তুমি তাহলে খেয়ে নাও, আমিও শুয়ে পড়লাম, শরীরটা আজ ভালো লাগছে না। ”
আসিফ কোন কথা না বলে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জামা বদলালো। ডায়নিং রুমের দিকে পা বাড়াতেই ঈশিতা পেছন থেকে বলল, “আগামীকাল আমাদের ম্যারেজ ডে। দুপুরে একসাথে লাঞ্চ করার কথা। ভুলে যেও না।
”
আসিফ আবারো কিছু না বলে মাথাটা একটু ঝাঁকিয়ে বোঝাল যে তার মনে আছে।
(৩)
রাতের খাবার খেতে খেতে আসিফ পরবর্তী দিনের কাজ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে। এতে তার কাজে সুবিধা হয়। যে দিন ঈশিতা পাশে থাকে সেদিন আর কিছু করা যায় না। বসে বসে ওর জমানো কথা শুনতে হয়।
বিরক্তিকর একটা অবস্থা। খেতে বসে আসিফ ঠাণ্ডা মাথায় অনেকগুলো চিন্তা ভাবনা করলো।
আসিফের মনের ভাসা ভাসা ভাবনাগুলো এখন আমি খানিকটা হলেও বুঝতে পারছি। এতক্ষণে ওর সম্পর্কে অনেক কিছু আমার কাছে পরিষ্কার হলো। তবে আগামীকাল ও যে পরিকল্পনাটা করেছে সেটা বুঝতে পেরে আমি চমকে উঠলাম।
ঈশিতা জানে না যে অফিসে ওর জন্য বিশাল সারপ্রাইজ পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। সবাই সেখানে আসবে। ঈশিতা আসবে, আসবে জামশেদও।
জামশেদ সেখানে কেন আসবে সেটা বুঝতে পেরে আমার মেরুদণ্ড বেয়ে একটা শীতল স্রোত যেন নেমে গেল। আসিফ জামশেদকে একটি বিশেষ কাজের নির্দেশ দিয়েছে।
আসিফের সাথে জামশেদও ঈশিতার জন্য অপেক্ষা করবে। হয়তো অপেক্ষায় থাকবে শাহেদও।
ছয় মাস আগে থেকে আসিফের মনে ঈশিতা আর শাহেদকে ঘিরে সন্দেহের দানা বেঁধেছে। এক সময় সেই সন্দেহ রূপান্তরিত হয়েছে বিকৃত ঘৃণা আর প্রতিহিংসায়। সত্য মিথ্যা যাচাই করার মতো মানসিক অবস্থা এখন ওর নেই।
গতকাল রাতেই জামশেদ লিফটের হাইড্রলিক ব্রেক অকেজো করে এসেছে। আগামীকাল সে আসিফের ফোনের জন্য অপেক্ষা করবে ছাদে, লিফটের মেশিন রুমে। ঈশিতাকে নিয়ে লিফটটা যথেষ্ট উচ্চতায় পৌঁছালে, সেটা জামশেদের নিপুণতায় বিকল হয়ে তীব্র গতিতে নিচে নেমে আসবে। সমস্ত ঘটনাটা ঘটবে একটা দুর্ঘটনার মতো।
সে রাতে আসিফ ঘুমিয়ে পড়লেও আমি ওর মনের অন্ধকারে এক ভয়াবহ আতংক নিয়ে জেগে রইলাম।
নিজেকে প্রচণ্ড অসহায় লাগছে। হঠাৎ করে এটা কোন ঝামেলায় জড়িয়ে গেলাম আমি? কি করবো আমি এখন? সারারাত পার হল প্রচণ্ড অস্থিরতায়। কিছুই ভেবে উঠতে পারলাম না।
আমার অস্থিরতা ঘুমন্ত আসিফকেও স্পর্শ করল। ঘুমের মধ্যেও সে বারে বারে কেঁপে উঠছিল।
আমার ভয়াবহ দুশ্চিন্তা হয়তো ওর কাছে দুঃস্বপ্ন হয়ে ধরা দিচ্ছিল। আর প্রতিবারই আমি টের পেলাম আসিফের মাথায়-বুকে ঈশিতার নরম হাতের কোমল স্পর্শ। প্রতিবার ওর মায়া ভরা স্পর্শে আসিফের সাথে সাথে আমার অস্থিরতাও কমে আসছিল।
আমার খুব ইচ্ছা করছিল একবার চোখ খুলে তাকাই।
(৪)
ঈশিতার আজ মনটা খুব খুব খুব ভালো।
আজ ওদের তৃতীয় বিবাহ বার্ষিকী। সে উপলক্ষে আসিফ আজ অফিসে বিশাল আয়োজন করেছে। আসিফ এমনিতে খুব রগচটা হলেও ঈশিতা জানে ভেতরে ভেতরে আসিফ আসলে কোমল মনের একজন মানুষ। ম্যারেজ ডে-তে ও যে এতো বড় একটা প্রোগ্রাম অ্যারেঞ্জ করবে সেটা সে ভুলেও ভাবতে পারেনি। রাতের বেলাও আসিফের মুখ দেখে সে কিছু বুঝতে পারেনি।
হয়তো সারপ্রাইজ দেয়ার জন্যই ও রকম চেহারা করে ছিল।
কথাটা মনে পড়ে ঈশিতা মনে মনে একটু হাসলো। মুখ চোখ ও রকম কালো করে না রাখলে ঈশিতাও কালকে আসিফকে একটা সারপ্রাইজ দিতো। এক মাস পুরোনো হলেও আসিফকে চমকে দেয়ার মতো একটা সুখবর তার কাছেও আছে।
কথা ছিল ম্যারেজ ডে উপলক্ষে দুপুরে ওরা এক সাথে লাঞ্চ করবে।
সেখানে সকাল বেলাতেই সাহেদ ভাইয়ের ফোন,
“হ্যাপি ম্যারেজ ডে ভাবী!”
“থ্যাঙ্ক য়ূ, শাহেদ ভাই। ”
শাহেদ খুশী খুশী গলায় বলল, “আপনার বদ মেজাজী জামাই তো বিশাল কাণ্ড করেছে। ”
“কি করেছে ও আবার?”
“দুপুরে অফিসে আজ বিশাল এক পার্টি থ্রো করেছে আপনার সম্মানে। হা হা হা। দেখলেন? আমার বন্ধুকে আপনি এখনো চিনতে পারেন নি।
”
ঈশিতা এতো অবাক হয়েছিল যে ওর মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হল না। আসিফ মনে হয় শাহেদ ভাইয়ের সাথেই ছিল।
“নিন ভাবী, আপনার জামাইয়ের সাথেই কথা বলেন। ”
ফোনে আসিফের শীতল কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
“হ্যাপি ম্যারেজ ডে। ”
কথাগুলো শুনে খুশীতে ঈশিতার চোখে পানি চলে এলো।
কোন রকমে চোখের পানি আটকে বলল,
“তুমি কি জানো আমি তোমাকে কত ভালোবাসি?”
আসিফ আবারো শীতল গলায় বলল, “জানি। ” তারপর একটু থেমে বলল, “তুমি নিচে এসে আমাকে ফোন দিয়ো। ”
“আচ্ছা। ” বলে ঈশিতা ফোন রেখে দিল।
আনন্দে তার চোখে এখন সত্যিই পানি চলে এলো।
চোখে পানি নিয়েই আজ সে অনেক সময় নিয়ে সাজলো। সাজগোজ শেষ করে আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজেকে অনেকক্ষণ প্রাণ ভরে দেখল সে। পেটের কাছটায় পরম মমতায় কিছুক্ষণ হাত বুলিয়ে সে চোখ মুছে নিল। আজ তার আনন্দের দিন। আজ তার চোখে পানি মানায় না।
(৫)
আসিফ এখন বসে আছে জেভিয়ার টাওয়ারের টপ ফ্লোরে, তার অফিসে। পুরোটা স্পেস নিয়েই অফিস। অফিসে ঢুকেই চোখে পড়বে দামী আসবাব আর আরামদায়ক সোফায় সজ্জিত ওয়েটটিং রুম। সোফাগুলোর বিপরীতে যে দেয়ালটা আছে, তাতে জলরঙে আঁকা এক বিষণ্ণ বিকেলের ছবি ঝুলছে। ছবিটা আসিফেরই আঁকা।
সম্ভবত তার সবচেয়ে প্রিয় ছবিগুলোর মধ্যে এটা একটা।
রুমের শেষ প্রান্তে আছে বড়সড় কালো একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিল, তার সম্মুখে কাঠের তৈরি ভারী ভারী কয়টা চেয়ার। এইমুহূর্তে টেবিলের পেছনে রাজকীয় সুইভেল চেয়ারে হেলান দিয়ে আসিফ তাকিয়ে আছে ওয়েটিং রুমের সেন্টার টেবিলে রাখা বড় একটা ফুলের তোড়ার দিকে। অ্যানিভারসেরির গিফট।
ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল আসিফ।
কিছুই ভালো লাগছে না। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। ভয়াবহ কিছু দুঃস্বপ্ন সারারাত তাকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। এখন ফুলগুলোর দিকে তাকিয়েও কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে তার। মনে হচ্ছে সব কয়টা ফুল বড়বড় চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
দূর থেকে তোড়াটা দেখে মনে হচ্ছে ওটা ফুল দিয়ে বানানো একটা মানুষের মুখ। মুখটা হাসি হাসি। সেই হাসির কোন অর্থ নেই কিন্তু অদ্ভুত একটা আকর্ষণ আছে।
টেবিলের ওপর রাখা ফোনটায় এমন সময় আলো জ্বলে উঠল। ঝট করে আসিফ সেদিকে তাকাল।
তাকালাম আমিও। ঈশিতা চলে এসেছে। আমার কেমন যেন টেনশন লাগা শুরু হল।
আলগোছে ফোনটা তুলে আসিফ স্ক্রিনটার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে একবার দেখল। তারপর রিসিভ করে কানের কাছে নিয়ে ধীর গলায় বলল, “হ্যালো... হ্যাঁ বল।
”
ফোনের ওপাশ থেকে ঈশিতার উৎফুল্ল কণ্ঠ ভেসে এলো, “অ্যাই, আমি নিচে চলে এসেছি। তুমি কি নিচে আসবে? এখানে সবাই খুব হৈচৈ করছে!” কথাটা বলে ও খিল খিল করে হাসতে লাগলো। ওর হাসিটা শুনতে আমার খুব ভালো লাগছিল। হাসিটা কেমন যেন রিনিঝিনি বাজছিল কানের মাঝে। ফোনের মধ্যেই বোঝা যাচ্ছে নিচে অনেক লোক ওকে ঘিরে ধরেছে।
কিন্তু তার মধ্যেও শাহেদের গলাটা আলাদা ভাবে বোঝা যাচ্ছে।
মুহূর্তেই ভুরু জোড়া কুঁচকে ফেলে আসিফের চেহারা পাল্টে গেল। আমি টের পেলাম অসম্ভব রাগে ওর হাত পা নিশপিশ করছে। চোয়ালটা শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে ও কোন রকমে শান্ত গলায় বলল, “তুমি উপরে চলে এসো। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
”
ঈশিতা বলল, “আচ্ছা, আসছি . . . তোমার জন্য দারুন একটা সুখবর আছে। ”
আসিফ অধর্য্য হয়ে বলল, “কি বলবে তাড়াতাড়ি বল। ”
আসিফের কণ্ঠের অস্থিরতা টের পেয়ে ঈশিতা আবার রিনঝিন করে হেসে উঠে বলল, “আসছি জনাব। এতো অস্থির হওয়ার কিছু নেই। সুখবর আমি সাথে নিয়েই আসছি।
”
বিরক্তিতে আসিফ মুখ চোখ বিকৃত করে ঈশিতার ফোনটা কাটল। তারপর পকেট থেকে আরেকটা ফোন বের করলো। ডায়াল লিস্টে জামশেদের নামটা উঠতেই আমার বুকটা কেঁপে উঠল। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করলাম আসিফকে থামাতে। কিন্তু পারলাম না।
ফোনে আসিফ শুধু বলল, “সময় হয়েছে। ” তারপর লাইনটা কেটে দিলো।
প্রচণ্ড টেনশন লাগছে। কিন্তু তার মাঝেও অদ্ভুত একটা অনুভুতি আমার মাঝে আবার ফিরে এলো। ঈশিতা কিসের সুখবর সাথে করে নিয়ে আসছে? কথাটায় কি কিছুর ইঙ্গিত দিতে চাইল?
আমি চমকে উঠলাম।
আচ্ছা, মেয়েটা প্রেগন্যান্ট নাতো? আসিফের দেহে আমি বসে আছি তারপরও কথাটা মনে হওয়ার পর আমার সারা শরীরে আতংকের হিম শীতল একটা স্রোত বয়ে গেল। বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডটা এতো জোরে ধকধক করা শুরু করলো যে কান পাতলে আওয়াজ শোনা যাবে।
আমাকে কিছু একটা করতেই হবে। এই ঘটনা ঘটতে দেয়া যাবে না। কিছুতেই না।
কিন্তু কিভাবে? বুঝতে পারছি না। কিছুই বুঝতে পারছি না। সব কিছু এলোমেলো লাগছে।
=============================================
অদ্ভুত, অলৌকিক কিছু একটা ব্যাপার ঘটছে। তার সমস্ত মন-প্রাণ যেন অব্যাখ্যাত কোন একটা আবেগে ভেসে যাচ্ছে।
সেই আবেগের মাত্রা এতো তীব্র যে আসিফ সেটা সহ্য করতে পারছে না। অসহ্য সুখের এক অজানা অনুভূতির সাথে সাথে ভয়াবহ এক নিঃসঙ্গতা তাকে প্রতি মুহূর্তে বিমোহিত করে ফেলছে। এটা কি ভালোবাসার অনুভূতি? ভালোবাসার অনুভূতি এতো তীব্র হয়? হ্যাঁ, ভালোবাসাই তো! ঈশিতাকে সে যে কি প্রচণ্ড মাত্রায় ভালোবাসে সেটা কি কেউ জানে?
চোখ মুছে আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। খুব বেশী দেরী হয়ে যায়নি তো?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।