আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সময়ের নিদর্শন : মনিকা আলি ( পর্ব ২ )

বাস্তবতা ফেরী করে বেড়াচ্ছে আমার সহজ শর্তের সময়গুলোকে

পাঠকদের নৈমিত্তিক কিছু ব্যাপার সব সময়ই থাকে। নারায়ণ তার উপন্যাসে ডেইসির শিষ্টাচার সম্বন্ধে পাঠকদের জানিয়েছেন। পাশাপাশি দারিদ্র্যের সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সমস্যাটি সম্বন্ধে বলেছেন। যদিও বইটিতে নারায়ণ লেখক হিসেবে তার চরিত্র ডেইসির সঙ্গে মাঝেমধ্যে নিছক কৌতুক করেছেন। তবু তিনি লজিকাল আর্গুমেন্ট তাতে দাড় করিয়ে রেখেছেন।

ডেইসি আধুনিক কিছু চিন্তা-ভাবনা বয়ে বেড়ায়, যা নারায়ণের পশ্চিমের সঙ্গে মেলবন্ধন করার প্রয়াস। যখন তিনি চরিত্রটি সাজাতে যাচ্ছিলেন তখন তিনি তাকে ইউনিভার্সিটি অফ অস্ট্রেলিয়ায় পাঠানোর চিন্তা করেন। কিন্তু শেষে তার বদলে মিশনারি শিক্ষাকে নির্বাচন করেন। অন্যদিকে রমন যুক্তিবোধের প্রতি সমানভাবে দায়বদ্ধ। যখন তার বন্ধু গুপ্ত গ্রামে তাদের কাজ জন্মহার কমিয়ে আনছে কি না তা তদন্ত করতে যায় তখন রমন বলে, এটি কি এক বছরে পাচ ভাগ কমে যায়নি, কোনটি তাহলে ক্রেডিটেবল।

কিন্তু যখনই সে প্রচারাভিযানে যায় তখন ঠিকই সে কথামতো কাজ করে। এটি যুক্তির বাইরে থেকে নয় বরং ভালোবাসার বাইরে থেকে। প্রাথমিক পর্যায়ে সে এর বিরোধিতা করেছিল। এক পর্যায়ে রমনের বুঝতে বাকি থাকে না, ডেইসির দৃষ্টিভঙ্গি এমন এক দিকে গড়িয়েছে যে, দাম্পত্য জীবনে হস্তক্ষেপ করা নিষ্ফল হবে। এই ইসুটির মাধ্যমে পূর্ব এবং পশ্চিমের চিন্তা-ভাবনা পারস্পরিক বিরোধ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

ডেইসি আরো অধিক প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে ওঠে যে, সব কিছু অবশ্যই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকতে হবে। টাউন হলে প্রফেসরের দেয়া ছোট একটি বক্তব্য রমনকে নাড়া দেয়। প্রফেসর বলেছিলেন, এটি এক সময় শেষ হয়ে যাবে। এ শব্দগুলো তার মনে নাড়া দেয়। আজ আগামীকালে গিয়েই আগের দিন হয়ে যাবে, এটি হয়ে দাড়ায় মহা বিশ্বে নিঃসঙ্গতার প্রতীক স্বরূপ।

মানব জাতির পক্ষে এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এই চিন্তা-চেতনা মনে করিয়ে দেয় যে, ডেইসির উচিত তার নিজস্ব কাজে স্থির হওয়া। যদিও নারায়ণ নিজে ডেইসির আর্গুমেন্টের প্রতি আলাদা মূল্য দিয়েছে। এটি তার চরিত্রের প্রতি যথেষ্ট সম্মান জানিয়েই করেছে। তবে কোথায় সহানুভূতি লুকিয়ে রয়েছে তা খুজে বের করা মোটেও কঠিন নয়।

রমনের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ হচ্ছে শিশুদের ঘাটতিগুলো সম্বন্ধে জ্ঞানদান করা ছাড়া অন্য কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখানো। তবে নারায়ণের দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ এর বিপরীত। শিশুদের প্রতি নির্যাতন সম্বন্ধে ইনডিয়ার পার্লামেন্টের মেম্বার হিসেবে তিনি অনেক বলেছেন। তিনি ভারী স্কুল ব্যাগের বিষয়টি অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে বাতিল করার বিষয়ে জোর দিয়ে বলেছিলেন। ইউনিফর্মের বাধ্যবাধকতা এবং সব সময় হোমওয়ার্কের পেছনে ব্যয় করার বিষয়টিরও বিরোধী তিনি।

কারণ এগুলো শিশুদের খেলতে কিংবা স্বপ্ন দেখতে কোনো সময়ই দেয় না। নারায়ণ খুবই মজার একজন লেখক। দি পেইন্টার অফ সাইনস বইটি তার সবচেয়ে ফানি একটি বই। ডেইসির অর্জিত কমিটমেন্টগুলো নিয়ে তিনি খুব ফান করেছেন। কমেডি বেশি দূর এগোয় না, কারণ রমন নীরবে ডেইসিকে খোচা মেরে কথা বলতে শুরু করে।

তার সিরিয়াসনেসকে অবজ্ঞা করে। কিন্তু হিউমারের দিক থেকে রমন নিজের মধ্যে লাগাম রাখতে পারে না। সে ডেইসিকে গর্ভধারণ বর্জনের প্রতি প্রবল তার অনুরাগের বিষয়টি সম্বন্ধে বলতেও দ্বিধাবোধ করে না। একই সময়ে সে তার জীবনকে নিয়ন্ত্রিত রাখতে চায়। মনকে যৌনতার বিরুদ্ধে সাজাতে চায় আবার আচ্ছন্নতার বিপক্ষেও সে।

আবার সে বেশির ভাগ সময়ই ডেইসির সাহচর্যে কাটায়। নারায়ণের লেখায় সব সময়ই কিছু বিষয় উঠে আসে। তা হলো, কাউকে কষ্ট দিয়ে আমরা মজা পাবো না। তার বদলে কৌতুকটি হয়ে উঠুক আপামর সবার জন্য। নারায়ণের চিন্তা-ধারণার পদ্ধতি অন্য রকম।

এ ক্ষেত্রে র‌্যাশনালিজম অথবা হিন্দুইজম অথবা যে কোনো ধরনের ইজম সমানভাবে অসার এবং কমেডিক হয়ে উঠে। রমনের ডেইসি-ইজম-এ ক্রমাগত আকৃষ্ট হওয়ার মধ্য দিয়েই নারায়ণ চিন্তা-চেতনার প্রকাশ করেছেন। তবে ডেইসি-ইজম সঠিক এবং ইন্টারেস্টিং ছিল, তা কখনোই সিরিয়াসলি কিংবা ট্র্যাজিকালি নেয়ার মতো হয়নি। অবশ্য এটাও ঠিক, রমন ক্রমাগত ডেইসি-ইজমকে সিরিয়াসলি এবং ট্র্যাজিকালি দুভাবেই নেয়া শুরু করেছিল। লোকটির এ থেকে পরিত্রাণের উপায় ছিল কম ।

তাদের পরিচয়ের প্রথম থেকেই সে তার অনুভূতি নিয়ন্ত্রণে অক্ষম ছিল। বইটির অধিকাংশ জুড়ে রমন তার ফুফুর দ্বারা উত্ত্যক্ত হয়েছে। তার ধর্মীয় ত্যাগ, তার প্রশ্ন, তার গোড়ামি, জীবন সম্পর্কীয় চিন্তা-চেতনার সঙ্কীর্ণতা দিয়ে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। যখন রমনের ফুফু বেনারসে তীর্থযাত্রী হয়ে যাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন তখন রমন ভাবে, সে সেখানে মরার জন্য যাচ্ছে। রমন একটি দিনও তাকে ছাড়া চিন্তা করতে পারে না।

এরপর থেকেই রমনের ফুফু বুঝতে পারেন তার জীবন সম্বন্ধে। তিনি উপলব্ধি করেন কতো নিরাপদে তিনি জীবনযাপন করছেন। নারায়ণ সব সময় ইনডিয়ান নারীদের অবস্থা সম্বন্ধে সহানুভূতিশীল। তার একটি উপন্যাস (দি ডার্করুম) প্রধানত এই থিমটির ভিত্তিতেই রচিত। দি পেইন্টার অফ সাইনস-এ আমরা দেখতে পারি নারীর সত্তা শুধু ফুফুটিই বয়ে চলেন না, বরং তা ডেইসির মধ্যেও রয়েছে।

ডেইসি এবং ফুফুর চিন্তা-চেতনা সম্পূর্ণ বিপরীত। এ যেন মেরুর এপিঠ ওপিঠ। ডেইসি তার যুক্তিবাদিতা এবং চিন্তা-ভাবনার আধুনিক পদ্ধতির কাছে দায়বদ্ধ। সে রমনের প্রতি এমন আকর্ষণ দেখায় যেন সে তার প্রতি খুবই দুর্বল। অন্যদিকে ফুফুটি ধর্মীয় বিশ্বাস এবং রাশিচক্রের প্রতি দায়বদ্ধ।

এভাবেই সে তার চিন্তাকে পরমানন্দদায়ক করে তোলে। যদিও তারা চিন্তা-চেতনায় একে অন্যের বিপরীতমুখী, তবুও পরিহাসমূলকভাবে তার নির্দিষ্ট কিছু বিশ্বাস একই রকম। অন্য একটি উপন্যাসে নারায়ণের পর্যবেক্ষণ (দি ভেন্ডর অফ সুইটস), আমরা আমাদের আসক্তির কারণে অন্ধ। প্রতিটি আসক্তিই বিভ্রম তৈরি করে। অবশেষে এটি আমাদের বয়ে বেড়াতে হয়।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।