যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবী করছি
সেমিস্টারের শুরুতেই জানলাম সর্বমোট ২২ টা ফিল্ড ট্রিপ হবে। আমার মতো একজন ঘরকুনো বাঙালীর এহেন বিদেশ দর্শনের সুযোগ একটা বিরাট বিষয় সন্দেহ নেই। প্রথম ফিল্ড ট্রিপের বিষয়ে নোটিশ পেলাম সপ্তাহ খানেক আগে। একটা চাপা আনন্দের সাথে নোটিশটা পড়লাম। তাতে কি কি নিতে হবে তার লিস্ট।
যেমন - গরম কাপড়, গ্লাবস ছাড়াও বিশেষ ভাবে লেখা ছিল পাসপোর্ট এবং রেসিডেন্ট কার্ড।
ভ্রমনসূচীতে দেখলাম - আমরা যাবো এন্ডোভান শহরের বাইরে একটা কনজারভেশন এরিয়ায়। যেখানে রাইন নদীর অতিব্যবহারের ক্ষতিগ্রস্থ একটা এলাকাকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে নিতে জার্মান-নেদারল্যান্ডস-ফ্রান্স মিলে একটা রিবাট এলাকায় প্রজেক্ট নিয়েছে। সেটা অবশ্যই ভাল একটা কাজ। কিন্তু আমাকে যে বিষয়টা বিশেষভাবে আমোদিত করছে তা হলো আমাদের বাহনটা গন্তব্যে যাওয়ার রাস্তাকে সংক্ষিপ্ত করার উদ্দেশ্য বেলজিয়াম নামক আরেকটা দেশের ভিতর দিয়ে যাবে।
নেদারল্যান্ডস আসার আগে আমার বিদেশ ভ্রমনে অভিজ্ঞতার মধ্যে ছিল হবিগঞ্জ জেলার বাল্লা নামক এক স্থানে ট্রেনে গিয়ে খোয়াই নদী পাড়ি দিয়ে (প্রায়ই হেটে) ভারতের খোয়াই টাউনের বাজারে যাওয়া। তাতেই মনে মনে বিদেশ ভ্রমনে একটা পুলক অনুভব করতাম। এহেন বঙ্গসন্তানের জন্যে ইউরোপের তৃতীয় আরেকটা দেশ দর্শন আসলেই বিরাট ব্যাপর বটে।
যাত্রার আগের রাতে ভাল ঘুম হলো না। কারন কিছুটা উত্তেজনা আর কিছুটা আড্ডাবাজি।
কয়েক ঘন্টা ঘুমের পর এলার্মের তীব্র কর্কশ শব্দে ঘুম থেকে উঠে তাড়াহুড়া করে এক স্লাইস রুটি আর কফি দিয়ে নাস্তা শেষ করে নীচে আসতেই দেখি বিরাট এক বাস দাড়িয়ে। ট্যুর গাইড প্রফেসার হাসিমুখে ঘড়ি দেখালো - দেখলাম যাত্রা শুরু ৫ মিনিট বাকী। ভিতরে গিয়ে বসলাম কেনিয়ান সহপাঠী ইয়ানের সাথে। বলা দরকার - ইয়ান ছিল আমাদের ক্লাশের সবচেয়ে বড় কথক - ভাল ইংরেজীতে ননস্টপ কথা বলার কোন রেকর্ডে হয়তো ওর নাম যেতে পারতো - শুধু উদ্যেগের অভাবেই হয়নি বলে আমার বিশ্বাস।
বাস ছাড়তেই শুরু খোলে গেল ইয়ানের মুখ।
এক ফাকে ওকে বেলডিয়ামের বিষয়টা বললাম। দেখলাম ওর আগ্রহ আমার চেয়ে অনেক বেশী। দুইজনই পাসপোর্ট খুলে ব্যানেলাক্সের ভিসার সিলটা পরখ করে নিলাম - পাছে না আবার ঝামেলা হয়।
ইয়ানের বকবক শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি খেয়াল করিনি। সম্ভবত ইয়ানও একসময় কথাক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলো।
ঘুম ভাংগলো প্রফেসরের স্পীকারের ঘোষনায় - লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান...উই আর ...। হুড়মুড় করে দাড়িয়ে গেলাম। কি অবাক কান্ড। আমরা এন্ডোভানে - আমাদের বাস কি বেলজিয়াম যায় নি, মনে মনে বললাম হয়তো বর্ডারের ঝামেলা এড়ানোর জন্যে ঘুরেই এসেছে।
বেলজিয়াম অদর্শণের দু:খ মনের মধ্যে চেপে রেখে প্রফেসরকে অনুসরন করলাম।
প্রজেক্ট দেখলাম, এক জার্মান পরিবেশ বিজ্ঞানীর কঠিন বকবক শুনলাম। প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষ হলো। তখন প্রায় দুপুর বারটা বাজে। প্রফেসর ঘোষনা দিলেন - যেহেতু দামে সস্তা এবং স্বাদের বৈচিত্র্য পাওয়া যাবে - সুতরাং আমাদের লাঞ্চ ব্রেক হবে বেলজিয়ামের একটা ছোট্ট শহরে - সেখান থেকে সোয়া ঘন্টার ড্রাইভ। প্রফেসর আশা করছেন - এই সময়টুকু আমরা অনশনে রাজি হবো।
প্রায় চিতকার করে “রাজী” বললাম। মনে আবার উত্তেজনা এসে গেল বেলজিয়াম দর্শনের। বাসে ঠাস হয়ে বসে থাকলাম। কোন ভাবেই ঘুমানো যাবে না। বাসে এবারও ইয়ান দোস্তের সাথে বসলাম - পাশের সীটে পিটার নামে এক নাইজেরিয়ান আর এক পাকিস্থানী বালুচ।
শুরু হয়ে গেল ভু-রাজনীতি নিয়ে কথা। সেই সময় আল কায়দা ইয়ামেনে এক ইউএস নেভি শিপে বোমা মেরেছিল। আলোচনা আর বিতর্ক চললো মুলত সেই ঘটনা ঘিরে। আমাদের কঠিন আলোচনা জমে উঠার আগেই বাস থামলো। প্রফেসরের ঘোষনা।
আমরা পৌছে গেছি। অবাক হয়ে বাস থেকে নামলাম। এবারও তাহলে বেলজিয়াম দেখা হলো না। প্রফেসর ব্যস্ত। উনাকে জিজ্ঞাসা করার মওকা খুঁজছি - কেন আমরা বারবার বেলজিয়াম এড়িয়ে যাচ্ছি।
কিন্তু সেই সুযোগ পাওয়ার আগেই একটা ছোট্ট রেস্টুরেন্টে খাবার লাইনে দাঁড়াতে হলো। পছন্দমতো কিছু খাবার নিয়ে যখন মূল্য পরিশোধ করতে গেলাম - তখন আবার অবাক হবার পালা। ক্যাশিয়ার মেয়েটা জানতে চাইলো - কিভাবে বিল পরিশোধ করবো? আমি কিছু বুঝার আগেই আমার পিছনে দাড়ানো এক ডাচ ছাত্র বললো - “গিল্ডার”। আমি বিল দিতে গিয়ে দেখলাম - ক্যাশে দুইটা মেশিন - একটা নেদাল্যান্ডসের গিল্ডার আরেকটা বেলজিয়াম ফ্রাঁ জন্যে। আমার জটপাকানো মাথায় তখনও ধরা পড়েনি যে আমি বেলজিয়ামের ভিতরে এক রেস্টুরেন্টে খাবার কিনছি।
ডাচদের স্বভাবগত কারনেই সেই ছাত্রটা এগিয়ে এসে আমাদের টেবিলে বসলো এবং আমাদের বুঝিয়ে দিলো - সীমান্তের কাছাকাছি সকল বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠান দুই দেশের মুদ্রা একই ভাবে ব্যবহার করে। সে ভবিষ্যত ইউরোর আগমন এবং সুবিধা বর্ননা করছিলো - কিন্তু আমি বোকা হয়ে বসে বসে ভাবছি - আমি বেলজিয়ামে আর একটুও বুঝলাম না। এদের বর্ডারের কি হলো?
আমাদের মতো বিডিআর- বিএসএফ নাই কেন? এরা কি চোরাকারবারী করে না? এখানে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া নেই কেন? এরা কি অন্যদেশের কৃষকদের চোরাকারবারী সন্দেহের কথা বলে টার্গেট প্রাকট্যিসের জন্যে ব্যবহার করে না? হাজারো প্রশ্ন এই বঙ্গসন্তানকে ভারাক্রান্ত করলেও জাতীয়তা বোধ আর দেশের ভাবমূর্তির কথা ভেবে মুখ খোখা থেকে নিজেকে নিবৃত্ত করলাম।
খাওয়া শেষ করে ঘুরেটুরে ছোট্ট শহরটা দেথে ফেরার জন্যে বাসে উঠলাম। ইয়ান আর পিটার অতিভোজনে ক্লান্ত হয়ে মুখ বন্ধ করে ঘুমের ভাব করছে।
আমি জানালা দিয়ে বাইরে দৃশ্য দেখছি। আর ভাবছি - আমার দেশের কথা। চোরাকাবার ঠেকানো আর দেশের জমি রক্ষার জন্যে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে বিডিআর পোষা হয় সেখানে। কিন্তু চোরাচালান ঠিকই হচ্ছে। ঢাকার সবচেয়ে বড় বাজারে ভারতীয় পন্য পাওয়া যায় অবাধে।
এই সব মেকী আয়জনে লাভবান হয় বিডিআর এর কর্তারা আর চোরাকারবারী প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ। সাধারন মানুষের ভাগ্যন্নোয়নে অর্থ ব্যয় না করে সীমান্ত রক্ষার নামে একশ্রেনীর মানুষকে ধনশালী বানানোর এই অপরাধ থেকে কি বাংলাদেশ কখনও মুক্তি পাবে!
এই সব এলেবেলে ভাবনায় যখন মন বিভোর - তখন দেখলাম দুরে একটা সাইনবোর্ড দেখা যাচ্ছে - তাতে ডাচ, ডয়েচ আর ইংরেজীতে লেখা - “বিদায়, বেলজিয়াম”। কয়েক মিটার দুরে আরেকটা সাইনবোর্ডে দেখলাম - তাতে তিন ভাষায় লেখা - “স্বাগতম, দ্যা নেদারল্যান্ডস”। আরে এইতো বর্ডার - এইতো সীমান্ত। এই দুইটা সাইবোর্ডই ভাগ করেছে দুইটা স্বাধীন সর্বোভৌম দেশকে।
এই বর্ডার অতিক্রম করতে ১০০ কিমি গতিতে চলমান বাসটাকে একটু ধীরগতিতে যেতে হলো না। থেমে না যাওয়া বা গতি না কমানোর এই ঘটনা কি আসলে ইউরোপের অগ্রবর্তী চিন্তাভাবনারই সিম্বল কিনা ভাবছিলাম।
(২)
এই ঘটনার পর আজ দশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। পরে ট্রেনে গিয়ে বেলজিয়াম দেখে এসেছি। দেখেছি এরা কত দুরদর্শী চিন্তা করছে।
ইইউ পার্লামেন্টের সামনে দাড়িয়ে ভেবেছি - আমরা কি পারিনা ধর্ম- বর্ণ- জাতীয়তার উর্দ্ধে উঠে সার্ক পার্লামেন্ট চালু করতে? আমরা কি বর্ডার নামক একটা কৃত্রিম বিভাজনকে রক্ষার নামে চোরাকারবারী আর রক্ষীদের দূর্নীতির সুযোগ বন্ধ করতে পারিনা? কিন্তু আজও দেখি ধর্ম আর জাতীয়তাবাদের নামে একদল মানুষ সাধারন মানুষকে বোকা বানাচ্ছে - তখন মনে হয় আমরা আসলেই দুর্ভাগা। বিশেষ করে বাংলাদেশ যদি ভারতে সাথে তাদের সীমান্ত নিয়ে একটা ভাল সমযোতায় পৌছতে পারে - মানুষের অবাধ যাতায়াত নিশ্চিত করতে পারে - যদি অবাধ বানিজ্যের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে - তাহলে বাংলাদেশ ১০০ কোটি মানুষের একটা বিরাট বাজার পাবে। কেন বাংলাদেশের মানুষ এই বিষয়টা থেকে বঞ্চিত হবে!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।