জীবন গঠনে নিজেস্ব প্রতিক্রিয়ার দায় বেশি, ঘটে যাওয়া ঘটনার ভূমিকা সামান্য।
ড্যানিশ কার্টুন নিয়ে যখন তোলপাড় শুরু হলো, তখন চারিদিকে নানা মতবাদ, কেউ বলছে কি কার্টুন, তার আবার প্রতিবাদ, কেউ মুচকি মুচকি হেসে নিচ্ছে, কেউ আগুন জালাচ্ছে, কেউ আগুন জালাতে নিষেধ করছে, গম্ভীর মুখ করে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের আহবান জানাচ্ছে। তখন একটু বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম, আসল ব্যাপারটা কি জানার জন্য কৌতুহলী হয়েই গুগল সার্চ দিলাম। যা দেখলাম, তাতে কষ্ট হলো। তবে আমি ওসবের কিছুই করি নি।
আস্তে করে শুধু উইন্ডোটা বন্ধ করে রাখলাম। অনেক্ষন খারাপ লাগাটা ছিল।
তবে খারাপ লাগাটা প্রতিদিন বাড়তো যখন মুসলিম দেশগুলোতে জালাও পোড়াও করার খবর আসতো পত্রিকার হেডলাইনে। ডেনমার্ক ক্ষমা চেয়েছে অনেক পরে, ব্যবসায়িক ক্ষতি হওয়া শুরু হওয়ার পরে। যখন মুসলিমরা ড্যানিশ পণ্য বর্জন করলো, তখন।
যারা অফেন্ডেড হয়েছে, তারা ওই একটা কাজই বুদ্ধিমত্তার সাথে করেছে। নিজেদের ব্যবসায়িক, রাজনৈতিক লাভের চেয়ে মুহাম্মদ (সা) এর প্রতি ভালোবাসা বড় সেটা প্রমান করেছে। কিন্তু অন্যরা এসব কি করছিল! সারা পৃথিবীর কাছে মুসলিমদের চেহারাটা কেমন হয়ে দাঁড়ালো? মুহাম্মদ (সা) নিজে যদি থাকতেন আজ, তাহলে এসব দেখে কি ভীষণ ক্ষুব্ধ হতেন না! মানুষগুলো এসব করছে, একবারও কি যাকে নিয়ে এত হৈ চৈ তার কথা ভেবে দেখছে!
তখন চারিদিকে চলছিল নানা মুনীর নানা মত। অনেক বুদ্ধিজীবিরা মুখ গম্ভীর করে বলছে, এতে ধর্মের অবমাননার কি হলো? আল্লাহ রসুল কি এত ঠুনকো, কোথাকার কোন ডেনমার্কের একজন কার্টুন আঁকবে তাতে আল্লাহ রাসুল অপমানিত হবেন।
এই যুক্তিটা শোনার পরে হেসে ফেলেছি।
কষ্টের হাসি। হায় রে, এত কিছু হচ্ছে, কিন্তু বুঝতে পারছে না আসলে কেন হচ্ছে। যারা এত কিছু করছে, তারাও বুঝাতে পারছে না কেন করছে!
আল্লাহ রাসুলের কিছু হবে কেন, হচ্ছে মানুষদের। এখানে একটু নেপথ্য কাহিনী বলে নেওয়া দরকার। আগেই বলে নেই, এটা আমার ব্যক্তিগত অবজারভেশন।
অবজারভেশন একশ ভাগ সত্যি হবে গ্যারান্টি দিচ্ছি না।
পৃথিবীর জনসংখ্যার ১.৫ বিলিয়ন এখন মুসলিম। অন্য সব ধর্মের অনুসারীদের চেয়ে মুসলিমরাই কিন্তু নিজেদের ধর্মের অনেকটুকু এখনও ধরে রেখেছে। প্রতিটা মুসলিম দেশে গেলেই দিনে ৫ বার আজান হয়। সব মানুষ হয় তো নামায পড়ে না, কিন্তু দিনে নিদেন পক্ষে ৫ বার তো ঈশ্বর চিন্তা হয়, সেটা জোর করে হলেও! অন্য কোন ধর্মের অনুসারীদের সামষ্টিক ভাবে এমনটা হয়? কোথাও না।
সপ্তাহে একদিন কিংবা ষান্মাসিক উৎসবগুলো তে ঈশ্বর চিন্তা হয়তো মনে আসে, এতটুকুই।
তাই মুসলিমদের ধর্ম নিয়ে যেই সেনসিটিভিটি, সেটা অন্য কেউ বুঝার চেষ্টা করলে বুঝতে পারবে না...
শুধু ধর্ম না, মুহাম্মদ (সা) নিয়ে সেনসিটিভিটি। এক্কেবারে ছোট্ট বেলা থেকে মানুষটার আত্মত্যাগ, ২৩ বছরের মাথায় পৃথিবীর চেহারা বদলে দেয়ার স্টেপিং স্টোন তৈরি করে দেয়া, এগুলো মুসলিমরা জেনে আসে। ভালোবাসতে শিখে মানুষটাকে। তখনকার গল্পগুলো পড়ে, যখন মানুষ সব ছেড়ে ছুড়ে দেশান্তরী হতো শুধু এই মানুষটার সামান্য আহবানে।
অনেক মুসলিমের জন্য তাই নিজের বাবা মায়ের চেয়েও মুহাম্মদ (সা) অনেক বেশি প্রিয়। এটা ঠিক স্পষ্ট তুলনা করার বিষয়ও না, মুহাম্মদ (সা) সবচেয়ে প্রিয় মানুষ বনে যায়, এতটুকুতেই থাক।
নিজের বাবা মাকে নিয়ে কেউ আজে বাজে কথা বললে কোন সুসন্তান হাত গুটিয়ে বসে থাকবে? মুহাম্মদ (সা) এর ক্ষেত্রে একই তীব্র ভালবাসা কাজ করে। (বি:দ্র: এটা একটা হাদীসেরই কথা--বিশ্বাস পূর্ণতা পায় যখন মুহাম্মদ (সা) কে জাগতিক সবকিছু, সব মানুষের চেয়ে বেশি ভালোবাসা হয়)।
তাই মানুষগুলো কষ্ট পায়, নিজের মাকে নিয়ে মিথ্যা বললে যেমন আগুন জ্বালিয়ে দিবে, পাগল হয়ে যাবে, তেমনই হয়ে যায় আবেগী মুসলিমগুলো।
আর দেশগুলো যেহেতু নিজেদের গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে দাবী করছে, তাই মানুষদের ভালো লাগা খারাপ লাগাকে মূল্য দিতেই হবে। গণতান্ত্রিক দেশই তো বাই দ্যা পিপল, অফ দ্যা পিপল, ফর দ্যা পিপল। কোন আদর্শিক রাষ্ট্র হতো, ফ্রান্সের মত নিষ্ঠুর হাতে হিজাব ছিঁড়ে নিত, মানুষ বেশি কিছু বলেও পাত্তা পেত না। কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র!
এখন একটা ব্যাপার পরিষ্কার করে দেয়া দরকার। মানুষগুলো কেন কষ্ট পেয়েছে, কেন অমন আচরণ করেছে, সেটার মানবিক ব্যাখ্যা দিলাম আমি।
আমার ধর্মীয় চেতনা সেটা মানতে পারে না। উল্টো ধর্মের অবমাননা মনে হয় অতো সব তুলকালাম কান্ড করে জ্বালানো পোড়ানোকে। তবে প্রতিবাদ, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ, ক্ষমা আদায় করে নেয়া--আমি এতে দোষের কিছু পাই না। অমনটা না হলে কি করে সাহিত্যিকরা জানবে 'সেনসিটিভিটি জোন' কোনটা, তাই কোন অংশটা এড়িয়ে চলতে হবে? কি করে জানবে হলোকস্ট নিয়ে খুচাখুচি যেভাবে সেনসিটিভিটি জোন হিসেবে এড়িয়ে চলে, মুহাম্মদ (সা) কেও সেভাবে ছেড়ে দিয়ে অন্য কিছু নিয়ে সাহিত্য করতে হবে!
কিন্তু বাংলাদেশে এখন যেটা হলো সেটাকে শুধু চূড়ান্ত বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না!
কার্টুনটা আগেও শোনা। এ তো নেহায়তই বালখিল্যতা! কার্টুনিস্ট আর যাই করুক মুহাম্মদ (সা) কে নিয়ে ব্যাঙ্গ করেছে একবারও মনে হয় নি, করেছে মুহাম্মদ নামের আগে লাগানো নিয়ে হুলস্থুলকে।
উদ্ভট! এমন কার্টুন দেশের পত্রিকায় আগেও তো পড়েছি!
ধরে নিলাম, ওই দাড়িওয়ালার ছবি, আর মুহাম্মদ নামটার ব্যবহারে জন্য কিছু মানুষেরা কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু আর যাই হোক, একে কিছুতেই ড্যানিশ কার্টুনের সাথে তুলনা করা চলে না। ড্যানিশ কার্টুনের সাথে তুলনা করা মানেই ব্যাপারটাকে টেনে খুব বেশি প্রসারিত করা। 'বাড়াবাড়ি' করা।
আর এই বাড়াবাড়ির ফলশ্রুতিতে যা হলো, একটা কার্টুন নিয়ে (রোজার দিন) সভার পর সভা, বিক্ষোভ, আলপিন বাজেয়াপ্ত, সুমন্তু আসলামের চাকরিচ্যূত, অল্পবয়সী কার্টুনিস্টের চুড়ান্ত হয়রানি (আমি মনের চোখে দেখতে পাচ্ছি, ছেলেটা সারা জীবনের জন্য 'মুহাম্মদ' নামটা সহ্য করতে পারবে না)--এসব তো মুহাম্মদ (সা) প্রতি ভালোবাসার মত এত ভারি এবং 'সিরিয়াস' একটা ব্যাপারকে ভীষণ রকমের ব্যাঙ্গাত্মক আর ফালতু করে তুলবে বুদ্ধিমান, বিবেকবান মানুষদের কাছে!
এখন হিতে বিপরীত হবে, অতি অবশ্যম্ভবী ভাবেই।
মোটামোটি যা হবে তা দেখা যাক--একে নিয়ে প্রগতিশীলেরা হালকা লেখা লেখি করবেন। দেশের বাইরে এই নিয়ে লেখা লেখি হবে। প্রথমে ছোট আকারে। ব্লগে ব্লগে, শখের সাংবাদিকতায়। তারপরে বড় আকারে।
তসলিমার প্রতি আচরনের সাথে একে তুলনা করা হবে। কার্টুনটা এমনিতেই সবার চোখের আড়ালে চলে যেতে পারতো, কিন্তু এখন, কার্টুনটা আরও অসংখ্যবার পূর্নপ্রকাশিত হবে, দেশের ধার্মিক জনগোষ্ঠী কতটা ফ্যানাটিক আর জঙ্গি সেই নিয়ে প্রতিবার আলোচনা হবে, বাংলাদেশ আর মুসলিমরা বাক স্বাধীনতার গলা চিপে ধরে, পূর্নবার পৃথিবীর মানুষ এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবে।
সালমান রুশদীর স্যাটানিক ভার্সাস লেখার পরেই এই রকম লেখাগুলো একে একে আসছে, কার্টুন আসছে। ট্রাবল উইথ ইসলাম, ইনফিডিল, ড্যানিশ কার্টুন, তসলিমার উত্থান। এক দল মানুষ মজা পেয়ে গেছে, বিখ্যাত আর ধনী হওয়ার সহজ উপায় পেয়ে গিয়েছে।
মুসলিমেরাও নিজ পায়ে জোরসে কুড়াল মারছে।
কোন মানে হয়!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।